কুলদা রায়ের গল্প : বিদ্যেসুন্দর

উলপুরের বাবুদের বাড়ি পার হলেই বামদিকে মোল্লাকান্দি। ডানদিকে মালেঙ্গা। এর মধ্যে বটবাড়ি। বটবাড়ি যাওয়ার আগেই বিনোদিনীর ঘুম ভাঙ্গে। তার ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে আছে। মাঝিকে জিজ্ঞেস করে, বিদ্যেধর কি পার হইছি?

সূর্য মাথায় উপরে উঠেছে। রায়েন্দা ধানক্ষেখেতের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার জন্য একধরনের ক্যাচচ ক্যাচচ শব্দ হচ্ছে। ঘাস ফড়িং উড়ে এসে চুলে পড়ছে। মাঝি বলে ওঠে, এখনো তিন গ্রাম পাড়ি দিতে হবে। তারপর নারকেল বাড়ি।

বিনোদিনী সেটা জানে। নারিকেলবাড়ি তার বাপের বাড়ি। আবার তার ঘুম পায়। জিজ্ঞেস করে, বিদ্যেধর কি ছাড়ায়ে গেছি?

মাঝি এইকথার জবাব দেয় না। মাথালটা একটু নাড়িয়ে সোজা করে। বলে, আল্লা সাফি। আল্লা মাফি।

আবার ঘুমিয়ে পড়ে। নারিকেলবাড়ির ঘাট দেষ্টে নৌকা ফিরলে সেই ঘুম ভাঙল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

প্রতি বছর আশ্বিনে দুর্গাপূজার সময়ে তাকে আনতে মেজোদা যায়। একেবারের লক্ষ্মীপূজা সেরে ফেরে। সন্ধ্যে-সন্ধ্যি তার জন্য ঘাট দেষ্টে কেউ না কেউ অপেক্ষা করে। এবার কেউ নেই। বিনোদিনী একটু আগে ভাগে একাই বাপের বাড়ি এসে পড়েছে। খবর দেওয়ার কোনো সুযোগই পায়নি। নৌকা থেকে ছেলেটাকে কোলে করে উঠোনে এল। তার মা দুটো পুঁই শাক তুলতে এসেছিল। হঠাৎ করে তাদেরকে দেখে বলল, বিনা তুই?

বিনোদিনী কেঁদে ফেলল। কোলের ছেলেটাকে তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, আমার খোকা।

খোকার মুখ দেখে মনে হল না কিছু হয়েছে। গভীর ঘুমের মধ্যে একবার হেসেও উঠল।

বিনোদিনীর তিন মেয়ের পর এই ছেলে হয়েছে গেল বছর। সবে হামাগুড়ি দিতে শিখেছে। বিনোদিনী গেল সেদিন দুপুরে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে রান্না করতে গেছে। কিছুক্ষণ পরে এসে দেখতে পেল ছেলে নেই। খুঁজে খুঁজে হয়রান। ঘরদোরের কোথাও পাওয়া গেল না। বর্ষাকাল। বাড়ির পাশেই ভরা পুকুর। বিনোদিনী কেঁদেও তাকে পাচ্ছে না। ছেলের বাবা গেছে কাজে। দিশা না পেয়ে কান্নাকাটি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলছে। কিন্তু সাড়া দেওয়ার মতো বাড়িতে কেউ নেই। আর বাড়ির পাশ দিয়ে কে একজন লোক হেঁটে যাচ্ছিল। কান্নাকাটি শুনে বাড়ির ভেতর ঢুকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা?

অন্য সময় হলে বিনোদিনী বাইরের লোকের সামনে আসত না। কিন্তু এখন বিনোদিনী পাগল প্রায়। লোকটির কাছে এসে বলল, আমার ছেলেকে পাইতিছি না।

লোকটা এক লহমায় বাড়ির চারিদিকে নজর করে এগিয়ে গেল পূবদিকের খড়ের পালানের কাছে। এখানেও বিনোদিনী উবু হয়ে খুঁজেছে। পাওয়া যাবে না। খড়ের পালানের নিচ দিয়ে পুকুরের থৈ থৈ জল দেখা যাচ্ছে। জলে সূর্যের আলো ঝিলিক দিচ্ছে।

লোকটা কি ভেবে পালানের খুব কাছ থেকে সরে দাঁড়াল। তারপর দুহাতে জোরে জোরে তালি দিল। এই তালি এতো জোরে হল যে কানে তব্দা লেগে যেতে চায়। আর তখনি খোকাটির কান্না শোনা গেল। বিনোদিনী ভরসা পেল। বলে উঠল, খোকা কাঁদে। আমার খোকা আছে।

কিন্তু খোকা কোথায়? চারিদিক থেকে খোকার কান্না শোনা যাচ্ছে। কোনদিকে পাওয়া যাবে খোকাকে এই দিশা না পেয়ে বিনোদিনী আরো দিশাহীন হয়ে গেল।

আর তখনি লোকটা উবু হয়ে পালানের নিচ থেকে টেনে বের করে আনল ছেলেটাকে। বলল, কাইন্দো মা জননী। ছেলেকে দুধ দেও।

বিনোদিনী দুধ দেবে কি, ছেলেকে নিয়ে লোকটার পায়ে পড়ল। বলল, আপনি আমার ছেলেরে ফিরাইয়া দেছেন। দুগগা না খাইয়া আজ যাইতে পারবেন না।

লোক লোকটা হেসে বলল, মাগো আমি বিদ্যেধর রওনা হইছি। আজ আর সময় নাই।

--তাইলে বসেন, দুটো মুড়ি নিয়া আসি।

ঘর থেকে মুড়ি নিয়ে বিনোদিনী দেখতে পেল, লোকটা নেই। চলে গেছে। বাড়ির বাইরে ছুটে এসেও কাউকে দেখতে পেল না। কেউ তাকে দেখতে পেয়েছে বলেও মনে করতে পারল না। কেউ কেউ লোকটিকে অলৌকিক মানুষ হিসেবেও মনে করল। বলল, বৌমা, যে-ই আসুক না কেনো সে যে-সে লোক না। এলেম আছে। তার সন্ধান কর।

ছেলের বাবা শুনে হাসল। তার মতে, ছেলে ঘুম থেকে উঠে হামা দিয়ে বাইরে চলে এসেছে। কাউকে না দেখতে পেয়ে খড়ের পালানের নিচে এসেছে। এর মধ্যে অলীক কিছু নেই। তবে এখন থেকে সাবধান হতে হবে যাতে ছেলেটি এভাবে যেখানে সেখানে চলে না আসতে পারে। এ ব্যাখ্যায় বিনোদিনীর মন সারে না। যে খড়ের পালার নিচে সে আগেই খুঁজে দেখেছে— কয়েকগাছা সাদা ঘাস লম্বা ঘাস ছাড়া যেখানে আর কিছুই ছিল না, সেখান থেকে ছেলেটির বের হয়ে আসার ঘটনাগুলো মোটেই স্বাভাবিক নয়। পাড়া-প্রতিবেশীদের কেউ কেউ বলল, ছেলের পরীর আছর লেগেছে। এই আছর না কাটাতে পারলে সামনে বিপদ। সে বিপদে রক্ষা পাওয়া মুশকিল।

তার স্বামী এইসব বিপদ-আপদের পাত্তাই দিল না। বলল, এসব ভাইবা লাভ নাই। সতর্ক থাকলেই হবে।

বিনোদিনী দেরি না করে ছুটে এসেছে বাপের বাড়ি। তার মনে হয়েছে ওই লোকটাই ছেলেকে ফিরিয়ে এনেছে। তার কাছে ধর্ণা দিতে হবে। তাকে দুগগা মুড়ি দিতে হবে। তিনিই পারেন তার ছেলেকে পরীর আছর থেকে রক্ষা করতে। লোকটি বিদ্যাধরে যাবে বলেছিল। বিনোদিনীর মনে হল, বিদ্যেধরে গেলে তাকে পাওয়া যাবে।

বিদ্যেধর গ্রামটি কোথায়? এই প্রশ্নে বিনোদিনীর বাবা-মা ভাই-বোন সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। শুরুতে তাদের কাছে শব্দটি নতুন মনে হয়। অথচ শব্দটি নতুন নয়। দরকারের সময় মনে পড়ে না। মনে করতে সময় লাগে। তারাও বিদ্যেধর গ্রামটির নাম শুনে এসেছে তাদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষ ধরে। এই চৌদ্দ পুরুষ ধরে বিশ্বাস করেছে এই গ্রামগুলোর আশেপাশে কোথাও বিদ্যেধর নামে একটি গ্রাম থাকতে পারে । তবে গ্রামটি যে ঠিক কোথায় আছে সে ব্যাপারটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে এই এলাকায় একটা গান গীত হয়। গানটির কথা নিম্নরূপ—

জুত কইরা আইসো গো মালতিবালা
ফুত কইরা ভাইসো গো মালতিবালা
হাইতনা জোড়া গদাধরের মালা
আমি কী কহিব তারে, আমার চউক্ষে নিদ্রা নাই
আমি বিদ্যেধরে যাই।।

