কুলদা রায় আমার কাছে আবিষ্কারই। আর যে আন্তরজাল নিয়ে তো উদ্বেগ, সেখানেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া। না, আমি তাকে খুঁজিনি। আন্তরজাল ফেসবুকে একদিন একটি পোস্ট দেখি। হাংরি জেনারেশনের লেখকদের নিয়ে সেখানে কিছু ভুল কথা, আন্দাজ কথা লিখেছিলেন কুলদা রায় নামে একজন। আমি তখন ফেসবুকে নতুন। তাও কুলদার লেখার নিচে নিজের মতামত জানিয়েছিলাম। সেই থেকে মতের নিচে মত, এই রকম চলছিল।
কিন্তু এরপর আমি এক সন্ধ্যায় কুলদা রায়ের একটি বড় লেখা পড়ি তাঁর গ্রাম, আত্মীয়স্বজন, ঠাকুমা, ঠাকুরদা, পিসিদের নিয়ে। কৃষিজীবী এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান তিনি।
বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের মানুষ, থাকেন আমেরিকায়। আর সেই দূর পরবাসে বসে নিজ দেশের কথা ফেসবুকে লিখে মাতৃভূমি তর্পণ করেন। কিন্তু কেমন সেই তর্পণ? এমন অনুভূতিময় কুলদা রায়ের লেখা, পূর্ববঙ্গের কথা এমন ভাবে লেখেন, তা পড়ে একদিন আমি তাঁকে বললাম, গল্প লেখেন না কেন, এমন বাংলাদেশ আমি গল্পে পড়তে চাই। কুলদা রায় তার আগে সেই ভাবে গল্প লেখেন নি। আন্তরজালে তিনি নিজের অনুভূতিময় কথা যা লিখতেন, তা বাছাই করে ‘গুরুচণ্ডালী’ গ্রুপ্রের ইপ্সিতা পাল, সুমেরু মুখোপাধ্যায় এরা একটি পুস্তিকা গত বছর বইমেলায় প্রকাশ করেছিল, সেটা ‘কাঠপাতার ঘর’। সেটা কুলদা রায়ের প্রথম গল্পের বই। কিন্তু তা মূলতই ছিল অনুভূতিময় গদ্যে মাতৃতর্পণ। ঠিক গল্প নয়, ফিচার। কিন্তু অসম্ভব সৌন্দর্যময়। ভাষা চিত্ররূপময়। কুলদা বাংলাদশের নদী, প্রান্তর, মাঝি মাল্লা, বাছাড়ি নৌকা, ধান পাট, হাট, বাজার, লাঙল, গরু, ক্ষুধা, মৌলভী স্যার, ধর্মাধর্ম সব জানেন। তিনি তাঁর লেখায় অকপট।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল ছয়। তাঁরা বনগাঁর কাছে রেললাইনের ধারে একটি উদ্বাস্তু শিবিরে ছিলেন। সেইখানেই গাছ পোতা, তুলসি মঞ্চ করা... এক পিসির মেয়ে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে তাঁর লেখা পড়ে আমি তাঁর অনুরাগী। অনুজপ্রতিম আমার এই বন্ধু কুলদা রায়ের পঠন পাঠন অনেক। তিনি ওপারের, কিন্তু এপারের শ্যামল, সিরাজ, দেবেশ রায় থেকে আমাদের সময়ের লেখকদের লেখাও সংগ্রহ করে পড়েছেন ঐ আমেরিকায় বসে।
