কুলদা রায়ের গল্প : মেঘনাদ বধ

ক্লাস সিক্সে আমাদের যিনি বাংলা পড়াতে এলেন তাঁর পরণে সিল্কের পাঞ্জাবী। গলার দুধারে থেকে কারুকাজ। তবে এতো পুরনো যে সেটা আলাদা করে চেনা যায় না। আর সাদা চোস পাজামা ভাজে ভাজে নেমে গেছে। মাথার পিছনে ঢেউ করা চুল। বাম হাতে কালো একটা ছড়ি। ছড়িটা এমনভাবে ঘুরাতে ঘুরাতে তিনি এলেন যে দেখে কম্প লাগে।

ডান হাত দিয়ে একটা বই বুকের সঙ্গে ধরে রেখেছেন। বইটি অতি যত্নের সঙ্গে টেবিলের উপর রাখলেন। প্রচ্ছদে বড় বড় করে লেখা—মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রণীত মেঘনাদ বধ।


তিনি আমাদের দিকে তাকালেন কি তাকালেন না বোঝা গেল না। এসেই নিষ্পলকভাবে বেশ কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পকেট থেকে চশমা বের করলেন। তারপর পড়াতে শুরু করলেন, মেঘনাদ বধ কাব্য। প্রথম স্বর্গ। কিন্তু বইটি খুললেন না। টেবিলেই রইল।
আমরাও আমাদের বাংলা বই বের খুলতে গেলে তিনি ইঙ্গিতে না করলেন। চোখ দিয়ে বই পড়ে জ্ঞান হয় না। জ্ঞানের জন্য লাগে অন্তর্চক্ষু।

তিনি পড়লেন–

সম্মুখ সমরে পড়ি বীর চূড়ামণি
বীরবাহু,চলি যবে গেলা যমপুরে অকালে,

আমরা শুনে মুগ্ধ। সুন্দর—নাটকীয় গলা। কিন্তু সম্মুখ,সমর,বীর,চূড়া,মণি—এইসব শব্দ বেশ কটমট মনে হল। এর আগে শুনিনি।

তিনি জিজ্ঞেস করলেন,তোরা বুঝেছিস?

আমরা বুঝিনি। মাথা নাড়লাম। শুনে তিনি রেগে যাবেন ভেবেছিলাম। ছড়িটা উঠাবেন। আমাদের পিঠে সপাং সপাং করবেন। ছড়িটা উঠালেনও। কিন্তু সপাং সপাং করার বদলে তিনি হাতের মধ্যে ছড়িটা বার কয়েক ঘুরিয়ে হেসে দিলেন। বললেন, আমি গত উনত্রিশ বছর ধরে মেঘনাদ বধ পড়াচ্ছি। কেউ বুঝেছে বলে শুনিনি। আমি নিজেও বুঝিনি। তোরাও বুঝবি না। তবে একজন মাত্র বুঝেছিলেন –

–তিনি কে স্যার? আমরা সমস্বরে জিজ্ঞেস করলাম।

তিনি উত্তর দিলেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি বুঝেছিলেন বলেই মহাকাব্যটি লিখেছিলেন। মধুসূদনের পরে আর কেউ মহাকাব্য লিখতে পারেনি।

–রবীন্দ্রনাথ পারেননি?

–না। ঠাকুরবাড়ির এই ছেলেটিও পারেননি। পারার কথা নয়। তাদের বাড়ি কোলকাতায় জোড়াসাঁকোতে। আর মধুসূদনের বাড়ি যশোরের সাগরদাড়িতে। জোড়াসাকো হয় খালে। আর সাগরদাড়ির মধ্যে সাগর আছে। সাগরে সাঁকো বা বাঁধ দেওয়া যায় না। বিরাট বিশাল ব্যাপার। খাল আর সাগর কি এক হল?

কঠিন যুক্তি। এ বয়সে পালটা যুক্তি দাঁড় করানোর মতো এলেম আমাদের তৈরি হয়নি। ফলে আমাদের ক্লাস সিক্সের এ সেকশনের কারো মুখে কোনো কথা নেই। এটা তিনি জানেন। জানেন বলেই তিনি উদাত্ত স্বরে বললেন, রবিবাবু এজন্য কবি। আর মাইকেল মহাকবি। আকাশ আর পাতাল।

তবে আমাদের পাশের পাড়ার রামহরি দত্ত কালীবাড়িতে নিয়মিত রামায়ণ পাঠ করতেন। তাঁর সেজো ছেলে ক্ষেত্রচরণ পেছনের বেঞ্চিতে বসা ছিল। হঠাৎ করে সে উঠে দাঁড়াল। রিনরিনে গলায় বলে উঠল, সাগরেও বাঁধ দেওয়া যায়। বাঁধ দিয়েছিলেন শ্রীরামচন্দ্র। রামায়ণে লেখা আছে।

