আমার বড় মেয়ে স্কুল থেকে ফিরেই বলল, বাবা, হাতি আসছে।
হাতি কথাটা বলার সময় মেয়ের চোখে-মুখে এক ধরণের শঙ্কা আর কৌতুহল ফুটে উঠেছে। ছোটো মেয়েছে বেশ হাটতে শিখেছে। দৌড়ে এসে বলল, বাবা, আত-তি। হাতি দেও--খাবো।
বড় মেয়েটা বোনকে ধরে বলল, ধুর বোকা। হাতি খায় না। হাতি মারে।
মার কথাটা শুনে ছোটো মেয়েটা ভয় পেয়ে কেঁদে কেটে অস্থির। চিৎকার করে মায়ের কাছে ছুটে গেল। বলল, ও মা, আত--তি মালবে।
গিন্নি রান্না ফেলে মেয়েকে কোলে নিয়ে এল। বলল, কে মারবে কইছে?
বড় মেয়ে বলল, আমি মারি নাই।
–তাইলে কে মারবে?
–হাতি মারতে পারে কইছি।
–ও। হাতি। বলেই হাতি মেরে সাথি সিনেমার গান গান ধরল। গিন্নিএকটু নেচেও দেখালো। ছোটো মেয়ে বড় বড় চোখে দেখে কোল থেকে নেমে পড়ল। সেও মায়ের সঙ্গে সঙ্গে নাচতে লাগল।
গিন্নি বলল, ছোটো বেলায় আমাদের বাড়ি হাতি আসত। আমার মা হাতিকে নারকেল আর কলাগাছ খেতে দিত। হাতি মাকে পেন্নাম করত। হাতি মারে না। খুব ভালো।
ছোটো মেয়ে এবার বলে উঠলো, বালো আততি দেকপো।
আমার দুই মেয়ের কেউই সত্যিকারের হাতি দেখে নি। বড় মেয়েটা স্কুলের প্লে ক্লাশে পড়ে। তার বর্ণ শেখার বইয়ে একটা হাতির ছবি আছে। তার ছাপা ভালো না। স্পষ্ট করে বোঝা যায় না। তবু সেই ছবিটা দেখিয়ে বললাম,এই দেখো হাতি।
দু মেয়ে হুমড়ি খেয়ে দেখতে লাগল হাতির ছবিটার উপরে। বড় মেয়েটা বানান করে করে পড়ল। ঐ--রা--ব--ত। ঐরাবত। প্রশ্ন করল,এটা তো ঐরাবত। হাতি হবে ক্যামনে?
বললাম, ঐরাবতই হাতির ভালো নাম।
এবার ছবিটা আরো ভালো করে দেখে বলল, ও বাবা হাতির কি আরেকটা নাম ইন্দুর?
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ইন্দুর কেনো হবে?
মেয়ে সোজা সাপ্টা বলে দিল, হাতি দেখতে ইন্দুরের মতো।
বলে ঘর থেকে প্লাস্টিকের ইন্দুরটা নিয়ে এল। বলল, এই দ্যাখো। ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নাও।
গিন্নি হেসে বলল, হাতি ইন্দুরের মতোই। তবে ইন্দুর ছোটো। আর হাতি হল অনেক বড়।
এবার আর অবিশ্বাস করার মতো কিছু নেই। দু মেয়েই খুশি। ছোটো মেয়ে এবার ইন্দুরটা নিয়ে মেতে উঠল। হাতির কথা ভুলে গেল।
দুদিন পরে শহরে পোস্টার পড়ল—সার্কাস সার্কাস। সার্কাস আসছে। বিশেষ আকর্ষণ—হাতির খেলা। স্থানঃ স্টেডিয়াম ময়দান।
দীর্ঘদিন এ শহরে কোনো সার্কাস পার্টি আসেনি। সার্কাস পার্টির আসার খবর শুনে সারা শহরটা নড়ে চড়ে উঠল। যারা সার্কাস দেখেছে তারা আবার সার্কাস দেখতে পারবে বলে খুব খুশি। আর যারা দেখেনি শুধু সার্কাসের কথা শুনেছে– তারা আশায় বুক বেঁধে রইল—এবার তারা দেখতে পাবে। এদের মধ্যে অনেকেই ঘোড়া দেখেছে। কিন্তু বাঘ কিম্বা ভালুক দেখেনি। হাতির কথা শুনেছে বটে, তবে দেখার সুযোগ ঘটেনি।
এই এলাকায় সর্বশেষ এসেছিল লক্ষ্মণ দাসের হাতি। সে স্মৃতি মানুষের মনে এখনো জ্বল জ্বল করে। এতো বড় হাতি সেকালে দেশে আর ছিলো না। বড় বড় কান। ঘাড়টা বড়। পেটটা মোটা। শুড়টা অনেক লম্বা। গায়ের রং কড়া ছাই রঙের। লোকে বলে এটা এই ভারত উপমহাদেশের হাতি নয়। আফ্রিকার হাতি। হাঁটলে মেদিনি কাঁপত।
পোস্টারে সার্কাস পার্টির নাম লেখা হয় নি। ফলে লোকের মধ্যে একটা কৌতুহল হল—পার্টির নাম কি? এ ব্যাপারে আয়োজকদের একজন জানালেন– ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিউ স্টার সার্কাস পার্টির সঙ্গে কথা অনেকটাই পাকা হয়েছে। শুনে পুরনো লোকজনের মন খারাপ হয়ে গেল। তাদের ইচ্ছে গৌরনদীর লক্ষ্মণ দাসের সার্কাসের দলটিই আসুক। লক্ষ্মণ দাস তাদের অঞ্চলের মানুষ। এ ব্যাপারে ডিসি সাহেবের কিছু আপত্তি ছিল। লক্ষ্মণ দাসের সার্কাস দীর্ঘদিন চালু ছিল না। টাকা পয়সার অভাব ছিল। কোনো রকমে ঠেকা দিয়ে নতুন করে সার্কাসটি আবার দাঁড় করা হয়েছে। দলটির উপর ভরসা করা কঠিন।
এই এলাকার এমপি সাহেব অতি সজ্জ্বন মানুষ। এলাকার মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছার মর্যাদা দিয়ে থাকেন। জনগণের ইচ্ছের কথা জানতে পেরে এমপি সাহেব ডিসিকে বলে দিলেন—নিউ স্টারের বদলে লক্ষ্মণ দাসের সার্কাসই আসবে। উদ্বোধনী উনুষ্ঠানে তিনি নিজেই উপস্থিত থাকবেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়কেও তিনি দাওয়াত দেবেন। তিনি নিশ্চয়ই এই দাওয়াত ফেলতে পারবেন না। তিনি তার ভালো বন্ধু। এবং এমপি মহোদয় আরো জানালেন—স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী মহোদয়ও আসতে পারেন। তিনি দাওয়াত গ্রহণ করেছেন। তিনি আসতে না পারলেও তার পরিবারের কেউ আসতে পারেন। এর অন্যথা হবে না।
সার্কাস পার্টি আসার আগে সাধারণত হাতি আগে আসে। এতদ অঞ্চলের সর্বত্র ঘুরে বেড়ায়। উদ্দেশ্য হাতির খাবার জোগাড় করা। মাহুতের খোরাকি যোগাড় করা। এর থেকেও বড় ব্যাপার সার্কাসের প্রচারণা করা। প্রতিটি বাড়ি হাতি যায়। গৃহস্থরা কিছু চাল কলা আনাজ আর টাকা কড়িও হাতির নজরানা স্বরূপ দিয়ে থাকে। হিন্দু গৃহস্থরা শুড়ে তেল-সিন্ধুর দেয়। আর দেয় স্বস্তিবাচক উলুধ্বনী। হাতি তখন শুড় উঁচিয়ে সালাম দেয়--নমস্কার করে। কখনো কখনো কিছু ছেলে মেয়েদের পিঠে চাপিয়ে ঘুরিয়ে আনে।
যে কোনো দিনই লক্ষ্মণ দাসের হাতিও চলে আসবে। শোনা গেল রওনা হয়ে গেছে।
এই মফস্বল শহরটির মাঝ দিয়ে দামোদর নামে ছোটো মতো একটি ভারানী খাল বয়ে গেছে। তার পাশেই বাজার। প্রতিদিনই বাজারে যাই। সাজো আনাজ--পাতি কিনি। তাজা মাছ পাই। এই বাজারেই শুকচাঁদ ঘরামী পূর্বপাশে নারিকেল বেঁচেন। ছোটোখাটো মানুষটি। গাট্টা--গুট্টা শরীর ছিল এককালে। এখন বেশ বয়েস হয়েছে। আমাকে হাত ইশারা করে বললেন, স্যার লক্ষ্মণ দাসের হাতি আইতেছে। দুজোড়া ঝুনো নারিকেল লইয়া যান।
একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার তো এখন নারিকেল দরকার নেই।
শুকচাঁদ ঘরামী বললেন, দরকার আছে স্যার। লক্ষ্মণ দাসের হাতি আপনার বাসার সামনে যাইবে। হাতিরে খাইতে দেবেন। দেখবেন হাতি নারিকেল মুখের মধ্যে নেবে--নিয়া ভাইঙ্গা তার জল খাইবে। আপনার মাইয়ারা দেইখা খুব খুশি হইবে। আর--
--আর কি শুকচাঁদ?
