কুলদা রায়ের গল্প :মথি উদয়ের তারা


মফস্বলের ছোটো একটি শহরের একপ্রান্তে টিনের ঘর। তার বারান্দার বসে আছে মথি উদয় ও হারাধন। এই দুজনকে পণ্ডিত স্যার বিশেষ স্নেহ করেন। একা মানুষ তিনি। স্কুল শেষে তার বাড়িতে এ রকম দুটি-একটি ছেলেকে পড়ান।

পণ্ডিত স্যার আজ পড়াচ্ছিলেন ন্যায় দর্শন। বলছিলেন, উপনিষদের মাণ্ডুক্য উপনিষদ থেকে একটা শ্লোক–

অনিশ্চিতা যথা রজ্জুরন্ধকারে বিকল্পিতা।

সর্পধারাদিভির্ভাবৈস্তদ্বদাত্মা বিকল্পিতাঃ।।

অন্ধকার জায়গায় কোন দড়ি দেখে আমরা অনেক সময়ই সাপ বা জলধরা বা এই ধরনের কোনো বস্তু বলে ভুল করে থাকি। এ সবই আমাদের মনের ভুল। আলো নিয়ে এলে আমরা দেখি সেখানে আদৌ কোন সাপ ছিল না। ওটা দড়ি। এটা মায়া।


মথি উদয়ের ফিরতে ফিরতে অন্ধকার ঝেঁপে এলো। এর মধ্যে চাঁদ উঠে পড়েছে। জ্যোৎস্না ফুটেছে। গোসাই পাড়া থেকে ঘুরে ছবির বাগানে একটু ছায়া। তার আগে হারাধনের বাড়ি। সে চলে গেছে। বাগানের এইটুকু পথ মথি একা আসে। সেখানে এসেই মথি উদয় পথের উপরে আজ একটা সাপ দেখে থমকে দাঁড়ালো। সাপটি একটু নড়ছে। হিস হিসে শব্দও কানে এল। ওটা সাপ না দড়ি এই ভাবনাটা করার আগেই ফনা তুলে সাপটি মাথা তুলল। মথি উদয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মথি উদয় চিৎকার করে উঠল।

চিৎকারটা একটু জোরেই হয়েছিল। সেটা বাগান পেরিয়ে মথি উদয়দের বাড়িতেও পৌঁছাল। ওর মা মার্থা রান্না করছিল। ছেলের চিৎকার শুনে ঘর থেকে মার্থা ছুটে এলো। ততক্ষণে সাপটা নেই। কোথাও সাপটা দেখা গেল না। শুধু একটা লাঠি পড়ে আছে। মাথাটি একটু বাঁকা। মার্থা লাঠিটা হাতে নিতে গেলে মথি চেঁচিয়ে বলল, সাপ।

মথি উদয়কে ধরে নিয়ে এল ঘরে। তার গা কাঁপছে। ঘরে পুরনো তেঁতুল ছিল। জলে গুলিয়ে মথিকে খেতে দিল। বলল—ওটা সাপ নারে বাপ। ওটা লাঠি। আমাগো আন্নাকালীর লাঠি। গরু চরানোর লাঠি। ভুল করে পথে ফেলে গেছে।

সেদিন রাতে মথি খেল না। ভয়ানক গা গরম করে জ্বর এল। জ্বরের ঘোরে বার বার বলতে লাগল সাপ সাপ।

জ্বর কোনো রোগ নয়। রোগের লক্ষ্মণ মাত্র। সে কারণে প্রেমানন্দ ডাক্তার ছেলেকে কোনো ওষুদ দিলেন না। তিন দিন অপেক্ষা করবেন। স্ত্রী মার্থাকে বললেন বার বার মাথা ধুয়ে দিত।

জ্বর কমার কোনো লক্ষ্মণ না দেখতে পেয়ে বিকেল নাগাদ মার্থা সায়েম কবিরাজের কাছে গেল। কবিরাজ সব শুনে বললেন, ওটা পরীর কাণ্ড।

মার্থা তাকে বললে, পরীর কাণ্ড হয় কি প্রকারে? ও তো লাঠিরে সাপ দেইখা ভয় পাইছে।

কবিরাজ একটু হেসে বললেন, তাইলে বোঝো। লাঠি যখন সাপ হইয়া যায় তখন এর মইধ্যে একটা ঝামেলা আছে। একটা দুষ্টু পরী তোমার পোলারে দেইখা আসনাই হইছে। তার ঘাড়ে ভর করছে।

সায়েম কবিরাজ নিদান দিলেন বিলাই-হেঁচড়া ডাল পানিতে ভিজাইয়া ছেলেরে গোসল করায়ে দাও।

পরদিন পণ্ডিত স্যার এলেন। মথি উদয় তখন ঘরের মধ্যে কাঁথা গায়ে শুয়ে আছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। ঘুমোতে পারছে না। ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে।

পণ্ডিত স্যার মথি উদয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন, বাবা তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? তুমি যাকে সাপ বলে ভুল করছ–তাতো আসলে লাঠি। তোমার মনের ভুল। এই মনের ভুলকে মায়া বলে। তুমি যদি ভয় না পেয়ে ভালো করে দেখে নিতে—দেখার চেষ্টা তাহলে লাঠির বদলে সাপকেই দেখতে পেতে। তোমার ভয় কেটে যেত।

তারপর তিনি পকেট থেকে একটি রুমাল বের করলেন। হাতের মধ্যে রুমালটিকে পেঁচিয়ে একটি বিশেষ আকার দিলেন। সেটাকে দেখিয়ে বললেন, এটা কি বলতো?

মথি উদয় কিছু বলল না। রুমালটিকে একবার দেখে চোখ বন্ধ করল। পণ্ডিত স্যারের সঙ্গে এসেছিল হারাধন। স্যার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বলতো বাবা, কি দেখছ আমার হাতে?

হারাধন উত্তর দিল, পাখি। টিয়া পাখি।

–গুড। ময়না পাখি না কেন?