এই গানটির ভেতরে বিদ্যেধর শব্দটি শুধু নয়—গদাধর শব্দটিও পাওয়া যায়। মালতিবালা নামে কাউকে পাওয়া যাবে না। কারণ এটা ধুয়া—এই গানের সৌন্দর্য। মালতিবালার বদলে শেফালিবালা হলেও ক্ষতি ছিল না।

তাহলে গদাধর ও বিদ্যেধরের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটি বের করতে পারলেই মুশকিল আসান পাওয়া যেতে পারে।

ছেলেবেলায় এই গানটি বিনোদিনীরাও ভাদ্রের শেষাশেষি করেছে। বাড়ির পুবদিকে যে জামতলা আছে তার পাশেই গদাধরের ব্রতে বসেছে। ব্রতের প্রসাদ বলতে তিন মুষ্টি চাল। আর গোটা চারেক আনাজ। তারা জানে গদাধর এই চাল আর আনাজ দিয়ে ফেনা ভাত করবে। বেলাবেলি ভোজ সারবে। তার আর কোনো বাসনা নেই। আর যদি দিতে চাও তবে দুটো কাঁচা মরিচ দিও। স্বাদে অমৃত।

গদাধর যেকোনো দিন এসে পড়বে। এসে পড়লে তাকে দেরী করানো যাবে। তাকে যেতে হবে বহু পথ—বহু গ্রামে। চাল আর আনাজ রেডি রাখতে হয়।

তবে গদাধর কোনোদিন এসেছে কিনা জানা যায়নি। বিনোদিনী তাকে নিজ চোখে দেখে নি। দেখার দরকারও নেই। তার আজিমার কাছে গদাধরের কথা শুনেছে। আজিমা বলেছে-- দিদিরে, মনের মধ্যে অবিশ্বাস রাইখো না। গদাধর কিন্তু আসে। আমার আজিমা কইছে— তার মায়ের আজিমার পাশের গ্রাম পদ্মবিলার দিকে গদাধর হাঁইটা গেছে। হাতে করতাল। তার এক পিঠ ফাঁটা। ঝনঝন কইরা শব্দ হয়। এই করতাল বাজাতে বাজাতে গেছে। সহসা এই গ্রামেও ফিরবে।

বহুদিন পরে বিনোদিনীর বাপের বাড়ির লোকজন বিদ্যেধর আর গদাধরের প্রশ্ন বেশ ধ্বন্দে পড়ে যায়।

বিনোদিনীর মেজদাও আজিমার কাছ থেকে শোনা গল্পের মধ্যে শোলোক-সন্ধান করার চেষ্টা করে। শুধায়, তুই কি লোকটার হাতে কোনো করতাল দেখছিলি?

সেটা মনে নেই। বিনোদিনী মাথা নাড়ে। ছেলের খোঁজে তখন সে পাগলপ্রায়। কারো দিকে তাকানোর অবস্থায় নেই। লোকটার হাতে করতাল ছিল কি ছিল না—সেটা খেয়াল করার প্রশ্নই আসে না। হয়তও ছিল—হয়তো ছিল না।

মেজদা ভ্রু কুঁচকে বলল, লোকটার হাতে ফাঁটা করতাল থাকলে গদাধর হতে পারে। তারপর এলাকার বহু পুরনো জনশ্রুতি উল্লেখ করল। গদাধর মরা মানুষকে জেতা করতে পারে। কানাকে চক্ষু দিতে পারে। খোঁড়াকে হাঁটাতে পারে। হারানো ছেলেকে ফিরিয়ে আনার মতো এলেম গদাধরের আছে।

বিনোদিনী একথার পরে বলে উঠল, তার হাতে ফাঁটা করতাল দেখছি। ঝনঝন করে বাজে। লোকটা করতাল বাজাতে বাজাতেই এসেছিল।

বিনোদিনীর বাবা বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি ইতিহাস-ভূগোল জানেন। তিনি জানেন, কবি রসরাজ শ্রীমৎ স্বামী তারকচন্দ সরকার প্রণীত রচিত এলাকার প্রাচীন পুস্তক হরিলীলামৃতে গদাধরের কথা লেখা নেই। হরিলীলামৃত গ্রন্থটি অত্র এলাকার ঘরে ঘরে তেল-সিঁদুর সহযোগে রক্ষিত হয়।

১৯০২ সালে হরিলীলামৃত লেখা হয়। প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে। যাকে নিয়ে এই লীলামৃত রচিত হয়েছে সেই জগদব্রহ্ম হরিচাঁদ ঠাকুর ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন সফলিডাঙ্গা গ্রামে। এরপরে তিনি ওড়াকান্দি গ্রামে থিতু হন। মহাধাম প্রতিষ্ঠিত করেন। ওড়াকান্দি গ্রাম থেকে নারিকেলবাড়ি গ্রাম ৬ কিলোমিটার। এইখান থেকে উলপুর গ্রাম ৫ কিলোমিটার হতে পারে। হরিলীলামৃতে অত্র এলাকার সকল গ্রামের কথা লেখা থাকলেও বিদ্যেধরের নাম নেই। গদাধরেরও নাম নেই। ফলে সুস্পষ্টভাবে বোঝা যায়—হরিলীলামৃতের কালে গদাধর নামে কোনো পাগল, গোঁসাই কী সাধুপুরুষ জন্মেনি। এখানে উল্লেখ্য যে, শ্রীমৎ কবি রসরাজ তারক গোঁসাই লেখাপড়া জানতেন না। হরিচাঁদ ঠাকুর যথোচিৎধামে উঠে যাওয়ার কালে তাকে বাক্য দিয়েছিলেন। সেই বাক্যবলে তিনি পয়ার, ত্রিপদী, দীর্ঘ ত্রিপদী ছন্দ লিখতে আরম্ভ করেন। তারক গোঁসাই মারা যান ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে। তারক গোঁসাই লিখেছেন--

শ্রীশ্রী হরিলীলামৃত সুধাধিক সুধা।
তারক যাচিছে হেতু রসনার ক্ষুধা।।

তবে বিদ্যেধরের কথা না থাকলেও মোল্লাকান্দি বিলের উল্লেখ পাওয়া যায়। মোল্লাকান্দি বিলে শরৎকালে নিয়মিত দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার ভাসান যাত্রার কথা লেখা আছে । এ পূজার আয়োজন করতেন উলপুরের বাবুরা। কোলকাতা থেকে পরিবার-পরিজন সহকারে জমিদারি এলাকায় আসতেন। বড় বড় নৌকায় জ্বলত পেট্রম্যাক্সের বাতি। আতশ বাজি ফুটত। সে রোশনাই দেখতে দিক-দিগন্ত থেকে লোকজন নৌকা করে এই বিলে আসত। এটা ছিল এই এলাকার একমাত্র সাংবাৎসরিক উৎসব।

এই মোল্লাকান্দি বিলে শেষ কবে দুর্গাপ্রতিমা দেখা গেছে তা ঠিক করে বলা যায় না। কেউ বলে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে। কেউ বলে ১৯৪৭ সালের আগের বছরের সেপ্টেম্বর মাসে। উলপুরের বাবুরা এইকালে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণে আর পূজা হয়নি। এলাকার নমঃশুদ্ররা দুর্গাপূজা আয়োজনের মতো সাহস বা টাকা পয়সা যোগাড় করার এলেম অর্জন করেনি। তার বদলে এলাকায় জারি হয়েছে তেন্নাতের মেলা। আর খুব বেশি হলে নেংটা গোঁসাইর পূজা। এক পয়সার গাঁজা আর দুপয়সার চিনিই এই মেলা বা পূজার উপাচার। সঙ্গে বেলপাতা।

১৯২২ সালে নমঃশুদ্রদের নেতা যোগেন মণ্ডল অত্র এলাকায় ভ্রমণ করেছিলেন। সে সময়ে তিনি পদ্মবিলায় এসেছিলেন। পদ্মবিলা গ্রামটি নারিকেলবাড়ি গ্রামের পূর্বদিকে অবস্থিত। যোগেন মণ্ডল কবিগানে গেয়েছিলেন—

শেখ আর শুদ্দুরের একই দুশমন।
বামুন-কায়েত-বৈদ্য উচ্চ হিন্দুগণ।
পদ্মবিলায় কুনো কালে কাইজ্যা হয় না।
কাইজ্যার গল্প-গান সব মিথ্যে রটনা।।

এই কবিগানের মধ্যে বিদ্যেধরের নাম পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না গদাধরের নামও।

না পেলেও কোনো ক্ষতি নেই। লোককথা মুখে মুখে জমে ভালো—বইতে নয়। বইয়ের মধ্যে কথা থেমে যায়। নতুন কথার জন্ম হয় না। আর যে কথা লোকমুখে ফেরে—তা নতুন করে পল্লবিত হয়। তার ডালপালা ছড়ায়। বহুকথার জন্ম দেয়। একটি পাখির গান বহুপাখির গান হয়ে বাজতে থাকে। ফলে গদাধর বিষয়ে বহুকথা ধীরে ধীরে জেগে ওঠে।