শুনে স্যার থরথর করে কেঁপে উঠলেন। কিছুক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে রইলেন। তারপর টেবিল থেকে ছড়িটি নিলেন। টেবিল থেকে বইটি খুব যত্নের সঙ্গে তুলে নিলেন। বুকের কাছে ধরে ক্লাশরুমের বাইরে চলে গেলেন। আজ আর পড়াবেন না।

আমাদের এই স্যারের নাম শেখ জহুরুল ইসলাম ওরফে জহুর স্যার। বাসা পদ্মপুকুর পাড়ায়। আমার বাবা তাঁর কাছে পড়েছেন। বাবা এখনো দিব্যি গড়্গড় করে বলতে পারলেন, মেঘনাদ বধের প্রথম স্বর্গের প্রথম দশ লাইন। বাকিটা মনে নেই। আমাদের ছোটোকাকাও জহুর স্যারের ছাত্র। তিনিও বিশ লাইন পারেন। আমার দাদা আমার থেকে সাত বছরের বড়। দাদাও বলল, স্যারের কাছ থেকে শোনা প্রথম সর্গের পুরোটা মনে আছে। তবে এই তিনজনই বলেছেন স্যার কখনোই মেঘনাদ বধের পুরোটা পড়ানো শেষ করতে পারেননি। নানা টিকা-টিপ্পনি, কাহিনী-উপকাহিনী আর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে করতে খেই হারিয়ে ফেলেন। দেখা যায় তার মেঘনাদ বধের শুরুটাও নেই। মাঝখানটাও নেই। শেষটা থাকার প্রশ্নই থাকে না। নতুন নতুন বধের আখ্যানের জন্ম হচ্ছে। তবে পুরোটা শেষ করবেন। এর আগে তিনি ইন্তেকালে যাবেন না। 

জহুর স্যার মুরশিদাবাদের মানুষ। সেখান থেকে তাদের কোনো এক পুরুষ হিজরত করে চলে এসেছিলেন সেই ১৭৫৭ সালে— বাংলা বিহার উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ্দৌলার সময়ে। স্যারের ধারণা তিনিও নবাব বংশের মানুষ। তবে কোনো প্রমাণ তাদের হাতে নেই। লর্ড ক্লাইভ তাদের সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছিল। তারা পালিয়ে পূর্ববঙ্গে চলে এসেছিলেন। ভয়ে কোনোদিন নিজেরা নবাব পরিবারের পরিচয়ও দিতে পারেননি। দেওয়ার চেষ্টাও করেননি। না দিতে দিতে তারা ভুলেও গিয়েছেন। শুধু জহুর স্যার ভুলতে পারেননা। তিনি মনে করেন একদিন লোকে সেসব কথা স্মরণ করবে। তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেবে।

জহুর স্যার পাকিস্তান আন্দোলনের সময় খুব উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। আমার ঠাকুরদা বলেছিলেন, তবে তিনি কোনো মিটিং মিছিলে অংশ নেননি। একা একা একটা প্লাকার্ড হাতে নিয়ে রাজপথে ঘুরেছেন। তাতে লেখা–কুইট ইন্ডিয়া।

এর মধ্যে বৃটিশরা ইন্ডিয়া কুইট করেছে। র‍্যাডক্লিপ সাহেব ইন্ডিয়ার ম্যাপ লাল দাগ দিয়ে নির্মমভাবে কেটে দিয়েছেন।প্রখ্যাত শিক্ষক সূর্যকান্ত চৌধুরী বিএ বিটি এক রাত্রে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। যাওয়ার আগে তিনি একটি বই নিয়ে নদীর ঘাটে উসখুস করছেন। নৌকায় উঠতে পারছেন না। বইটি নেবেন নেবেন কি নেবেন না তা ঠিক বুঝতে পারছেন না। এই বইটি তাঁর ঠাকুরদা ১৮৬১ সালে কিনেছিলেন। বইটির নাম মেঘনাদ বধ। লেখক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কোলকাতা থেকে কিনে ফিরে আসার সময় শুনেছিলেন জোড়াসাঁকোর দেবেন ঠাকুরের চতুর্দশ সন্তানের জন্ম হয়েছে। তার নাম রবি।সূর্যকান্তর ঠাকুরদার সমাধি-মঠ বাড়ির পিছনে ফেলে যাছেন। তিনি মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, কাউকে ত্যাগ করতে নেই। কাউকে ছেড়েও যেতে নেই। কেউ ত্যাগ করলেও সে ছেড়ে যেতে পারে না। ঠাকুরদা চোখ বোজার পর থেকে সূর্যকান্ত চৌধুরী বইটি প্রতিদিন পাঠ করে চলেছেন। স্কুলে ছাত্রদের সামনে, পথে ঘাটে, নদীতে, কেরায়া নৌকায় যেতে যেতে, শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে, সমাধী মঠের কাছে, গাছ–গাছালির নিচে দাঁড়িয়ে। তার ধারণা প্রতিদিনই এরা মেঘনাদ বধ মহাকাব্য শোনার জন্য অপেক্ষা করে। দেশ-ছাড়ার সময়ে বইটি নিয়ে গেলে এদেরকে আর শোনানোর মত সুযোগ থাকবে না। এই ভেবে তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। তার স্ত্রী নৌকার ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে বলছেন, আর কত দেরী করবেন? দেরী করলে মানিকদিয়া থেকে ইস্টিমার ছেড়ে চলে যাবে। আমরা ধরতে পারব না। পথ-ঘাটে বিপদের কী শেষ আছে! দুদিন আগে খুলনার রূপসা ঘাটে দাঙ্গা হয়েছে। 

