কুলদা রায়ের গল্প : যে গ্রামের সবাই ধর্ষিত হয়েছিল



১.

আজ রাতে ঘুম হয়নি সিভিল সার্জনের। তিনি নিতান্তই গোবেচারা মানুষ। ছেলেপিলে নেই। ঘরে বাইরে স্ত্রী আর তিনি। বছর তিনেক হলো তিনি আর স্ত্রীর এক ঘরে ঘুমান না। বেচারী মেনোপজ দশায় চলে গেছেন। এখন একটু ব্যথা পান। সেজন্য মনমেজাজ খুবই খারাপ থাকে। কাছে গেলেই তিনি মুখ ঝামটা দেন। তাকে বলেন, আটকুড়া বেটা।

এটা শুনে সিভিল সার্জন মনে মনে হাসেন। তিনি আটকুড়ে হলেও তার স্ত্রীটিও আটকুড়ে। মুখের কথা নয়। বিবাহিত জীবনের শুরুতেই জেনেছেন পরীক্ষা করে। তার স্ত্রী অবশ্য এসব কখনো বিশ্বাস করেননি। তার বিশ্বাস, তিনি অবশ্যই গর্ভবতী হবেন। এক ফুটফুটে সন্তানের মা হবেন। তাকে তিনি বুলবুল পাখি ময়না টিয়ে গানটি শোনাবেন। এই গানটি তিনি খুব ভালো করে গাইতে পারেন। এক সাধু তার হাত দেখে এক সন্তানের জননী হবেন বলে কিশোরীকালে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন। সাধুটি হিন্দু হলেও লোক ভালো। তিনি টাকা পয়সা কিছু নেন না। মুড়ি দিলে খান। তাই তিনি মুড়ি সাধু হিসেবে পরিচিত। সেই মুড়ি সাধুর কথা বিফলে যেতে পারে না।

সিভিল সার্জনের স্ত্রীর নাম ছিল একটু সেকেলে-- মোছাম্মাৎ মঞ্জে আরা বানু।

ফোনটি এসেছিল ঠিক রাত পৌনে বারোটায়। কিছুক্ষণ আগে মঞ্জে আরা বানু ক্রিম মাখছিলেন। হাওয়ায় জুঁই ফুলের সুগন্ধি উড়ে এসেছিল। শোয়ার আগে আধখানা ঘুমের বড়ি খেয়ে নিয়েছেন সিভিল সার্জন। সাইলেন্ট মোডে রেখে দিয়েছেন তার সেলফোন। ঘুম ঘুম আসছিল। ফোনের মনিটিরে লাইট জ্বলতেই বুঝলেন ফোন এসেছে। ধরব না ধরব না করে স্বভাব বশে ধরলেন। কিন্তু ততক্ষণে ফোন কেটে গেছে। একটা ভয়েস মেইল এসেছে। কে একজন বলছে, বি রেডি। আর কিছু নেই।

কেনো রেডি, কিভাবে রেডি? কার জন্য রেডি? কোথায় রেডি? কখন রেডি? এই রেডি নিয়ে ভাবতে ভাবতে সিভিল সার্জন বেচারার ঘুম টুটে গেল। এর মধ্যে তিনি টের পেলেন তার স্ত্রীও জেগে আছেন। ফেসবুকে আছেন। চ্যাটিং করছেন। হা হা হি হি। ভিডিও করছেন। একবার শুনতে পেলেন গুণগুণ করে কাকে গেয়ে শোনাচ্ছেন,



নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে

চুপি চুপি বাঁশি বাজে বাতাসে বাতাসে।।

এই গানটি মঞ্জে আরা বানু তাদের বাসর রাতে গেয়েছিলেন। শুনে তখন মনে হয়েছিল, এই গানখানির তার জীবনসঙ্গীত হয়ে উঠেছে। প্রতি বিয়েবার্ষিকীতেই এটা গীত হয়। আর এখন মরনসঙ্গীত। মনে হলো ছুটে গিয়ে তার গলা টিপে ধরেন! বিছানা থেকে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

ফজরের আজান কানে এলে সিভিল সার্জন উঠে পড়লেন। তখন মনে হলো, রাতে ফোনটি আসেনি। দুঃস্বপ্ন দেখেছেন।

অফিসে আজ কিছু জরুরি ফাইল সই করার কথা। হেড ক্লার্কের দেখা নেই। খোঁজ নিয়ে জানলেন তিনি এখনো আসেননি। এরকম দেরি তিনি সাধারণত করেন না। হাসপাতালের পাশেই তার বাসা। তার পিওন মোবারক একটু উসখুস করছিল। জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বলবে মোবারক?

মোবারক বলল, আপনের কি ফেসবুক আছে স্যার?

--কী বুক?

-- ফেসবুক।

একটু অবাক হলেন সিভিল সার্জন। এই পিওনটির স্বভাবচরিত্র মন্দ নয়। কখনো কিছু বলে না। মাথা নিচু করে শোনে শুধু। শুনে সেটা পালন করে। সেও ফেসবুকের কথা জানে।

-- ফেসবুক দিয়ে কী করবে?

--কিছু না স্যার। বলে দরোজার বাইরে মুখ সরে গেল মোবারকের।



তার মন একটু খচ খচ করতে লাগল। তিনি হাসপাতালের আরএমওকে ফোন করলেন। রিং হলো। কিন্তু তিনি ধরছেন না। এরকম হওয়ার কথা নয়। তিনি দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তি। কখনো দেরি করেন না অফিসে আসতে। অফিস ফাঁকি দিয়ে বাইরে ক্লিনিকে রোগী দেখেন না। পাঁচটা পরে অফিস শেষে নিজের চেম্বারে যান। তার সেলফোনে রিং করলেন। এনগেজ টোন এলো। তিনি একটি মেসেজ রাখলেন। বললেন, ফ্রি হলে কল করুন প্লিজ।

পিওন মোবারক এবারে ভেতরে এলো। নিঃশব্দে কফি বানাতে শুরু করল। খুব মৃদু স্বরে বলল, আরএমও স্যার অফিসে এসেছেন। তবে রুমে নাই।

কফির কাপ হাতে নিয়ে সিভিল সার্জন শুধালেন, উনি কি রাউন্ডে বেরিয়েছেন?

-- না। উনি ডাঃ মাহমুদের ঘরে।

-- আচ্ছা।

নিঃশব্দে কফি খেতে খেতে বাইরে তাকালেন। দিনটা সুন্দর। হালকা রোদ আছে। মুদু হাওয়া বলছে। ইলেকট্রিকের তারে একটু কালো কাক ঠোঁট ঘষছে।

পিওন মোবারক কফির কাফ গুছিয়ে নিতে নিতে আবার জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনার ফোনে ফেসবুক আছে?