–স্যার আমি ময়না পাখি দেখি নাই কোনোদিন। টিয়া পাখি দেখছি।

–যেটা তুমি দেখ নাই, যেটা সম্পর্কে তুমি কিছুই জান নাই, শোনো নাই—তাকে তুমি কল্পনা করতে পার না। আর কল্পনাতো বাস্তবের ভেতর থেকেই গড়ে ওঠে। তার নিজের কোনো সত্ত্বা নাই। আমরা যে দেবতাকে দেখি—তাকে মানুষ রূপেই দেখি। আমরা মানুষ বলেই মানুষ হিসেবে দেখতে ইচ্ছে করি। ইচ্ছের বাইরে এ জগতে কিছুতেই হয় না।

এই সব কঠিন কথা হারাধন সবটা ধরতে পারছে না। তবু মাথা নেড়ে বলল, সে বুঝতে পেরেছে। পণ্ডিত স্যার বললেন, কিন্তু বাবা, এটা তো আসলে টিয়া পাখি না। রুমাল। এই দেখ। ভাল করে চেয়ে দেখ।

তিনি হাতটি একজন দক্ষ যাদুকরের মত একটু নাড়লেন।

হারাধন এবার হাতের মধ্যে পাখির বদলে রুমালটিকেই শুধু দেখতে পেল। বলল, স্যার রুমাল দেখতিছি।

–গুড। প্রকৃত স্বরূপকে দেখার চেষ্টা করতে হবে।

–কিন্তু স্বরূপ কি জিনিস?

–অরূপকে যখন তোমার নিজের মত করে দেখতে পাও—তখন সেই নিজের মত করে দেখাটাই স্বরূপ।

কিন্তু মথি উদয় চোখ খুলে স্যারের হাতে একটি ময়না পাখি দেখতে পেল। পাখিটি তার দিকে ঘাড় কাত করে আছে। ঠোঁট ফাঁক করে দিব্যি মানুষের গলায় পাখিটা ডেকে উঠল—মথি উদয়। চোখ ম্যালো।

শুনে মথির চোখ বুজে গেল। পণ্ডিত স্যার রুমালটিকে ভাজ করে পকেটে রাখলেন। বললেন, এই রুমালের খেলাটা হাত-সাফাই মাত্র। এটা সার্কাসে দেখানো হয়। চেষ্টা করলে তোমরাও খেলাটি শিখে আরো ভালো করে দেখাতে পারো। পণ্ডিত স্যারের এই হাত-সাফাই বিষয়টি হারাধনের মনে ধরেছে। এই খেলাটি তার শিখতে ইচ্ছে জাগল।

পণ্ডিত স্যার মথির দিকে তাকিয়ে বললেন, এ পৃথিবীতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

তিনি চলে গেলেন।

পণ্ডিত স্যারের পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেলে ভয়ে ভয়ে চোখ খুলল মথি উদয়। দেখতে পেলো তার বাম হাতের ডানার উপরে ময়না পাখিটি বসেছে। ভালো করে দেখে বুঝলো পাখিটার চোখ নাই—চোখের তারা নেই। সাদা।

পাখিটি বলল, খিদা লাগছে। খাতি দাও।

পাখিটিকে খেতে দেবে কি—ওতো নিজেই খায় না। ঘাড় উচু করে দেখল—ঘরে কেউ নেই। ধীরে ধীরে হাতে ভর দিয়ে উঠল। শরীরে কাঁপুনি জাগছে। খাবার টেবিলের কাছে পৌঁছাতে বেশ সময় লেগে গেছে। এর মধ্যে পাখিটা আবার বলল, খাতি দাও। খিদা লাগছে।

টেবিলের উপরে ভাত ঢাকা ছিল। সেটা নিয়ে পাখির মুখের দিকে এগিয়ে দিল। পাখিটা ঠোঁট নেড়ে খেতে খেতে বলল, তুমি খাও।
এক গ্রাস ভাত মুখে দিল মথি। তার তখন খিদে বোধ হল। থালার সবগুলো ভাত সে খেয়ে ফেলল।

খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে বিকেল পড়ে এল। ঘুম ভাংল পাখির আর্তনাদে। একটা বিড়ালের গলা শুনে ভয় পেয়েছে। পাখিটি তার বালিশের পাশ থেকে তার বুকের মধ্যে ভয়ে সেধিয়ে গেছে। তাদের বাড়ির বেড়ালটির মিয়াও মিয়াও করে ডাকছে লেজ ফুলিয়ে।

মথি উদয় পাখিটিকে নিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। বেড়ালটিও তার পেছনে মিয়াউ মিয়াউ করে ঘুরতে লাগল। এই শব্দ শুনে মার্থা ছুটে এল। দেখতে পেল, মথি উদয় একটি রুমাল বুকে চেপে ধরে ঘরের বাইরে যাচ্ছে। মথির নাম ধরে ডাক দিল। কিন্তু তার কোনো কোনো চেতনা নাই। ছন্ন হয়ে গেছে। উঠোন ভরে ভয়ে আতঙ্কে ছুটে বেড়াছে। যে বিড়ালটির ভয়ে সে ছুটছে সে বিড়ালটি কিন্তু নেই। বিড়ালের পশমে হাঁচি আসে বলে মার্থা বেড়াল পোষে না।

প্রেমানন্দ ডাক্তার বাইরে থেকে এসে সব দেখে শুনে তার গুরু বিজিতেন ডাক্তারকে ডাকতে চাইলেন। কিন্তু মার্থার অনুরোধে তিনি চার্চের ফাদারকে নিয়ে এলেন। ফাদার এসে বাড়ির চার দিকে প্রভু যীশুর চারটি ক্রুশকাঠি পুঁতে দিলেন। কিছু লোক সমাগম হল। ফাদার বিকেলের শান্ত হাওয়ায় উঠোনে পবিত্র বাইবেলের মথি লিখিত সুসমাচার পাঠ শুরু করলেন। শুরুতে প্রভু যীশুর জন্মবৃত্তান্ত–

‘মরিয়ম যোষেফের প্রতি বাগদত্তা হইলে তাহাদের সহবাসের পূর্বে জানা গেল, তাঁহার গর্ভ হইয়াছে—পবিত্র আত্মা হইতে। আর তাহার স্বামী যোষেফ ধার্ম্মিক হওয়াতে ও তাহাকে সাধারণের কাছে নিন্দার পাত্র করিতে ইচ্ছা না করাতে, গোপনে ত্যাগ করিবার মানস করিলেন। তিনি এই সকল ভাবিতেছেন, এমন সময় দেখ, প্রভুর এক দূত স্বপ্নে তাঁহাকে দর্শন দিয়া কহিলেন, যোষেফ, দায়ুদ-সন্তান, তোমার স্ত্রী মরিয়মকে গ্রহণ করিতে ভয় করিও না, কেননা তাঁহার গর্ভে যাহা জন্মিয়াছে, তাহা পবিত্র আত্মা হইতে হইয়াছে; আর তিনি পুত্র প্রসব করিবেন, এবং তুমি তাহার নাম যীশু (ত্রাণকর্ত্তা) রাখিবে; কারণ তিনিই আপন প্রজাদিগকে তাহাদের পাপ হইতে ত্রাণ করিবেন। ‘

সমাগত লোকদের মধ্যে হারাধনও উপস্থিত ছিল। হারাধন ফাদারকে জিজ্ঞেস করল, তাইলে কি যীশুর বাবা নাই?