বিনোদিনীর বাবা-মা-ভাই-বোন অথবা আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী ধীরে ধীরে গদাধর বিষয়ে ভুলে যাওয়া আরও কিছু প্রচলিত কথা স্মরণে আনতে পারে। তাদের এলাকায় জনশ্রুতি ছিল-- গদাধর বিদ্যেধরেই জন্মেছিল। তবে কেউ কেউ বলেন, বিদ্যেধরে নয়—গদাধরের জন্ম মোল্লাকান্দি। মোল্লাকান্দিতে লোকবসতি ছিল না। ছিল নিষ্কর মৎসক্ষেত্র। এলাকার জেলেরা এই বিলে নিরবে-নিভৃতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। শুধু আশ্বিনে মোল্লাকান্দি বিলটি মানুষের কলরবে-উৎসবে জেগে উঠত।

এই রকমই এক আশ্বিন মাসে উলপুরের মেজোবাবু এসেছেন। সঙ্গে তার বছর দেড়েকের ছেলে মহিমকুমার। এ উপলক্ষ্যে কোলকাতা থেকে মুন্নি বেগম এসেছেন মুজরো করতে। আর বাইশারির নট্ট কোম্পানী সাতদিন ব্যাপী যাত্রাপালা করবে। পালার মধ্যে অভিনীত হবে ব্রজেন্দ্রনাথ দে রচিত ঐতিহাসিক পালা নবাব সিরাজুদ্দৌলা। এ উপলক্ষ্যে উলপুর স্কুলের সামনে বিরাট প্যান্ডেল বসেছে।

চারিদিকে ভরা বর্ষা। জল থৈ থৈ। দুপুরের আগে থেকেই বাবুদের দুর্গাপ্রতিমা নৌকায় উঠেছে। নানা বাদ্যি বাজনা বাজছে। কয়েকটি নৌকায় সঙ নাচছে। নৌকায় নৌকায় করে দূর দূরান্ত থেকে লোকজন চলে এসেছে। মোল্লাকান্দির বিলে আর ঠাঁই নেই। সন্ধে হতেই প্যাট্রোম্যাক্সের আলো জ্বলছে নৌকায়। হাওয়াই বাজি ফুটবে এর কিছুক্ষণ পরেই। তার আগে মেজোবাবুর গিন্নী ছেলে কোলে নিয়ে দুর্গাপ্রতিমার কপালে তেল সিন্দুর দিতে গেলেন। আর তখনি নৌকাখানি একটু কাত হয়েছে। এর মধ্যে শোনা গেল মেজবাবুর কোলের ছেলেটি জলের মধ্যে পড়ে গেছে। চারিদিকে হৈচৈ উঠেছে। সারা রাত্রি ব্যেপে ছেলেটি খোঁজা হল। বাবুরা তাকে না পেয়ে কোলকাতায় ফিরে গিয়েছিল।

শোনা যায়, সে সময়ে ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। বেশ কয়েকটি নৌকা ডুবি হয়েছিল।

তবে আরেক মতে—বাবুরা সে বছর মোল্লাকান্দি বিলে মাছ ধরার জন্য খাজনা ধার্য করে। জেলেরা বিপদে পড়ে যায়। তারা আগের মতো মাগনা মাছ ধরতে পারছিল না। এই কারণে ক্ষিপ্ত জেলেরা মেজোবাবুর ছেলেকে ডাকাতির নাম করে তুলে নিয়ে যায়। এবং বটবাড়ির লোকজনেরা এই কাজটি করতে পারে বলে কারো কারো সন্দেহ ছিল।

তবে উলপুরের অষ্টগ্রাম জনসম্মিলনী নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক প্রসন্ন দত্ত’র মতে মেজোবাবুর ছেলে ঝড়ে-জলে ডুবে গিয়েছিল বা তাকে ডাকাতরা নিয়ে গিয়েছিল—যাই হোক না কেন মেজোবাবুর ছেলেকে কিন্তু ফিরে পাওয়া গিয়েছিল। ছোট খাটো গড়নের একটি বালক জল থেকে ছেলেকে উদ্ধার করে দিয়েছিল। বাবুরা তাকে সোনাদানা দিতে চেয়েছিলেন। ছেলেটি এসব কিছুই চায়নি। শুধু দাবী করেছিল মোল্লাকান্দির বিলকে যেন আবার নিষ্কর জলাভূমি করে দেন। তারা আগের মত মাছ মাগনা ধরে বাঁচতে চায়।

বাবু সেটা করেছিলেন। এমন কি তিনি আর কখনো মোল্লাকান্দি আসেননি। কোলকাতায় গদাধরের নামে একটি একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অথবা দক্ষিণেশ্বরে গদাধরের নামে একটি সিঁড়ি বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা আছে। এমনকি মেজবাবুর ছেলেটি যে বেঁচেছিল তার প্রমাণ হিসেবে মেজবাবুর ছেলের একটি ছবি উলপুরের অষ্টগ্রাম জনসম্মিলনী নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে রক্ষিত আছে। ছেলেটি বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়েছিল।

উদ্ধারকারী ছেলেটির নাম গদাধর বলে মনে করতে পারেন প্রসন্ন দত্ত। এই গদাধর কোন গদাধর এই প্রশ্নে তিনি জানান— এই গদাধর নামের ছেলেটির আকার-প্রকার এমনই অদ্ভুত যে তাকে নির্দিষ্ট কোনো গদাধর বলে সনাক্ত করা যায় না। তার মাথাটি অপেক্ষাকৃত বড়। হাতদুটোর মধ্যে একটি খাটো। আরেকটি এমন লম্বা যে তা হাঁটুর নিচে পড়ে। এটা শুনে নিজামকান্দির একরাম মাওলানা দাবী করেছিলেন—সে কোনো বালক নয়। পুরোদস্তুর যুবক ইনসান। তুর্কি। নাম বখতিয়ার খিলজি। তবে ঠিক তুর্কি নয়। কাবুল দেশের। লক্ষ্মণ সেনকে বখতিয়ার খিলজি হটিয়ে দিয়েছিল।

এলাকার ফেলা মজুমদার নামের লোকটি সব কিছুর মধ্যে থেকে কুকথা বের করতে ওস্তাদ। তিনি হুঁকোতে গোটা তিনেক লম্বা টান দিয়ে বললেন, এই যে গদাধর নামে ছেলেটির কথা কইতেছো সে আসলে উলপুরের মাইজাবাবুর ঔরসজাত পোলা। তার মায়ের নাম –মুন্নিবাই। বাবুর লগে ওঠোন-বসোন ছিল। মুন্নিবাই ফি-বছর উলপুরের বাবুর বাড়ি মুজরো গান গাইতে আসত। এ পর্যায়ে ফেলা মজুমদার গলা খাটো করে বললেন, বোঝলেন তো, কুসঙ্গের পোলা-মাইয়া আন্ধা-গান্ধা হয়। এই পোলাটার বাম হাত আর বাম পায়ে গান্ধা ছিল। মেজো বাবু তারে এই এলাকায় একটা গ্রাম লেইখা দিছিলেন। এই গ্রামটির নামই বিদ্যেসুন্দর। বিদ্যেসুন্দর গ্রামে উলপুরের মেজোবাবু আর মুন্নিবাইয়ের পোলার বসতভিটে।

বিনোদিনী জিজ্ঞেস করল, বিদ্যেধর, না, বিদ্যেসুন্দর?

একথার জবাব নেই। ফেলা পাগলার মধ্যেও একটু সংশয় এসে গেল। তবে বিদ্যে নামটি ঠিক আছে।

বিনোদিনীর বাবা বলে ওঠেন, যা বিদ্যে—তাই সুন্দর।

বিনোদিনী আবার শুধাল, বিদ্যেসুন্দর বা বিদ্যেধর যে নামই হোক না কেন সেই গ্রামটি কোথায়?

--সেটা জানি না। ফেলা মজুমদার তার কুকথায় ক্ষান্ত দিলেন। শুধু বিনোদিনীকে প্রবোধ দিতে গিয়ে জানান যে, গ্রামটি এইখানেই কোথাও ছিল। মোল্লাকান্দি আর মালেঙ্গার মাঝামাঝি। এই দুই গ্রামের মাঝখানে বড় হিজল গাছ। তার দক্ষিণে গদাধরের ভিটে। মুন্নি বাইয়ের ইচ্ছে, মেজোবাবু তার পোলার জন্য যেন একটা বাংলোঘর করে দেন। তার ঘাট বাঁধানো পুকুর। পুকুরে পদ্মফুল। আর ঘাটে কোষা নৌকা। বাবু করে দেবেন দেবেন বললেও শেষ পর্যন্ত করে দেননি। শুধু পুকুরটা কাটা হয়েছিল। ফেলা মজুমদার একটু গলাখাটো করে জানালেন, নাবালক পোলার বাড়িটা যাতে কেউ দখল না করতে পারে সেজন্য মুন্নি বাই তুকতাক করে পুরো বিদ্যেধর গ্রামটিকেই লোকচক্ষুর আড়াল করে দেয়। শুনে বিনোদিনীর চোখ কপালে ওঠে। জিজ্ঞেস করে, কন কী কাকা?