কফিটা ভালো বানায় মোবারক। তার প্রশ্নে ক্ষিপ্ত হলেন না। একটু হেসে বললেন, তুমি কি আজকাল ফেসবুক খুলছো নাকি?

মোবারকও একটু হাসল। বলল, ফোনই নাই তার আবার ফেসবুক।

--কিনতেও তো পারো। এখন ফোনটা তো দরকারি।

-- একটা আছে। বিবির কাছে থাকে। শুধু কথা বলা যায়। দামে সস্তা।

একটু থেমে মোবারক আবার বলল, ফেসবুকে নাকি কিছু একটা হয়েছে।

-- কী হয়েছে?

-- ভয়ঙ্কর কিছু একটা। লোকে হুমড়ি খেয়ে ফেসবুক দেখছে।

তিনি অতোটা উতলা হলেন না। ফেসবুকে কী আর হবে। প্রেম ভালোবাসা হবে। মিষ্টি মিষ্টি ভালোবাসা হবে। লোকে ছবি টবি দেবে। তাই দেখে লাইক কমেন্ট হবে। ফেসবুক খোলার পরে প্রথমদিকে তার স্ত্রী মঞ্জে আরা বেগম এরকম কিছু হলে খুব খুশি হয়ে তার কাছে ছুটে আসত। তাকে দেখাতো।

হাসপাতালে ডাঃ মাহমুদ ফেসবুকে ওস্তাদ। অনেককেই খুলে দিয়েছেন। তাকেও খুলে দিতে চেয়েছিলেন। তিনি রাজি হননি। তবে তার স্ত্রী মঞ্জে আরাকে খুলে দিয়েছেন।

তার স্ত্রীর সঙ্গে মাহমুদ এ নিয়ে নানা সময়ে কথাবার্তাও বলেন। তারা এখন ভার্চুয়াল বন্ধু। এ নিয়ে কিছু লোকজন ঠারেঠোরে কিছু ফিসফাস করেন বলে তিনি শুনেছেন।

পিওন মোবারককে দিয়ে ডা. মাহমুদকে ডেকে আনলেন।

মাহমুদ এলেন বটে। তবে হাতে আইফোন ধরা। তার পিছু পিছু আরো কজন ডাক্তার। এসেই বললেন, খবর খারাপ স্যার।

কী খারাপ সেটা জানতে চাওয়ার আগেই মাহমুদ বললেন, এক ছেলে পবিত্র কাবাশরীফের অপমান করেছে।।

সিভিল সার্জন ঠিক বুঝতে পারেননি মনে হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কাবাশরীফে কী করেছে?

--একটা হিন্দু মূর্তি বসিয়ে দিয়েছে।

--সেকি? কাবাশরীফের উপরে হিন্দুমুর্তি? অবাক হয়ে গেলেন তিনি। এটা অসম্ভব ঘটনা। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, সেখানে সিকুরিটি গার্ড ছিল না? সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না? তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কী করে মূর্তিটি নিয়ে যেতে পারল সেখানে? আর কিভাবেই বা মূর্তিটি কাবাশরীফের ছাদের উপরে বসিয়ে দিল? আর কেই বা এই কাজটি করার দুঃসাহস করল? ইহুদীরা নাকি?



মাহমুদ এবারে সামান্য একটু হাসলেন। বললেন, না, স্যার। ইহুদীরা নয়। একজন হিন্দু।

--হায় আল্লাহ, হিন্দু। মক্কায় কোনো অহিন্দুর যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাইলে?

-- তাইলে স্যার হিন্দু লোকটি মক্কায় যায়নি।

-- না গিয়েই এই ভয়ানক কাজটি করল কীভাবে? ড্রোন বিমানে করে পাঠিয়েছে মূর্তিটি?

এর মধ্যে মাহমুদের ফোনটি বেজে উঠেছে। সিভিল সার্জনের এই এক রোগ। নানা প্রশ্ন করে বসেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে জেরবার করে ফেলেন। ফোনটি ধরার আগে উঠতে উঠতে বললেন, হিন্দু লোকটি কাবাশরীফের উপর মূর্তি বসিয়েছে মক্কায় গিয়ে নয় -- ফেসবুকে।

দরজা পার হতে হতে বলে গেলেন, ফেসবুকে সিকিউরিটি অফিসার লাগে না। সিসিটিভিও লাগে না। একটা একাউন্ট থাকলেই হলো।

মাহমুদ ফোনটি ধরে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন। সিভিল সার্জন দেখলেন, তিনি অফিসার্স কোয়ার্টের দিকে যাচ্ছেন। বাইরে, পিওন মোবারক দেখল, ডাঃ মাহমুদ সিভিল সার্জনের বাসার দরোজায় নক করছেন। অন্য সময় হলে সে একটু মুচকি হাসি দিত। এখন দিল না। এর চেয়েও জটিল বিষয় আছে।

সেটা কী? তার বিবিও বাড়িতে একা আছে। বিয়ের বয়স পাঁচ বছর। দুটি সন্তান হয়েছে। তার বউ আর সন্তান চায় না। ফ্যামিলি প্লানিং অফিসে গিয়ে টিউবেকটমি অপারেশন করে নিয়েছে। তার আপত্তি শোনেনি। বলেছে, বেশি ল্যাদাগ্যাদা হলে শরীর টেনে না। একটু তরতাজা থাকতে চায়। বলে বউ তার দিকে একটু টিপে হাসি দিয়েছিল। সেই হাসির কারণে ডাঃ মাহমুদের দিকে তাকিয়ে পিওন মোবারকের মনে হল, তার এখুনি বাড়ি যাওয়া দরকার।



২.

বিকেল নাগাদ এসপি সাহেব নিজে এসে সিভিল সার্জনকে থানায় নিয়ে গেলেন। থানার সামনে অনেক ভীড়। ভীড় ঠেলে তারা অফিসে ঢুকলেন। সেখানে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। থরথর করে কাঁপছিল। দারোগা জানালেন, এই লোকের নাম রসরাজ। বয়স ২৬। লুঙ্গিপরা। গায়ে গেঞ্জি। তাকে দেখিয়ে দারোগা জানালেন, এ লোক অভিযোগ জানাতে এসেছে। সে বলছে, কে বা কারা তার নামে একটি ফেসবুক আইডি খুলেছে। সেখানে কাবাশরীফের ছবি দিয়েছে। তার উপরে দিয়েছে দিয়েছে একটি মূর্তি।

-- কিন্তু বাইরে কারা? জিজ্ঞেস করলেন এসপি।

দারোগা জানালেন, এলাকার লোকজন। তারা দাবী করেছে, এই ছেলেই ছবিটি ফেসবুকে দিয়েছে। তারা এর ফাঁসির দাবী করছে।

ছেলেটিকে এসপি জিজ্ঞেস করলেন, তুকি কী করো?

ছেলেটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, মাছ ধরি। মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করি।

-- পড়াশুনো করেছ?

-- তিন চার ক্লাশ।

-- তোমার কম্পিউটার আছে?

-- কী পিউটার স্যার?

--কম্পিউটার।

না। স্যার। মাথা নেড়ে বলল, জাইলা মানুষ। কম্পিউটার দিয়ে কী করব?

-- হু। ফোন আছে?

এবারে একটা ফোন বের করে দিল। অতি সাধারণ ফোন। শুধু ফোন করা যায়। আর ফোন ধরা যায়। ইন্টারনেট নেই।

--হুম। তোমার ফেসবুক আছে?

এবারে অবাক হয়ে বলল, জাইলা মানুষ। ফেসবুক দিয়ে কী করব? আর চালাবোই বা কী করে।

সিভিল সার্জন এবার তাকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলেন। বললেন, পড়ো তো বাবা।

বাংলা ভাষায় লেখা রেনিটিডিন ওষুধে ফ্লায়ার। সে বানান করে করে পড়ে ফেলল। এবার তাকে ইংরেজি ভার্সনটা দিলেন। এবারে বানান করে করে পড়ার চেষ্টা করল বটে। কিন্তু পারল না। তবে ইংরেজি কিছু অক্ষর চিনতে পারল।

রসরাজের অভিযোগটি জিডি করা হলো। তিনি সিভিল সার্জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী মনে করেন?

সিভিল সার্জন জিজ্ঞেস করলেন, কোন বিষয়ে?

-- এই ছেলেটার বিষয়ে?

--আমার তো মনে হয় ছেলেটা সত্যি বলেছে।

-- ওর মাথা টাথা?

এই প্রশ্নে সিভিল সার্জন নজর করে দেখলেন রসরাজ নামের ছেলেটা গ্রামেই ল্যাদাগাদা মানুষের মতোই একটি তেরছা হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোখের তারায় একটু ভয়ের চিহ্ন আছে। আর কোনো অস্বাভাবিকতা নেই।

তিনি বললেন, সব ঠিক হ্যায়। কোনো ঝামেলা নেই।

এবারে এসপি মুচকি মুচকি হাসলেন। বললেন, আছে। সেটা আপনি বুঝতে পারবেন না ডাক্তার সাহেব। অলরেডি ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে। একে বাঁচানো কঠিন।

--তাহলে?

--তাহলে আমার সঙ্গে আসুন। বলে এসপি সিভিল সার্জনকে নিয়ে অফিসের বারান্দায় এলেন। দেখলেন, লোকজন থানার দিকে পিল পিল করে আসছে। তারা উত্তেজিত। কারো হাতে লাঠিসোঁট। রসরাজকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবী করছে। বলছে, তার ব্যবস্থা তারাই করবে।

এসপি লোকটি এক সময় ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন, সামথিং ইজ রটেন ইন ডেনমার্ক।

তিনি রসরাজকে ছেড়ে দিলেন না। বাড়তি ফোর্স এনে তাকে জেলা কারাগারে নিরাপত্তা হেফাজতে পাঠিয়ে দিলেন।

এই রাতেও সিভিল সার্জন আবার ফোনটি পেলেন। বি রেডি।

আর কোনো বাক্য নয়। বি রেডি বাক্যটি বলেই ফোনটি কেটে গেল। তবে গলাটি আগেরটার মতো নয়। অন্য কেউ হবে। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ করে গলার স্বরটি তার চেনা মনে হলো। মনে হলো, গলাটি এসপির।

হতে পারে। আবার নাও হতে পারে।

তিনি শুনলেন, তার স্ত্রী খিলখিল করে কাকে গান গেয়ে শোনাচ্ছেন, নিশিরাত বাঁকা চাঁদ।

চুপি চুপি কথা বলে আকাশে বাতাসে।



৩.

পরদিন হাসপাতালে এমার্জেন্সি ওয়ার্ড রেডি রাখলেন সিভিল সার্জন। সব ডাক্তার নার্সদের উপস্থিতি নিশ্চিত করলেন। তার সিক্সথ সেন্স বলল, খুব খারাপ কিছু ঘটতে পারে। অনেক রক্তারক্তির রোগী সামলাতে হতে পারে। এরমধ্যে ডাঃ মাহমুদকে একবার তার বাংলোর দিকে যেতে দেখলেন। অন্যদিন হলে তিনি তাকে দেখেও না দেখার ভান করতেন। আজ জীবনে প্রথমবারের মতো মাহমুদকে ডেকে ফেরালেন। বললেন, হাসপাতালের বাইরে যাওয়া যাবে না। সবাইকে এলার্ট থাকতে হবে।

মাহমুদ তার অফিস রুমের দিকে ফিরে গেলেন। আর কিছুক্ষণের মধ্যে তার স্ত্রীর ফোন পেলেন। সুতানলী সাপের মতো হিসহিস করে গালি দিলেন সিভিল সার্জনকে, "সান অফ এ বিচ।"

সেদিন হাসপাতালে একটা মাছিও পড়ল না। সব কিছু শুনশান। সর্দি কাশি আমাশয়ের রোগীদের লম্বা লাইন দেখা গেল না। একটি শিশুর জন্ম হলো শুধু লেবার ওয়ার্ডে।

শিশুটির কান্না শুনে তার মনে এক ধরনের হাহাকার জেগে উঠল। তার নিজের জন্য নয়। স্ত্রীর জন্য। বহুবার তার স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার কথা তাকে বলেছে। কখনো কখনো বমিও করেছে হড়হড় করে। তেঁতুল আচার খেয়েছে। কখনো কখনো পেটের মধ্যে শিশুর নড়াচড়াও টের পেয়েছে।

বাইরেও খুব বেশি লোকজন দেখা গেল না। রিকশা গাড়ির চলাচলও খুব কম। মনে হলো এ শহরটি হঠাৎ করে জনশূন্য হয়ে পড়েছে। গণগণে সূর্যটা পূব দিক থেকে ধীরে ধীরে মাথার উপরে অতি ধীর লয়ে উঠে গেল। তারপর পশ্চিমে হেলে গেল। কোনো কাজ থাকায় তিনি চেয়ারে একবার ঘুমিয়েও পড়লেন। কয়েকটা কাক নিস্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ঠোঁট ঘষছে। মনে হলো, শহরের অলিগলিতে গেলে মন্দ হতো না। কিন্তু গেলেন না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি একটু ঘরকুনো লোক। অফিস আর বসা। বাসা আর অফিস। এর বাইরে ঘোরাঘুরি করতে ইচ্ছে করেন না। এইজন্য অফিসের পরে কোনো প্রাইভেট প্রাকটিস করেন না।