--আর শাস্ত্রে কয় হাতিতো আদতে হাতি নয়—সিদ্ধিদাতা গণেশ ঠাকুর। মা দূর্গার বড় পোলা। নারকেল ছাড়া তার রোচে না। যা-ই খান না ক্যান নারকেল তার থাকন লাগবোই। বড় পোলার রকম সকম একটু আলেদা হয় স্যার, না কি কন?
মাথা নেড়ে সায় দেই। একটু আল্লাদী হয়ই।
--তাইলে বোঝেন। এবার কানের কাছে মুখটা এনে গলা খাটো করে শুকচাঁদ বললেন, নারিকেল হল গে মানুষের অহঙ্কারের চিহ্ণ। গণেশ ঠাকুরের হাতির কাছে নারকেল দিলেন মানে--আপনার অহঙ্কারকে দিয়া দিলেন। হাতি সেই নারকেলটা দাঁত দিয়া ভাইঙ্গা ফেলল। মানে হল গে আপনার অহঙ্কারকেই তিনি ভাইঙ্গা দিলেন। হাতিরূপী গণেশ ঠাকুর আপনার অহংকারের শ্বাসটুক খাইলো। জল টুক খাইলো। তারপর আইচাটা দূরে ছুইড়া মারল। আর আপনার মনে পাপ আসার কোনো সুযোগ থাকল না। পাপ মনে কল্যাণ আসে ক্যামনে স্যার!
কঠিন প্রশ্ন। শুকচাঁদকে আজ দার্শনিকতায় পেয়েছে। এ প্রশ্নের জবাব নেই। শুনে মাথা নাড়ি। ঠিক ঠিক শুকচাঁদ।
শুকচাঁদ ঘরামী গল্পগুজব করতে পছন্দ করেন। ছুটির দিন দেখা হলেই আমাকে বাজারে দেখে ডাক দেন। তার মামাবাড়ি গৌরনদী। ছেলেবেলা থেকে মামাবাড়িতেই মানুষ। তিনি বললেন, লক্ষ্মণ দাস যে সে লোক নয়। অতি বিখ্যাত লোক। গৌরনদীর পালরদী গ্রামের মানুষ এই লক্ষ্মণ দাস। সম্পর্কে আমার মামা লাগে। দুই বাড়ি পরে দাসেগো বাড়ি। গৌরনদীর অশোকাঠি মহল্লার মোহন কুমার নাম শুনছেন?
মাথা নাড়লাম। শুনিনি।
শুকচাঁদ অবাক হয়ে বললেন, সে কি স্যার। গৌরনদীর অতি বিখ্যাত জমিদার এই মোহন লাল সাহা। ভারত ভাগ হওয়ার আগে গৌরনদীর মোহনলাল সাহার জমিদার বাড়ির দুর্গাপূজাটি সব চেয়ে বড় ছিল। এর তুল্য পূজা ভারতে আর ছিল না। হিন্দু-মুসলমান সে পূজার ভোগ পাইত।
শুকচাঁদ গৌরনদীর মোহনলাল সাহার গল্প বলতে শুরু করেন--
মোহনলাল সাহার বাবা প্রসন্নকুমার সাহা আশুকাঠির জমিদার বাড়ি বানালেন। ছাঁদে দিলেন মস্ত সিংহ। কেশর ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকে সিংহ দেখে ভয় খেলো। বলল, হুজুর আপনের বাড়ি আসি কেমনে?
প্রসন্নকুমার গুরুগম্ভীর গলায় জবাব দিলেন, না আইসা পারবা না। সেই কাম করতেছি।
এরপর দেখা গেলো সারা বছর ধরে জমিদার বাড়িতে নানা পালা পার্বন শুরু হল। কখনো পালা গান তো কখনো কৃষ্ণ যাত্রা, সখি নৃত্য হয়—হয় রয়ানী গান । মাগুরার বিজয় সরকার আর রাজেন সরকারও এসে দলে বলে প্রতি বছরই কবিগান করেন। নাট মন্দিরের সামনে থিয়েটার। মুকুন্দ দাস এসে মাতিয়ে যান শ্যামা সঙ্গীত গেয়ে। শুকচাঁদ একটু গলা খাটো করে বললেন, শোনা যায় লকনৌ থেকে মতি বাইও মুজরো কইরা গেছেন বার কয়েক। এটা নিয়ে জমিদার গিন্নীর আপত্তি ছিল। তবে একদিন তার গাওয়া মীরার ভজন শুনে তিনি আর না করেন নাই।
জিজ্ঞেস করলাম, আপনি দেখেছেন--বাইদের মুজরো?
শুকচাঁদ মাথা নাড়লেন। বললেন, না, আমি দেখি নাই। আমার ঠাকুরদা দেখছেন। আমার বাবাও দেইখা থাকতে পারে। আমি দেখছি যাত্রা পালা। বাইশারীর নট্ট কোম্পানীর রাজা হরিশচন্দ্র পালা শুইনা না কাইন্দা থাকতে পারে নাই এমন লোক এই এলাকায় নাই। আমি দেখছি খাটরার শঙ্কর অপেরার ম্যালকম সাহেবের পার্ট। পালার নাম সতী সাবিত্রী।
ম্যালকম সাহবের নাম শুনে জিজ্ঞেস করলাম, ইনি কি সত্যি সাহেব? বৃটিশ?
একথার জবাব নেই শুকচাঁদের মুখে। তিনি তখন তদ্গত। চোখ বুঝে বলছেন, বোঝলেন স্যার, তখন প্রসন্নবাবু প্রয়াত হইছেন। তার পোলা মোহনলাল সাহা গুড়গাড়া টানতে টানতে পালা দেখছেন। আর গ্রীনরুমের সামনে ছড়ি হাতে দাঁড়ায় আছে খাটরার বিধু বাবু। শঙ্কর অপেরার অধিকারী। জাতে নমশুদ্র। ভুলচুক হওয়ার সুযোগ নাই। ভুল হইলেই বেতের বাড়ি। বোঝেন। মোনা শেখের কারবালার জারীও শুনছি সাহা বাড়িতে।
প্রসন্নবাবুর খুব ইচ্ছে ছিল কোলকাতার বিখ্যাত অম্বুবাবুরে গৌরনদীতে আনবেন। কুস্তিখেলা দেখাইবেন। সেই উপলক্ষ্যে একটা কুস্তির আখড়াও তৈরী হয়েছিল। কিন্তু তদ্দিনে অম্বুবাবু আর নাই। সাধনোচিত ধামে গমন করেছেন। তার পোলা খেতুবাবু আইসা পড়লেন বছর আটেক পর। সঙ্গে তার ভাগ্নে যতে গুহ। খেতু বাবুও বাবার ন্যায় নামী কুস্তিগীর।
মোহনলাল সাহা ঘোষণা করলেন, গৌরনদীর কেউ এদেরকে পরাস্ত করতে পারলে তিনি তাকে সোনার মেডেল দেবেন। আর দেবেন পাঁচ বিঘা নিস্কর জমি।
শুকচাঁদকে জিজ্ঞেস অরলাম, কেউ এল কুস্তি লড়তে?