ফেলা মজুমদার একটু হেসে বললেন, অবাক হইও না। আগেকার দিনে এসব হইত। কেউ কেউ কুহক বিদ্যে জানত।

গ্রামটি আছে—আবার নেই। নড়ে-চড়ে, খুঁজলে জনম ভর মেলে না। সাতচল্লিশে যখন র‍্যাডক্লিফ সাহেব বাংলা ভাগ করে দিল, তখন তার লোকজন বিদ্যেধর গ্রামটি দেখতে না পেয়ে ম্যাপে জায়গা দিতে পারেনি। সরকারের নথিপত্রে বিদ্যধর গ্রামটি নেই। হাপিস।


এতো কথা বলা বা শোনার মন নেই বিনোদিনীর। বিদ্যেধরে যাওয়া ছাড়া তার উপায় নেই। বিদ্যেধরে গিয়ে গদাধরের থানে যেতে হবে। গদাধরকে মুড়ি খাওয়াতে হবে। তার ছেলের বালা-মুসিবত দূর করতে হবে।

তার বাবা একটু উশখুশ করে বলল, যে গ্রাম নাই—সেইখানে যাই কেমনে রে মা?

এই প্রশ্নের উত্তর বিনোদিনীর জানা নেই। জানার দরকারও নেই। কোলের ছেলেটিকে নিয়ে বাবার পায়ের কাছে ভুট হয়ে পড়ল। 


পরদিন ভোর ভোর নৌকায় করে এই ভরা বর্ষায় বিনোদিনীকে নিয়ে গ্রামের লোকজন বিদ্যেধরের সন্ধানে রওনা করেছে। তারা প্রথমে গেল বটবাড়ি। সেখান থেকে মোল্লাবাড়ির সোভান মিয়া উঁকি দিয়ে বললেন, আপনেরা কই যান গো মাস্টার দাদা?

মাস্টার দাদা উত্তর করেন, বিদ্যেধরে যাই।

--কোন বিদ্যেধর?

--গদাধরের বিদ্যেধর।

--গদাধর?

প্রশ্নটি করেই কিছুক্ষণ চিন্তা করল সোভান আলী। বিদ্যেধর শব্দটির সঙ্গে গদাধর শব্দটি একসঙ্গে শুনে আর অচেনা লাগে না। সোভান আলীর একটি ছড়া মনে পড়ে যায়। ছড়াটি ছোটবেলায় তার দাদাজানের কাছে শুনেছেন।

বিদ্যেধরের গদাধর।

ভাইঙ্গাচুইরা নৌকা ভর।

তার দাদাজান একবার দক্ষিণে রওনা করেছেন। সাগরে মাছ ধরতে গেছেন। মাছের দেখা নাই। এদিকে ফেরার সময় হয়ে গেছে। ফিরলে কী খাবে এই নিয়ে ভয়ানক চিন্তা। কী দিয়ে মহাজনের ঋণ শোধ করবে? তার মধ্যে কী মনে করে গদাধরের নাম বলে উঠলেন। তারপর সকাল সকাল তার নৌকা ভরে গেল মাছে। দাদাজান মরার কালে বলে গিয়েছিলেন—গদাধরের দেখা পেলে তার সেলাম পৌঁছে দিস। গদাধরের কাছে যাওয়ার এই মওকা ছাড়তে সোভান আলী রাজী নন। সোভান আলী আর দেরি করেন না। তিনি নৌকা ভাসিয়ে দিলেন তাদের পিছে পিছে।

তাকে বিনোদিনীর বাবা জিজ্ঞেস করলেন, সোভান আলী, বিদ্যেধর চেনো তুমি?

তিনি মাথা নাড়েন। না, তিনি চেনেন না।

সোভান আলী একটু দাড়ি চুলকান। গদাধরকে সালাম পৌঁছে দিতে তার দাদাজান অনেক খুঁজেছেন বিদ্যেধর নামের গ্রামটি। পাননি। তবে তিনি তার নানাজানের কাছে শুনেছেন—বিদ্যেধর গ্রামটি আছে। তাকে হেলা করা যায় না। বিদ্যেধর না থাকলে গদাধর থাকে কী প্রকারে। শুধু খুঁজতে হবেরে বাপধন। একা খুঁজলে যে জিনিস পাওয়া যায় না, দশজনে মিলে খুঁজলে তাকে পাওয়া সহজ।

রাউৎখামার থেকে জুড়ালচন্দ্র মাঝিও উঠেছে। তার বউয়ের হাতে একটা তালের পাখা। পাখাটি রঙিন সুতো দিতে নকশি করা হয়েছে। পাখাটি বুনেছিল তার শ্বাশুড়ি। তাদের বকনা গাইগারুটি একটু দেরি করে গাভীন হয়েছে। তার ইচ্ছে পাখাটি গদাধরকে দেবে। জুড়ালচন্দ্র মাঝি বা তার হাতপাখা বানানো বউ বিদ্যেধর গ্রামটি কোথায় জানে না। তবে তারা শুনে এসেছে—বিদ্যেধর গ্রামটি এই এলাকায়ই আছে। না থাকলে মানুষে বিদ্যেধরের নাম বলবে কেন?

আরও কয়েকটি নৌকা উঠল পারকুল থেকে, পুব নিজড়া থেকে। খবর পেয়ে তেতুলিয়া থেকে এসে পড়েছে জোলা বাড়ির কয়েকসারি বাচাড়ি নৌকা। মালেঙ্গার মনসুর আলীর বুড়ো বাপের হাতে আবে জমজমের পানির বোতল। মুন্সীগঞ্জে তার সম্বন্ধীর নানা শ্বশুরবাড়ি। সে বাড়ির মাইজা চাচা হজ্বব্রত করে এসেছেন বছর দশেক আগে। তিনি বলেছেন এই আবে জমজমের পানি খেলে সর্বোরোগ দূর হয়। এই পানি গদাধরকে দিতে চান তিনি। গদাধর দেশবিদেশে ঘুরে বেড়ায়। তার কাছ থেকে সবাই পাবে। সবাই রোগমুক্ত হলেই তার শান্তি।

এই নৌকার সারি পদ্মবিলা, মোল্লাকান্দি হয়ে আন্দারকোটা ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে গেল। কিন্তু বিদ্যেধরের সন্ধান পাওয়া গেল না। যেখানে যায় সেখানকার লোকজনই ধীরে ধীরে বিদ্যেধর গ্রামের কথা শুরুতে মনে করতে পারে না। ধীর ধীরে আবছা করে মনে পড়ে। মনে করতে পারে-- তাদের বাপ-দাদারা ঘনবৃষ্টির মধ্যে, তীব্র রোদের কালে, অথবা হাড় কাঁপানো শীতের ছোবলে এই বিদ্যেধর গ্রামের গল্পগাছা করেছে। কিন্তু কেউ জানে না বিদ্যেধর গ্রামটি কোন দিকে আছে? ঠিক কোন জায়গাটিতে আছে।

বিনোদিনীর মুখ শুকিয়ে যায়। দেখে তার বাবা বলে, মা—চিন্তা কইরো না। উলপুর যাইয়া দেখি। সেইখানে বাবুগো বাড়ির লোকজন থাকতি পারে। তারা কেউ না কেউ জানে বিদ্যেধরের সন্ধান।

উলপুরের বাবুদের বাড়ি উলপুরে এখনো আছে। তবে পড়ো পড়ো। ইট বেরিয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও বটের চারা গজিয়েছে। দরোজা-জানালা ভাঙা-চোরা। এ বাড়িতে বাবুদের কেউ নেই। আছে তহশীল অফিস। তহশীলদার এলাকার মৌজা ম্যাপ বের করলেন। সেখানে বিদ্যেধর নামে কোনো মৌজা বা গ্রাম নেই। দাগ পরচাও বের করে দেখালেন। সেখানে বিদ্যেধরের নামে কোনো জমি নেই।

এটা জানতেন বিনোদিনীর বাবা। তিনি জ্ঞানী মানুষ। তার হতাশা কম। কিন্তু বিনোদিনী হতাশ হল। তার মানতে কষ্ট হচ্ছে।

কোলে বিনোদিনীর খোকাটি ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে দেখিয়ে জানতে চাইল, বিদ্যেধর খুঁজে না পেলে গদাধরকে পাব কি করে?