পাঁচটা বাজতেই মোবারক দরোজার টোকা দিল। এখন দরোজা জানালা বন্ধ করবে। তার বাড়ি যাওয়ার সময় হয়েছে। আজ দেরি করতে চাইছে না। বলল, এখন বাসায় যান স্যার। সময় হয়ে গেছে।

তিনি উঠতে উঠতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন,

যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,

সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,

যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,

যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গ নামিয়া,

মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,

দিক্‌-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা—

তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,

এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।



সেদিন খুব ভালো ঘুম হলো তার। বেশ বেলা করে ঘুম ঘুম ভাঙল। পরপর দুদিন ছুটি থাকায় বাসায় থাকলেন। কিছু পুরনো দিনের গান শুনলেন। দুটো সিনেমা দেখলেন। রুমির কবিতা পড়লেন। আর নিজের আত্মজীবনীর খসড়া লিখলেন। লিখলেন গদ্যে নয়-- পদ্যে। কোনো সংবাদপত্র তিনি পড়েন না। পড়লে তার মাথা গরম হয়ে যায়। এই সময়কালে তিনি আত্মসমাহিত থাকেন। তিনি লিখেছেন--

এ জগৎ রহস্যময়।

তাকে বোঝা দায়।।

' আজ ঝকঝকে রোদ উঠিয়াছে। ফুল্ল বাতাস বহিতেছে। বাগান কুসুম ফুটিয়াছে। তাহাতে অলি আসিয়া গুণগুণ করিতেছে। এইসব দিনে আমার মন কেমন করিয়া বেড়ায়। তাহার কোনো কুলকিনারা খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।

আজ বাসায় সংবাদপত্র বাহক দরোজায় কড়া নাড়িলে মঞ্জে আরা আসিয়া ছো মারিয়া লইয়া গেল। আমার আর দেখিবার সুযোগ ঘটিল না। পরের দিনও না। তৃতীয় দিবসে মঞ্জে আরা আসিয়া কহিল, আজ আপনার অফিস যাওয়ার দরকার নাই। আপনার শরীর খারাপ।

কহিলাম, আমার শরীর খারাপ, কিন্তু তাহা আমি জানি না।

মঞ্জে আরা কহিল, রাত্রে তুমি খুক খুক করিয়া কাশিয়াছ। আমি অফিসে খবর পাঠাইয়া দিয়াছি। সুস্থ না হওয়া অবধি তোমার ছুটি।

ছুটি ব্যাপারটা মন্দ নহে। এক সময় ছুটি নেওয়ার কোনো ইচ্ছা হইতো না। মনে হইত কাজ করিয়া যাওয়াটাই জীবনের উদ্দেশ্য। আমার পেশায় মানুষকে সুস্থ করিয়া তুলিতে বড়ো আনন্দ। এখন চাকরিকাল শেষের পথে। অনেক ছুটি পাওয়া আছে। ক্লান্ত জীবন। ছুটি পাইতে ইচ্ছা করে। মনে হয় মানুষজনের ভিড় হইতে দূরে থাকিতে বেশ লাগিবে।

মাঝে মাঝে বুঝিতে পারি, বাইরে কিছু একটা ঘটিতে পারে। টিভির খবর কানে আসে। নাসিরনগর গ্রামে কে বা কারা আক্রমণ করিয়াছে রাত্রিকালে। বেশ কিছু ঘরবাড়ি পুড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। সরকাররের প্রেসনোট বলিয়াছে, কিছুই ঘটে নাই। কাবা শরীফের অবমাননা করিবার কারণে সংক্ষুব্ধ হইয়া কিছু লোকজন আবনাননাকারীদের পাড়ায় আক্রমণ করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। কিন্তু সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপে তাহাদের তৎপরতাবন্ধ করা সম্ভব হইয়াছে। এলাকায় শান্তি বিরাজ করিতেছে। স্বাস্থ্য বিভাগে ঐ এলাকার কেহ আহত হয়ে ভর্তি হয় নাই বলিয়া ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন জানাইয়াছেন। অবমাননাকারীকে আটক করিয়া ১৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হইয়াছে।

সরকার সোস্যাল মিডিয়ায় নেতিবাচক লেখালেখির মাধ্যমে কতিপিয় বিরুদ্ধ পক্ষ দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করার পয়তারা করিতেছে। তাহাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হইবে বলিয়া সরকার ঘোষণা করিয়াছে। প্রয়োজনে সোস্যাল মিডিয়া বন্ধ করা হইবে।

বাংলোর বাগানে পায়চারি করিতে করিতে দেখিতে পাই, বাইরে পুলিশের টহল গাড়ি ঘুরিয়া যাইতেছে। তাহাদের মাথায় কালো কাপড় বাঁধা। পুলিশের এলিট ফোর্স।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। জোনাকি পোকা জ্বলে আর নেভে। শান্ত হাওয়া এসে লাগে গায়ে। রাস্তার বৈদ্যুতিক বাতি কেঁপে কেঁপে ওঠে। ঘর থেকে মঞ্জে আরা বহুদিন পরে ডাকে। এ জীবন বড়োই রহস্যময়।



৪.

একদিন ভোর বেলাতেই ফোন পান সিভিল সার্জন। তখনো অফিসে যাওয়ার সময় হয়নি। বারান্দায় বিড়ালকে খাবার দিচ্ছিলেন।

ফোন থেকে গমগমে গলা শোনা যায়। বলে, সিএস, তুমি কি কিছু শুনেছ?

অবাক হয়ে শুধান, কী বিষয়ে।

-- পাঁচটি মেয়ে গর্ভবতী হয়েছে।

এবারে হাসলেন। বললেন, এ আর নতুন কী। প্রতি মিনিটে দেশে গড়ে ৪ জন নারী গর্ভবতী হয়। এ জেলায় প্রতিদিন গর্ভবতী নারীর সংখ্যা কমবেশি ১৩৫ জন।

জেলায় নয়। একটি গ্রামে। গ্রামের পরিসংখ্যান কী?

--একটি গ্রামে? চিন্তায় পড়ে গেলেন সিভিল সার্জন। গড়ে একটি উপজেলায় গর্ভবতী নারীর সংখ্যা ১৪-১৫ জন হতে পারে। গ্রামপ্রতি মাসে ২টি নারী গর্ভবতী হয় খুব বেশি হলে।

--আমি যে পাঁচটি নারীর কথা বলেছি।

-- এরা নারী নয়। এরা বালিকা। বয়স বারো তেরো। ফাইভ সিক্সে পড়ে।

--এদের কি বাল্য বিয়ে হয়েছিল?