শুনে তিনি পালটা প্রশ্ন করলেন, আপনার কি মনে হয়?
--আসতে পারে। পুরস্কার তো মন্দ নয়। এলাকার গরীব মানুষের কাছে পাঁচ বিঘা জমি অনেক কিছু। পেলে কপাল ফিরে যাবে।
শুকচাঁদ বললেন, ঠিকই বলছেন। অভাবে মানুষের গতিক খারাপ। নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা।
তার উপরে জমিদারের ট্যাক্সো দিয়ে দিয়ে চৌদ্দ পুরুষের জান কয়লা কইরা দিছে।
--ঠিক কিনা কন স্যার?
মাথা নাড়ি। ঠিক ঠিক। সেকাল ছিল বড় ভয়ঙ্কর।
আমার মাথা নড়া দেখে শুকচাঁদ বেশ জোস পান। বলেন, এই এলাকার কেউ সাহস করল না। শুধু একজন এগিয়ে এল। বয়সে বাচ্চা ছেলে। পালরদির দাসবাড়ির লখাই। তারে দেখে সবাই হেসে খুন। কে একজন ফোঁড়ন কেটে বলল, হাতি ঘোড়া গেল তল/ মশা বলে কত জল।। শুকচাঁদ এবার একটু নট্ট করে বললেন, বাপু হে, অই কাণ্ড কইরো না। ভালোয় ভালোয় মায়ের কোলে ফিরা যাও।
--সেকি ফিরা গেলো? জিজ্ঞেস করলাম।
--ফিরা যাওনই তো উচিত। খেতু বাবু আর তার ভাগ্নে যতে বাবু তো হেলা--ফেলা গোছের কাউ না। দস্তুরমতো আখড়ায় আখড়ায় কুস্তি করা লোক। পেল্লাই শরীর। গোটা ইন্ডিয়ায় তাদের পালোয়ান বলে চেনে।
--তাইলে তো গল্প শেষ। আজ উঠে পড়ি শুকচাঁদ।
শুকচাঁদ হাত ধরে বসালেন। বললেন, না স্যার। গল্প শেষ হয় বটে। কিন্তু সত্যি কখনো শেষ হয় না।
লখাই ছোড়াটা নাছোড় বান্দা। সে ফিরে গেল না। দাঁড়িয়ে রইল। যতে গুহর গা থেকে তেল চুপ চুপিয়ে পড়ছে। তার মামা খেতু বাবু মোচে তা দিতে দিতে ছেলেটাকে দেখতে লাগল। এই এলাকার ছেলে পেলের মোদ্দা চেহারা প্যাকাটে থেকে একটু আলাদা। শরীরে তাগদ আছে। আর চোক্ষে আছে অন্য কোনো রোশনাই। একেবারে বাতিল করে দেওয়া যায় না।
আরেকজন মস্করা করে বলল, ওরে বেটা, তুই যে কুস্তি লড়তি আইছিস। কিন্তু কার দোহাই নিয়া আইছিস?
প্রশ্ন শুনে অনেকেই হা হা করে হাসতে শুরু করল। তাদের বেশ রগড়ে পেয়েছে।
লখাই নির্বিকার চিত্তে জবাব দিল--দুধকুমার। দুধকুমারের দোহাই নিয়া আইছি।
এবার যারা হাসতে শুরু করেছিল তাদের হাসি থেমে গেল। আর যারা হাসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল তারা আর হাসতে পারল না। অবাক হয়ে লখাইয়ের দিকে চেয়ে রইল। দুধকুমার এই এলাকার জাগ্রত পীর। টর্কি বাজারের কাছে তার মাজার। তিনি জাহাঙ্গীর বাদশার আমলে ইয়েমেন থেকে এসেছিলেন। একটা বাঘের পিঠে চড়ে বেড়াতেন। গরুগুলির পাশ দিয়ে গেলে তাদের বাটে দুধের বান নামতো। সেই দুধ তাকে পান করতে হত। জাহাঙ্গীর বাদশা কসবা গ্রামটি তার সম্মানে নিস্কর করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে গ্রামটির নাম লাখেরাজ কসবা। তার কাছে যা মানত করা যায়—তাই তিনি পূর্ণ করেন। এই এলাকার হিন্দু কি মুসলমান কি খ্রিস্টান--সবাই দুধকুমারের দোহাই মেনে চলে।
জমিদার মোহনলাল সাহা গড়গড়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। লখাইয়ের কাছে এসে এগিয়ে এলেন। তার কাঁধে হাত রাখলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তুই কুস্তি লড়তে চাস?
লখাই মাথা নেড়ে বলল, চাই।
--কুস্তি লড়া শিখেছিস?
--না, শিখি নাই। দেইখা দেইখা বুঝছি এই কাজটা করা আমার অসাধ্য নয়।
--ঠিক আছে। তাইলে তুই লড়। দেখি-- কেমন পারস।
মোহনলাল সাহার ইঙ্গিতে লখাইকে এক শিশি তেল দেওয়া হল। লখাই সারা গায়ে মাখিয়ে নিল। রোদ্রে তার গা চকচক করতে লাগল। কুস্তিগীর খেতু বাবু ভাগ্নে যতের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, তুই--ই লড়।
লখাই আখড়ার মধ্যে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। যতে এগিয়ে এল তার ভীমের মতো সবল বাহু নিয়ে। লোকে চিৎকার চেঁচামেচি করে ডাকতে লাগল—ওরে লখাই, বেত্তমিজি করিস না। ফিরা আয় রে। অকালে মরিস না।
লখাই যতে পালোয়ানের দিকে এগিয়ে এল। কে একজন মহিলা ভয় পেয়ে কেঁদে ফেলল। যে লোকটি একটু আগেই ঠাট্টা করছিল—সেও ভয়ে চোখ বুজে ফেলল। দুর্গা দুর্গা করতে লাগল। এর পর যতে পালোয়ান আকাশ ফাটিয়ে হুঙ্কার দিয়ে উঠল।
বলতে বলতে শুকচাঁদের শ্বাস ঘণ হয়ে আসছিল।
এই পর্যন্ত বলে থেমে গেল।
বললাম, তারপর কি হল?