নৌকা যখন ছাড়বে ছাড়বে করছে তখন দেখা গেল ছুটতে ছুটতে আসছে একটি ছায়া মূর্তি। কাছে আসতেই স্পষ্ট হল--সে শেখ জহুরুল ইসলাম। এসে সূর্যকান্ত চৌধুরীকে বললেন, খবর পেতে দেরী হয়েছে। আর সময় নেই। সূর্যকান্ত চৌধুরী তার হাতেই বইটি তুলে দেন। বলেছিলেন, মাইকেল বড় দুঃখি। একে যত্নে রাখিস। কখনো হেলা করিস না। তার বাবাও তাকে ত্যাগ করেছিলেন। তিনি কাউকে ত্যাগ করেননি। স্বদেশকে সব সময় প্রাণের মধ্যে ধরে রেখেছেন।

জহুর স্যার তখনো স্যার হননি--সবে মাত্র ক্লাস টেন। বিদ্যে বলতে সূর্যকান্ত চৌধুরীর দেওয়া মেঘনাদ বধ। এটা তিনি প্রাণে ধরে রেখেছেন। গড়গড় করে মুখস্ত বলতে পারেন। সেটা শুনে ১৯৪৭ সালের ১৬ অক্টোবর মডেল হাই স্কুলের বাংলা টিচার হিসেবে নিয়োগপত্র দিয়েছিলেন তৎকালীন স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির নতুন প্রেসিডেন্ট মৌলভি রহিমুদ্দিন খাঁ।

এর মধ্যে ১৯৫২ সালের বাংলাভাষার জন্য ঢাকায় গুলি খেয়েছে রফিক সালাম জব্বার। ১৯৫৮ সালে ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খাঁ এসে বাঙালীর চুল কেটে খাটো করে দিয়েছে। ১৯৬৭ সালে মোনায়েম খাঁ ঘোষণা দিয়েছে --পাকিস্তানে নো রবি ঠাকুর। ১৯৬৯ সালে জহুর স্যারের গ্রামের ছেলে শেখ মুজিবরের নামে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করেছে পাকিস্তানী সরকার। তার গলায় ফাঁসির দড়ি ঝুলবে ঝুলবে করছে। দেশের মানুষ উত্তাল হয়ে শ্লোগান দিচ্ছে--পাকিস্তানের কবর খোড়ো—বাংলাদেশ স্বাধীন কর। এর কোথাও জহুর স্যারের উপস্থিতি নেই। শুধু জানা যায় ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী জহুর স্যারকে তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গেছে। বুকের কাছে তখনো মাইকেল মধুদূদন দত্তের মেঘনাদ বধ বইটি ধরে আছেন খুব যত্নে। তার দিকে রাইফেল তাক করে পাক আর্মির মেজর আরমান জিজ্ঞেস করেছে—মে শোন রাহা হো---তুম নে স্টুডেন্ট কো হিন্দুস্তান কি শায়েরী পড়হা রে হো?

তিনি বলেছেন, না। আমি কোনো হিন্দুর কবিতা পড়াই না। আমি হিন্দুধর্মত্যাগকারী এক কবির কবিতা পড়াই। বলে পাকবাহিনীর মেজর আরমানের সামনে নির্ভিকচিত্তে মেঘনাদ বধ কাব্যের প্রথম স্বর্গ থেকে আবৃতিই করে গেলেন--

কোন বীরবরে বরি সেনাপদে
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষকুলনিধি
রাঘিবারি? কী কৌশলে, রাক্ষসভরসা—

মেজর আরমান জিজ্ঞেস করল, কেয়া মতলব হ্যায়? 