শুনে ফাদার একটু নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি উত্তর দিলেন, তিনি ঈশ্বরের নির্দেশে পবিত্র আত্মা হতে জন্মেছিলেন। তিনি পবিত্র।

সুসমাচার থেকে ফাদার পড়লেন–যীশুর জন্ম হইলে পর, দেখ, পুর্ব্বদেশ হইতে কয়েকজন পণ্ডিত যিরুশালেমে আসিয়া কহিলেন, যীহুদীদের যে রাজা জন্মিয়াছেন, তিনি কোথায়? কারণ আমরা পূর্বদেশে তাঁহার তারা দেখিয়াছি, ও তাঁহাকে প্রণাম করিতে আসিয়াছি।

এইটুকু পড়ার সময় ফাদারের গলা ধরে এল। পণ্ডিতগণ তখন যীশুর সন্ধানে আকাশের নিচ দিয়ে রাত্রিবেলা হেঁটে চলেছেন। আর দেখ, পূর্ব্বদেশে তাহারা যে তারা দেখিয়াছিলেন, তাহা তাহাদের অগ্রে অগ্রে চলিল, শেষে যেখানে শিশুটি ছিলেন, তাহার উপরে আসিয়া স্থগিত হইল। তারাটি দেখিতে পাইয়া তাহারা মহানন্দে আতিশয় আনন্দিত হইলেন।

সুসমাচারকে মহিমান্বিত করতে ফাদার তার ঝোলা থেকে মাতা মরিয়মের একটি ছবি বের করলেন। নিষ্পাপ মরিয়মের কোলে শিশুপুত্র যীশু। পাশে কয়েকটি মেষশাবক জাবর কাটছে। ছবিটা বেশ পুরনো—উপরের এক কোনে একটু ছিড়ে গেছে। একটু বাতাস লাগলেই ফর ফর করে। কিন্তু মাতা মরিয়মের চোখ দুটি করুণায় পূর্ণ বলে নতুন বলেই মনে হয়।

ঘরের চালের বাতায় একটি জিল-কাগজের তারা গড়া ছিল। মথি উদয় বড়দিনের জন্য তৈরী করেছিল। প্রেমানন্দ ডাক্তার তারাটি এনে একটি লাঠির মাথায় বেঁধে উঠোনের মাঝখানে পুঁতে দিলেন। তারাটিতে মাকড়সার জাল জড়িয়েছিল। হারাধন উঠে এসে তার গামছাটি দিয়ে মুছে দিল। সকলে জয়ধ্বনি করে তারাকে প্রণিপাত করল। চারিদিকে প্রভুর মহিমা কীর্তিত হল।

এ সময় মথি ঘরের ভেতরে ঘুমিয়ে আছে ভেবে তাকে ডাকা হল না। ফাদার সকলের উদ্দেশ্যে মথির নামের মহিমা বর্ণনা করে বললেন, সাধু মথি প্রভু যীশুর দ্বাদশ শিষ্যের অন্যতম—তিনি সুসমাচার বলে গেছেন সারাজীবন।এ বাড়ির প্রেমানন্দ ডাক্তার তার প্রিয় পুত্রের নাম রেখেছেন সুসমাচার প্রচারকারী সেই সাধু মথির নামে। ঈশ্বরের ইচ্ছায় এ বাড়ির মথি উদয়ও সুসমাচার প্রচার করে যাবে। তার কোনো ভয় নেই। ফাদার দীর্ঘ হাত তুলে মথি উদয়কে আশীর্বাদ করলেন।

সে সময় বাড়ির পিছনে পুকুরঘাটে জলের শব্দ হল। শব্দ লক্ষ করে মথি উদয় দরজা খুলে বেরিয়ে এল। ঘাটে আন্নাকালি গরুর জাবনা ধুচ্ছে। আন্নাকালীর মা হরিদাসী বাড়ি বাড়ি কাজ করে। আর আন্নাকালী মথি উদয়দের গরু চরায়। গরু চরানো কাজটি সে ছোটো থেকেই করে আসছে। তার এ কাজটি সবাই সহজ স্বাভাবিক ভেবে নিয়েছে। এর মধ্যে যে কখন বালেগ হয়ে হয়ে উঠেছে, সেটা বোঝাই যায়নি।

আন্নাকালী মথি উদয়কে দেখে ফিক করে হাসল। বলল, মথি দাদাগো, তোমার জ্বর কমছে?

এই কথার জবাব নাই মথির গলায়। ঘোরলাগা চোখে সে তাকিয়ে আছে। তার হাতে ময়না পাখিটি দেখে আন্নাকালী বলল, এই রুমাল দিয়া পাখিডা বানাইছ—কিন্তু চোখ দ্যাও নাই ক্যান। আসো—আমি চোখটা খাইড়া দেই।

বলে আন্নাকালী তার নিজের চোখ থেকে কাজল নিয়ে পাখিটার চোখ এঁকে দিল। পাখিটা এবার আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল—আমি দেখতি পাইতিছি।

মথি উদয়ের ঠোঁট একটু কাঁপল। ঘাটের পাশে কলমি লতা। সে পাখির জন্য কচি কলমির ডগা তুলতে গেল। দেখতে পেল জলের উপর কলমির ছায়া পড়েছে। একটু একটু করে দুলছে। একই লতার দুটো চেহারা। একটি কায়া লতা—আরেকটি ছায়া লতা। ছায়া লতাটিকেই তার পছন্দ হল। সেটি তুলতে যাবে এ সময়ে আন্নাকালী জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে নাইতে নেমেছে। ঢেউয়ের আঘাতে ছায়া ভেঙ্গে গেছে। কায়াটি আছে। ছায়াটি নাই।

পুকুরের মাঝখানে দুটো পদ্ম ফুটেছিল। একটি তুলে এনে মথির হাতে দিল আন্নাকালী। বলল, এইটা নেওগো দাদা। পাখিটা তখন সেই পদ্মের পাপড়ি খেতে খেতে বলল, মজা লাগতিছে।