শুকচাঁদ এক গ্লাশ জল খেল। গামছা দিয়ে মুখটা মুছল। শুকচাঁদ একটু দম নিল। বলল, তারপর মোহনলাল সাহা দুজনকে থামায়ে দিলেন। বললেন, ওরে লখাই। কুস্তি দেইখা বোঝনের ব্যাপার নয়—ওস্তাদের কাছে শেখনের ব্যাপার। তবে তার আগে কুস্তিটা ভালো করে শিখে নে।
এলেম আছে লখাইয়ের।
খেতু বাবু আর ভাগ্নে যতে গুহর কাছ থেকে লখাই কুস্তিটা শিখে নিল। যেদিন তারা গৌরনাদী ছেড়ে কোলকাতায় ফিরে যাবে--সেদিন খেতু বাবু বললেন, লখাই, এবার তো তোর শেখা শেষ হইছে। গুরু দক্ষিণা দে।
বলে মুস্কি মুস্কি হাসতে লাগলেন তিনি।
মোহন লাল সাহা বললেন, ও আর কি দেবে আপনেরে খেতু বাবু। ওর হইয়া আপনেরে আমিই দিচ্ছি।
খেতুবাবু বললেন, ওরেই দিতে হইবে। ট্যাকা না দিক। অন্তত খুশি করে দিক।
শুনে লখাই তখন মুখ দিয়ে একটা শিস দিল। শিস শুনে কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে পত পত শব্দ হল। গোটা দশেক টিয়ে পাখি উড়ে এল। উড়ে এসে লখাইয়ের মাথায়, কাঁধে আর হাতে বসে লেজ নাড়তে লাগল। লখাই বলল, গুরু মশাইকে নমস্কার কর।
শুনে টিয়ে পাখিগুলি শিস দিয়ে অনেকটা মানুষের গলায় বলে উঠল, পেন্নাম গুরু মশাই। পেন্নাম গুরু মশাই।
লখাই বলল, গুরু মশাইদের পায়ে গড় কর।
আর তক্ষুণি টিয়া পাখিগুলি উড়ে গিয়ে খেতু বাবু আর যতে গুহর পায়ের উপর পড়ে বলতে লাগল, পেন্নাম গুরু মশাই। পেন্নাম মশাই।
দেখে খেতু বাবু আর যতে গুহ মুগ্ধ হলেন। এই গাঁ গ্রামে এ রকম পাখির খেলা দেখবেন আশা করেননি। খেতু বাবু আশীর্বাদ করে বললেন, তোর হবে রে লখাই। শুধু কুস্তি না। তোর যা এলেম আছে তা দিয়ে তুই সার্কাসে যোগ দিতে পারবি। সেটাই তোর পথ।
টিয়া পাখিগুলো দুধকুমারের মাজারে থাকে। সেখানে লখাই প্রায়ই যায়। যেতে যেতে এই সব পাখিদের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। লখাই যা বলে তারা তা তামিল করে।
শুকচাঁদ বললেন, ঢাকার নবাবগঞ্জে সেকালে বিখ্যাত লায়ন সার্কাস গড়েছিলেন বর্ধমানপাড়ার রায়মোহন চন্দ্র সরকার। লালমোহন সাহার নির্দেশে লখাই সেই লায়ন সার্কাসে যোগ দিল। এই লখাইরে চিনছেন স্যার?
জবাব দিলাম, লক্ষ্মণ দাস।
লখাইকে চিনতে পেরেছি বলে খুব হলেন শুকচাঁদ। বললেন, আপনি শিক্ষিত মানুষ। সরকারী চাকরী করেন। নানা জায়গায় চাকরি করেন। আপনি তো চিনবেনই।
গৌরনদীর লক্ষ্মণ দাস। পাকিস্তান আমলে নিজেই গড়েছিলেন একটা সার্কাস পার্টি। সার্কাস পার্টির জন্য হাতি দিয়েছিলেন লাখেরাজ কসবা গ্রামের পীর দুধকুমার।
একটু অবাক হয়ে বললাম, দুধকুমার তো মারা গেছেন জাহাঙ্গীর বাদশার আমলে। সেটা ১৪০০ সালের ঘটনা। কিন্তু ১৯৪৫ সালে কি করে সেই দুধকুমার লক্ষ্মণ দাসকে হাতি দিলেন?
শুকচাঁদ কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, জাগ্রত পীর দুধকুমার। তিনি মরবেন কেনো। তিনি উইঠা গেছেন। কিন্তু তিনি আছেন। তার কাছে কোনো মানত করলে তা তিনি পূর্ণ করেন।
সেইবার ভারত ভাগ হল। লায়ন সার্কাসের মালিক রায়মোহন চন্দ্র সরকার বাবু ঐপারে চইলা যাইবেন। রায়মোহন সরকারবাবু লক্ষ্মণ দাসকে ডেকে বললেন, বয়স হইছে রে লখাই। ওইদ্যাশে গিয়া আর সার্কাস গড়ার তাগদ নাই।
লক্ষ্মণ দাসের চাকরি শেষ। কি করবেন বুঝতে পারছে না। লাখেরাজ কসবা গ্রামে এসে পড়লেন। সার্কাস বিনা তার মন টেকে না। শেষমেষ দুধকুমারের মাজারে ধর্ণা দিয়ে বললেন, আমারে একটা সার্কাস গইড়া দেওগো পীর সাহেব।
ধর্ণা শেষ করে যখন লক্ষ্মণ দাস উঠলেন, ঠিক তখনি কালকিনীর রাস্তা দিয়া হাতীর ডাক শোনা গেল। ডাকটা তার চেনা মনে হল। এটা ঠিক লায়ন সার্কাসের হাতি।
শুকচাঁদের গল্প শোনার আর সময় ছিল না। বাজার নিয়ে আমাকে বাসার দিকে রওনা হতে হবে। তা না হলে গিন্নীর রান্না চাপাতে দেরী হয়ে যাবে। আমার মেয়ে বলেছে দুটি খেয়ে দেয়ে তারা ঐরাবত সাজবে। কিছুদূর যেতেই শুকচাঁদ ডেকে বসল। বলল, একটু খাড়ান স্যার। একটা কথা জিগানোর আছে। আপনার কি মনে হয়--হাতিটা কি লায়নের সার্কাসের?
বললাম, হতে পারে। লায়ন সার্কাসের হাতির খেলা দেখাতেন লক্ষ্মণ দাস। সার্কাসের মালিক রায়মোহন বাবু কোলকাতায় চলে যাওয়ার আগে লক্ষ্মণ দাসকে হাতিটা দিয়ে গেছেন। তিনি জানেন--হাতিটা পেলে লক্ষ্মণ দাস পারবে আরেকটা সার্কাস দল গড়তে।
শুকচাঁদ মাথা নেড়ে বললেন, আপনের কথা ঠিক আছে। কিন্তু স্যার, আপনেরে কই, এই হাতিটা কিন্তু লায়ন সার্কাসের হাতি না। এটা আফ্রিকার হাতি। বড় বড় কান। দশাসই শুড় আর কাল বর্ণ। এই হাতি রায়মোহন বাবু পাইবেন কোথায়? তার হাতি ছিল চিটাগঙের হাতি। আকারে ছোটো।
--তাইলে?
--তাইলে এইটা দুধকুমারের হাতি। লাখেরাজ কসবার জাগ্রত পীর দুধকুমার লক্ষ্মণ দাসের লাইগা আইনা দিছেন। কথা কিন্তু মিছা না। তিনি তার ভক্তের আশা পূর্ণ করেন। যারা দেখছে—তারা কিন্তু এই কথা মানে। এই তুল্য হাতি এই বাংলা ভূখণ্ডে আর কারো নাই। একে কেউ হাতি কয় নাই। কইত-- ঐরাবৎ। আর লক্ষ্মণ দাস আদর করে নাম দিছিলেন মধুবালা।
এইটুকু বলে শুকচাঁদ সালাম ঠুকলো। বলেন, তাইলে আসেন আপনি। আরো দেরী করলে মা জননী গোস্যা করবেন।
শুকচাঁদের নারিকেল দিয়ে আখের গুড়ের নাড়ু বানালো গিন্নি। তাই খেয়ে আমার মেয়েরা খুব খুশী। তারা কিছু নাড়ু রেখে দিল--ঐরাবতের জন্য। ঐরাবত এলে খাবে। আর বড় মেয়েটি সাজলো ঐরাবত। ছোটো মেয়েটি মাহুত। গিন্নিকে গান গাইতে হল—চল চল চল মেরে হাতী। দুনিয়ার ধাক্কা মার।
