কুলদা রায়ের গল্প নিয়ে আলোচনা : ভোরের শিশিরকণার আখ্যান

 

দীপেন ভট্টাচার্য

কুলদা রায় একটি অসামান্য গল্প লিখেছেন, নাম দিয়েছেন শবনম বা হিমিকালিপি। শবনম নাকি ভোরের শিশির, হিমিকাও হিমে জমে জল হয়েছে - ঊষার টলটলে শিশিরকণা। সূর্যের আলোয় সবদিক উদ্ভাসিত হবার আগেই যেমন সেই হিমবিন্দু হারিয়ে যায়, এই গল্পের শবনম আর হিমিকাও তেমনি ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে, পাঠক হারিয়ে যায় বাস্তব ও অধিবাস্তবের এক প্রহেলিকার মাঝে।


এই লেখাটি হিমিকালিপির একটা রিভিউ করার প্রচেষ্টা। কিন্তু এটি আসলে নিতান্তই কিছু ব্যক্তিগত খাপছাড়া চিন্তার সমষ্টি। আমি নিজে কোন গল্প পড়তে বা সিনেমা দেখতে চাইলে সেটির কোন আলোচনা পড়ি না। সিনেমা দেখতে হলে আমি প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত হতে চাই সাদা মনে। আমি পাঠককে বলব এই লেখাটি কুলদা রায়ের মূল লেখা পড়ার আগে অবশ্যই পড়বেন না, কারণ তাঁর কাহিনীকে এখানে আমাকে বর্ণনা করতে হয়েছে, কারণ সেই বর্ণনা ব্যতিরেকে এই আলোচনা সম্ভব নয়। আমি সাহিত্য সমালোচক নই, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে এই গল্পটি একটি বলিষ্ঠ লেখা হিসেবে স্থান পাবে এই আমার বিশ্বাস।

সৈয়দ সালামাতউল্লাহ হচ্ছেন হুজুর স্যার। আমরা প্রথমে জানি তিনি অকৃতদার, হুজুর স্যার অঙ্ক আর আরবী পড়াতেন দক্ষিণ বঙ্গের এক স্কুলে। তিনি থাকতেন চিলেকোঠার বাড়িতে। চিলেকোঠায় ঊণিশ শতকে থাকতেন ইংরেজ গ্রেগরি চিলম্যান, তার নামেই বাড়িটির নাম হয়েছে। হুজুর স্যারের ছাত্র ছিল আলমগীর। আলমগীর ভাল ছবি আঁকতে পারত। সেই কবে ভোলা মনের আলমগীরকে ছবি আঁকতে দেখে তিনি বলেছিলেন --

হলুদ বনে কলুদ ফুল
তারার নামে টগর ফুল ।

তিনিই আলমগীরকে বলেছিলেন, যেই কাজটি করে তুমি শান্তি পাও সেই কাজটি করার মধ্যে কোন কসুর নাই। তারপর হুজুর স্যার ইন্তেকাল করলেন, ওনার কবর হল চিলেকোঠা বাড়ির সাথে। আলমগীর মাঝে মাঝেই হুজুর স্যারের কবরে সালাম দিতে যেত। বছর তিনেক বাদে স্কুলে নতুন শিক্ষক আসলেন, আনিস স্যার এসে উঠলেন চিলেকোঠার বাড়িতে, তার সাথে বৌ গুলবদন বানু, আনিস স্যার তাঁকে ডাকতেন হিমিকা বলে।

কিন্তু আনিস স্যার যে বিবাহিত সেটা লেখক প্রথমেই আমাদের জানতে দেন নি। লেখক গল্পে নিয়ে আসলেন শাহনাজ সুলতানা এনি নামে এক মেয়েকে যে কিনা আনিস স্যারের গাওয়া গানের দুটি কলিতে মশগুল হয়ে ছিল

শিব ঠাকুরের গলায় দোলে বৈঁচি ফুলের মালিকা
গলায় দড়ি কে পরালে বল না গৌরী বালিকা ।

আলমগীর এনিকে খুঁজে দিল বৈঁচির বদলে কুঁচ ফল। সেই এনি কুঁচ ফলের মালা গেঁথে নিয়ে গিয়েছিল আনিস স্যারকে দিতে, সেখানেই দূর থেকে দেখল হিমিকাকে, তার আর মালা দেয়া হল না। আহারে।