তহশীলদারের বয়স হয়েছে। তার এই এলাকার লোক নন। বরিশালের উলানী গ্রামে তার বাড়ি। চাকরি সূত্রে তিনি কিছুদিন আগে এই এলাকায় বদলী হয়ে এসেছেন। তিনি সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, বিদ্যেধর ছাড়াও এই এলাকায় অনেক গদাধর আছে। তারা খাজনাপাতি দিতে এই অফিসে আসে। সবার নাম ধাম লেখা আছে। আপনেরা চাইলে তাগো নাম-ধাম দিতে পারি। তাগো সঙ্গে দেখা করতে পারেন।

ফাইল বের করার আগে তহশীল অফিসের সবচেয়ে পুরনো পিওন হরনাথ এ ব্যাপারে বলল, মা জননী, তুমি যে গদাধরের কথা কইছ, সে এই আমাগো বাল্যকালের গদাধর। বাপ-দাদার খোঁজ খবর নাই। লোকে তারে মান্য করে। পুরনো ফাইল পত্র দে্খলে তার সন্ধান পাওয়া যাবে।

খুব মন দিয়ে শুনে তহশীলদার পুরনো কিছু ফাইলপত্র বের করলেন। এগুলো এতো পুরনো যে তার পাতাগুলো জিরজিরে হয়ে গেছে। সাবধানে না ধরলে গুড়ো গুড়ো হয়ে পড়তে পারে। এগুলো তিনি বাবুদের বাড়ির পুরনো সিন্দুকে পেয়েছেন। মাঝে মাঝে সেগুলো পড়েও দেখছেন। তিনি খুঁজতে খুঁজে দেখলেন একটা ফাইলে লেখা আছে, কোনো এক গদাধরের নামে কোলকাতা থেকে ৫০১ টাকার একটা মানি অর্ডার এসেছে। অনাদিনাথ চৌধুরী নামে একজন স্বাক্ষর করে লিখেছেন, এই টাকা দিয়ে গদাধরের ভিটেয় একটা চালাঘর তুলে দিতে হবে। সেজন্য নায়েব মশায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন।

তারিখ দেওয়া আছে—৭ এপ্রিল, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ।

বিনোদিনীর বাবা জিজ্ঞেস করলেন, এই অনাদিনাথ চৌধুরী লোকটি কে?

তহশীলদার তার পরিচয় দিতে পারলেন না। তবে জোর দিয়ে বললেন, তিনি উলপুরের জমিদার নয়। জমিদার হলে নামের সঙ্গে শুধু চৌধুরী নয়—রায় চৌধুরী দিতেন।

হরনাথ পিওন উত্তর করল, অনাদিনাথ চৌধুরী জমিদার নয় বটে। কিন্তু তিনি জমিদারের সম্বন্ধী।

বিনোদিনীর বাবা বেশ উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, চালাঘরটি করা হয়েছিল?

তহশীলদার আবার কাগজপত্র ঘাটলেন। না, এ তথ্য নেই। তবে ১৯৪৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারী গোপালগঞ্জ থানার দারোগার একটি নোটিশ খুঁজে পাওয়া গেল। দারোগা লিখেছেন, উলপুর এস্টেটের নায়েব শ্রী হরিচরণ দত্ত গত ১৬ মার্চ তারিখ থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। তার স্ত্রী ও পুত্রকন্যাগণ তাকে খুঁজে না পেয়ে থানায় ডাইরি করেছে। তাদের অভিযোগ, সেদিন ভোরবেলা বাড়ি থেকে খাজনা আদায়ের কাজে মোল্লাকান্দি গিয়েছিলেন। তারপর আর কোন খোঁজ নেই। তারা খুবই উদ্বেগের সঙ্গে দিনাতিপাত করছে।

বটবাড়ির সোভান আলী জিজ্ঞেস করলেন, নায়েব মশাইকে কী পাওয়া গেছে?

--সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। বললেন তহশীলদার। তবে আরেকটি চিঠি খুঁজে পেলেন তিনি। সেটা পাকিস্তান ডাকবিভাগের চিঠি। জনৈক হরিচরণ দত্তের নামে লেখা হয়েছে। লেখা রয়েছে যে, তার নামে কোলকাতা থেকে আগত ৫০১ টাকা অবিতরিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এর মধ্যে ৪ বছর ৬ মাস কেটে গেছে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে চিঠি লেখা হয়েছে। তবে এখনো এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। চিঠির নিচে উলপুরের চৌকিদারকে অনুরোধ করে লেখা হয়েছে যে, তিনি যেন আন্তরিকভাবে হরিচরণ দত্তের সন্ধান করে এই টাকা বিতরণের ব্যবস্থা নেন। চৌকিদার এই চিঠির নিচে আঁকা বাঁকা অক্ষরে লিখেছে, হরিচরণ দত্তের সন্ধান পাওয়া সম্ভব নয়। তবে টাকাটা যদি তাকে দেওয়া হয়, তবে গদাধরের নামে বিদ্যেধরে চালাঘরটি তিনি নিজ দ্বায়িত্বে গড়ে দিতে রাজী আছেন।

বিনোদিনীর বাবা কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে থাকলেন। তারপর শুধালেন, ডাকবিভাগ কি টাকা চৌকিদারকে দিয়েছিল?

ফাইলটি আরো কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে তহশীলদার হতাশ হয়ে জবাব দিলেন, সে বিষয়ে কিছু লেখা নাই। তারপর উঠতে উঠতে গলা খাটো করে বললেন, সব কিছু ফাইলে লেখা থাকে না। ফাইলগুলো তহশীলদার আবার যত্ন করে বেঁধে রাখলেন।

নৌকাগুলো অপরাহ্নের কোমল আলোর মধ্যে দিয়ে যার যার গ্রামে ফিরতে লাগল। থৈ থৈ জলের মধ্যে ঘন ধানক্ষেতে ঘাসঘড়িংগুলো শেষবারের মত উড়ছে। বিনোদিনী ভেঙ্গে পড়েছে। বিদ্যেধরকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যেধরকে না পেলে গদাধরকেও পাওয়া যাবে না। তার খোকার ঘুম ভেঙ্গেছে। সে জল দেখতে দেখতে হেসে উঠেছে। হাত বাড়িয়ে মায়ের আঁচলটা মুখে পুরেছে।

মাস্টারবাবু মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, মাগো চিন্তা কইরো না।

বিনোদিনী এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। বললেন, না চিন্তা কইরা কী করি। গদাধর ছাড়া আমার পোলারে পরীর হাত থেকে বাঁচাই কী করে!

বিচলিত হলেন মেয়ের কান্নায়। তাকে খুব শান্ত সুরে বললেন, বিদ্যেধর গ্রাম আছে। না থাকলে কি কোলকাতার বাবুরা ভিটেয় ঘর তোলার জন্য মানি অর্ডার করে টাকা পাঠায়?

এই প্রশ্নে বিনোদিনী ঘাড় তুলল। কথায় যুক্তি আছে। তার কান্না থেমে গেল।

তার বাবা এলাকার মাস্টারবাবু। তিনি মিছে কথা বলেন না। তিনি বললেন, বিশ্বাস রাখো। আজ না হোক কাল, কাল না হোক পরশু বিদ্যেধরের সন্ধান পাওয়া যাবে। গদাধরকেও সেই গ্রামে পাওয়া যাবে। গদাধরকে স্মরণে রেখো। তোমার ছেলেকে পরীতে কিছুই করতি পারবে না।

এ যেন অনেককালের গল্পগাছা। এর মধ্যে বিনোদিনীর বাবা মারা গেছে। সেদিনের দেড় বছরের খোকাটি আর খোকা নেই। এখন সে এক যুয়ান পুরুষ। তার একটি মেজোখুকি হয়েছে। বিনোদিনীর চুল পেকেছে। চোখে ছানি পড়েছে। দূরে ছোট মফস্বল শহরে থাকে। সেখান থেকে বাপের বাড়ি যাওয়া থেমে গেছে।

সেবার মাঠে মাজড়া পোকার আক্রমণে ধানে মার খেয়েছে। মানুষের মন মেজাজ ভালো নেই।

তার মধ্যে উলপুরের কে একজন রামচন্দ্র বিশ্বাস ঝিনঝিনা রোগ নিয়ে ফিরেছে। সেতো মরেছে মরেছে—এলাকায় এই রোগটি রেখে গেছে। পায়ের বুড়ো আঙুলের আগা থেকে ঝিনঝিনা লক্ষ্মণ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে সেটা শরীরের উপরের দিকে ওঠে। তবে মাথায় উঠলে আর বাঁচন নেই। এটা নিয়ে এলাকায় বেশ আতঙ্ক জেগেছে। এজন্য সায়েম কবিরাজের শ্বাস ফেলার সময় নেই। এদিকে বারখাদিয়া গ্রামের কালী কবিরাজ সোজা বলে দিয়েছেন, তিনি ছাড়া এই ঝিনঝিনা রোগের নিদান করার মতো এলেম অত্র এলাকায় আর কারো নেই। তাকে নগদ একান্ন টাকা একান্ন পঁয়সা না দিলে রোগের নিদান দেবেন না। শুধু বলেই ক্ষান্ত দিলেন না। কোথায় কোন বিলে লুকিয়ে গেলেন সেটা কেউ জানতে পারেনি। লোকজনের মাথা খারাপ।

শহরের উত্তর পাড়ার আশুবাবুর মোক্তারী ব্যবসা লাটে ওঠায় সপরিবারে উধাও হয়ে গেলেন। তার বাড়িটা কিছুদিন ফাঁকাই পড়েছিল। একদিন পূবপাড়ার পলুমিয়া লোকজন নিয়ে দখল নিতে গেল। আশু মোক্তার তার কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল বলে সবাইকে জানান দিল। সে বাবদ এই বাড়িটা আশু মোক্তার তাকে দিয়ে গেছেন। তবে দক্ষিণ পাড়ার মোজাম সর্দার এরপরই একটা দলিল দেখাল। দলিলে লেখা আছে, আশু মোক্তার নগত পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে মোজাম সর্দারের স্ত্রীর কাছে বাড়িটি বেঁচে দিয়ে গেছেন।