এদিকে দামুদর নদীতে সার্কাস পার্টির নৌকা এসে গেছে। স্টেডিয়ামে তাবু গাড়া শুরু হয়েছে। হাতি গৌরনদী থেকে সপ্তাহখানেক আগেই রওনা হয়ে এসেছে। কিন্তু এখানে হাতি আসার খবর নেই। সবাই একটু অবাক হয়ে গেলো। হাতির জন্য রাখা নাড়ুগুলো খাওয়া হলে গেলো। বড় মেয়ে এসে বলল, বাবা—তুমি আরো নারিকেল আনো। মা চিনির নাড়ু বানাবে। ছোটো মেয়ে বলল, ঐলাবত নালু খাবে।
নারিকেল আনতে শুকচাঁদের দোকানে গেলাম। শুকচাঁদ এবার তিন জোড়া নারিকেল দিলেন। তিনি বললেন, খবর পাইছি—রাজাপুর পর্যন্ত হাতি আইসা পড়ছে। ওখানে লক্ষ্মণ দাসের দূর সম্পর্কের মামাবাড়ি। মেলাদিন মামাবাড়ি বেড়ায় না। একটু বেড়াচ্ছে। আজ দুপুর নাগাদ রওনা হইবে।
এ সময় শুকচাঁ আরো জানালেন—তার এক মাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন নাজিরপুরের দীঘিরজানে। সার্কাস উপলক্ষ্যে মেয়ে--জামাই দুদিনের মধ্যেই এসে পড়বে। তাদের তিনটি মেয়ে। এখন ছেলে দরকার। এই জন্য তারা দুধকুমারের কাছে মানত করবে। তার কাছে মানত করলে তা বৃথা যায় না।
শুকচাঁদের ভক্তি দেখে বললাম, শুকচাঁদ, এইখানে সার্কাস আসছে। কিন্তু দুধকুমার আসছেন না। দুধকুমারের কাছে মানত করতে হলে তোমার মেয়ে--জামাইকে গৌরদীর লাখেরাজ কসবায় যেতে হবে। সেখানে দুধকুমারের মাজার পাবেন। সেইখানে যাওয়াই তো ভালো।
এ ব্যাপারে শুকচাঁদ উত্তর হল-- দীঘিরজান থেকে লাখেরাজ কসবায় যাওয়া অনেক ঝক্কি--ঝামেলা। এখানে গৌরনদীর হাতির কাছে মানত দিলেও চলে। সেই মানত দুধকুমারের কাছে পৌঁছে যায়। পরে সময় সুযোগ বুঝে মাজারে গিয়ে দুধ দিলেই চলে।
এর পরে শুকচাঁদ একটি উদাহরণ দিয়ে বললেন, আমার মাইসাতো বোনের শ্বশুরবাড়ি বাড়ি বাগেরহাট জেলার চিতলমারি। তার মেলাদিন ছেলেপুলে হয়না। লোকে তাকে বাঁজা কওয়া শুরু করছিল। সেবার অঘ্রাণ মাসে চিতলমারী সার্কাস নিয়া আইলেন লক্ষ্মণ দাস। মাইসাতো বোনের শ্বাশুড়ি লক্ষ্মণ দাসের হাতি মধুবালার কাছে মানত কইরা কইলো, মাগো আমার বেটার বউয়ের যদি ছেলে--পুলে হয় তাইলে গৌরনদী যামু। লাখেরাজের দুধকুমারের মাজারে দুধ সিন্নি দিয়ে আসব। আর মধুবালার মাথাল বানায় দেব।
জিজ্ঞেস করলাম, তারপর বাচ্চা-কাচ্চা হল?
--হবে না ক্যান! শুকচাঁদ একগাল হেসে বললেন, বছর ঘোরার আগেই তার জোড়া ছেলে-মেয়ে হইল। শুধু তাগো নয়--তাগো বাড়ির গাই গরুটা আইড়া বাছুর বিয়াতো। সে বচ্ছর থেইকা বকনা বাছুর হওয়া শুরু করছে। আবাক কাণ্ড কি জানেন স্যার, তাগো দুইটা সিংহলী নারিকেল গাছ ছিল। একটায় ফল ধরত না। সেই বাজা গাছেও নারিকেল ধরতে শুরু করল। তার জলের স্বাদে তুল্য ঐ এলাকায় আর নাই। সেবার তাগো দক্ষিণ ভিটায় যে পরিমাণ ধান হইল--তা রাখতে আরো দুইটা গোলা বানান লাগছে।
শুকচাঁদ আরো কিছু দুধকুমারের এলেমের কথা বলতে চাইছিলেন। তাকে থামিয়ে বললাম, সেই মাথালটা কি মধুবালা হাতিকে দেওয়া হয়েছিল?
–সেটা মস্ত ঘটনা। আবার গল্প জুড়ে দিলেন শুকচাঁদ। বললেন, মাইসাতো বোনের শ্বাশুড়ি নিজের হাতে মাথালটা বানায়ছিলেন। চারিদিকে চিকদানা দিয়ে ঘের দিছিলেন। আর দিছিলেন লালচেলির পাইড়। গোপালগঞ্জের কানাই কর্মকারের কাছ থেকে একটা রূপার মেডেল গড়ায় আনছিলেন। তার তুল্য মেডেল এই এলাকায় কেউ এর আগে দেখে নাই। মেডেল মাথালের মাঝখানে সেলাই কইরা দেওয়া হইল। আর লাল সুতো দিয়ে লেখন হইল—মাতা মধুমালতী। মেনাজ ফকিরের মাইজা মাইয়া ফতিমার হাতের লেখা সুন্দর। সে--ই লেইখা দিল। দেড় হাত সমান মাথাল। আলো পড়লে চিক চিক করে। ঠিক যেমন রাজাগজাদের হাতির মাথায় থাকে। এই উপলক্ষ্যে চিতলমারিতে দুধকুমারের নামে একখোলা পালাকেত্তনও হইল।
তখন জৈষ্ঠ্য মাসের আধাআধি। মাইসাতো বোনের শ্বাশুড়ি খবর দিলেন। আমারে ডাইকা কইলেন, পুত্রা, আর তো দেরী করণ যায়। নাতীর বয়স ছয় মাস হইছে। অখন তো আমারে গৌরনদীতে যাওন লাগে।
বুড়া মানুষ মায়ৈ। তার মানসিক পূরন করণ দরকার। সঙ্গে ছোটো পোটলা--পুটলি। একটার মধ্যে মাথাল। আর তিলের নাড়ু। পাখিমারা গ্রামের নকুলদানাও নিছেন আধা সের। আরেক পোটলায় তার নাতির মাথার চুল। এ সবই দুধকুমারের মাজারে দেবেন।
শুকচাঁদ থামলেন। এদিক--ওদিক তাকালেন। মনে হল খেই হারিয়ে ফেলেছেন। মনে করতে পারছেন না। অথচ তার মনেই ছিল। মন থেকে হারিয়ে যাওয়ায় কষ্ট হচ্ছে। বললাম, থাক শুকচাঁদ, আর বলতে হবে না। আরেকদিন বলবেন।
একথা শোনেন কি শোনেননি বোঝা গেল না। তিনি বলতে শুরু করলেন–
গৌরনদী বাজারের আইসা দেখি লোকজন নাই। চার পাঁচটা ঘর পুড়ছে। আর কা কা করে কাক ডাকে। মায়ৈ মা আমার হাত ধইরা কন, ও পুত্রা, এডা কি গৌরনদী? না, অন্য জায়গায় আইছি?
সেখান থেকে আশুকাঠি আমার মামাবাড়ি যাইয়া দেখি—বাড়ি ফাঁকা। অনেক্ষণ ডাকাডাকি কইরা দেখি পাশের বাড়ির রহমতো মুন্সী মামা ঘরের পিছন থেকে বাইরাইয়া আইছেন। আইসা কয়—মামাজান। সবাই পলারদি গেছে।
মামাজানরে জিগাই, সেইখানে গেছে ক্যান?
--খবর খারাপ। বরিশালের কর্নেল সাবের মাইয়া হাতির খেলা দেখতে চাইছে। কর্নেল সাব লক্ষ্মণ দাসরে অবিলম্বে হাতি লইয়া বরিশালে রওনা করতে কইছেন। কিন্তু লক্ষ্মণ দাসের খবর নাই।
--তিনি কোথায়?