স্যার বললেন, শ্রীরামচন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চলেছে মেঘনাদ নামে এক সেনাপতি।

--এ শ্রীরামচন্দ্র কৌন হ্যায়? 

--হিন্দু লোগ কো নবী। 

তারপর তিনি বইটি মেজর আরমানের সামনে মেলে ধরলেন। দেখালেন, বাংলা লেখার নিচে পরিস্কার ইংরেজিতে লেখা আছে--

Meghnadbadh by


কোনো হিন্দুর নাম মাইকেল হয় না। মাইকেল কলিন্স নামে এক লোক চাঁদে রকেট নিয়ে গিয়েছিলেন। লোকটি জাতে খ্রীস্টান। তিনি মেজরকে পাকিস্তান অবজার্ভার পত্রিকায় প্রকাশিত মাইকেল কলিন্সের চাঁদে গমনের একটা পেপার কাটিং দেখালেন। হাফটোন ব্লকে তার একটা ছবিও খবরের সঙ্গে ছাপা আছে। 

শুনে মেজর আরমান মহাখুশি। তার পিঠ চাপড়ে বলল, ডরো মাৎ। তুম সাচ্চা পাকিস্তানী হ্যায়। তুম যা রহে হো। কোই আদমী তুম কো নেহি ছুয়ে গা। তুম মাহফুজ হো। 

এইভাবে জহুর স্যার ১৯৭১ সালে বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে এই বেঁচে যাওয়ার কারণে তাকে স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ কেউ পাকিস্তানের কলাবরেটর বলত আড়ালে আবডালে। তাকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ারও চেষ্টা হয়েছিল। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবরের ক্লাসমেট হওয়ায় তাকে বের করে দেওয়ার মতো সাহস হয়নি।

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবকে যখন মেরে ফেলা হল, তখন জহুর স্যারের বিরুদ্ধে শিক্ষাবিভাগে তিনটি অভিযোগ তোলা হয়েছিল,
এক. তিনি বাংলাদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের ইমান-আকিদা বিরোধী পাঠদান করছেন স্কুলের কোমলমতি ছাত্রদের। দুই. তাঁর ক্লাশমেট শেখ মুজিবর রহমান। তিন. তিনি নন ম্যাট্রিক। হাইস্কুলের শিক্ষকতা করার মত শিক্ষাগত যোগ্যতা তার নেই এই অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।

এ সংবাদ শুনে তার সহকর্মীদের কেউই জহুর স্যারকে সমবেদনাও জানাতে এলো না। বরাবরই জহুর স্যারের সঙ্গে এদের দূরত্ব ছিল। টিচার্স রুমে একা একটি চেয়ার ঠেলে নিয়ে একা একা চূপ করে বসে থাকতেন। কারো সঙ্গে বিশেষ কোনো কথা বলতেন না। গভীরভাবে মধুসূদন দত্তের মহাকাব্যটি নিয়ে মগ্ন থাকতেন। এর মধ্যে থেকেই তার নবাবী ঠাঁট ফুটে উঠতো। তবে স্যারের বরখাস্তের আদেশ এসেছে শুনে দূর থেকেই নিজেরা ফিসফাস করে বললেন, জহুর স্যারের উচিত হেড স্যারের সঙ্গে কথা বলা। ডিজি অফিসের সঙ্গে তার ভালো খাতির আছে। তিনি চেষ্টা করলে এ বরখাস্ত ঠেকাতে পারেন। তবে তারা এ-ও জানেন যে জহুর স্যার এ ব্যাপারে কারো কাছে দয়া ভিক্ষা করতে যাবেন না। নবাবী ঠাঁট অনুসারে যেতে পারেন না। ফলে এবার চাকরিটা তার যাবে নিশ্চিত। এটা বুঝতে পেরে দূর থেকে তারা দুঃখ করতে লাগলেন। 

হেডমাস্টারও তার এককালের ছাত্র। তিনিও তার কাছে মেঘনানাদ বধ পড়েছেন। এই একটি মাত্র কবিতা সারা বছর ধরে স্যারের কাছে তাদেরকেও পড়তে হয়েছে বলে তৎকালীন হেডমাস্টার বাংলা বইয়ের অন্যান্য কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প পড়ানোর জন্য আরেকজন বাংলা শিক্ষককে দ্বায়িত্ব দিতেন। এটা একটা বাড়তি ঝামেলা। তবে প্রবীণ শিক্ষক বলে তাঁকে কিছু বলাও যায় না। তিনিও পূর্বতন হেডমাস্টারকে অনুসরণ করেন বলে জহুর স্যারের প্রতি বিরক্ত।

হেডমাস্টার নিজেই এলেন জহুর স্যারের কাছে। বললেন, স্যার, আমি নিজে ডিজি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। তাকে রাজী করিয়েছি। আপনি যদি ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করেন তবে আপনাকে স্কুলের কোনো একটি চাকরিতে পূনর্নিয়োগ দেওয়া হবে?