--না। এদের কারোরই বিয়ের বয়স হয়নি। আর ঐ উপজেলায় গত ১৫ বছরে কোনো বাল্য বিয়ে হয় না। উপজেলা নির্বাহী অফিসার এজন্য বিশেষ পুরস্কারও পেয়েছেন এ বছর। তাছাড়া সরকারি রিপোর্ট বলছে, স্বাস্থ্য বিভাগে এরকম কেস আসেনি। নাসিরনগর থানাও ধর্ষণের কোনো অভিযোগ পায়নি।

--তাইলে?

--তাইলে আর নাই। বি রেডি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কম্পিউটার অপারেটর একটা প্রিন্ট বের হাতে নিয়ে এলো। সেখানে ডয়েসে ভেলের একটি প্রতিবেদন রয়েছে। লেখা--

নাসিরনগরে পাঁচটি নাবালিকা মেয়ে গর্ভবতী। তারা অবিবাহিত। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। তাদের গর্ভদশা হিসেব করে দেখা যায়, তাদের গর্ভকাল চার মাস। নভেম্বর মাসে তারা গর্ভবতী হয়েছে। একই সময়ে এই চারটি অপ্রাপ্ত নাবালিকা স্কুল বালিকার এক সঙ্গে গর্ভবতী হওয়ার ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।

প্রকাশ থাকে যে, উক্ত নাসিরনগর উপজেলায় গত নভেম্বর মাসে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ণ সংঘটিত হয়েছিল। এই পাঁচটি মেয়ে সে সময়ে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক ধর্ষিত হতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহল সন্দেহ করছে। গ্রামের নাম, দুর্গাপাশা।

ফোন আবার বেজে উঠল।

--খবরটা পড়েছ?

--পড়েছি। কিন্তু আমার কাছে একটু সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। দুর্গাপাশা নামে কোনো গ্রাম নেই নাসিরনগর উপজেলায়।

-- ছিল। এখন নেই। ১৯৭৫ সালের ১০ নভেম্বরে সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে লেখা আছে-- মহামান্য রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের অনুমোদনক্রমে নাসিরনগর থানার হরিপুর ইউনিয়নস্থ ২৭৫--২৭৯ মৌজাধীন দুর্গাপাশা গ্রামের নাম-- ফাতেমানগর করা হলো। এ আদেশ দেশের উপপ্রধান সামরিক শাসকের অনুরোধক্রমে করা হয়েছে। সরকারি নথিপত্রে ফাতেমানগর ব্যবহৃত নানটি ব্যবহার করা হলেও স্থানীয় বাসিন্দারা গ্রামটিকে দুর্গাপাশা বলে থাকে। ডয়েচে ভেলের যে সাংবাদিক ঐ গ্রামে গিয়েছিলেন তিনি সরকারি নথিপত্র দেখেননি মনে হয়। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলার কারণে ফাতেমনগরের বদলে দুর্গাপুর নামটি পেয়েছেন।

মাথা নাড়লেন সিভিল সার্জন। কথায় যুক্তি আছে। তিনি এবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরকারি তথ্যফাইলটি বের করলেন। সেখানে নাসিরনগর উপজেলার ফাতেমনগর গ্রামের একনজরে প্রদত্ত তথ্যে চোখ রাখলেন। পড়ে বললেন, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু ফাইল বলছে-- ঐ ফাতেমানগর গ্রামে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্পাদায়ের লোক নেই। সেক্ষেত্রে ঐ গ্রামের সব মেয়ে মুসলমান। সেদিন নাসিরনগরে বিভিন্ন গ্রামে সংখ্যালঘুদের পাড়ায় আক্রমণ হলেও ফাতেমানগর গ্রামে আক্রমণ ঘটেনি। তাহলে এই পাঁচটি মুসলমান নাবালিকা মেয়ে ধর্ষিত হলো কী করে?

--ইয়েস। ইয়েস। প্রশ্নটা এখানেই। সরেজমিন ইনকোয়ারি লাগাও। নো লেট। বি রেডি। বাই দি ওয়ে, মনে রাখবে, গত নভেম্বরে নাসিরনগরে কোনো সংখ্যালঘু নিপীড়ন ঘটেনি। সেখানে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও সরকারের তড়িৎ তৎপরতায় তার বিস্তার ঘটতে পারেনি। এলাকায় শান্তি শৃঙখলা যাথারীতি বিরাজ করছে। নো লুটপাট। নো অগ্নি সংযোগ। নো মারপিট। নো হত্যা। তবে--



--তবে কিছু মিডিয়া আর বিরোধী দিল কিছু হৈ চৈ করেছিল। প্রমাণ করতে পারেনি। তারা থেমে গেছে। এটাই সরকারি ভাষ্য।

সিভিল সার্জন কী জানি কেনো হুট করে জিজ্ঞেস করে বসলেন, আর ধর্ষণ?

-- কোনো ধর্ষণ হয়নি। ফাইনাল। ফুল স্টপ।



৫.

উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার প্রতিবেদন--

বিষয় :পাঁচজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক স্কুলছাত্রীর ধর্ষিত হওয়া বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন।

সূত্রঃ সিভিল সার্জন মহোদয়ের দূরালাপনি নির্দেশনা।

মহাত্মন

উপর্যুক্ত বিষয় ও সূত্রের আলোকে অদ্য সকাল দশ ঘটিকায় নাসিরাবাদ উপজেলাস্থ ফাতেমানগর যাহা পূর্বে দুর্গাপাশা গ্নামাঙ্কিত ছিল, গ্রামে উপস্থিত হই। সেখানে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বর, স্থানীয় পাঞ্জেগানা মসজিদের ইমাম ও চৌকিদারের সঙ্গে কথা বলি। তাহারা জানান যে, এ গ্রামে কোনো বালিকা বিদ্যালয় নাই। একটি প্রাইমারি বিদ্যালয় থাকিলেও এ গ্রামের কোনো মেয়ে সেই স্কুলে গমন করে না। কেহ কেহ পার্শবর্তী আব্দুল্লাহপুর আশেকে রসুল ফাজিল মাদ্রাসায় পড়িতে যায়। তাহাদের কেহই ক্লাশ ফোর বা ফাইভে যাইবার উপযুক্ত নয়। কেহ কেহ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে যায়। তাহাদের বয়স যথাক্রমে ছয় ও সাত বৎসর। তৃতীর শ্রেণীতে যাওয়ার আগেই বালিকাদের বাড়ির বাহিরে লেখাপড়া করার কোনো প্রচলন এ গ্রামে নাই। ফলে এই গ্রামে পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়িবার উপযুক্ত মেয়েরা বাড়িতে থাকিয়া পর্দা রক্ষা করিয়া গৃহকর্ম করিয়া থাকে বলিয়া তাহারা জানান।

তাহাদের মারফতে আরো জানা যায় যে, এই গ্রামে অমুসলিম কোনো পরিবার নেই। একঘর নাপিত থাকিলেও তাহাদের কোনো কন্যাসন্তান নাই।

ইহাতে প্রতীয়মান হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ রহিয়াছে যে, উক্ত ফাতেমানগর ওরফে দুর্গাপাশা গ্রামের পাঁচজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক স্কুল ছাত্রীর ধর্ষিত হইবার খবরটি সত্যি নহে।

ইহা আপনার সদয় অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরিত হইল।



এই রিপোর্ট পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই মহাত্মন ফোন করলেন সিভিল সার্জনকে। খুব উত্তেজিত হয়ে তাকে বললেন, এটা কী পাঠিয়েছ?