--আজ উজিরপুর তো কাল কালকিনী। পরশু হিজলা তো তরশু বাবুগঞ্জ। তারে কোথাও পাওয়া যায় না। এলাকার লোক কিছুই কইতে পারে না। এর মধ্যে খবর আইলো লক্ষ্মণ না আইলে তার বাড়ির লোকজনরে ধইরা নিয়া যাবে। তার দুই পোলারে ধইরা জাহান্নামে পাঠায় দেবে। তাতেও লক্ষ্মণ দাসের খবর নাই। শেষে ফাইনাল অর্ডার আইলো যদি লক্ষ্মণ দাস দুদিনের মইধ্যে কর্নেল সাহেবের মেয়েরে হাতির খেলা দেখাইতে বরিশালে না যায় তাইলে গৌরনদী এলাকার সব লোকজনরেই মাইরা ফেলাইবে। যারা খবর আনছিল--তারা যাওয়ার সময় গৌরনদীর বাজারে চারটা ঘর পোড়ায় দেছে। আর বাজারে যে পাগল লোকটা ঘোরাঘুরি করত—তারেও গুলি করে গেছে। শ্যাষ।
শুনে মায়ৈ হাহাকার করে উঠল--ও পুত্রা। এ কোনহানে আনলা। এ যে যমপুরী।
রহমতো মুন্সী মামাজান বলল, এই খবর পাইয়া পালরদি ফেরছে লক্ষ্মণ দাস। গ্রামের লোকজন হ্যার কাছে গেছে। তোমার মামা--মামিও গেছে। আমিও যামু। তোমরা আর খাড়াইয়ো না। এইখান থেকে চইলা যাও।
মায়ৈ হাহাকার কইরা কয়, ও পুত্রা। তাইলে হাতির জন্য যে মাথালটা আনছি সেইটার কি হইবে?
শুনে রহমতো মুন্সি মামাজান পরামর্শ দিলেন, ভাইগ্না তোমরা পালরদি যাও। সেইখানে হাতির দেখা পাইবা। কপালে থাকলে মাথায় মাথালটা পরায় দিতে পারবা। তারপর ফিরা যাইও ওইপথে। অত্র এলাকায় আর থাইক্য না। জান বাঁচানো ফরজ।
শুকচাঁদকে জিজ্ঞেস করলাম, আর আপনারা ফিরে এলেন?
তিনি বললেন, ফিরা না আইসা উপায় কি। লোকজন নাই। ঘরবাড়ি ছাইড়া সবাই পলাইছে। কিন্তু--
--কিন্তু কি?
--কিন্তু মায়ৈর মন দোনামোনা। কাইন্দা কইলেন, এদ্দুর আইসা ফিরা যাই ক্যামনে পুত্রা! দুধকুমারের হাতির মাথায় মাথালডা না পরাইয়া ফিরা যাইতে মন চায় না। আর কী এ জীবনে সুযোগ পাব এইখানে আসার! মাথালডা না পরাইলে নাতির অমঙ্গল হবে।
শুকচাঁদ বললেন, বোঝলেন স্যার, তখন তো সব শুইনা মাথা খারাপ। পালরদি গিয়া শুনি হাতি নাই। এলাকার লোকজনও লক্ষণ দাসের লগে মধুবালার পিছনে পিছনে রওনা হইছে।
জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাইতেছে?
শুকচাঁদ বললেন, কোদালধোয়ার বিলে।
--সেইখানে কি দুধকুমারের ওরশ শরীফ?
--না। ওরশ শরীফ না। সেইখানে সবাই পলাইতে গেছেন।
পালরদিতে লোকজনরে আসতে দেইখা লোকজনরে লক্ষ্মণ দাস কইছিল--আমি মধুবালারে লইয়া বরিশাল যাই। কর্নেল সাহেবের লগে দেখা করি। তাইলে আপনেরা বাঁইচা যাবেন। আমার জন্য আপনারা মরবেন ক্যান! লোকজনে কয়—মধুবালা আমাগো লগে থাকলে দুধকুমারের আশীর্বাদের আমাগো কেউ কিছুই করতে পারবে না। মধুবালা যেইখানে--আমরাও সেইখানে যামু। তিনি সাক্ষাৎ মা জননী। তিনি আমাগো আগলাইয়া রাখবেন।
এর মধ্যে খবর আইলো--মাহিলাড়া থেকে উজিরপুরের দিকে আগুনের ধোয়া দেখা যাইতেছে। সে সময় আমাদের সামনে দিয়ে অসংখ্য লোকজন কোদালধোঁয়ার বিলের দিকে ছুইটা যাচ্ছিল। তারা আমাদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেইখা কইলেন, এইখানে দাঁড়ায় থাইকা লাভ নাই। আমাগো লগে চলেন। আমাদের তারা ঠেইলা নিয়া গেল।
কোদাল ধোওয়া বড় বিল। তখনো পুরো বর্ষা আসে নাই। ধান গাছে কচি থোড় আইতেছে। কোথাও কোথাও কচুড়ীপানার ধাপে কুমড়া গাছ সবে উঠতে শুরু করেছে। আর সারি সারি পাটক্ষেত। বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। সেখানে লক্ষ্মণ দাস নাই। তার হাতি মধুবালাও নেই। যারা আসতেছে তারা এদিক ওদিক তাকিয়ে পাটক্ষেতের আড়ালে চইলা যাচ্ছে। মায়ৈ হতাশ গলায় কইলেন—ও পুত্রা, এইখানে হাতি দেখতেছি না। অখন কী করি। আমার মাথালের কি হইবে?
তখন উত্তর দেওয়ার মতো সময় ছিল না। দূর থেকে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ঘর বাড়িতে আগুনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল। কারা কারা আমাদেরকে টেনে একটা পাটক্ষেতের আড়ালে ঠেলে দিল।
কিছুক্ষণের মধ্যে হাত মাইকে কে একজন মাইকে ঘোষণা করল, লক্ষ্মণ দাস, আপনি উঠে আসুন। না হলে আমরা এখানে শেল মারব।
শুকচাঁদ বলছেন। আমি শুনছি-- কোথাও কোনো শব্দ নেই। সব চুপচাপ। বড় বিল। সবুজ বর্ণের ধান ক্ষেত। আর পাড়ে আড়াল করে আছে লম্বা লম্বা পাট ক্ষেত।
আবার হাত মাইক বেজে উঠল, তিন গোনার সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসুন। এক, দুই। তিন বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঠিক পিছন থেকে জলের মধ্যে একটা আলোড়ন উঠল। একটা গম্ভীর মন্দ্র গলার শব্দ বিলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কাঁপিয়ে দিল। আকাশের দিকে জলস্তম্ভ উৎক্ষিপ্ত হল। তার ভেতর থেকে দেখা গেল একটা হাতির শুড়। বিল ফুড়ে হাতি উঠে আসছে। তার পিঠে লক্ষ্মণ দাস। বলে উঠলেন—ইউ স্টপ ইট। আই আম কামিং।
হাতিটা জল থেকে উঠে মাটিতে পা রাখতেই কে একটা ছোট ছেলে সুর করে বলে উঠল--ও হাতি তোর পায়ে কাদা। ছেলেটা তার মায়ের সঙ্গে পাটক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে ছিল। কথা বলতে দেখে মা ছেলেটার মুখ চেপে ধরলো। মায়ৈ তার বোচকা থেকে মাথালটা বের করল। বলে উঠল--ও দুধকুমারের দুত। এই নেও তোমার মাথাল।
শুকচাঁদ আর কিছু বললেন না। থেমে গেলেন। নিজের পায়ের দিকে তাকালেন। এই দিনে দুপুরে সেখানে একটা মশা বসেছে। কামড় দিচ্ছে।
বললাম, শুকচাঁদ, তারপর কী হল বলেন।
শুকচাঁদ এক গ্লাশ জল খেলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তারপর আর কী হবে।
বললাম, হাতিটার কি হল? লক্ষ্মণ দাসের কি হল?
শুকচাঁদ দোকান গোছাতে শুরু করলেন। অসময়ে দোকান বন্ধ করে দেবেন। জানালেন– বাড়িতে অতিথি আসবে। জোগাড় যন্ত্র করতে হবে। আজ আর বলার সময় নেই।
আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শুকচাঁদ বললেন, আর তো কিছু দেখি নাই আমি স্যার। দেখার মতো সময় আমার ছিল না। বিলের ভেতর নাক ডুবিয়ে যাইতে যাইতে শুধু একবার দেখেছিলাম--মাথালটি জলে মধ্যে ভাইসা আছে। লাল।
শুকচাঁদ আর দাঁড়ালেন না। দোকানের ঝাঁপ ফেলে চলে গেলেন।
দুদিন পরে শুকচাঁদ একদিন ভোরবেলা আমার বাসা খুঁজে খুজে হাজির। উদ্বিঘ্ন গলায় বললেন,স্যার শুনছেন, দি লক্ষ্মণ দাসের হাতির খবর নাই। কাউখালির চিড়েপাড়ায় আসার পরে তার আর কোনো পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে সব রেডি। সোমবার সার্কাস শুরু হওয়ার কথা। আমার মেয়ে--জামাই আইসা পড়ছে। হাতি না আইলে মানত করে কেমনে?