তবে দুএকদিনের মধ্যে আরও কিছু লোকজন পাওয়া গেল যাদের কাছ থেকে আশুবাবু টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেল। এদের সবাইকে তিনি বাড়িটি লিখে দিয়েছেন স্ট্যাম্পে সই করে। একটি বাড়ি আশু মোক্তার অনেক লোকের কাছে বিক্রি করে গেছেন।

দেখতে দেখতে ঘটনাটি এতো জটিল হয়ে গেল। এলাকার ধান ফসল ‘মাইর’ খাওয়া, মাঝে মধ্যে কলেরা বসন্ত, ঝিনঝিনা রোগ, ম্যালেরিয়া রোগ দমনের উদ্দেশ্যে মশক নিধন কর্মসূচীর জন্য সরকারি টাকা পয়সার বিলিব্যবস্থায় অনিয়ম, সায়েম কবিরাজের ব্যস্ততা অথবা কালী কবিরাজের একান্ন টাকা একান্ন পয়সার ঘোষণা দিয়ে বিলে লুকিয়ে থাকার ঘটনাগুলোর সঙ্গে আশু মোক্তারের এই বহুলোকের কাছে একটি বাড়ি বেঁচে দিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়া ব্যাপারটির ঘটনকাল কাকতালীয় ভাবে মিল থাকায় এলাকায় প্রবল সন্দেহ ও উত্তেজনা ছড়াল।

এ পাড়ায় ও পাড়ার এটা নিয়ে ফিসফাস, গুরুগম্ভীর আলাপ, উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়, এবং ছোট ছোট খাটো সংঘর্ষ দেখা দিল। পলু মিয়ার লোকজন মোজাম সর্দারের এক ভাগ্নের মাথা ফাটিয়ে দিল। শোনা গেল ছেলেটি পলু মিয়ার ভাইজির ওড়না ধরে টান দিয়েছিল। এর জের ধরে মোজাম সর্দারের খালাতো ভাইয়ের কাপড়ের দোকান ঝাঁপ ভেঙ্গে ফেলল। ঘটনাটি শুধু মোজাম সর্দার বনাম পলু মিয়ার মধ্যে রইল না। পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ল। কারো বা গোয়াল ঘর থেকে গরু ছাগল উধাও হয়ে গেল। এলাকায় চোর ডাকাতের উৎপাত বেড়ে গেল। থানা পুলিশ বা চেয়ারম্যান মেম্বরও এই ঝামেলা সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। পুরো শহরটাই নরক হয়ে উঠেছে। শেষে কে বা কারা রটিয়ে দিল—রামচন্দ্র বিশ্বাস, কালী কবিরাজ অথবা আশু মোক্তার এই মহাঝামেলা বাঁধিয়েছে। তবে এই মহাঝামেলা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়—কারো কারো মতে পরিকল্পিত।

ফলে শেষ নিদান হল—এদেরকে খুঁজে বের করে বিচারের ব্যবস্থা করা। তবে এর মধ্যেও একটা ঝামেলা আছে। সেটা হল—রামচন্দ্র বিশ্বাস বেঁচে নেই। আশু কবিরাজ কোথায় জানা নেই। কেউ বলল, তিনি গুটি বসন্তের ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। আবার কেউবা বলল, মেলা টাকা পয়সা নিয়ে বর্ডার পাড়ি দিয়েছেন। আরেকদল বলল, আশু ডাক্তারের বাড়িটা দখল করার জন্য তাকে গায়েব করে মাঝিগাতির বিলে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। সর্বোপরি কালী কবিরাজ এলাকার লোকজনের কলাটা-মূলোটা খেয়ে ঘাড়ে-গর্দানে মোটা সোটা হয়েছে। এখন বিপদে সরে আছে-- এটা রীতিমত বেঈমানী। শোনা যায় তাকে মাঝে মধ্যে সাহা পাড়ায় দেখা যায়। আবার কে বা তাকে মণ্ডলবাড়ি থেকে বের হতে দেখেছে। সুবোধ ঘরামীর মেজো ছেলেটা মরতে মরতে বেঁচেছে। তার এক চোখ কানা হয়ে গিয়েছে। ছেলেটির মা কালী ডাক্তারের নামে ধন্য ধন্য করতে লেগেছে। কিন্তু মোল্লাবাড়ির সেজো মেয়েটাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। মোল্লাবাড়ির লোকজনের ধারণা কালী কবিরাজের ইচ্ছে থাকলেও নমোপাড়ার লোকজন তাকে মোল্লাবাড়ি যেতে দেয়নি। তারা তাকে লুকিয়ে রেখেছে। কাল কবিরাজ এলে নিশ্চিত বাঁচত।

এই প্রশ্নেপলু মিয়া বা মোজাম সর্দার বা অন্যান্য লোকজন জনসমক্ষে সম্মিলিতভাবে ঘোষণা দিল—রামচন্দ্র বিশ্বাস, আশু মোক্তার এবং কালী কবিরাজ এই তিনজনকে যদি আগামী অমুখ দিনের মধ্যে তাদের হাতে জীবিত অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া না হয় তবে তাদের খুঁজতে ঘরে ঘরে তল্লাশী করা হবে। কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।

এ ঘোষণার অর্থ বুঝে অনেকেই এলাকা ছেড়ে পরিবার-পরিজন ছেড়ে নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নিতে ছুটল। কেউ কেউ আবার সে সুযোগটা পেল না। চারিদিকে পাহারাদার বসে গেল। কারো কিছু করার নেই। বিনোদিনী ছেলেপেলেরা অতি নিরীহ মানুষ। কারো সাতেও নেই—পাঁচেও নেই। এ-রকম বিপদ যে তাদের ঘাড়েও চেপে বসবে এটা ভাবতেও পারেনি। দিশা-হারানো ছেলে-পুলে নাতি-পুতি নিয়ে বিনোদিনী কোনো উপায় না দেখে সামনের বাড়ির আব্দুল হক বিএ’র কাছে গেল।

আব্দুল হক বিএ তখন বয়সের ভারে ন্যূব্জ। ঘর থেকে বের হন না। পায়ে আগের মতো জোর পান না। ঘরের মধ্যেই নামাজ সারেন। তার গ্রামের বাড়ি নারিকেল বাড়ির উত্তরে সীতারামপুর গ্রামে। তিনিই বিনোদিনীর বিয়ের সম্বন্ধ এনেছিলেন। তখন বিনোদিনীর বয়স মাত্র পনের। এখন তার নাতি পুতি হয়েছে। চুলে পাক ধরেছে। বিপদে-আপদে তিনিই ভরসা।

আব্দুল হক বিএ’র কাছে ভেঙ্গে পড়ে বিনোদিনী বললেন, এখন কী করি চাচাজান?

তিনি মৃদু হেসে বললেন, ভয় পাইও না মাগো। এসব বালা-মুসিবত মাঝে মাঝে আসে। আবার চইল্যাও যায়।

তিনি ১৯২২ সালের ঘটনা দেখেছেন। কংসুরে রায়ট লেগেছে। মোসলমান আর নমুশুদ্রদের রায়ট। কেউ কেউরে ছাড়ে না। দু পক্ষই হাইলা-জাইলা। শেখেরা বলে, এইবার নমুগো ছাড়ন নাই। হেগো দেশছাড়া করণ লাগবে। আবার নমুরা বলে, বাওনরা আমাগো পোছে না। এই ভিটে মাটি ছাইড়া যাব কোথায়। লাগলে শ্যাখগো মাইরা এই ভিটামাটিতে থাকব। দারোগা ওয়াটসন সাহেব ক্যাম্প করলেন বৌলতলী স্কুল মাঠে। কিন্তু রক্তারক্তি থামার কোন লক্ষণ নাই। পুরুষ মানুষ ঢাল সড়কি নিয়ে নামে। আর মাইয়া মাইনসে ছাই ওড়ায়।

রায়ট থামাতে ফরিদপুরের শামসুদ্দিন খান সাহেব এলেন। বরিশালের যোগেন মণ্ডল এলেন। তাদের কথা কেউ শোনে না। পরদিন আখেরি যুদ্ধ।

এর মধ্যে একজন লোক এসে দুদলের মাঝখানে দাঁড়াল।

--কে তিনি? বিনোদিনী জিজ্ঞেস করল।

আব্দুল হক উত্তর দিলেন না। তিনি চোখ বুজে রায়টের কথায় মেতে আছেন। লোকটা কাউকে কিছু বলে না। দুদল উন্মত্ত লোকের মাঝখানে নিজের মতো করে দাঁড়িয়ে গেছে। শুধু কী একটা অদ্ভুদ সুরে গান করে।

--কী গান?