-- কেনো স্যার। পাঁচটি অপ্রাপ্তবয়স্ক স্কুলবালিকার গর্ভবর্তী হওয়ার রিপোর্ট। সরেজমিন তদন্ত।

এই রিপোর্ট পড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খেপে অস্থির। তিনি জানতে চেয়েছেন, এইটা স্বাস্থ্য বিভাগের রিপোর্ট মনে হয় না। মনে হয় প্রশাসন বিভাগের রিপোর্ট। স্বাস্থ্য বিভাগের রিপোর্ট হলে প্রেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্ট থাকত। সেইটা নাই। অথচ ডয়েচে ভেলের সেই সাংবাদিক নিশ্চিত করেই দাবী করেছেন, তাদের কাছে মেয়ে পাঁচটির প্রেগনেন্সি টেস্টের পাকা রিপোর্ট আছে। সাংবাদিকরা যদি প্রেগনেন্সির টেস্ট করতে পারে, তাইলে তোমরা স্বাস্থ্য বিভাগ করছ কি?

-- তাইলে কী করব আমরা?

--কী করবা মানে? করবা প্রেগনেন্সি টেস্ট। টেস্ট করে রিপোর্ট দাও যে ঐ গ্রামে প্রেগন্যান্ট কেউ নেই। এটা মিথ্যে রিপোর্ট। সরকারের বিরুদ্ধে একটা অপপ্রচার মাত্র। নিজে যাও। কারো উপর নির্ভর করো না। বিষয়টা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের।

পরদিন লোকজন নিয়ে সিভিল সার্জন ফাতেমানগর ওরফে দুর্গাপুর গ্রামে চলে গেলেন। গ্রামটির এক পাশ দিয়ে একটি নদী চলে গিয়েছে। এখন ঠিক নদী বলা যায় না। খালের মতো হয়ে পড়েছে। মার্চ মাস। বাতাস গরম। রবিশস্য ফলেছে। মাদ্রাসায় তিনি তদন্ত ক্যাম্প বসালেন।

মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল খুব করিৎকর্মা ল্যক। তাদেরকে যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করলেন। এর মধ্যে জানালেন এ গ্রামে কিছু ঘটলে কাকপক্ষীটি জানার আগেই তিনি জেনে যান। কিন্তু ধর্ষণজনিত কারণে পাঁচটি মেয়ের গর্ভবতী হওয়ার খবর তিনি আদৌ জানেন না। তার মানে ঘটনা ঘটেনি। ঘটলে জানতেন। গ্রামে মহিলারা ফিমেল সমস্যা নিয়ে তার তেসরা বিবির কাছে পরামর্শ নেয়। এ রকম কেউ বিবির তার কাছে গত চার মাসে আসেনি।

সিভিল সার্জন তার বিবির সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। শুনে প্রিন্সিপাল মাথা নাড়লেন। বললেন, তৌবা তৌবা। সিভিল সার্জন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হওয়া সত্বেও বিবিরা তার সামনে আসতে পারেন না। তাদের পর্দা নষ্ট হবে।

সিভিল সার্জন তাকে অনুরোধ করলেন, গ্রামের সকল অবিবাহিত মেয়েদেরকে জড়ো করার জন্য। শুনে প্রিন্সিপাল খুব ব্যথিতভাবে জানালেন, সেটা আরো সম্ভব নয়। এমন কি মেয়ে শিশুদেরকেও পরপুরুষদের সামনে আনার রেওয়াজ নেই এ গ্রামে।

কিন্তু সরকারের নির্দেশনা অনুসারে তিনি প্রিন্সিপালের কথার উপরে ফিরে যেতে পারেন না। তিনি গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। বাড়িতে বাড়িতে পুরুষ মানুষ পেলেন। কিন্তু স্ত্রীলোকদের সাক্ষাৎ পেলেন না। তাদের কোনো সাড়া শব্দ শোনা গেল না। পুরুষ মানুষরা প্রিন্সিপালের প্রতিধ্বনিই করল। নাউজুবিল্লাহ উচ্চারণ করে বলল, এ গ্রামে জেনার কোনো ঘটনা নেই। কোনো ধর্ষণ বা অবিয়েতো মেয়েদের কেউ গর্ভবতী হলে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলার বিধান তারা অনুসরণ করবে। এ ব্যাপারে কোনো মাপ নেই।

তিনি তবুও প্রেগনেন্সি টেস্টের কথাটা পাড়তে গেলে লোকজন তার মুখের সামনেই দরোজা বন্ধ করে দিল। বলল, টেস্ট করে মেয়েদের গুপ্ত ব্যাপারগুলো অন্যকে জানানোর মতো গুনাহর কাজ তারা করতে পারে না।

সেদিন ফাতেমানগর ওরফে দুর্গাপাশা গ্রামে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু, বালিকা, কিশোর, তরুণী, বয়স্কা, অথবা বিবাহিতা বা অবিবাহিতা কোনো নারীর দেখা পাওয়া গেল না। কোনো প্রেগন্যান্ট টেস্ট করার সুযোগ হলো না।

বিকেল নাগাত ফোন এলো।

--রিপোর্ট পাঠাতে দেরি হচ্ছে কেনো?

--রিপোর্ট রেডি হয়নি।

-- কেনো হয়নি?

-- কোনো মহিলার সাক্ষাৎকার নেওয়া যায়নি।

-- দরকার নেই। প্রেগন্যান্ট টেস্ট করেছ?

-- তারা তো সামনেই আসেনি তো টেস্ট কী করে করব!