এর মধ্যে বিকেল পড়ে এসেছে। আন্নাকালীর তখন গরু আনতে যাওয়ার কথা। তার আগে পায়ে কলমি ফুলের মালা পরল গলায়। পায়ে দিল নাটা ফলের নূপুর। চোখে আবার কাজল মেখে নিল। জলের দিকে একবার তাকিয়ে সে উঠে পড়ল। গোহাটা দিয়ে মাঠের দিকে যাত্রা করবে। তার আগে ছবির বাগান।

তার পিছনে পিছনে চলে এসেছে মথি উদয়। আর তার পেছনে হারাধন। হারাধন একটু আড়ালে থাকে। সামনে আসে না। আন্নাকালী চলেছে পরীর মত। দুহাত ডানার মত বাতাসে দুলছে। পায়ে নাচের মুদ্রা। গুনগুন করে কী একটা গান করছে। তা পরিস্কার করে শোনা যায় না। কিন্তু তার মধুর সুর কানে এসে লাগে। ছবির বাগানের যেখানে ছায়া গভীর হয়ে গেছে সেখানে পরীর গা থেকে আলোরবিন্দু ঝরছে। সে আলো পথের উপরে, ঘাসে গায়ে—লতা-পাতায় ঝিকমিক করে জ্বলছে।
সন্ধ্যা আসার আগে যে লাল আলোটুকু ফাঁক ফোকর দিয়ে তার মুখে পড়ছে তা দেখে তাকে মথির খুব চেনা মনে হল। কিন্তু মনে করতে পারছে না। ঘাড়ের উপরে বসে থাকা ময়না পাখিটা বলে উঠল–মাতা মরিয়ম। আন্নাকালী তখন আর আন্নাকালী নয়–প্রভু যীশুর মাতা মরিয়মে রূপান্তরিত হয়েছে।

মাঠের মধ্যে পৌছে দেখল গরুটির যেখানে থাকার কথা—সেখানে নাই। দেখে আন্নাকালীর প্রাণ উড়ে গেল। ডাকল—ধ্বলি, ধ্বলি রে। তার ডাক মাঠের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে গেল। ধ্বলির কোনো হাম্বা শোনা গেলো না।

আন্নাকালী তার হাতে গরুর লাঠিটা দিয়ে বলল, মথি দাদা, তুমি এইখানে বস—আমি গরুডারে খুঁইজা নিয়া আসি।
মাঠের মধ্যে আন্নাকালী ছুটে গেল। মাঠের মাঝখানে একটা ছাড়া ভিটা। সেইদিকে মিলিয়ে গেল। আর তার পিছনে হারাধনও এগিয়ে গেল।

মথি উদয় আন্নাকালীর কথামত পথের পাশের বাঁশঝাড়ের ভেতরে বসে আছে। লাঠিটাকে দেখে আজ তার ভয় করছে না। লাঠিটাকে আজ লাঠিই মনে হচ্ছে—সাপের মত লাগছে না। মথির ঘাড়ের উপরে ময়না পাখিটা বসে বসে ঝিমুচ্ছে।

এর মধ্যে সন্ধ্যে ঘুরে এসেছে। এক ঝাঁক বাদুড় উড়ে গেছে। বাঁশঝাড়ে জোনাকী জ্বলছে। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকতে লেগেছে। এই প্রায় অন্ধকারে মথি উদয়ের গা ছম ছম করে। সে বসেও থাকতে পারছে না। কাঁধের পাখিটা বলে উঠল—ছাড়া ভিটা।
মথি উদয় ছাড়া ভিটার দিকে পৌঁছে দেখল—সেখানে কেউ নেই। আরেকটু এগিয়ে দেখতে পেল–গাছপালার মধ্যে পড়ে আছে মাতা মরিয়ম। তার মুখ থেকে গো গো শব্দ হচ্ছে। তাই দেখে পাখিটা পবিত্র আত্মার মত তার ঘাড় থেকে উড়ে গেল মাতা মরিয়মের কাছে।

সেই রাতে লোকজন মথি উদয়কে খুঁজে পেল নদীর ধারে। অচেতন হয়ে পড়ে আছে।

মথিকে দেখতে স্থানীয় ডাক্তার বিজিতেন বাবু এলেন। তিনি তার মাথা ধুয়ে দিতে বললেন। মথি পাশ ফিরল। এলেন সায়েম কবিরাজও। কবিরাজ হেসে বললেন—চিন্তা নাই। দুষ্টু পরীটা চইলা গেছে। সে কোনো ক্ষতি করতে পারে নাই। পাড়াপ্রতিবেশিরাও দল বেঁধে দেখতে এল মথিকে।

সেদিন হারাধন বেলা করে এল। তার চোখে মুখে অস্থিরতা। হারাধন এলে মথি উদয় তার হাত ধরল। হাত কাঁপছে। কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু গো গো শব্দ ছাড়া কিছু বোঝা গেল না। তার ঠোঁট নড়া আর ইঙ্গিত দেখে হারাধন বুঝল, মথি উদয় আন্নাকালীর কথা জিজ্ঞেস করছে।

এ ইঙ্গিত বুঝে হারাধনের মুখ কালো হয়ে গেছে। সে পালিয়ে যেতে পারলে স্বস্তি পেত। কিন্তু মথি উদয় তার হাত এমনভাবে ধরে আছে যে জবাব না দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সে কোনোভাবে বোঝাল যে আন্নাকালী এখন ঠিক কোথায় তা হারাধন জানে না। রাতে সবাই মথিকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। আন্নাকালীর খবর নেওয়ার মত সময় ছিল না। পরে কে একজনের কাছে খবর নিয়ে জেনেছে, আন্নাকালী এখন তার মায়ের কাছে আছে। ঘুমোচ্ছে।

পরদিন জানা গেলো আন্নাকালী নেই। সে মামাবাড়ি গেছে। কদিন গরু চরাতে আসতে পারবে না।

ভোর বেলা আন্নাকালীর মা হরিদাসী এসে মথি উদয়দের বাসন-কোসন মেজে দিয়ে যায়। আজ তার মন ভালো নেই। মার্থা জানতে চাইল—কি হইছে গো হরিদাসী?
হরিদাসী কিছু বলল না। কাজ সেরে যাওয়ার আগে মাথা নিচু করে বলল—যা হইছে—তাতো আমাগো বেলায় নিত্যই ঘটে। বাল্যকালে আমিও রেহাই পাই নাই।