আমার একটি গর্বের জায়গা আছে, কুলদা রায় আমার কথায় গল্প লিখতে শুরু করেন। বলেছিলাম, আপনি লিখলে আমাদের সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে। তিনি লিখেছিলেন ‘শবনম অথবা হিমিকালিপি’ নামে একটি গল্প। এই বই পড়ে পাঠক বুঝতে পারবেন, আমি ভুল বলিনি। কুলদা রায় গল্প পাঠালেন আমাকে মেইল করে। সেই গল্প আমি অনিষ্টুপ পত্রিকায় দিয়ে আসি। অনুষ্টুপ ছাপে ছ-মাস বাদে। আর ছেপে বেরনোর পর অনুষ্টুপ সম্পাদক অনিল আচার্য কুলদা রায়ের লেখায় তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করে বলেন, এই লেখককে কোথায় পেলেন? কুলদার সেই গল্পটির নাম সুবলসখার বিবাহ বৃত্তান্ত। সেই গল্প ১৯৭৪ এ বাংলাদেশে ভাতের অভাব নিয়ে। আসলে মহাদুর্ভিক্ষ নিয়ে এমন গল্পটি আমাকেও স্তম্ভিত করেছিল। কুলদা তাঁর সমাজ, নমঃশুদ্র সম্প্রদায়কে এমন ভাবে চেনেন, যেমন চেনে জলের মাছ জল, বনের প্রাণী বন।
অভাবের দিনে সুবলসখার বিয়ে। তার বাবা দীননাথ সেই ১৯৫০ সালে আয়ূবশাহী আসার আগে নিরুদ্দেশ যাওয়ার আগে, কিংবা দাঙ্গায় হত হওয়ার আগে একটি বেলগাছ পুতে বউকে বলে গিয়েছিল প্রথম ফল এলে, সুবলের বিয়ে দিতে। তাহলে সব রক্ষে হবে। কৃষ্ণ সব রক্ষা করবেন। এই বিশ্বাসেই সুবলসখার বিয়ে ঠিক হল দূর গাঁয়ে। নৌকার বরযাত্রীর দল বিচিত্র সব মানুষ। সকলেরই যাওয়ার উদ্দেশ্য এই উপলক্ষ্যে ভাত খাওয়া। বরপক্ষের পাওনা দাবী কিছু নেই। সুবলসখার মা বলেছে, বরযাত্রীরদের শুধু দীঘা চালের ভাত খাতি দিলিই হবে, আর সঙ্গে মাছের তরকারী হলে তো আরো ভালো হয়। এই গল্প ভাতের গল্প। কণে পক্ষ কুমড়ো আর একটা শোলমাছ যোগাড় করেছিল, কিন্তু চালের যোগাড় হয়নি। সেই দ্বায়িত্ব মেম্বর হরেনের। সে ফেল করেছে। তাই কাজিয়া বাঁধিয়ে দিয়ে কোনোরকমে বিয়েটা সেরে দিতে পারলেই হয়ে যায়। সুবলসখার ভাই সুদামাসখা এবং অনিল মুহুরির ভাগ্নে রেডিও শচীনকেই বর ভেবে নিয়ে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল সেই অন্ধকার রাতে। আসল বর আসবে পরের নৌকায়। সে কাজ করে মোহন মিয়ার রেশন দোকানে। সেই দোকানে সরকারী চাল আসবে। মাল তুলে রেখে মোহন মিয়া পরের নৌকোয় আসছে সুবলকে নিয়ে। এই গল্পে হত দরিদ্র কণে বাড়িতে গাঁয়ের মানুষও ভাতের লোভে ভীড় করেছিল। আমি এই গল্প যতবার পড়েছি ততবার মাথা নামিয়ে রেখেছি। ওদেশ আমার পিতৃপুরুষের দেশ। আমি আমার পিতৃকুলকে দেখতে পেয়ে চোখের জল ফেলি। মহৎ গল্প। এই গল্প অনুষ্টুপে পড়ার পর দিল্লি থেকে এক চিত্র পরিচালক লেখককে খোঁজ করেন। তারপর কী হয়েছে জানি না। দুর্ভিক্ষের এমন বৃত্তান্ত আমি আগে পড়িনি।
