লেখকের পুরস্কার--পুরস্কারের লেখক


কুলদা রায়

১.

জাকির তালুকদার কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁকে অভিনন্দন।

বহুদিন পরে একজন প্রকৃত কথাসাহিত্যিক পুরস্কার পেলেন। এর চেয়েও বড় বিষয় মফস্বলের একজন লেখক পুরস্কার পেলেন। এটা একটা বিরল ঘটনাও বটে। সাধারণত রাজধানীর লোকজন বিশ্বাস করেন তারাই সাহিত্য করেন। সকল পুরস্কার তাদের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। মফস্বল একটু শুদ্র টাইপ। মফস্বলের দ্বায়িত্ব হল রাজধানীর লোকজনকে স্তুতি করা। তাদেরকে ভালোমন্দ খাওয়ানো। সংবর্ধনা দেওয়া। মাথায় করে নাচা।

কিন্তু সাহিত্যের রাজধানী বলে কোনো ব্যাপার নেই। এবং এই অন্তর্জালের জমানায় সাহিত্যের দেশটাও উঠে যাচ্ছে। ভুবনগাঁয়ের পথযাত্রী হওয়াটাই তার নিয়তি।

এই পুরস্কার-পদক পাওয়ার জন্য লেখক-অলেখকদের মধ্যে একটা উন্মাদনা আছে। এর জন্য নিজেকে বিকিয়ে দিতে পারেন। হাস্যকর হয়ে উঠতে পারেন। লেখাকে অপমান করতে পারেন।এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী হিসেবে পরিচিত বেশ নামী লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য মাদুলি-তাবিজ কবজ ধারণ করেছিলেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার জন্য।অথচ পুরস্কার-টুরস্কারের প্রতি প্রকৃত লেখকের কোনো লক্ষ্য থাকে না। লেখাটাই তাঁর একমাত্র কাজ। তিনি লিখবেন। ক্রমাগত নিজেকে ছাড়িয়ে যাবেন। সেরা লেখাটাই লিখবেন। জীবনকে লিখবেন। মৃত্যুকে লিখবেন। আবার অমৃতকেও লিখবেন।


২.
কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস জীবদ্দশায় ফিলিপস পুরস্কার গ্রহণ করেননি। তিনি যখন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কোলকাতায় চিকিৎসারত, চিকিৎসার ব্যায়ভার বহনে অক্ষম হয়ে উঠছেন--তখন তাঁকে কোলকাতার আনন্দ পুরস্কার প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।

ছিয়ানব্বই সালের মার্চ মাস। ইলিয়াসের পা কেটে ফেলার তা্রিখ নির্ধারিত হয়েছিল ২০/৩/১৯৯৬। সে সময়ে ঢাকা থেকে প্রফেসর আনিসুজ্জামান কোলকাতায় ইলিয়াসের সঙ্গে দেখা করে পুরস্কারটি গ্রহণের অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন পুরস্কারটা না হোক--পুরস্কারের টাকাটা তাঁর জন্য এ মুহুর্তে দরকারী। ইলিয়াস সোজা না করে দিয়েছিলেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও লেখক তপন রায়চৌধুরীও তাঁকে বোঝাতে অক্ষম হলেন। মিহির সেনগুপ্ত সহ যাঁরা তাঁকে অনুরোধ করতে গিয়েছিলেন, ইলিয়াস তাঁদেরকে গালিগালাজ করে বের করে দিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

ইলিয়াস পুরস্কারটি গ্রহণ না করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অর্থের অভাবে যখন তাঁর সার্জারী পর্যন্ত থেমে যাচ্ছে, তাঁর নিকটজনরা অর্থ-যোগাড় করতে খাবি খাচ্ছেন তখন ইলিয়াস পুরস্কারটা নিতে সম্মত হয়েছিলেন। প্রকৃত অর্থে সেটা না নেওয়ারই শামিল।

ইলিয়াস খুব বেশি লেখেননি। যা লিখেছেন--সেটাই মাসটারপিস হয়েছে। তিনি জানতেন-- তাঁর পুরস্কারপিস হওয়ার দরকার নেই। নিজের লেখাটাই তার বড় অর্জন। এটাই একজন লেখকের শক্তি।

৩.
জাকির তালুকদার পুরস্কারপ্রাপ্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিছুদিন ধরে নানা পুরস্কার তিনি পাচ্ছেন। সপ্তাহখানেক আগে পশ্চিম বঙ্গের লালগোলা নামের একটি মফস্বল থেকে পুরস্কার আনতে গিয়েছিলেন। বাংলা একাডেমীর পুরস্কার এতো হেঁজিপেঁজি লোকজন পাচ্ছিলেন যে তাঁর না পাওয়াটি ছিল বিস্ময়কর।

এখন জাকির তালুকদার কি করবেন?
দুটো কাজ করার আছে তাঁর।
এক. লেখালেখি ছেড়ে দেওয়া। আরো বড় পুরস্কার পাওয়ার জন্য লাইনে থাকতে পারেন।
দুই. বাংলা একাডেমী পুরস্কার যখন পেয়েই গেছেন, তখন তিনি এই পুরস্কারের মোহটা ছেড়ে দেবেন। এতোদিন যা লিখেছেন, সে সব লেখার দুর্বলতাকে খুঁজে বের করবেন। নিজেকে আরো শক্তিশালী জায়গায় নিয়ে যাবেন। নিজেকে ছাড়িয়ে যাবেন। সেরা লেখার কাজটি করবেন।

সেই মাস্টারপিস লেখককে অভিনন্দন জানানোর জন্য আমি অপেক্ষা করবো।


Post a Comment

0 Comments