মার্থা কি বুঝে বলল, মাইয়া বড় হইতেছে। বুইঝা শুইনা রাখন লাগে।

এর মধ্যে মথি উদয় অনেকটা সেরে উঠেছে। হারাধন তাকে পণ্ডিত স্যারের কাছে নিয়ে যায়। চুপ করে বসে থাকে। পড়ানো শেষ করে স্যার তাকে বাসায় পৌঁছে দেন। রাত হয়ে গেলে স্যারের হাতে একটা টর্চ লাইট থাকে। লাইটটা মাঝারী গোছের। মুখটা একটু লম্বা। ফলে আলো খুব বেশি ছড়ায় না। অল্প জায়গায় জ্বল জ্বল করে। দূর থেকে তারার মত মনে হয়।

পণ্ডিত স্যার যেতে যেতে একদিন তাদের দুজনকে আত্মা-পরমাত্মার তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, প্রাচীন ঋষিরা বলেছেন—অহম বয়ম। আমিই সেই। সে-ই আমি। আমরাও পরমপ্রাণের অংশ। এই সে-ই হল ঈশ্বর বা পরম প্রাণ। আমরাও পরম প্রাণের মত পবিত্র।

যদিদং কিঞ্চ জগৎ সর্বং প্রাণ এজতি নিঃসৃতম।

এই জগতের সকল বস্তু প্রাণ থেকে এসেছে। আবার এই প্রাণকে আশ্রয় করেই সব বস্তু সক্রিয়। এই প্রাণই ঈশ্বর। এই ঈশ্বরই সকল সকল প্রাণ।

টর্চ লাইটের আলো এ সময় প্রাণের মত জ্বলে ওঠে। রাস্তার ধূলোটিকেও প্রাণময় মনে হয়। যে পিপ্পল পাতাটি বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে গেছে—সে লতাটিও প্রাণের মত আরেকটি প্রাণবন্ত বাঁশঝাড়ের সঙ্গে মিলেছে। একটি ব্যাঙ থপ থপ করে আলোর আড়ালে যাচ্ছে। ব্যাঙটির এই থপথপ ধ্বনির সঙ্গে প্রাণপ্রবাহের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

তখনই দেখা গেল হরিদাসীর সঙ্গে আন্নাকালী হেঁটে হেঁটে ফিরছে রাস্তা দিয়ে। তার মাথাটা ঘাড়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। শোনা যাচ্ছে ওয়াক ওয়াক শব্দ। আন্নাকালীর পেট বড় হয়ে গেছে। দেখে হারাধন কেঁপে ওঠল। একটু ভয় পেল। স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল—কী হইবে স্যার।

পণ্ডিত স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, কিসের কী হয়েছে?

হারাধন মুখে কিছু না বলে আঙুল দিয়ে আন্নাকালীকে দেখিয়ে দিল। কিছুক্ষণ পরে উদ্ভ্রান্তের মত বলল, মেয়েটি নষ্ট হয়ে গেল।

স্যার দেখলেন। আবার দেখলেন না। তিনি উর্ধপানে তাকিয়ে বললেন, মাতা মরিয়ম কুমারী অবস্থায় যীশুকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। শুরুতে তার প্রস্তাবিত স্বামী যোশেফও তাকে নষ্ট মেয়ে মনে করেছিলেন। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন এই গর্ভধারণের জন্য মরিয়মের কোনো দোষ নেই। তিনি নষ্ট বা অপবিত্র নন। কে নষ্ট আর কে নষ্ট নয়—এটা বিচার করবে কিভাবে? তুমি যদি তাকে নষ্ট চোখে দেখ—তাহলে তিনি নষ্ট। আর তুমি যদি তাকে পবিত্র চোখে দেখ তাহলে তিনি পবিত্র। দেখা বিষয়টাই আসল। সত্যকে খুঁজে দেখার জন্য প্রকৃত চোখ লাগে।

হারাধন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল স্যারের দিকে। মথির মাথাটা একটু ঝুলে আছে। সে কিছু লক্ষ্য করছে না।
স্যার একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, সত্যকে খুঁজে বের কর। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত কর। সত্যের জন্য প্রাণ দাও। সত্যই প্রাণ। সত্যকে ভয় পেয়ো না।

আন্নাকালী চলে যাচ্ছে। তাদের দুজনের দুটো ছায়া লম্বা হয়ে কাঁপছে। ছায়াটিও এক সময় মিলিয়ে যাচ্ছে।

হারাধন সেদিকে তাকিয়ে পণ্ডিত স্যারকে জিজ্ঞাসা করল, সত্য কি স্যার?

স্যার উত্তর দিলেন, ঘটনাই হল সত্য। যে ঘটনা প্রাণকে ধারণ করে, যে ঘটনা প্রাণকে প্রকাশ করে—যে ঘটনা প্রাণকে রক্ষা করে—সেই ঘটনাই হল সত্য। প্রাণের ধর্মই হল সত্য। এর বাইরে আর কোনো সত্য নাই।

পরদিন পাড়ায় পাড়ায় ফিসফাস শোনা গেল আন্নাকালী মা হচ্ছে। এতোদিন মামাবাড়ী ছিল। এখন তার গর্ভদশা প্রকাশ্য হওয়ায় লোক নিন্দার ভয়ে মামা আর রাখতে চায়নি। আন্নাকালীকে দেখে অনেকেই ছি ছি করতে লাগল। গরু চরানোর কাজটা আর আন্নাকালীর রইল না। যারা দুধ-রোজ নিত—তাদের মধ্যে পালবাড়ির বড়গিন্নি বলে পাঠাল—আন্নাকালীর দোয়া দুধ দিয়ে পূজা দিতে তার মন সরছে না। অসুচি লাগে। তার গর্ভদশা দেখিয়ে মথি উদয়ের মা জিজ্ঞেস করল—এই কাজটা কে করল?

আন্নাকালী কিছু বলল না। তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। তার মা হরিদাসী বলল, আন্নাকালী অন্ধকারে কারো মুখ দেখে নাই। কে কইরেছে চিনতে পারে নাই।

আন্নাকালী একবার চোখ তুলে তাকাল। হরিদাসী বলল, চিন্যা কি করব? চিনলেই কি কিছু করার আছে?