স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কোন পদে?

--কেরানী পদে।

শুনে জহুর স্যারের মুখ লাল হয়ে গেল। তিনি মাথা নাড়লেন। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এটা তার জন্য অবমাননাকর।

হেড মাস্টার শেষ চেষ্টা করলেন। বললেন, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এখন হাইস্কুলের শিক্ষকতার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ পাশ দরকার। আপনি যদি কখনো বিএ পাশ করে আসতে পারেন তবে কেরানী পদ থেকে টিচার পদেই নেওয়া হবে। কোনো সমস্যা হবে না।

জহুর স্যার রাগে কাঁপতে থাকলেন। চেয়ার ছেড়ে চলে গেলেন। যেতে যেতে তিনি বিড় বিড় করে বলছেন-- আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে?

ফলে জহুর স্যার চাকরিহীন হয়ে গেলেন। এবং সরকারী প্রস্তাব অগ্রাহ্য করায় তিনি পেনশন-গ্রাচুইটি কিছুই পেলেন না।

এটা নিয়ে জহুর স্যারের মনে ক্ষোভ রইল না। তার ধারণা ছিল অন্তত তার জন্য একটা ফেয়ার-ওয়েলের ব্যবস্থা করা হবে।সেখানে তার উদ্দেশ্য মানপত্র পড়া হবে। গলায় মালা পরানো হবে। তার ইচ্ছে ফেয়ার ওয়েলের দিন তিনি নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজমুকুটটা পরে যাবেন যাত্রার দলের নটদের মত। তিনি যে মুরশিদাবাদের নবাব বংশের প্রতিনিধি সেটা সবাইকে তিনি জীবনে একবার হলেও দেখাতে চান। আর কিছু নয়। তিনি খোঁজ নিয়ে জেনেছেন এই মুকুটের দামও বেশি নয়। মাত্র পঁচাত্তর টাকা। আর এলাকার দীপালী অপেরার মালিক ধীরের বাকচিও তার ছাত্র। ধীরেন বাকচিকে বললে তার সাজপোষাকের ট্রাঙ্ক থেকে একটা পুরনো মুকুট মাগনা দিলেও দিতে পারে। তবে জহুর স্যার মাগনা নেবেন না। একদিনের জন্য ভাড়া দেবেন। এই ফেয়ার ওয়েলের দিনে শেষবারের মতো সবাইকে মেঘনাদ বধ পূর্ণভাবে শোনাবেন। বাকি রাখবেন না। তিনি বোঝাবেন—কাউকেই ভূমিচ্যুত করা অন্যায়। সে বেদনা জন্ম-জন্মান্তরে বয়ে যায়। তিনি বলবেন, এ বেদনা মেঘনাদের নয়—মাইকেলের। এ বেদনা তোমার—এ বেদনা আমার। এ বেদনা সূর্যকান্ত চৌধুরীর। হায় তাত, উচিত কী তব এ কাজ!

স্কুল থেকে জহুর স্যারকে কোনো ফেয়ার--ওয়েল দেওয়া হল না। মেঘনাদ বধ পূর্ণভাবে পড়ানোর খেদ রয়ে গেল। তার ছেলে--মেয়েরা তখনও স্বাবলম্বী হয়নি। সংসারটা বেশ বড়। চাকরি চলে যাওয়ায় স্যারের পরিবার বিপদে পড়ে গেল। নিজে অন্য কোনো কাজ করবেন না। তার বড় ছেলে তখন কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে মোহরীগিরি করা শুরু করল।

তবে চাকরি চলে যাওয়ার পরেও জহুর স্যার নিয়মিত স্কুলে আসতে লাগলেন। তার যে চাকরি চলে গেছে এটা মনেই করলেন না। ঠিক আগের মতোই টিচার রুমে আলাদা চেয়ারটিতে বসেন। ঘণ্টা পড়লে ক্লাশে ঢোকেন। মেঘনাদ বধ পড়াতে শুরু করেন। কেই কিছু বলার সুযোগ বা সাহস পায় না। হেড মাস্টার একদিন তাকে ডেকে বললেন, স্যার, আপনি বুঝদার মানুষ। এমন করলে সরকার স্কুলটিই উঠিয়ে দেবে। আমাদের না খেয়ে মরতে হবে। আপনি আর স্কুলে আসবেন না।