-- ওকে। তুমি রিপোর্ট পাঠিয়ে দাও। দেরি করো না। লিখে দাও, প্রেগনেন্সি টেস্ট করা হয়েছে। রেজাল্ট নেভেটিভ। কেউ প্রেগন্যান্ট হয়নি। রিপোর্ট নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কাল সংবাদ সম্মেলন করবেন।

-- কিন্তু সত্যি সত্যি টেস্ট করে যদি পজিটিভ পাওয়া যায়?

--পাওয়া যাবে না। কাল এলিট ফোর্স ঠিক করে ফেলবে।

৬.

খুব ভোর ভোর সিভিল সার্জন বিছানা ছেড়ে উঠলেন। দেখতে পেলেন মঞ্জে আরা বেগম ল্যাপটপের সামনে বসে আছে। তার মুখ গম্ভীর। চোখ দুটো লাল। খুব মৃদু লয়ে মোহাম্মদ রফি বৈজু বাওরা সিনেমার গান করছেন। ভগবান, তু রাখনেওয়ালে--

সিভিল সার্জনের টেবিলের উপরে রিপোর্ট লেখার কাগজ পড়ে আছে। কলমের কভার খোলা হয়নি। ফোনটা বন্ধ করে রেখেছেন। এই ভোরে কোনো গুরু গম্ভীর কণ্ঠ শুনতে চান না।

জানালার কাছে এসে দেখলেন, বাইরে গেটের কাছে ডাঃ মাহমুদ দাঁড়িয়ে আছে। চুল উস্কো খুস্কো। তাকিয়ে আছে মঞ্জে আরার জানালার দিকে। দেখে আজ ভোরে তার রাগ হলো। মাহমুদ কি তবে সারারাত গেটের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে! দাঁড়িয়ে আছে তার স্ত্রীর জন্য! ব্যাপারটা ভব্যতার বাইরে চলে যাচ্ছে।

তিনি দ্রুত নিচে নেমে এলেন। গেট খুলে মাহমুদের কাছে এগিয়ে গেলেন। মনে করলেন কষে একটা চড় মারবেন তার গালে। হাত তুলতে যাবেন, ঠিক এ সময় মাহমুদ ফস করে বলে উঠল, স্যার, অফিসে চলেন।

তিনি বিরক্ত মুখে জবাব দিলেন, অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। যা কথাবার্তা এখানেই সেরে নেই।

কথাটি শেষ করার আগেই মাহমুদ বললেন, স্যার, দেরি করবেন না। অফিসে এলিট ফোর্স অপেক্ষা করছে। আপনাকে তারা চাইছে।

এলিট ফোর্সের কথা শুনে সিভিল সার্জনের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। তিনি ভুলে গেলেন ডাঃ মাহমুদকে চড় মারবেন বলে ঠিক করেছিলেন। তিনি বলে উঠলেন, রিপোর্ট তো লিখিনি!

-- রিপোর্ট নয় স্যার। এলিট ফোর্স আপনাকে চাইছে।

শুনে সিভিল সার্জনের গায়ে কাঁটা দিল। এলিট ফোর্সের চাওয়াটা বিপজ্জনক। তারা যাদেরকে ধরে তারা নাই হয়ে যায়।

অফিসের সামনেই একটি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। তিনি যেতেই দরোজা খুলে গেল। ভেতর থেকে হুকুম হলো-- উঠে পড়ুন।

--তিনি উঠলেন। উঠতে উঠতে ডাঃ মাহমুদের দিকে তাকালেন। বললেন, আপনিও উঠুন।

মাহমুদ উঠবে কি উঠবে না এই নিয়ে দোনামোনা করতেই আবার হুকুম হলো, না। উনি আপনার গাড়ি নিয়ে আসবেন। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

এলিট ফোর্স আসার খবর পেয়ে গ্রামের মাদ্রাসার ইমাম, ইউপি মেম্বার, চেয়ারম্যানও হাজির হয়ে গেল। তারা আগের মতোই গড়গড় করে জানালেন, এ গ্রামে কোনো মেয়ে গর্ভবতী হয়নি। এ গ্রামে কোনো হিন্দু বাস করে না। করলে না হয় রসরাজের ঘটনায় ধর্ষিত হলেও হতে পারত। সরকারকে বিপদে ফেলতেই এ ধরনের অপপ্রচার হচ্ছে।

এলিট ফোর্স সেকথা বিশ্বাস করলেও সেটা টেস্ট করে তারা নিশ্চিত হতে চায়। তাদেরকে টেস্ট করার হুকুম দিল।

এ ব্যাপারে ইমাম, মেম্বর, চেয়ারম্যান একটু ইতস্তত করলে এলিট ফোর্সের কর্নেল কোমর থেকে পিস্তল বের করে দুটো ফাঁকা আওয়াজ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সবাই মেয়েদেরকে নিয়ে আসার জন্য বাড়ির দিকে ছুটে গেল। এর মধ্যে সিভিল সার্জনের গাড়ি এসে গেছে। ডাঃ মাহমুদ মাদ্রাসায় টেস্টিং কিট সাজিয়ে বসলেন।

কিন্তু গ্রামের ঘরবাড়ি থেকে কোনো মহিলাকেই বের হতে দেখা গেল না। এমন কি পুরুষদেরও যেন হাওয়া হয়ে গেছে।

ঘণ্টাখানেক পরে এলিট ফোর্সের কর্নেলের হুকুমে স্থানীয় চৌকিদার স্থানীয় মেম্বরকে তার বাড়ির ভেতর থেকে খুঁজে নিয়ে এলো। খুব আমতা আমতা করে মেম্বর কর্নেলকে জানাল, বাড়ির মহিলারা বাইরে আসবে না। তারা বলেছে, এলিট ফোর্সের সামানে আসতে তাদের ডর করে।

কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, কোনো ডর নেই। সিভিল সার্জন সাহেব টেস্ট করে সেই পাঁচজন মেয়েকে খুঁজে বের করবেন। তাদেরকে আমরা নিয়ে যাব। আর কিছু নয়।

-- নিয়ে কী করবেন স্যার?

-- নিয়ে এই গ্রামকে প্রেগন্যান্ট শূন্য করে দেবো।

-- তাদেরকে ক্রস ফায়ার করে দেবেন স্যার?

এই কথার কোনো উত্তর দিলেন না কর্নেল। তিনি পিস্তলটা হাতে নিলেন। তারপর মেম্বরের কপাল বরাবর নলটা রেখে গুলি করে দিলেন। দীর্ঘ চিৎকার করে তার শরীরটা মাটিতে পড়ে গেল। দাপাতে দাপাতে মরে গেল।

সেই চিৎকার গ্রামের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে গেল। পাখিরা কলরব করতে করতে উড়ে গেল। কুকুরগুলো একটু দূরে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল।

আর কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রামের মেয়ে শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মহিলারা ঘরবাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। কর্নেলের নির্দেশে আট থেকে সতেরো বছরের মেয়েদেরকে আলাদা করা হলো।। তারা খুব জড়ো সড়ো হয়ে দাঁড়াল। কর্নেল তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কে কে প্রেগন্যান্ট?