আন্নাকালীরা যে বাড়িতে থাকত সে বাড়ি থেকে তাদের উঠিয়ে দেওয়া হল। বলল, আপদ বিদায় হও। ঝামেলা কইরো না।

এমনকি আন্নাকালীর মাকে কোনো কোনো বাড়ি বাসন-কোসন ধোয়ার কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিল।

এসব দেখে হারাধন চিন্তিত হয়ে গেল। এক ধরনের গ্লানি বোধ করছে। গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সে নানাদিকে ছোটাছুটি শুরু করল। শুরুতে আন্নাকালীর কাছে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু তার কাছে যাওয়ার সাহস পেল না। তার মায়ের কাছে গেল। আন্নাকালীর মা তাকে কিছু বলার সুযোগ দিল না। কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোমরা কি দেখছ, কেডা আমাগো সর্বনাশ করল? তারে খুঁইজা বাইর কর। আমাগো বাঁচাও।

এর উত্তরে হারাধন কিছু বলল না। সেখান থেকে সরে এল। এ শহরের মানুষ সায়েম কবিরাজের কথা বিশ্বাস করে। তার কিছু এলেম আছে। আয়না পড়া জানেন। আয়নায় সব কিছু দেখতে পায়। হারাধন তখন একটা আয়না নিয়ে গিয়ে সায়েম কবিরাজকে গিয়ে বলল, আপনি গোণা-গুণতি জানেন। গুইণা কনতো সবাইরে এই মাইয়া নির্দোষ। সে নিজে কিছু জানেই না। ঘটনার শিকার।

সায়েম কবিরাজ আয়নাটি সরিয়ে দিলেন। তিনি হাসলেন। তিনি বললেন, জেনা করা পাপের কাজ। তার পাপের ফল প্রকাশ পাইছে। আমি কী করুম।

ফাদার বললেন, প্রভুর পথে আইস। তিনি তোমাদের সকল পাপ মোচন করবেন।

পণ্ডিত স্যার এ সময় কী একটা কাজে বাইরে চলে গেছেন। তাকে না পেয়ে হারাধন একটু বিচলিত হল। এলাকার গোপী সাধুর কাছে গেল। তিনি গঙ্গাজল ছিটিয়ে বললেন, নরকের কীট। এদের কথা শোনাও পাপ।

এই পাপের কথা সারা শহরে প্রচারিত হলে গেল। কেউ কেউ উদ্যোগী হয়ে বলতে লাগল, এই পাপ শহরে থাকলে অনাসৃষ্টি শুরু হবে। শহর থেকে পাপ-বিদায় কর্মসূচী গ্রহণ করা হল।

মথি উদয় কিন্তু নির্বিকার। নিজের ঘোরের মধ্যে আছে। হারাধন তাকে বার বার বলতে লাগল, তুই দেখিছিস কেডা আন্নাকালীরে বিপদে ফেলছে। এই কথা মথির কানেই যায় না। সে কিছু বলেও না। হারাধন মরিয়া হলে তাকে অনুরোধ করল, তুই তার কথা সবাইরে কইয়া দে। সত্য কইরা কইয়া দে।

মথি সমাহিত হয়ে আছে। এই সব কোনো কথা বলার মধ্যে নেই। হারাধন ভেঙ্গে পড়ল।

হরিদাসী সবার কাছে হাত জোড় করে বলতে লাগল, তার মেয়ে কিছুই জানে না। সে নির্দোষ। যে দোষ করেছে তারে তোমরা খুইজা বাইর কর। তারে শাস্তি দ্যাও।

এ কথায় কান দেওয়ার মত লোক পাওয়া গেল না। সবাই তখন পাপ বিদায় করার জন্য ব্যস্ত।

আন্নাকালী ততদিনে বেশ ভারী হয়ে গেছে। তার হাটতে চলতে কষ্ট হয়। চোখের নিচে কালি। দিশা না পেয়ে মা আর মেয়ে দুজনে লোকজনের দোরে দোরে যায়। লোকের কাছে হাহাকার করে। তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর মত কেউ নেই।

এরই মধ্যে একদিন শহরের শেষে নদীতে নৌকা প্রস্তুত। শহরেরর লোকজন ঠিক করেছে মা ও মেয়েকে নৌকায় করে শহর থেকে বের করে দেবে। কেউ কেউ চেঁচিয়ে বলছে-ওকে পাথর ছুড়ে মারো। কেউ কেউ বলল, ওকে জলন্ত চিতায় তোলো। ঠিক তখনই দূর থেকে কে একজনকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। লোকজনকে ঠেলে সরিয়ে আন্নাকালীদের কাছে এল। সেই লোকটি মথি উদয়। সে হাপাচ্ছে। তার চোখ দেখে মনে হল—সে কিছু বলতে চায়। কিন্তু বলতে পারছে না।

পাপ বিদায় কর্সূচীতে বাঁধা পড়ায় কে একজন বিরক্ত হয়ে বলল, এই পাগলটা আবার আইল কোত্থেকে?

অরে সরাইয়া দেও।

মথির পিছনে মথির মা মার্থা এসেছে। সে মিনতি করে বলতে লাগল, তার ছেলে সত্যি সত্যি পাগল। তাকে তোমরা কিছু কইয়ো না। আমি তারে সরায়ে নিয়া যাচ্ছি।
মার্থা তার ছেলে মথি উদয়ের হাত ধরে সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইল। বলল, বাবারে, এইখানে থাইকা বিপদ বাড়াইস না।

হারাধন এ সময় মথিকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলছে—মথি সত্যি কথা কইয়া দে। কিছুই লুকাইস না। আরো কিছু বলতে চাইছিল হারাধন তার আগে মথি গো গো করে কিছু বলার চেষ্টা করল। উপস্থিত লোকজন তখন অধৈর্য হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ এগিয়ে এলো মথিকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার জন্য। আর কজন মা -মেয়েকে ধরে নৌকায় ওঠাতে যাবে এ সময় মথি উদয় স্পষ্ট গলায় বলে উঠল—দাঁড়াও।

লোকজন এবার দাঁড়িয়ে গেল। নৌকায় যারা জোর করে উঠাচ্ছিল তারাও থেমে গেল। মথি উদয় বলল, আন্নাকালী পাপী নয়। সে কোনো পাপ করে নাই। তার পেটে পবিত্র আত্মা।

লোকজন জিজ্ঞেস করল, পেটেরডার জন্মদাতা কেডা? তার নাম কও।

মথি বলল, ঈশ্বর জানেন। ঈশ্বরের কৃপায় তার জন্ম হচ্ছে। বাইবেলে লেখা আছে প্রভু যীশুর জন্ম হয়েছিল ঈশ্বরের ইচ্ছায়। যীশু সবাইকে উদ্ধার করতে এ পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিলেন। আন্নাকালীর সন্তানও সবার মঙ্গল করতে আসছে। এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা।

কেউ কেউ বলে উঠল, তার প্রমাণ কি?