ফলে জহুর স্যার স্কুলে এলেন না বটে, কিন্তু স্কুলের টাইমে স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকেন।। ছাত্রদেরকে ডেকে ডেকে মেঘনাদ বধ কাব্য থেকে পড়ে শোনান। তবে এভাবে ছাত্রদের সময় নষ্ট হয় অভিযোগ পেয়ে থানার দারোগা তাকে স্কুলের আশেপাশে ঘুরতে নিষেধ করে দেন। তিনি দারোগাকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন--ছাত্রদের এই কাব্যটি পড়া দরকার। সে জন্য তাদেরকে ফ্রি পড়াচ্ছেন। সরকারের কোনো আর্থিক ব্যয় হচ্ছে না। দারোগা কোনো কথা শুনলেন না। কঠিন গলায় বলে দিলেন, এ রকম ঝামেলা করলে তাকে গ্রেফতার করা হবে।

এরপরে তিনি তার পাড়ার ছেলেদের ডেকে ডেকে কাব্যটি শোনানো শুরু করেন। খেলার সময় চলে যায় বলে তাদেরও স্যারকে অগ্রাহ্য করা ছাড়া উপায় থাকে না। এটা দেখে স্যারের ছেলেরা বাড়িতে বেশ শক্ত বেড়া দিয়ে দিল। তাকে বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করে দিল। স্যার সারাক্ষণ বাড়ি থেকে বের হন না। আবার ঘরেও থাকেন না। বেড়া ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। কোনো ছাত্র বা ছাত্রীকে রাস্তায় যেতে দেখলেই জোরে জোরে বলা শুরু করেন--এতোক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে। পাড়ার গার্জেয়ানরা এ ব্যাপারে প্রথমে বিরক্ত, পরে অসহ্য হয়ে স্যারের বড়ো ছেলেকে ডেকে বললেন, তোমার বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাকে পাবনার মেন্টাল হাসপাতালে পাঠাও।

বড় ছেলেটি হতাশ হয়ে বলল, এমনিতে বাবা খুব শান্ত শিষ্ট থাকেন। কোনো ঝামেলা করেন না। 

বড়ো গার্জেয়ান এবার একটু কড়া সুরে বললেন, তোমাদের বয়েস কম। তোমরা তার অসুখটা ধরতে পারছ না। 

ছেলেটা কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইল। বড়ো গার্জেয়ান এবার তার পিঠে হাত বুলিয়ে পরামর্শ দিলেন, তোমাদের অবস্থা বুঝতে পারছি বাবা। তোমরা ওনার কাছ থেকে বইটি নিয়ে নাও। আর ঘরের মধ্যে আটকে রাখার ব্যবস্থা করো। দিনকাল ভালো না।

এ কথার পরে ছেলেরা তার কাছ থেকে জোর করে মেঘনাদ বধ বইটি কেড়ে নিল। বাইরে ফেলে দিতে গেলে স্যার অনুনয় করে বললেন, ফেলে না দিয়ে কালিবাড়ির রামায়ণ পাঠক রামহরি দত্তের সেজো ছেলে ক্ষেত্রচরণকে বইটি দিয়ে দাও। ছেলেটি মেঘনাদকে জানে। ও বইটির যত্ন বুঝবে।

ক্ষেত্রচরনকে বইটি দেয়া হয়েছিল কিনা জানা যায় না। তবে ছেলেরা স্যারকে শর্ত দিয়ে বলেছিল, আপনি যদি ঘরের মধ্যে আটকা থাকেন তবে বইটি ক্ষেত্রচরণকে সত্যি সত্যি দেওয়া হবে। আপনি এ শর্তে রাজি না হলে বইটি শুধু ফেলে দেওয়া নয়-- আপনার সামনে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলা হবে। তারপর আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হবে। স্যার রাজি হয়ে বলেছেন,আমি ঘরের মধ্যেই থাকবো। কখনোই বের হবো না। তোমরা শুধু বইটা ধবংস করো না।

ফলে ছেলেরা স্যারকে একটা ঘরের মধ্যে আটকে রাখল। সেখান থেকেই তার আওয়াজ শোনা যেতো। তিনি বলছেন কোনো এক মেঘনাদের যুদ্ধের কথা। মেঘনাদ নামে এক লোক মেঘের আড়ালে থেকে যুদ্ধ করেন। সে যুদ্ধ বাইরে থেকে দেখা যায় না। সেটা তার নিজের যুদ্ধ। আর কারো সঙ্গে মিল নেই। তবে দিন দিন স্যারের গলা ক্ষীণ হতে হতে একদম মিলিয়ে গেল। এভাবে স্যারকে আমরা ভুলে গেলাম।

