![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhErAKcJ_SPXLB6LGIptLE5F7elHVKtg2A7_htZ_7EzjYW2w3CLwnQeKCLDRsE8SiaeGcq0-p9WlzLIh4xcLCioA8BMtdPjaf9mEZNxs06_9HeHczcn3OvBkhGNjJU456zbM6e51y1lZeM/s320/18920445_10212329082998208_5581230601309864157_n.jpg)
কুলদা রায়
ঈশ্বর মারা গেছেন। এখন তার চেয়ারে বসেছে শয়তান।
এই কথা দুটি আমাকে কাল বলেছে কিয়ারা। তার বয়স ছয় বছর। ছোট্ট প্রজাপতির মতো মেয়েটা। হোমলেস। তার বাড়ি সিয়েরা লীনে। তার বাবা নেই। শেষবার তার বাবাকে হোটেল রুয়ান্ডা নামে একটি হোটেলের দরোজা ভাঙার চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছিল। হোটেলটি নিচ্ছিদ্র পাহারায় আগুণে পুড়ে যায়। কিয়ারা ছুটে ছুটে আসে আমার কাছে। বলে, পবিত্র পুস্তকটি বের করো।
পবিত্র পুস্তকটি আমার টেবিলে সব সময়েই থাকে। একটা ইংরেজিতে। আরেকটি বাংলায়। আমি 'জোহন পর্ব'টি খুলে বসি। পড়ি, In the beginning was the word, and the word was with god. আদিতে বাক্য ছিলেন, এবং বাক্য ঈশ্বরের কাছে ছিলেন, এবং বাক্য ঈশ্বর ছিলেন।
কিয়ারা শুনতে শুনতে তার ছোট্ট ছোট্ট আঙুল দিয়ে আমার চুলগুলি পাট পাট করে দেয়। সিঁথি জলা করে। কলারটা সোজা করে। নাকের আগায় এক ফোঁটা ঘাম জমেছিল। এক টুকরো টিস্যু পেপার দিয়ে মুছতে মুছতে বলে, He was in the world, and the world came into existence through him, but the world did not know him.
'তিনি জগতে ছিলেন, এবং জগৎ তাহার দ্বারা হইয়াছিল, আর জগৎ তাহাকে চিনিল না'।
এবার আমার চশমাটি টেনে টুনে ঠিক করে কিয়ারা। তার আর দাঁড়াবার সময় নেই। দরোজায় মা ডাকছে। ঘুমোবার সময় হয়েছে। আমার ডান হাতটি একটু নেড়ে দিয়ে কিয়ারা বলে, বুঝলে ফ্রেন্ড, তাকে ওরা মেরে ফেলেছে। মিথ্যে বলে মেরে ফেলেছে।
মিথ্যে কিভাবে বলে? বাক্য দিয়ে মিথ্যে বলে। আদিতে এই বাক্য ঈশ্বর ছিলেন। এই বাক্য থেকে ঈশ্বর প্রকাশিত হলেন, তখন সেটা সত্য ছিল। এই বাক্য মিথ্যে ছিল না।
যখন বাক্যের মধ্যে মিথ্যে ঢুকে পড়ল ঠিক তখনই ঈশ্বরের মত্যু ঘটেছে। ঈশ্বর খুব ম্লান মুখে চলে গেছেন। তার চেয়ারটি খালি করে চলে গেছেন মৃত্যুর হাত ধরে। মিথ্যের সঙ্গে সত্যি থাকতে পারে না।
তারপর থেকে কৃষ্ণচন্দ্র বললেন, হে অর্জুন, বাণ ছোড়ো। দেরী করো না।
অর্জুন হাত দুটো বসনঅন্ধরে লুকিয়ে রেখে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, তা কি করে হয় সখা! আমি তীর ছুড়লেই আমার আত্মীয়-স্বজন মারা যাবে। মানুষ মরবে। আমি মানুষ মারতে পারব না।