এরপর কুলদা রায় অনুষ্টুপের আমন্ত্রিত লেখক যে কোনো সংখ্যায়। কোমল পুষ্প, গীতাদির বাড়ি যাব, সবই অনুষ্টুপে লেখা আমেরিকা প্রবাসী এই বাংলাদেশের লেখকের। কুলদা এরপর ২০১৪র পুজো সংখ্যা পরিচয় এবং কথা সোপানে লেখেন। কথা সোপানে যে অনন্য সুন্দর গল্প ‘বৃষ্টি চিহ্নিত জল’, সেই শিরোণামেই এই বই। সেই গল্প পড়ে জীবনের প্রতি মায়া বাড়ে। মানুষের প্রতি ভালোবাসা জন্মায়। হতদরিদ্র এক পরিবারে দুই কন্যার গল্প তা। সেই গল্পও বিবাহের গল্প। কুলদা যে বৃত্তান্ত লেখেন, তা যদি পশ্চিম হয়ে আমাদের ভাষায় আসত, আমরা আমাদের মুগ্ধতা জানাতে পারতাম এই বলে যে, ‘বাংলাভাষায় কিছু হয় না। এই দ্যাখো জীবন কোথায় কোথায় নিহিত। জীবন কত সৌন্দর্যময়’।
তাঁর দেশের মানুষকে কুলদা যে ভাবে আঁকেন, তা আমি আগে পড়িনি। কুলদার লেখায় কোমলতা থাকে, গদ্যভাষা চিত্ররূপময়। কুলদা বাস্তব থেকে ফ্যান্টাসিতে চলে যেতে পারেন। আবার ফিরেও আসেন নিজ কৌশলে। কৌশল চিনতে পারি না, কিন্তু মুগ্ধতা আমার বেড়েই চলে। তিনি যে মায়াবাস্তবতায় প্রবেশ করেন, তা আমাদের শেকড়ে। তিনি যে বাংলাদেশের কথা বলেন, তা আমাদের নিজের মাতৃভূমির কথাই। কুলদার গল্প বাংলাদেশের গল্প নয়। সারা পৃথিবীর গল্পই যেন। তিনি বহুদিন দেশছাড়া। দেশের প্রতি ভালোভাসাই তাকে দিয়ে এইসব লেখা লিখিয়ে নেয়। কপোতাক্ষ তীরের মানুষ নন কুলদা রায়, কিন্তু দূর পরবাসে বসে নদী স্রোতের মায়া মন্ত্রধ্বনি শুনতে পান। তাত গল্প যেন মধুকবির সেই কপোতাক্ষ প্রশস্তি...
সত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে
সতত তমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সেই নদী, মধুমতি, কীর্তনখোলা, কচা, পানঘুচি, সন্ধ্যা, সুগন্ধ্যা। সেই সব নদীর কলধ্বনি তিনি টের পান গভীর রাত্রিতে। দেখতে পান গৈলা গ্রাম,গৌরনদী থানা, মোড়েলগঞ্জ, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ। দেখতে পান সরল প্রাণ হিন্দু মুসলমান...আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম...দেখতে পান বনগাঁর পথের ধারে ঝুঁপড়ি বেঁধে থাকা পিসাতো বোনকে। ইটভাটায় কাজ করা পিসাতো বোনের ছেলেটিকে। তার মৃত্যুকে।
জীবন দারিদ্রে দোমড়ানো মোচড়ানো, কিন্তু তার ভিতরেও জীবন অনিঃশেষ। অনিঃশেষ জীবনের কথাই বলেন কুলদা। তাঁর গল্প অখণ্ড বাংলার কথা শুনিয়েছে। পুর্ববঙ্গের পটভূমিতে লেখা হলেও তা সমস্ত অনুভূতিময় মানুষেরই গল্প এইসব।
আন্তরজালকে গড় করি। কুলদাকে আমি কোথায় পেতাম তোমাকে ছাড়া? আর সুবলসখা, টুনি পুনি। অঞ্জলি বিজুলি, আজ্ঞামনি, তীর্থনাথ, সোমেদ খাঁ, মথি উদয়, দরিয়াবানু, সোনাবরু, জহুর স্যার, আনিস স্যার, হিমিকাবিবি..., এঁদের কোথায় পেতাম?
লেখক পরচিতি
অমর মিত্র
ভারতীয় সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পকার-ঔপন্যাসিক।
0 Comments