এদিকে হিমিকা মীর্জা নামের কারুর ডাকে-না-ফেলা কিছু চিঠি চিলেকোঠার বাড়িতে আবিষ্কার করেছে, চিঠিগুলো লেখা তাঁর স্ত্রী টগরকে। কবে লেখা হয়েছে এই চিঠিগুলো আমরা জানি না। মীর্জা কেউ তাও আমরা জানি না, চিঠি গুলো টগরকে লিখলেও মনে হয় নিজের কষ্ট প্রকাশ করার জন্যই মীর্জা এগুল্ল লিখেছিলেন। আমাদের ধীরে ধীরে মনে হয় মীর্জাই বোধহয় হুজুর স্যার যদিও সবাই জানত হুজুর স্যার অকৃতদার ছিলেন।

সেই চিঠিগুলোতে প্রকাশ হল টগরের সঙ্গে মীর্জার বিয়ে হয়েছে কিন্তু সংসার হয় নি, মীর্জার পিতা মীর্জাকে নিষেধ করেছেন নিজের পায়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত সংসার না করতে। কিন্তু একদিন কোন কাজ উপলক্ষে মীর্জার টগরদের মোহনগঞ্জের বাড়ীতে যাওয়া পড়ল ও টগরের সঙ্গে রাত্রিবাস হল। পিতার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার গ্লানিতে মীর্জা দক্ষিণাঞ্চলে পালিয়ে এল, সেখানে একটা স্কুলে কাজও জুটল। মীর্জার মাঝে টগরকে কাছে না পাওয়ার আকুলতা। ইতিমধ্যে তার ধারণা হল টগরের গর্ভ সঞ্চার হয়েছে। মীর্জা লিখলেন কন্যাসন্তান হলে তার নাম রাখতে শবনম। মীর্জা হুজুর স্যার হতে পারে, কিন্তু টগর কে? মনে পড়ে হুজুর স্যার আলমগীরকে ক্লাসে টগর ফুল আঁকতে দেখে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। আলমগীরকেও হিমিকা একটা টগর গাছ আঁকতে বলেছিল, আলমগীর এঁকে দিয়ে চলে গেলে হিমিকা আবিষ্কার করল একটা জীবন্ত টগর গাছ তার জানালার নিচে দাঁড়িয়ে আছে।

এদিকে হিমিকা মা হল, সে আনিস স্যারকে বলল মেয়ের নাম হবে শবনম। আলমগীর তাদের বাড়ী এলে হিমিকা তাকে বলে মুনিয়া পাখী আঁকতে, মাছ আঁকতে। আলমগীর যাই আঁকে তাই জীবন্ত হয়ে যায়। আনিস স্যার সন্দেহ করেন শবনম তাঁর মেয়ে নয়, হয়তো আলমগীরের। এর পরেই তিনি মা আর মেয়েকে রেখে এলেন বাপের বাড়ী বগুড়ার পত্নীতলায় কয়েক দিনের জন্য।

তারপর? তারপর তাঁর স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে গেলে দেখা গেল শ্বশুরবাড়ীর কেউ আনিস স্যারকে চিনছে না, তার বলছে তাদের মেয়ের নাম গুলবদন বানু, বিয়ে হয়েছে অন্য জায়গায়, এখন আছে সেইখানে। আনিস স্যার দেখলেন তাদের বাড়ীতে রয়েছে সেই মুনিয়া পাখী, হিমিকা বলেছিল আলমগীর যা এঁকে দেয় তাই জীবন্ত হয়ে ওঠে, আনিস স্যার তখন সেটা বিশ্বাস করেন নি।

আনিস স্যার ফিরে এলেন চিলেকোঠার বাড়ীতে, কানের কাছে শুধু শোনেন এক শিশুর কান্না, এখন তার মনে হয় শুধুমাত্র আলমগীরই পারে সেই শিশুকে জীবন্ত করতে। আলমগীরের খোঁজে আনিস স্যার এলেন গহরডাঙ্গার মাদ্রাসায়। মাদ্রাসার বড় হুজুর নাকি এক পরীর ডানা কেটে দিয়েছিলেন তার সঙ্গে বেয়াদপী করার জন্য। মাদ্রাসা থেকে বিতাড়িতত আলমগীরের খোঁজে আনিস স্যার উপস্থিত হলেন মধুমতীর তীরে রূপাজীবা পরীরানির ছাপড়াতে। পরীরানির কাঁধে একটা বড় দাগ, যেন সেখানে কোন বড় ডানা ছিল এক কালে, কেউ কেটে দিয়েছে। পরীরানির শিশুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। আনিস স্যার জিজ্ঞেস করেন, তোমার শিশুর নাম কি? পরীরানি বলে, শবনম।