মথি উদয় সে একই ভঙ্গীতে বলল, যীশুর যেদিন জন্ম হয়েছিল, সেদিন আকাশে একটি নতুন তারা উঠেছিল। আন্নাকালীর সন্তানের জন্মের সময়ও আরেকটি তারা উঠবে আকাশে। এই তারাটিই প্রমাণ।

কেউ কেউ এটা হেসে উড়িয়ে দিতে চাইল। মথি কিছু বলল না। সে শান্ত সমাহিত চোখে তাকিয়ে রইল নদীর দিকে। নদীতে তখন জোয়ার লেগেছে। দূরের গ্রাম দেখা যাচ্ছে। আকাশে পাখি উড়ছে। মথি উদয়ের এই মূর্তি দেখে অনেকের কাছে তাকে অচেনা মনে হল। কিন্তু মথি উদয়ের কথায় হারাধন এবার শ্বাস ফিরে পেয়েছে। আর দেরী না করে মথির হয়ে বলল, এই মথি উদয়কে আপনারা চেনেন। তার জবান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পবিত্র আত্মার কথা বলার জন্য সে এই মাত্র তার জবান ফিরে পাইছে। সে কথা বলতে পারছে। এটা ঈশ্বরের নির্দেশ।

এবার হারাধন একটা বাইবেল বের করে জনসমক্ষে বলল, এই রকম ঘটনা বাইবেলে লেখা আছে। যীশুর খালু জাকারিয়ার জবান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যীশুর জন্মের সুসমাচার বলার জন্য তার জবান খুলে গিয়েছিল।

এই কথায় অনেকেই ফিসফাস করতে লাগল। কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে হাত গোটাতে লাগল। তাদেরকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার জন্য সামনে এগিয়ে এল। তখন হারাধন পকেট থেকে একটা রুমাল বের করল। বলল, কি দেখছেন?

–রুমাল। উপস্থিত সবাই বলল।

রুমালটির এক কোনে ছোটো করে লেখা—মনে রেখ ভুলো না আমায়।–হারাধন।

লেখাটি হলুদ রঙের সুতো দিয়ে লেখা। দূর থেকে বোঝা যায় না। কাছে নিয়ে দেখলে লেখাটি পড়া যায়।
রুমালটিকে হারাধন আঙ্গুলে পেঁচিয়ে একটা পাখির আকার দিল। বলল, এই দেখেন—এইটা আর রুমাল নাই। এইটা একটা পাখি হয়ে গেছে।

শুনে কেউ কোনো কথা বলল না। খুব ভালো করে হারাধনের হাতের দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ কেউ চোখ ডলে নিল। কে একজন বুড়ো মত লোক ভাঙা ডাটির একটা চশমা পরে নিল। বুড়ো লীকটি চশ্মা পরেও কিছু দেখতে পেল না। তার সঙ্গে এসেছিল তার চার বছর বয়সের নাতি। নাতিকে জিজ্ঞেস করল বুড়ো লোকটা, তুই কি পাখিডারে দেখতি পাইতিস?

নাতি মাথা কাত করে বলে উঠল– পাখি দেখতি পাইতিছি। বুড়ো তখন নাতিকে জিজ্ঞেস করল—কী পাখি দেখতি পাইতিছিস?

নাতির ছবির বইয়ে ময়না পাখি আছে। সে ময়না পাখি পছন্দ করে। সে তখন বলল, ময়না পাখি দেখতি পাইতেছি। তারপর চেঁচিয়ে বলল, ও ময়না-কথা কও না।

বুড়ো এবার চশমাটা খুলে বলল, হাচাই দেহি ময়না পাখি। তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে হারাধনের হাতের রুমালটি ময়না পাখির মত মানুষের গলায় বলে উঠল—মথি উদয়। সত্যি কথা কয়।

এবার অনেকেই পাখিটাকে দেখতে পেল। পাখিটার কথা সবাই শুনতে পেল। পাখিটা হারাধনের হাত থেকে উড়ে মথি উদয়ের ডান কাঁধে গিয়ে বসল। বলল—মথি উদয়ের তারা—দেখবা তোমারা যারা। এই কথা বলতে বলতে পাখিটা লেজ নাড়াল। তারপর ডানা মেলল। উড়ে নদী পার হয়ে পশ্চিমে চলে গেল।

তখন লোকজন পাখির ঘটনায় মুগ্ধ। অবিশ্বাস করতে পারছে না। আবার পুরো মানতেও কষ্ট হচ্ছে। তখন সিদ্ধান্ত হল, আন্নাকালী ও তার মাকে এখনই এ শহর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে না। সন্তান হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। যদি দেখা যায়—সন্তানের জন্মের সময় আকাশে নতুন একটি তারা ওঠে তাহলে আন্নাকালীকে পবিত্র ঘোষণা করা হবে। তাদেরকে সসম্মানে শহরে থাকতে দেওয়া হবে। যদি তারা না ওঠে তাহলে তাদেরকে শুধু শহর থেকেই নয়—এই অঞ্চল থেকেই দূর করে দেওয়া হবে। এবং মিথ্যে বলার অপরাধে মথি উদয়কেও কঠিন শাস্তি পেতে হবে। সে শাস্তি আন্নাকালীর চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

আন্নাকালী আর তার মা হরিদাসী সে যাত্রায় শহরে থেকে গেল। গোহাটায় একটা চালাঘর করে সেখানে থাকার ব্যবস্থা হল। এবং শহরে বেশ একটা শোরগোল উঠল। লোকজন দল বেঁধে গোহাটার দিকে আসতে লাগল। যারা একটু কট্টরপন্থী তারা দিনরাত পাহারার ব্যবস্থা করল যাতে আন্নাকালী আর তার মা কেউ পালিয়ে না যেতে পারে। এমনকি মথি উদয়দের বাড়ির দিকেও চোখ রাখা হল।

হারাধন কিছুটা ভয় পেয়ে গেছে। সে বারবার মথিকে জিজ্ঞেস করতে লাগল, সত্যি করে বলত মথি, তারা কি উঠবে?