গানটির কথা আব্দুল হক বিএ বলেন না। তবে গেয়ে শোনান—

জুত কইরা আইসো গো মালতিবালা
ফুত কইরা ভাইসো গো মালতিবালা
হাইতনা জোড়া গদাধরের মালা
আমি কী কহিব তারে, আমার চউক্ষে নিদ্রা নাই
আমি বিদ্যেধরে যাই।।

গানটি শুনে বিনোদিনী বলে উঠল, চাচাজান এটা আমাগো গদাধরের গান। ছোটবেলায় আমরাও গাইছি।

উত্তরে আব্দুল হক বিএ কিছু বললেন না। বললেন, এই লোকের হাতে একটা করতাল ছিল। বাজাতে বাজাতে ফাইটা গেছে।

বিনোদিনীর মন কেঁপে উঠল। আবার তার পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, লোকটার নাম কি গদাধর নাকি চাচাজান? 

গদাধর কী অগদাধর সেটা নিয়ে বুড়ো মানুষটির কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তিনি নামকে নয়—মানুষকে চেনেন। বললেন, এই মানুষটি এসেছে সীতারামপুর থেকে। সীতারামপুরের মৃধাবাড়ির সালামত আলী মেয়াজানের মাইজা পোলা। বাল্যকালে মেয়াজান কোলকাতার মেটিয়াবুরুজ থেকে পোলাটাকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তত্ত্বতাল্লাশ করে যেটুকু খবর যোগাড় করেছিলেন, তাতে বোঝা যায়—ঐ এলাকায় লক্ষ্ণৌর এক বিখ্যাত বাইজীর মুজরো ছিল। সে উপলক্ষ্যে বিপুল জনসমাগম হয়েছিল। তাদেরই কারো হতভাগ্য এই পোলা। তিনি পোলাটার বাপ-মায়ের হদিশ করতে না পেরে নিজের সঙ্গে নিয়ে এলেন সীতারামপুরে। নাম রাখলেন গফুরুদ্দিন ওরফে গফফর কি গদাধর। লালন-পালন করলেন পুত্রস্নেহে। সেখানে যে বাইজী গান গেয়েছিলেন তার নাম ছিল মুন্নীবাঈ। তবে ছেলেটি খোদাতাল্লার গানও গাইতে পারে। আবার ভজন গানও গাইতে পারে। তার গান শুনে সীতারামপুরের মুসলমানরা তাকে মানে, সে এলে সবার দিল ঠাণ্ডা হয়ে যায়। হিংসাপাতি থাকে না। আর নমোশুদ্ররা গানের সঙ্গে দু হাত তুলে নাচে।

বিনোদিনী এবার নিশ্চিত হয়ে বলল, এ নিশ্চয়ই আমাদের গদাধর। বলে বিনোদিনী তার বাম হাতটিকে একটু বাঁকা করে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, তার হাতটি কী এই রকম ছিল চাচাজান?

--হয়তো ছিল। হয়তো ছিল না। বললেন আব্দুল হক বিএ। তখন তো আমি বেশ ছোট। পুরোটা আমার মনে নাই। শুধু মনে আছে—লোকটি কাইজার দুদলের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছিল।

কে একজন হেঁকে বলল, সইরা যা। বিরক্ত করিস না।

বিনোদিনী আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করল, সইরা গেল?

--সইরা যাওয়ার লোক সে নয়। আব্দুল হক বিএ মাথা নেড়ে জানালেন।

তখন কারো হুঁশজ্ঞান নেই। দুদলের লাঠির আঘাতই তার মাথায় পড়েছিল। মাথা ফেটে রক্ত আর ঘিলু বের হয়ে গিয়েছিল।

শুনে বিনোদিনী হাহাকার করে উঠল। গদাধর কী তাইলে সেদিন মারা গেল আপনার সামনে?

--না, মাগো। মরবে কেনো? লোকে বিশ্বাস করে—সে মরে নাই। সে এই গানটি গাইতে গাইতে উঠে পড়ল। করতালটা ঝনঝন করে বাজাতে বাজাতে চলে গেল। কে একজন চেঁচিয়ে জানতে চাইল, যাও কই? গান গাওয়ার ফাঁকে উত্তর করল, বিদ্যেধর। বিদ্যেধরে যাই।

--কোন বিদ্যেধর?

--সীতারামপুরের সালামত আলী মেয়াজানের পোলা গফুরুদ্দিন ওরফে গফফর কি গদাধরের বিদ্যেধর। বিদ্যেধরের দক্ষিণে উলপুর। উত্তরে বটবাড়ি। পশ্চিমে নিজামকান্দি। পূবে মালেঙ্গা। এরপর আব্দুল হক বিএ গম্ভীর মুখে বললেন, আমি এই বিদ্যেধর গেছি। সেইখানে বটতলা আছে। আর আছে হিজলগাছ। বর্ষার দিনে হিজলগাছটি গলাজলে দাঁড়িয়ে থাকে। লাল ফুল ফোটে।

বিস্ময়ে হতবাক বিনোদিনী জিজ্ঞেস করল, আপনি বিদ্যেধরে গেছিলেন?

--যাব না কেনো! যে যাইতে চায়—সে যাইতে পারে। আজ না হোক—কাল যাইতে পারবে। কাল হোক হোক পরশু। একদিন না একদিন যাওয়া যাবে।

বলে তিনি খুব কষ্ট করে বিছানা থেকে উঠলেন। পুরনো তোরঙ্গ থেকে বের করলেন একজোড়া বড় সড়ো করতাল। ফাঁটা। ঝনঝন করে শব্দ হয়।

বিনোদিনী হাত বাড়িয়ে করতাল দুটো ধরল। গালে ছোঁয়াল। বলল, চাচাজান, আমারে বিদ্যেধর নিয়া যাবেন? তারে দুটো মুড়ি খাইতে দেব।

আব্দুল হক বিএ বিনোদিনীকে জিজ্ঞেস করলেন, বিদ্যেধরকে তুমি মুড়ি খাইতে দিতে চাও কেনো?

--আমার ছেলের উপর পরীর আছর আছে। গদাধরকে মুড়ি খাইতে দিলেই সেই আছর কাইটা যাবে।

---তোমার ছেলে তো এখন আর ছোট নাই মা জননী!

--ছেলে বড় হইছে ঠিক। কিন্তু এখন নাতি-পুতি ছোট আছে। তাগো আছর করতে পারে। শাপমান্যি পড়তে পারে। পরী খেপলে আর রক্ষা নাই। তারা যা খুশি তাই করতে পারে।

আব্দুল হক বিএ শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, এই শহরে যে বালা-মুসিবত হইতেছে তা কোনো মানুষের কাজ নয় রে মা। খ্যাপা পরীর কাজ।

শুনে বিনোদিনী শিউরে উঠল, তাইলে যে আমাগো রক্ষা নাই চাচাজান!

আব্দুল হক বিএ নরম গলায় বললেন, চিন্তা কইরো না। কেউ না কেউ এই বিপদে থামাইতে আসবে।

এই উত্তরটায় জোর হল না। এ শহরে নরক গুলজার থামানোর মতো কেউ নেই। যারা আছে তারা জান বাঁচাতে নিরাপদ দূরত্বে বসে আছে। আর যাগো থামানোর মুরোদ নাই—তারা জান বাঁচানো ফরজ মনে করে গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করছে। সেটা তিনি জানেন। বিনোদিনীরও অজানা নয়।

বিনোদিনী অভিমানভরা গলায় জিজ্ঞেস করল, আর কে আসবে চাচাজান? গদাধর!

--হতে পারে। গদাধরও আসতে পারে। বুঝে কি না বুঝে চাচাজান উত্তর করলেন।

এই উত্তরে বিনোদিনীর মুখ উজ্জ্বল হল। এই আতঙ্কের মধ্যে বিনোদিনীর মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে দেখতে পেয়ে চাচাজান আরো বললেন, গদাধরই আসবে এ শহরে। ভরসা হারাইও না মা।

তিনি আর কথা বলবেন না। তার নামাজের সময় হয়ে গেছে। অজুখানায় যাবেন। বিনোদিনী দেখতে পেল, যেতে যেতে তার বাঁহাতটা একটু করে বাঁকানোর চেষ্টা করছেন।

এ শহরের সবচেয়ে বড় মসজিদ হল কোর্ট মসজিদ। তার পেশ ইমাম ফজরের নামাজ পড়ানোর উদ্দেশ্যে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। সেই আধো-অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পেলেন, মসজিদের গেটে একটু পোস্টার লাগানো হয়েছে। তখনো শুকায়নি। ভিজে ভিজে আঠার দাগ দেখা যায়। কী মনে করে তিনি পোস্টারটি পড়লেন। খুব আঁকাবাঁকা অক্ষরে লেখা–গফুরুদ্দিন ওরফে গদাধর আগমণ করিতেছে। আর কিছু লেখা নেই।

ইমাম সাহেবের মুখে এই খবর পেয়ে ধীর ধীরে সারা শহরে গদাধর আসার খবরটি ছড়িয়ে পড়ল। শহরের মানুষগুলো অতি দুঃখের মধ্যেও প্রথমে গদাধরের আসার খবরটি হেসেই উড়িয়ে দিল। তাদের কাছে গদাধর নামটি অচেনা। এবং গদাধর নামে কোনো লোক এলো কি গেল—তাতে এ শহরের মানুষের লাভ কী? এরকম কত মানুষই আসে যায়।