সেবার আমরা ক্লাস টেন। সরকার রাষ্ট্র ধর্ম বিল পাশ করেছে সংবিধানে। কালীবাড়ির রামহরি দত্তকে কালিবাড়িতে আর রামায়ণ পাঠ করতে দেখা গেল না। তিনি রাতারাতি দেশত্যাগ করেছেন। স্কুলের পাঠ্য বই থেকে মেঘনাদ বধ কাব্য তুলে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে কারো মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দিল না। সব কিছুই স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকল। সে সময়ে একদিন ভোর বেলায় জহুর স্যারের ছোটো ছেলে এলো। হেড মাস্টারের রুমের সামনে ঘুর ঘুর করতে লাগল। স্কুলের ড্রিল টিচার মোহসিন উদ্দিন তাকে দেখে এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে বাবা?

ছেলেটি বিমর্ষ গলায় উত্তর দিল, বাবা নাই।

ড্রিল টিচার চমকে উঠে আবার জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তার?

সে কিছু বলতে পারছিল না। তার চোখ ঠেলে কান্না আসতে চাইছে। তাকে দেখে যা বোঝার বুঝে নিলেন। ড্রিল টিচার তাকে হেড মাস্টারের রুমে নিয়ে গেলেন। এবার সে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল। বলল, বাবা সুবে সাদেকের কালে ইন্তেকাল করছেন।

হেড মাস্টার সাহেব শুনে খুব দুঃখিত হলেন। কোনো শিক্ষক মারা গেলে সাধারণত স্কুল ছুটি দেওয়া হয়। তবে জহুর স্যারের বেলায় হেড মাস্টার বেশ দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। তখন স্কুলের অন্য সকল টিচার এক ধরনের অপরাধ বোধ করতে লাগলেন। তাদের মনে হল জহুর স্যার জীবনে কখনো কারো প্রতি কোনো অন্যায় করেননি। কিছু ব্যক্তিগত বাতিক গ্রস্থতা ছাড়া মনে প্রাণে তিনি একজন ভালো মানুষ। তার প্রতি যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়নি। তারা তখন সকলে হেড মাস্টারকে স্কুল ছুটি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। বললেন, মরা মানুষ কোনো ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারে না। মৃত স্যারকে তারা শেষ দেখা করতে চান। জানাজায় অংশ নিতে চান।

হেড মাস্টার স্কুল ছুটি দিয়ে দিলেন। সবাই নীরবে শোকার্তভাবে হেড মাস্টারের নেতৃত্বে জহুর স্যারের বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

বাড়ির মধ্যে পরিবারের সবাই খুব গম্ভীর হয়ে ঘোরা ফেরা করছে। মৃতের বাড়ির মতো কোনো কান্নাকাটি নেই। শুধু তারা বিরক্ত আর ভীত মুখে ফিসফাস করছে। কোনো হাফেজকেও কোরআন তেলাওয়াত করতে দেখা গেল না। হেড মাস্টার খুব বিরক্ত হলেন। হেড স্যার স্কুলের আরবী শিক্ষক সুরা পাঠ করতে নির্দেশ দিলেন।

সুরা পাঠ করার আগে জহুর স্যারের বড়ো ছেলেটি হাত জোড় করে হেড মাস্টারকে বললেন, তার বাবা এখনো মারা যায়নি। তবে দেরী নেই। শীগগিরই মারা যাবেন।

হেড স্যার এবার খুব রেগে গেলেন বললেন, মৃত্যু নিয়ে এভাবে মস্করার অর্থ কী?

ছেলে বলল, তার বাবা মৃত্যু শয্যায়। অন্তিম বাসনা হিসেবে তিনি তার ছাত্রদের দেখতে চেয়েছেন। তার জীবিতকালে ছাত্রদেরকে তাদের বাড়িতে আনার কোনো উপায় নেই। তাই মৃত্যুর ঘোষণা দিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া বাবার অন্তিম ইচ্ছাটি পূর্ণ করা যাবে না।

হেডমাস্টার শান্ত হলেন। বললেন, ঠিক আছে। ঘরের মধ্যে একজন একজন করে যাবে। স্যারকে দেখা দিয়ে আসবে।

বড়ো ছেলেটি বলল, বাবা একজন একজন করে নয় সকল ছাত্রকে এক সঙ্গে দেখতে চান। সেজন্য আমরা তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসব। তিনি সবাইকে কিছু বলতেও চান।

হেডমাস্টার চমকে উঠলেন। বললেন, সে কি? তিনি মৃত্যুর সময়ও কি মেঘনাদ বধ শোনাতে চান?