তারা কেউ কথা বলল না।

কর্নেল তখন বেশ গম্ভীর স্বরে আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কি কেউ প্রেগন্যান্ট নাই? স্বীকার না করলে তোমাদেরকে ক্রস ফায়ার করা হবে।

শুনে মেয়েরা হাউমাউ করে কান্না শুরু করল। তখন গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ বয়স্ক মহিলা সোনাবুড়ি লাঠি ভর দিয়ে এগিয়ে এসে বললেন, আছে বাবা। আমি বলছি।

সেদিন মালোপাড়ায় আগুণ দেওয়ার পরে হিন্দু মালোদের মেয়েরা স্কুল ঘরে লুকিয়ে ছিল। সে স্কুলে এ গ্রামের কয়েকটি মুসলিম মেয়ে গোপনে পড়ে। তারা মালোদের সেই মেয়েদেরকে নিরাপদে নদী পার করে নিরাপদ স্থানে পাঠানোর জন্য রাতের অন্ধকারে যায়। তাদের গায়ে নিজেদের বোরকা পরিয়ে হিন্দু মেয়েদেরকে নদী পার করে দেয়।

এর কিছুক্ষণ পরে এই মুসলিম মেয়েদেরকে মালো মেয়ে মনে করে দুর্বৃত্তরা রেপ করে।

বুড়ি যখন এই কথা বলছিল, তখন চারিদিক শুনশান নীরব হয়ে গেল। একটা শীতল হাওয়া বইতে শুরু করল। সবার শীত শীত বোধ হতে লাগল। যে কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করছিল সেও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কী করবে বুঝতে পারছে না। কান দুটি খাড়া হয়ে আছে।

কর্নেল ফস করে সিগারেট ধরালেন। লম্বা করে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর সিভিল সার্জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, প্রেগন্যান্ট কিট রেডি করেন। এক্ষুণি সেই মেয়েদের টেস্ট করা হবে।

শুনে অল্প বয়েসী মেয়েগুলো কাঁপতে শুরু করল। সেটা বুঝে কর্নেল হেসে বললেন, ভয় পেয়ো না। সেই পাঁচজন মেয়ে এখানে চলে এসো। বাকিরা চলে যাও।

কেউই এগিয়ে এলো না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন কেউ এলো না তখন কর্নেল অই মেয়েদের সবাইকে আলাদা একটা লাইনে দাঁড় করালেন। তাদের দিকে রাইফেল তাক করে বললেন, সেই পাঁচজন না এলে তোমাদের সবাইকেই গুলি করে মারব।

বলে তিনি রেডি ওয়ান টু থ্রি গুণতে শুরু করলেন।

মেয়েগুলোর কাঁপাকাপি এবারে থেমে গেল। তারা এবার স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল রাইফেলের দিকে। কর্নেলের মুখ কঠিন হয়ে উঠেছে। যখন গোণাটা 9 থেকে দশে যাবে ঠিক তখনি একজন গ্রাম্য বধু এগিয়ে এলেন। বললেন, সেদিন মালোদের মেয়েদরকে বাঁচানোর জন্য সে রাতে ওদের সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম। আমাকেও ওরা রেপ করেছিল। আমিও গর্ভবতী । আমারে টেস্ট করেন।

একজন নার্স মাদ্রাসার একটি রুমে দরোজা বন্ধ করে টেস্ট করল। প্রেগন্যান্সি পজিটিভ পাওয়া গেল। তারপর গ্রামের একজন মধ্যবয়সী এলেন। তিনিও দাবী করলেন, সেদিন মালো পাড়ায় তিনিও গিয়েছিলেন। তিনিও রেপড হয়েছিলেন।

তারও টেস্ট রেজাল্ট পজিটিভ এলো। এরপর একজন বিধবা মহিলা এলেন। ষাটোর্ধ বয়স। তিনিও পজিটিভ।

দেখে কর্নেল নার্সকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, টেস্ট কিট ঠিক আছে কিনা।

গ্রামের একজন সাত মাসের গর্ভবতী নারীকে টেস্ট করে নার্স দেখালেন, পজিটিভ । কর্নেলের নির্দেশে এলিট ফোর্সের একজন পুরুষ সদস্যের ইউরিন টেস্ট করা হলো। সেটার রেজাল্টও নেগেটিভ এলো।

গ্রামের সব মহিলাই একে একে টেস্ট করতে এলো। সবাই পজিটিভ ।

গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক সোনাবরু বেওয়াও এসো পড়লেন লাঠি ভর করে। চামড়া কুচকে গিয়েছে। বয়সের গাছপাথর নেই। কেউ বলে একশো পাঁচ। কেউ বলে দেড়শ।

তাকে দেখে কর্নেল বিরক্ত হলেন। সোনাবরু বেওয়া বললেন, বাবারে, সেদিন মালো পাড়ার মাইয়াগুলোরে নদী পার করে দেওয়ার পরে যখন ব্যাটাগুলান কচি কচি মাইয়াগুলোনরে ধরে ধরে নষ্ট করছিল তখন কয়েকটা মাইয়া পলাইয়া আমার কাছে আইছিল। তাদেরকে ধাওয়া করে কয়েকটা ব্যাডা আইসা অগো ধরল। তারা আমারেও রেহাই দেয় নাই। বলে বুড়ি কাঁদতে টেস্ট রুমের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। তার কান্না দেখে উপস্থিত সবাই কাঁদতে লাগল।

নার্স এসে ঘোষণা করল, সোনাবরু বেওয়াও প্রেগন্যান্ট।

কর্নেলের এসিস্ট্যান্ট বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার গ্রামের সব মহিলাকেই ক্রস ফায়ারে দিতে হবে?

কর্নেল কিছু একটা বলতে যাবেন এ সময়ে হাসপাতালের একটি গাড়ি এসে সেখানে থামল। গাড়ি থেকে দ্রুত বেগে নামলেন মঞ্জে আরা বেগম। ছুটে এসে সিভিল সার্জনকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, জানো। আমি মা হতে চলেছি।

নার্স তারও টেস্ট করলেন।

রেজাল্ট শুনে সিভিল সার্জন সবার সামনে স্ত্রীকে ধরে ধেই ধেই করে নেচে উঠলেন।

সেটা দেখে গ্রামের মেয়েরাও মেতে উঠল। তারাও তাদেরকে ঘিরে ঘিরে নাচতে লাগল। গাইতে লাগল।

Post a Comment

0 Comments