কথা কিছুটা সত্যি। চিড়াপাড়ার পরে পাঙ্গাশিয়া। তারপর কচানদী পার হয়ে এলে কুমীরমারী। সেখান থেকে আমাদের শহরে আসতে সময় বেশী লাগে না। কচা নদীর পাড়ে লক্ষ্মণ দাস সার্কাসের নৌকাও গিয়েছিল হাতিকে পার করে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু হাতি চিড়াপাড়া থেকে ফেরে নাই। যতদূর খবর পাওয়া গেছে তাতে জানা যায়—চিরাপাড়া থেকে হাতিটা রওনাও হয়েছে। এ ব্যাপারে ডিসি সাহেব বেশ উদ্বিঘ্ন হয়ে পড়েছেন। তিনি এসপি সাহেবকে নিয়ে মিটিং করেছেন। সেখানে দি লক্ষ্মণ দাস সার্কাসের অন্যতম মালিক বীরেন দাসকে ডেকে নেওয়া হয়েছে। ডিসি সাহেব তাকে দেখে জিজ্ঞেস করেছেন, এমপি সাহেব রওনা হয়েছেন। সঙ্গে তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নাতী আসছে। ছোট মানুষ। নিউ ইয়র্কে থাকে। ছেলেটা হাতির সঙ্গে ফুটবল খেলবে। অথচ হাতির দেখা নেই। সুতরাং হাতি না এলে সবাই বিপদে পড়ে যাবেন।
বীরেন দাস জানালেন, হাতিটা ঠিকই আসছিল। কিন্তু পাঙ্গাশিয়া আসার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাকে আনা সম্ভব নয়। তারা হাতির বদলে অন্য খেলা দেখাবেন। সে খেলা দেখেও সবাই খুশি হবেন। এর মধ্যে হাতি সুস্থ হয়ে ফিরলে হাতির খেলা দেখানো হবে।
ডিসি সাহেব সেটা মানলেন না। তার হাতির খেলাই চাই। অন্য খেলা না হলেও চলবে।
ডিসি সাহেব তক্ষুণি ফোন করে জেলা পশু চিকিৎসকে পাঠালেন হাতির উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে জেলা পশু চিকিৎসক খবর পাঠিয়েছেন--হাতির পায়ে সমস্যা। হাঁটতে পারছে না। পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। তবে পায়ের সমস্যাটি এমন যে সঙ্গে সঙ্গে সারা সম্ভব নয়। সার্জারীও লাগতে পারে বলে চিকিৎসক ডিসি সাহেবকে জানিয়েছেন।
ডিসি সাহেব বীরেন দাসকে বললেন, যে করেই হোক হাতি আনা লাগবে। কোনো অজুহাত চলবে না। প্রয়োজনে অন্য কোনো হাতি ভাড়া করে আনতে হবে।
বীরেন দাস বললেন, সেটা সম্ভব নয়। কারণ এ এলাকায় আর কোনো হাতি নেই। আর হাতি পেলেই তো হবে না--তার ট্রেনিং দরকার। সেটা ছাড়া হাতি কি করে ফুটবল খেলবে?
ডিসি সাহেব এবার আরেকটু গম্ভীর হয়ে বললেন, দেখুন বীরেন বাবু, আপনাদের অরিজিনাল হাতিটা মারা পড়েছিল গৌরনদীর কোদালধোয়ার বিলে, ঠিক কিনা বলেন?
বীরেন দাস মাথা নাড়লেন। বললেন, ঠিক। শুধু হাতি নয়--আমাদের বাবা লক্ষ্মণ দাসকেও মেরে ফেলা হয়েছিল। আমার মাকেও মেরে ফেলা হয়েছিল। পরে বাবার লাশ আমরা খুঁজে পাইনি। মা লীলা দাসকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছিল। আর তার গা থেকে খুলে নেওয়া হয়েছিল সব গয়না গাটি। বিলের মধ্যে সেইখানে ডুব দিয়ে আমার মায়ের দুছড়া গলার হার পেয়েছিলাম শুধু। বলতে বলতে বীরেন দাসের গলা ধরে এল। রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, সেদিন আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে মারা গিয়েছিল হাজার খানেক লোক।
ডিসি সাহেব সিভিল সার্ভিসের লোক। সহজে আবেগ তাকে স্পর্শ করে না। আবেগ দিয়ে প্রশাসন চালানো যায় না। বললেন,সেটা আমাদের বিষয় নয়। আমাদের কাছে রেকর্ড আছে একাত্তর সালে বরিশালের কর্নেল সাহেব খবর পাঠিয়েছিলেন আপনার বাবা লক্ষ্মণ দাসকে হাতি নিয়ে বরিশালে যাওয়ার জন্য। কর্নেলের মেয়ে হাতির খেলা দেখতে চেয়েছিল। আপনার বাবা কর্নেল সাহেবের কথা রাখেননি। তিনি খবর পাঠিয়েছিলেন-- তার হাতিটি অসুস্থ। তথ্য বলে হাতিটা সুস্থই ছিল। মিথ্যে কথা বলে আপনার বাবা লক্ষ্মণ দাস হাতি নিয়ে কোদালধোয়ার বিলে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
বীরেন দাস বললেন, কথা সেটা নয়। আমাদের বাবা লক্ষ্মণ দাস সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধের কাজে জড়িত হয়ে গিয়েছিলেন। সেটা জানতে পেরে তাকে মেরে ফেলার জন্যই কর্নেল বরিশালে যাওয়ার হুকুম দিয়েছিলেন।
ডিসি সাহেব বললেন, সেটা নিয়েও আমাদের কথা নেই। কথা হল--আপনাদের পরিবারের লোকজনের একটা অভ্যাস আছে সরকারী আদেশ--নির্দেশ অমান্য করা। কর্নেল সাহেব আপনার বাবাকে মারবে কি বাঁচাবে সেটা প্রশ্ন নয়। কর্নেল সাহেব সরকারী লোক। তার কথাই সরকারী কথা। আদেশ। সরকারী আদেশ পালন করা নাগরিকের কর্তব্য। সেটা অবহেলা করেছিলেন আপনার বাবা লক্ষ্মণ দাস। ইচ্ছে হলে আপনারা সুস্থ হাতিকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলতে পারেন। সুতরাং পূর্ব রেকর্ড থাকার কারণে আপনার কথা আমরা বিশ্বাস করছি না। তাছাড়া--
বীরেণ দাস জিজ্ঞেস করলেন, তা ছাড়া কী?
ডিসি সাহেব বলে চললেন, আমাদের রেকর্ড বলছে-- দশ বছর পরে সরকার আপনাদের একটা হাতি কেনার জন্য দুইলাখ টাকা দিয়েছিল। সেই টাকা দিয়ে আপনারা হাতি কিনেছেন। সার্কাস চালাচ্ছেন। সুতরাং হাতিটা সরকারী। সরকার এখন হাতিটাকে দেখতে চাচ্ছে। আপনি আজকের মধ্যেই হাতি নিয়ে আসবেন। যদি না আনতে পারেন তাহলে সরকারি অর্থ আত্মসাতের মামলায় আপনাদেরকে ধরা হবে। এটাই শেষ কথা।
ডিসি সাহেব বলেই থামলেন না, দামোদরের ঘাটে পুলিশ দিয়ে সার্কাসের লোকজনকে নজরদারীতে রাখলেন যেন সার্কাসের কেউ সরে পড়তে না পারে।
শুকচাঁদ বেশ উদ্বিঘ্ন হয়ে পড়লেন। বলেন, স্যার এবার কি হবে?