বড় ছেলেটি বলল, বাবা সে রকমই বাসনা করেছেন।

শুনে হেডমাস্টার সোজা না করে দিলেন। মরণকালে এইসব হাবিজাবি বাদ দিয়ে ধর্ম--কর্ম বিষয়ে বলতে চাইলে বলতে পারেন। আর যদি তিনি কোনো উপদেশমূলক গল্প বলতেই চান তাহলে মীর মশারফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধুর কারবালা পর্বটি পড়তে পারেন। বইটি স্কুলে আছে। দরকার হলে তিনি কাউকে পাঠিয়ে আনিয়ে দেবেন। 

তখন ছেলেটি আবার হাত জোড় করে বলল, বাবা মুরশিদাবাদের নবাব বংশের মানুষ। তিনি মরে যাবেন তবু মাথা নোয়াবেন না। তাঁকে আমরা জোর করে ঘরে আটকে রেখেছি। তার বইটি কেড়ে নিয়েছি। তাঁকে খুব কষ্ট দিয়েছি। এখন অন্তিমকালে আর কষ্ট দিতে চাই না। তার বাসনা পূরনের সুযোগটা দেন।

ছেলেটি হেডমাস্টারকে আশ্বস্ত করে বলল, বাবা ইচ্ছে করলেও জোরে পড়তে পারবেন না। রোগে শোকে তার গলা আমরাও তার মুখের কাছে কান নিয়ে শুনতে পাই না।

হেড মাস্টার আরো নিশ্চিত হতে বললেন, তবে মাইক ব্যবহার করতে পারবেন না। সরকারের কানে গেলে আমরা বিপদে পড়ে যাব। সরকার খুব কড়া। মিলিটারি রেজিম। 

বড় ছেলে বলল, স্যার, মাইক ভাড়া করার মতো সামর্থ্য বা বিলাসিতা আমাদের নেই। আমাদের বাবা তার ছাত্রদেরকে কাছে পাবেন। ফ্যাসে ফ্যাসে গলায় কি বলবেন--সেটা বোঝা যাবে না। শুধু তার ঠোঁট নড়া দেখতে পাবে সবাই। তিনি আনন্দিত চিত্তে মারা যাবেন। আর কিছু আমাদের চাওয়ার নেই।

ছেলেরা ধরাধরি করে জহুর স্যারকে খাটসহ ঘরের বাইরে নিলে এল। স্যারকে চেনা যায় না। মাথায় চুল নেই। পরণে সিল্কের পোষাক নেই। হাড় জিরজিরে শরীর। চোখ বুজে আছেন। তিনি যে জহুর স্যার এটা কেউ বলে না দিলে বোঝা যায় না। তবে তার মাথার কাছে একটা রাজমুকুট আছে। স্যারের মাথাটা ছোটো হয়ে গেছে বলে টুপিটা ঠিক মতো আটেনি।পাশে হেলে পড়ে আছে। দীপালী অপেরার ধীরেণ বাকচি মুকুটটি দিয়ে গেছেন। স্যারের মৃত্যুর পরে তিনি ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।

বড়ো ছেলে জহুর স্যারের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, বাবাজান, চোখ খুলুন। ছাত্ররা এসেছে। এবার মেঘনাদ বধ কাব্যটি পাঠ করুন।

জহুর স্যার চোখ খুললেন না। তার মাথার কাছে একটা জীর্ণ পুরানো বই পড়েছিল। উত্তর দিক থেকে একটু হাওয়া এলো।আর তাতে ফরফর করে বইটির পাতাগুলো উড়তে লাগলো। উড়ে ছাত্রদের পায়ের কাছে পড়তে লাগল। বইটির নাম মাইকেল মধুসূদন দত্ত মেঘনাদ বধ কাব্য। মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মালিক--সূর্যকান্ত চৌধুরী।

বইটি ক্ষেত্রচরণ দেশ ছাড়ার সময়ে নিয়ে যায়নি। জহুর স্যারের কাছে ফেরত দিয়ে গিয়েছিল।



লেখক পরিচিতি
কুলদা রায়
ব্লগার। গল্পকার। প্রবন্ধকার।



প্রকাশিত বই--
১. কাঠপাতার ঘর। (জার্নাল)
২.বৃষ্টি চিহ্নিত জল। গল্পের বই। প্রকাশক সোপান। কোলকাতা। নালন্দা--ঢাকা।
৩.রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি ও অন্যান্য বিতর্ক। প্রকাশক--বিপিএল, ঢাকা।
(সহলেখক--এমএমআর জালাল)

Post a Comment

1 Comments

  1. এসব লেখা পড়লে বুকটা ভয়ঙ্কর রকমে মোচড় দিয়ে ্ওঠে। চোখ আসে জলে ভরে।
    দাদা এগুলো কিভাবে লেখেন? এতো আমার কথা। সার্বজনীন।

    ReplyDelete