মথি বলল, অবিশ্বাসী হয়ো না। তারা উঠবে।

পণ্ডিত স্যার এলে তার কাছে ছুটে গেল হারাধন। স্যার বললেন, সত্য খুব কঠিন। তাকে ভালোবাসো। এ জগতে যা কিছুই ঘটে—তার সবই সত্যি। অনেক সত্যিকে আমরা জানি না। নতুন করে জানতে হয়। সত্যকে খুঁজে বের করতে হয়।

স্যারের হাতে নতুন একটা টর্চ লাইট। সবে কিনেছেন। চক চক করে। হারাধন লাইটটার দিকে তাকিয়ে রইল।

আন্নাকালীর গর্ভবেদনা শুরু হল সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলে। গ্রামের লক্ষ্মী দাই আসার কথা। কিন্তু লক্ষ্মী দাই এল না। তার শরীর খারাপ। আন্নাকালীর মুখ শুকিয়ে গেছে। হরিদাসী বলল, ভয় পাইস না মা। আমিই সব কইরা দেব।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্নাকালীর গোঙ্গানীর শব্দ শোনা যেতে লাগল। শহরের লোকজন অপেক্ষা করছে যার যার ঘরে। তারা অপেক্ষা করছে তারার জন্য। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচালে সবাই দুলছে। তারা না উঠলে আর অপেক্ষা করবে না। এই রাতের আঁধারেই মা- মেয়েকে নদী পার করে দেবে। একদল মথিদের বাড়িও ঘিরে রইল লাঠি-সোটা নিয়ে। তারা না উঠলে মথি উদয় ভণ্ড প্রমাণিত হবে। এই মথি ছেলেটার ভন্ডামীর শাস্তি দেবে।

মধ্য রাতে চাঁদ ডুবে গেল। আকাশে অসংখ্য তারা ফুটে উঠল। এর মধ্যে গোহাটার আকাশে একটি আলো জ্বলে উঠল। কিছুক্ষণ জ্বলে নিভে আকাশের দিক থেকে ঘুরে আন্নাকালীদের চালাঘরের উপরে স্থির হয়ে রইল।

ঠিক এ সময় একটি শিশুর জন্মের ধ্বনি শোনা গেল। গোহাটার কয়েকটা গরু হাম্বা করে ডেকে উঠল। লোকজন আর অপেক্ষা করল না। ঢাক ঢোল নিয়ে পথে নেমে পড়ল। সেই উজ্জ্বল আলোটিকে দেখিয়ে সবাই আনন্দিত গলায় বলতে লাগল—মথি উদয়ের তারা উঠেছে। ভালো করে দেখার আগেই তারাটি নিভে গেল। আর কেউ দেখে নি। দেখার দরকার নেই।

পরদিন পবিত্র শিশুটিকে দেখতে লোকজন গোহাটায় ছুটে এল। নানা ধরনের উপহার নিয়ে এল। কেউ কেউ মানত করা শুরু করল। হরিদাসীর মুখে হাসি। চোখে জল। এতো সব উপহার কোথায় রাখবে বুঝে উঠতে পারছে না। লক্ষ্মীদাইও এসে পড়েছে। সে-ই সব গোছগাছ করে রাখছে।

শিশুটিকে কোলে করে আন্নাকালী বসেছে। তার মুখে মায়া। সেও একটু ভালো করে চোখ মেলে দেখতে পেল-শিশুটির গা থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে।

এদের মধ্যে শুধু হারাধনকেই দেখা গেল না। তাকে খুঁজেও পাওয়া গেল না। সে কোথায় গেছে কেউ জানেও না। পণ্ডিত স্যার গোহাটার দিকে গেলেন। আন্নাকালীদের চালাঘরের বদলে খালের দিকে চললেন। খাল পাড়ে একটা তাল গাছ মাথা উঁচু করে আছে। খালপাড়ে একটি চিকটি ঝোঁপের দিকে তার চোখ গেল। ঝোঁপের ভেতরে কী একটা চকচকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। আরো কাছে গিয়ে দেখলেন একটা টর্চ লাইট। এটা তার নিজের নতুন টর্চ লাইট। কাল হারাধন নিয়েছিল। তাকে ফিরিয়ে দেয়নি।

টর্চ লাইটটির কাছ ভেঙ্গে গেছে। মাঝখানের ডেবে গেছে। গাছের উপর থেকে পড়লে এ রকম হতে পারে। পণ্ডিত স্যার গাছের আগার দিকে তাকালেন। দেখতে পেলেন—সেখানে তালপাতার মোটা বোঁটায় একটা রুমাল বেঁধে আছে। বাতাসে ফরফর করে উড়ছে। তিনি কয়েকটি কঞ্চি এক সঙ্গে বেঁধে তাল গাছের আগা থেকে রুমালটিকে পেড়ে আনলেন। রুমালটির এক কোনে লেখা—মনে রেখো—ভুলো না আমায়।–হারাধন। রুমালটি ভাঁজ করে বাম পকেটে রাখলেন। ডান পকেট থেকে তিনি একটা কাগজ বের করলেন। সেখানে লেখা—
সেদিন সন্ধ্যায় ছাড়-ভিটায় আন্নাকালীকে দেখে আমার ঘোর লেগে গেল। আমি তখন নিজের ভেতরে নাই– প্রবৃত্তির বশে চলে গেছি। আন্নাকালী আমাকে দেখে বলেছিল–না। আর কিছু বলার শক্তি ছিল না তার।
কিন্তু এর পরেই আমি বুঝতে পারি যে হারাধন দুর্ঘটনাটি ঘটাল সে আমি নই। অন্য কোনো হারাধন। পাপ হলে তার হয়েছে। আন্নাকালীর নয়। সেই হারাধনও পরিকল্পনা করে সেই দুর্ঘটনাটি করেনি। তার জন্য আন্নাকালী বিপদে পড়েছে। তাকে বাঁচানো দরকার। আমি তাকে বাঁচাতে চেয়েছি।

ক্ষমা করবেন।

ইতি

– হারাধন।

অন্য কেউ আসার আগেই পণ্ডিত স্যার কাগজটি টুকরো করে ছিড়ে ফেললেন। জলে ভাসিয়ে দিলেন। তারপর লাইটটিকে খালের মধ্যে ছুড়ে মারলেন। খালে তখন জোয়ার ফিরছে। সড়সড় করে জলের শব্দ শোনা যায়।



লেখক পরিচিতি
কুলদা রায়



জন্ম : ১৯৬৫
বাংলাদেশের গোপালগঞ্জে। বরিশাল ও ময়মনসিংহের আধিবাসী।
লেখা পড়া ও পেশা : কৃষি।
গবেষণা : ধানের আমিষ বৃদ্ধি।
ব্লগার।



প্রকাশিত বই : কাঠপাতার ঘর



দীর্ঘদিন নিউ ইয়র্কে প্রবাসী।

Post a Comment

1 Comments