শহরের যারা একটু বেশি বয়েসী তারা ধীরে ধীরে গদাধরের কথা মনে করতে পারল। এমনকি বিদ্যেধর নামের গ্রামটির কথাও তারা স্মরণে আনতে পারল। তাদের মধ্যে দশজন অতি বুড়ো ঘোষণা করলেন, গফুরুদ্দিন ওরফে গদাধর অতি এলেমদার পীর। পাঁচ শত বছর পূর্বে তিনি এই এলাকায় কুমিরের পিঠে চড়ে এসেছিলেন। কেউ কেউ বললেন, তিনি ঠিক কুমিরের পিঠে নয়—আরবী ঘোড়ার পিঠে চড়ে এসেছিলেন। খাজা নিজামুদিন আউলিয়ার খাস তালবেলেম ছিলেন। খোরাসান প্রদেশ থেকে তিনি একটি বিশেষ বাদ্যযন্ত্র নিয়ে এসেছিলেন। তার বাদ্য শুনলে বাঘ-সিংহ স্তব্ধ হয়ে যায়। হিংসা ভুলে যায়। এইসব কথাবার্তা শুনে গফুরদ্দিন ওরফে গদাধরের আগমণ বার্তা শুনে লোকজন নড়ে চড়ে বসল। আশা জাগতে শুরু করল।

তাতে পলু মিয়া, মোজাম সর্দার বা এখলাস মোল্লার আখেরী লড়াইয়ের আয়োজন থেমে রইল না। সবাই সাজ সাজ রবে অস্ত্র শস্ত্র যোগাড় করতে লাগল। শহর থেকে যাতে কেউ পালাতে না পারে সেজন্য ডাবল পাহারা বসানো হল দিনে-রাতে। বিনোদিনীরা আরও চিন্তিত হয়ে পড়ল। তারা তাদের নাকের ডগায় সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখতে পেল। আব্দুল হক বিএ এর মধ্যে প্রতিদিন নিজের বাড়ি থেকে বিনোদিনীদের বাড়ি যেতে লাগলেন।

একদিন হেঁটে বাজারেও গেলেন। বাজারঘাট তখন খোলে কি খোলে না। বহুবার ডাকাডাকি করে ছোটকা দাসের স্টেশনারি দোকান খোলালেন। তিনি স্নো পাঊডার কিনলেন। কিনলেন মেকাপ বক্স। তার এক সেট বিনোদিনীর বড় মেয়েকে উপহার দিলেন। বললেন, মন খারাপ কইরো না নাতনী। যা মন চায় তাই সাজো।

মেয়েটির সামনে বসে নিবিড়ভাবে দেখতে থাকলেন তার সাজুনি গুজুনি। পরীর মতো দেখতে লাগছে। তিনি বুড়ো হয়েছেন। তার সাধ হল বিনোদিনীর নাতনীর গলায় একটা গান শুনবেন। এই ভয়ংকর কালে গান গাওয়ার কথা কারো মনে আসতেই পারে না। গাওয়াটাও নিরাপদ নয়। মেয়ের বাবা-মা ইতস্তত করলেও ছোটো মেয়েটি গেয়ে উঠল,

আর আমারে মারিস নে মা ।

বলি মা তোর চরণ ধরে ননী চুরি আর করব না ।।

এই গানটি শুনে আব্দুল হক বিএ-র চোখ ভিজে এল। তিনি রাত অব্দি এ বাড়িতে বসে রইলেন। মাগরিবের নামাজ পড়লেন। এ বাড়িতেই খানা খেলেন। বলে গেলেন, গদাধর আসবে।

সেদিন রাত পোহাবার আগেই বোমা ফুটতে লাগল। আর মাঝে মাঝে সমস্বরে হৈ হুল্লোড়। শোনা গেল ভোর হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে ওরা। পুলিশ মাঝে মাঝে টহল দিলেও তাদের উপর কেউ বিশ্বাস রাখতে পারছে না। কেউ কেউ পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হল। বাঁচার আর কোনো পথই যখন খোলা রইল না, কলেপড়া ইঁদুরের মতো সবার দশা হয়ে গেল, তখন কেউ কেউ আবার কী করে যেন গদাধরের কথা মনে করতে লাগল। তারা ভাবতে ভালো বোধ করল যে, গদাধর এই রাতের মধ্যেই শহরে চলে আসবে। রাত পোহাবার আগেই গদাধরকে দেখা যাবে।

গদাধর এলো না। বেলা বাড়তে লাগল। দাঙ্গাকারীরা মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র সহযোগে শহরের স্টেডিয়াম মাঠে জড়ো হতে লাগল। সেখান থেকে তারা পাড়ায় পাড়ায় যাবে। ঘরে ঘরে তল্লাশী করবে। তাদের সমবেত হতে দেখে লোকজনের আশা ভরসা শেষ হয়ে গেল। কেউবা চাপ সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গেল। কারো বা মাথা ঘুরতে গেল। কারো বা পাতলা পায়খানা দেখা দিল।। আর কেউবা গলায় দড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকল।

এ সময়েই শোনা গেল করতালের শব্দ। খুব ধীর ধীরে। অনেকে সন্দেহ করল—এটা করতালের শব্দ নয়। তারা আতঙ্কে ভুল শুনতে শুরু করেছে। তবে ভুল শুনুক কি সত্যি শুনুক শীঘ্রই জোরে জোরে শব্দ শোনা যেতে লাগল। বোঝা গেল--শব্দটা ঝন ঝন করে ফাঁটা করতালের মত বাজছে।

এই বাজনা এত স্পষ্ট যে যেসব লোকজন জান বাঁচাতে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, পালিয়েছিল ঝোঁপে জঙ্গলে, নিজেদেরকে ডুবিয়ে রেখেছিল পুকুরের কচুড়ি পানার নিচে জলের মধ্যে—তারা জানলা দরোজার ফাঁক গলিয়ে, ঝোঁপ জঙ্গল থেকে হামাগুড়ি দিয়ে সামান্য বেরিয়ে, জলের নিচু থেকে মাথা উচু করে উঁকি দিতে লাগল। যেদিক থেকে শব্দটি আসছিল পথের সে দিকটয় চোখ পেতে রইল।

তখন আকাশে মেঘ করেছিল। ঝোড়ো বাতাসও বইতে শুরু করেছিল। ধুলো-বালির ঝাপ্টার সব অন্ধকার হয়েছিল—কিছু স্পষ্ট দেখা সম্ভব ছিল না। তবে এর মধ্যেই কেউ কেউ দেখতে পেল—একজন ছোট খাটো আকারের লোক লোক খুব ধীরে ধীরে করতাল বাজাতে বাজাতে পথ দিয়ে হেঁটে চলেছে। কেউ কেউ তার বাঁহাত বাঁকা বলেও দেখতে পেল। কেউ কেউ তার গলার স্বরও শুনতে পেল। লোকটি গাইছিল—

জুত কইরা আইসো গো মালতিবালা
ফুত কইরা ভাইসো গো মালতিবালা
হাইতনা জোড়া গদাধরের মালা
আমি কী কহিব তারে, আমার চউক্ষে নিদ্রা নাই
আমি বিদ্যেধরে যাই।

এই গানটি কারো কারো এতো ভালো লেগে গেল যে ভয় আতঙ্ক ভুলে গানটির সঙ্গে উচ্চস্বরে গলা মেলাতে লাগল। এ গানটির নিচে স্টেডিয়ামের দাঙ্গাকারীদের হৈ হুল্লোড় চাপা পড়ে গেল। লোকজন গান গাইতে গাইতে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা গেল—দাঙ্গাকারীরা গান গাওয়ারত লোকজনের মুখোমুখি হয়েছিল। কারো কিছু হয়নি। গানের শব্দ এতো তীব্র ছিল যে তারা সহ্য করতে না পেরে শহর ছেড়ে পালিয়ে গেল। যাওয়ার সময় তারা কে একজন লোকের মাথায় লাঠি মেরে গেছে। কারো কারো মতে, সেই লোকটিই করতাল বাজিয়ে পথ দিয়ে গান গাইছিল। তার বাম হাত ছিল বাঁকা। এবং লোকটিকে আর কখনো দেখা যায়নি। কারো কারো মুখে শোনা গেল—লোকটির নাম ছিল গদাধর। লোকটি বিদ্যেধর চলে গেছে।

এরপর সারা শহরটি শান্ত হয়ে গেল। কোনো বালা মুছিবতের চিহ্ন দেখা গেল না। তিনদিন পরে শহরের প্রবীণ ব্যক্তি আব্দুল হক বিএ ইন্তেকালে যান। যারা তাঁকে শেষ দেখা দেখতে গিয়েছিল তারা দেখতে পেয়েছিল—বুড়ো মানুষটির মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। তার পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে জানা যায়—তিনি বাথরুমে যাওয়ার সময় পা পিছলে পড়ে যান। তার মাথা ফেঁটে যায়।

প্রবীণ আব্দুল হক বিএ’এর জানাজায় শহরের শোক-সন্তপ্ত বহুলোক অংশ নিয়েছিল।

Post a Comment

0 Comments