কৃষ্ণ নীল মুখে হাসলেন। বললেন, না, তুমি কেনো মানুষ মারবে! এ জগতে কোনো জীবিত মানুষ নেই। জীবন ব্যাপারটিই বিভ্রম। তুমি কল্পনা করছো যে এরা সবাই জীবন ধারণ করে আছে। তাই এরা জীবিত। কিন্তু আমি, এই আমি জগদীশ্বর বলে যে প্রচারিত-- যার কোটি কোটি উদোর, কোটি কোটি মুখগহবর, কোটি কোটি সূর্যের প্রভা যার চোখের মধ্যে উদিত হচ্ছে, আমি দেখতে চাইছি, এ পৃথিবীতে জীবিত বলে কোনো শব্দ থাকতে পারে না। আমি মৃতদের জগত দেখতে চাই। তাই এ জগতে সবাই মৃত। সবাইকেই আমি মৃত করে রেখেছি। তুমি যাদেরকে মারছ বলে ভাবছ, আসলে তাদেরকে তুমি মারছ না। মৃত মানুষকেই মারার অভিনয় করছ মাত্র। নো লেট অর্জুন। হানো বাণ।
সাই সাই করে অর্জুনের তুন থেকে বাণ ছুটে গেল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে পড়ল মানুষের বুক থেকে। ঘাসের উপরে। ক্ষুধার্ত গৃধিনী সকল ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে, ভয়ে থমকে দাঁড়াল। রক্ত নদীর দিকে এগিয়ে চলেছে। এ রকম উষ্ণ রক্তবর্ণ নদী তারা কখনো আগে দেখেনি। এ সময় কে একটি ছোট্টো শিশু ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে উঠল, বাবা...!
এই দেখে পরম ক্ষমতাবান প্রভু বললেন, ধর্ম রক্ষার জন্য মিথ্যে বলা জায়েজ। যে তোমার দাওয়াতে সাড়া দিয়ে তোমার ধর্ম গ্রহণ করিবে না, তাহাকে মনে করিবে সে তোমার পবিত্র গ্রন্থের শত্রু। তাহার বিরুদ্ধে ধর্যুমদ্ধ শুরু করো। তাহাকে হত্যা করো। এই রূপে হত্যা করিতে মিথ্যে বাক্যের ব্যবহার করার আদেশ রহিয়াছে পবিত্র পুস্তকে। এই আদেশ বায়ূযোগে প্রদত্ত হইয়াছিল বিশ্বাস করিবে। নিশ্চয়ই অবিশ্বাসীর একমাত্র শাস্তি হলো মৃত্য।
এই রূপে ঈশ্বরের পুত্রকে হত্যা করা হয়েছিল ক্রুশে চড়িয়ে। এই রূপে হত্যা করা হয়েছিল ৬০ লক্ষ ইয়াহুদিকে। এই রূপে ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল ঈশ্বরের নামে। এরা জানে না যে, যে ঈশ্বরের নামে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, হচ্ছে বা হবে, সেই ঈশ্বর কার্যত বহু আগেই মৃত।
তার চেয়ারে যে বসে আছে, যাকে ঈশ্বর বলে চালানো হচ্ছে, সে আসলে প্রতিঈশ্বর--শয়তান।
অন্ধকার রাত্রিতে কিয়ারার মা দরোজাটা খুব সাবধানে খুলে বেরিয়ে আসে। সে তুতসী। আর তার নিহত স্বামী ছিলেন হুতু। এখন বিধবা। সে আমাকে ফিসফিস করে বলে, কিয়ারা সহজে ঘুমোতে পারে না। থেকে থেকে উঠে পড়ে। তারপর শুধায়, শয়তানের এই জগতে তাহলে সত্যি কী?
এর কোনো উত্তর নেই। উত্তর খোঁজার দরকারও নেই। কিয়ারার মা নিজেই বলে, ঐ চেয়ারটিই এখন একমাত্র খাঁটি সত্যি।
0 Comments