এই হল গল্পের শেষ। টগর ফুলের গল্প শেষ হল ভোরের শিশিরকণায় - শবনমে। গল্প শেষ করে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হয়। চিন্তা ও যুক্তিকে মূহ্যমান করে দেয় এই গল্প। আমি কি এই গল্পটিকে বুঝেছি? হয়তো গল্পকার যা বলতে চেয়েছিলেন সেটা বুঝি নি, কিন্তু যে গল্প পাঠককে তার interpretationয়ের স্বাধীনতা দেয় সেটি নিসন্দেহে সার্থক - আমার খাতায়।

বাংলার প্রকৃতি, লোক ও মাদ্রাসা সংস্কৃতির ভাষা ও বোধ ব্যবহারে কুলদা রায়ের এই লেখা অনন্য। এই গল্পটির মাঝে লেখক ১৯৪৭য়ের দেশ ভাগোত্তর বাংলাদেশের স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থারও এক ধরণের সংকট হয়েছিল সেটা অস্ফূট একটা প্রেক্ষাপটে থেকেও আমাদের চোখে ধরা পড়েছে। তার সাথে রয়েছে ছোট শহরের একটা আমেজ যা কিনা এনির সেই শিবগাথা গাইবার আকুলতায় বোঝা যায়। আর আছে জীবন ও মৃত্যুর মাঝের সীমারেখার বিলোপ যেখানে গ্রেগরি চিলম্যানের কবর, হুজুর স্যারের কবর, মাদ্রাসার বড় হুজুরের পরীরানির ডানা কেটে দেয়া এই সবকিছুই আমাদের মাঝে একটা অবোধ্য অনুভূতির সৃষ্টি করে।

এমন কি হতে পারে এই গল্পটি আলমগীর সৃষ্টি করেছে তার পেন্সিলের আঁকায়। টগর ফুল থেকে টগর গাছ, মীর্জার স্ত্রী টগর, মীর্জার কল্পনার মেয়ে শবনম, আনিস স্যারের স্ত্রী হিমিকা, তাদের মেয়ে শবনম, আর পরীরানির মেয়ে শবনম। সব ঘেঁটে একাকার। সেই চিলেকোঠার বাড়িতে আলমগীর যেমন সৃষ্টি করেছে টগর গাছ, মুনিয়া পাখী, তেমন ভাবেই রূপ দিয়েছে হিমিকাকে, মীর্জার না-পোস্ট করা চিঠির বান্ডিলকে, মীর্জার অতৃপ্ত প্রেমকে। আনিস স্যার গীতগোবিন্দের জয়দেবকে নিয়ে গবেষণায় ব্যস্ত ছিলেন, হিমিকা আর শবনম যে তার জীবনে বাস্তব ছিল না বুঝতে পারেন নি, চিলেকোঠার বাড়িতে আনিস স্যার হয়ে উঠেছিলেন হুজুর স্যার, একই ভাবে তিনি মীর্জার ট্রাজেডিকেই অনুসরণ করেছেন।

হুজুর স্যার ও আনিস স্যার যেমন একটি অপরিপূর্ণ আত্মার অংশীদার, টগর, হিমিকা আর পরীরানী একটি অলভ্য নিহারীকার প্রতিভূ যা কিনা বর্ণনাতীত, আর অতৃপ্ত আত্মা ও অলভ্য স্ফটিকের মিলনে যে ফল সেই শিশিরবিন্দু শবনম থাকে আমাদের ধরছোঁয়ার বাইরে। শিশির হল প্রকৃতির এক সরল অথচ অপরূপ সৃষ্টি। সেই সৃষ্টি যেমন সহজ তেমনই কঠিন। এত সব বাস্তব, অধিবাস্তবের বেড়া পেড়িয়ে, জটিল ঘটনার কুহেলিকার বাতাবরণকে ডিঙিয়ে লেখক আমাদের উপহার দিয়েছেন সেই সহজ সরল বস্তুটিকে। তিনি এক জায়গায় লিখেছেন "ফুলের পরিণতি ফল, সুন্দরের পরিণতি মঙ্গল।" তাই আমি এই গল্পের শেষ লাইনটি ভুলতে পারি না যখন "পরীরানী একটু হেসে বলল, শবনম।"

কুলদা রায়ের মূল গল্পটি পড়তে ক্লিক করুন--
শবনম অথবা হিমিকালিপি

Post a Comment

0 Comments