বললাম, হাতির শো হবে না। আর সব কিছু হবে।
শুকচাঁদ ক্ষুদে ব্যাবসাদার মানুষ। কিন্তু সরকারী ক্ষমতার দাপট পুরো দরে বোঝেন। বললেন, তাতো ডিসি সাব মানবেন না। সার্কাস পার্টি বিপদে পড়বে।
তাকে জবাব দিলাম, এখন তো আর কোনো উপায় নেই। জেলা পশু চিকিৎসক যা খবর জানিয়েছেন তাতে হাতি আগামী দশ দিনেও সুস্থ হতে পারবে কিনা যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। এর মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নাতিও নিউ ইয়র্কে চলে যাবে। তার আর সময় নাই। ভিসা শেষ।
আমাদের দুজনের কথা শুনে আমার বড় মেয়ে ভেতর থেকে এসে জিজ্ঞেস করল, বাবা, ঐরাবত আসবে না?
ছোটো মেয়ে এসে কেঁদে পড়ল, আমাল ঐলাবত নালু খাবে না?
মেয়েদের মা ছুটে এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিল।
তাদেরকে কাঁদতে দেখেশুকচাঁদ শান্তনা দিয়ে বললেন, কাইন্দো না মা জননী। হাতি আসবে।
শুনে বড় মেয়ে জিজ্ঞেস করল, ঐরাবত আসবে?
শুকচাঁদ হেসে বললেন, চিন্তা নাই। তোমাগো ঐরাবতই আইসা পরবে।
শুকচাঁদের মুখে হাতি আসবে শুনে আমার মেয়ে দুটি খুব খুশি। বড় মেয়েটা দুটো নাড়ু এনে দিল তাকে। বলল, দাদু খাও। আর ছোটো মেয়েটা হাত তুলে নাচতে লাগল।
কিন্তু এই দুটি শিশুর কাছে মিথ্যা কথা বলাটা আমার পছন্দের নয়। মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে গেল। সেটা বুঝতে পেরে শুকচাঁদ বললেন, মিছা কথা কই নাই স্যার। হাতি নিশ্চয়ই আসবে।
তারপর তিনি যা বললেন তা শুনে আমার হাসি পেলো। তিনি বললেন, এই অসুস্থ হাতি নয় স্যার। আসবে মধুমালতী। লক্ষ্মণ দাসের ঐরাবত মধুমালতী।
অবাক হয়ে বললাম, লক্ষ্মণ দাসের সেই মধুমালতি হাতিটা সেই কোদাল--ধোয়ার বিলে মারা গেছে। সে আসবে কিভাবে?
--দুধকুমারের হাতি মরে নাই স্যার। তারে মারা অসম্ভব। দেখবেন--আইজ লক্ষ্মণ দাসের পোলাদের বড় বিপদ। তাগো বাঁচাতে ঠিকই মধুবালা আইসা পড়বে। দুধকুমার তারে পাঠায় দেবে। হাতি আসবে।
সেদিন বিকেলের মধ্যেই মাইকে ঘোষণা করা হল--আগামী কাল দি লক্ষ্মণ দাসের সার্কাসের উদ্বোধনী শো অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন--মাননীয় এমপি মহোদয়।
পরদিন এমপি সাহেব আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। সার্কাসের লোকজন পোষাক--পরিচ্ছদ পরে রেডি হয়ে গেলো। শুকচাঁদও হাজির।
সার্কাস শোতে কানায় কানায় লোকে পূর্ণ। শুরুতে কনসার্ট হল। আমার সোনার বাংলা গাওয়া হল। এমপি সাহেব উদ্বোধন করলেন। অনেকগুলো খেলা। দেখতে দেখতে আমার ছোটো মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়ল। আর বড় মেয়েটি ঢুলতে লাগল।
সবশেষে হাতির খেলার আগে--মঞ্চের বাতি নিভে গেল। ধীরে ধীরে বাঁশির সুর বেজে উঠল। তার মধ্যে পাকিয়ে পাকিয়ে ধোঁয়া উঠল। একটা মৃদু নীল আলো জ্বলে উঠল। গ্রীন রুমের দিক থেকে ছায়ার মতো একটা কিছু নড়ে চড়ে এগিয়ে আস্তে লাগল। সেটা মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বোঝা গেলো সেটা একটা শুড় মাত্র। তারপর দুটো বড় বড় কান ভেসে উঠল। আর পিছনে লেজ। পা নেই। পেট নেই। পিঠ নেই। সবাই স্তব্ধ হয়ে দেখছে। কিছুক্ষণ পরে শুকচাঁদ আমার হাত চেপে ধরল। মনে হল ভয় পেয়েছে। থর থর কাঁপছে। বললাম, শুকচাঁদ ভয় পাবেন না। এটা ম্যাজিক।
শুকচাঁদ বলল, ম্যাজিক নয় স্যার। চাইয়া দেখেন--আমি কইছিলাম,লক্ষ্মণ দাসের মধু বালা আইবে। দুধকুমারের বরকতে এই দেখেন মধুবালা আইসা পড়ছে।
চেয়ে দেখি তখন শুড় আর কানের মাঝে হাতির মস্ত মাথাটিও দেখা যাচ্ছে।
শুকচাঁদ আবার চেচিয়ে উঠল। বলল, ওই দেখেন আমার মাইসাতো বোনের শ্বাশুড়ীর বানানো মাথালটা হাতির মাথায় ঝুলছে। তাকিয়ে দেখুন।
তাকিয়ে দেখতে পেলাম--সত্যি সত্যি হাতির মাথায় একটি মাথাল আছে। মাথালের মাঝখানে রূপোর মেডেল। আর তার নিচে লেখা--মা মধুবালা।
শুড়টা উপরে উঠল। আর একবার গগণ বিদারী ডাক ছাড়ল। সবাই জয়ধ্বনি করে উঠল। এবার হাতির খেলা শুরু হবে।
বড় মেয়েটি ঘুম ঘুম চোখে বলে উঠল, ঐরাবত।
ছোটো মেয়েটি ঘুমের মধ্যে থেকেই অস্ফুট গলায় বলল, ঐলাবত নালু খাবে।
পরদিন পাঙ্গাশিয়া গ্রাম থেকে জেলা পশু চিকিৎসক ফিরলেন। একা নয়। কার্গোতে করে লক্ষ্মণ দাসের হাতিটা নিয়ে এসেছেন। কার্গোতে ওঠাতে ক্রেন ব্যবহার করতে হয়েছে। সঙ্গে একটা ডেথ সার্টিফিকেট লিখে এনেছেন। জেলা পশু চিকিৎসক লিখেছেন-- গতকাল দুপুরে লক্ষ্মণ দাসের হাতিটা অজ্ঞাত রোগে মারা গেছে। হাতিটা ছিল ছোটো খাটো। জন্মস্থান বান্দরবন বলে ধারণা হয়।
------------------
লেখক পরিচিতি
কুলদা রায়
জন্ম : ১৯৬৫
বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে। বরিশাল ও ময়মনসিংহের আধিবাসী।
লেখা পড়া ও পেশা : কৃষি।
গবেষণা : ধানের আমিষ বৃদ্ধি।
ব্লগার।
প্রকাশিত বই : কাঠপাতার ঘর
দীর্ঘদিন নিউ ইয়র্কে প্রবাসী।
2 Comments
গল্পটা জটিল করে ফেলা হয়েছে মনে হয়। বুঝতে বোদ্ধা পাঠক লাগবে।
ReplyDeleteচমৎকার হয়েছে ।আমি ঘটনার অংশ হয়ে উঠেছিলাম ।কঠিন বিষয় কে সহজ করে লেখা সহজ নয় । এটাই আধুনিক স্বার্থক লেখা !
ReplyDeleteলেখক সমাজের আয়না (পাঠক নয় !) আর সে আয়নায় পরিস্কার আমরা
৭১এর বাঙলার একটি জনপদের পরিস্কার ছবি দেখতে পাই ।
শহীদুল জহিরের , জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার পর মুক্তিযুদ্ধের আর একটি শক্তিশালী গল্প পড়লাম ।লেখক কে অভিনন্দন ।