কুলদা রায়
নরেন্দ্রনাথ মিত্র এই গল্পটি লিখেছেন একটি আলমারি নিয়ে। স্ত্রী আলমারি কিনতে চেয়েছে। স্বামী আলমারিটা কেনার জন্য টাকা ধারকর্য করেছে। আলমারিটা কেনা হয়েছে। সংক্ষেপে গল্পটি এই তিন লাইনের। অতি সাদা মাটা গল্প। এটাকে নিয়ে খুব আখ্যান গড়ে তোলা সহজ নয়।
আলমারিটা স্টিলেরই হবে। গল্পকার স্টিলের বদলে ইস্পাত শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এই আলমারিতে সুন্দর আয়না থাকবে। তাতে দুজনের সুখী মুখ দেখা যাবে। একজন সামনে বসে দাঁড়ি কামাতে পারবে। আর থাকবে বেশ কিছু ড্রয়ার। তার মধ্যে সাজিয়ে রাখা যাবে দামি জামা-কাপড়। মূল্যবান গয়নাগাঁটি। ঘরের শোভাও হবে। দাম মোটামুটি তিনশো টাকার মধ্যে হবে।
এই তিনশো টাকা কিন্তু এখনকার নয়। পঞ্চাশ দশকের তিনশো টাকা। এই টাকাটা গল্পের চরিত্রের জন্য মোটেই কম নয়। দেড় মাসের বেতনের সমান। এই টাকা দিয়ে আলমারি কিনলে সারা জীবনের জন্য আর দাড়ি কামানোর ব্লেড কেনার পয়সা জুটবে না। ঘটনাটা ও হেনরির গিফট অফ মেজাই গল্পের মত। যখন স্ত্রী ঘড়ির ব্যান্ড কিনল তখন স্বামীর হাতে ঘড়িটিই নেই। সেটা বিক্রি করে স্ত্রীর জন্য সোনার চিরুণী কিনেছে। চিরুণী নিয়ে এসে দেখে স্ত্রীর মাথায় সুন্দর চুলই নেই। ঘড়ির ব্যান্ড কিনতে চুল বেঁচে দিয়েছে।
এই তিনশো টাকা কথার মধ্যে দিয়েই বোঝা যাচ্ছে গল্পের পরিবারটি নিম্নবিত্ত আয়ের। পরিবারের প্রধান সামান্য চাকরি করেন। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর কেরানী। নাম পরিতোষ। সুপ্রীতি তার স্ত্রী। বিয়ে হয়েছে দশ বছর। দুটি ছেলে মেয়ে আছে। ছেলেটা সাত বছরের। নাম খোকন। আর মেয়েটি পাঁচ বছরের। আদরের নাম বুড়ি। পরিতোষের দু ভাইবোনও তাদের সঙ্গে আছে। বোনটির নাম অঞ্জলি। সে কলেজে পড়ে। ভাইটি স্কুলের গণ্ডী পারুবে আগামী বছর। তার নাম রন্টু। তারা সবাই ভাড়া বাড়িতে থাকে। পরিতোষের হাজার দুই টাকার ইনসিওরেন্স আছে। ব্যাঙ্কে একটা নাম মাত্র অ্যাকাউন্ট আছে। সেখানে আছে মাত্র শখানেক টাকার মত।
এই সকল তথ্য আলাদা করে গল্পকার বলেননি। বলতে চাননি। আলাদা করে বলাটাকে প্রয়োজনীয় মনে করছেন না। কিন্তু তথ্যগুলো গল্পের ঘটনার মধ্যে দিয়ে এসেছে। কখনো সংলাপের মধ্যে দিয়ে। কখনো আখ্যানের মধ্যে দিয়ে। তবে এক সঙ্গে নয়। একটু একটু করে এই সব তথ্য পাঠককে আবিষ্কার করে নিতে হচ্ছে। তিনি বেশ গুছিয়ে নিয়ে কোনো স্বামী স্ত্রীর জন্য গল্প লিখছেন—সেটা যেন কারো মনে করার সুযোগ হয় না। এগুলো কোনো ডকুমেন্ট হয়ে উঠছে না। সরাসরি আখ্যানের দৃশ্যের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিচ্ছেন। প্রয়োজনে ডকুমেন্টেশন গুছিয়ে নিতে হয় পাঠককে। তিনি গল্পকার। কোর্টের মোহরী নন। এটাই এই গল্পের শক্তির দিক।
গল্পটি তিনি শুরুই করেছেন একটি বাক্য দিয়ে—স্ত্রীর সঙ্গে রোজ ঝগড়া হয় পরিতোষ সরকারের। কেনো? দামী কাপড় চোপড় রাখবার মতো একটা আলমারি নেই ঘরে। ফলে ট্রাঙ্কে-স্যুটকেসে অতি কষ্টে জিনিসগুলি গুঁজে গুঁজে রাখতে হয়। এ অবস্থা চলছে দশ বছর ধরে। মনে হয় স্বামী-স্ত্রীর এই ঝগড়াটি তাদের দাম্পত্যের জটিল সম্পর্কের ইঙ্গিত করছে। কিন্তু একটু পড়লেই বোঝা যায় ঝগড়ার মধ্যে তিক্ততা নেই। আছে সরসতা। দুজনের মধ্যে বোঝাপড়া বেশ সুন্দর বলেই মনে হয়—
১.
সুপ্রীতি বলে, “আমি আর পারব না তোমার ঘর গোছাতে। আর এই দামি দামি জিনিসগুলি যদি নষ্ট হয় তার জন্যেও আমাকে দায়ী করতে পারবে না।“ পরিতোষ নির্লিপ্ত থাকবার ভাণ করে বলে, “ বেশ, করব না দায়ী। সব দোষ তুমি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ো।” সুপ্রীতি রাগ করে বলে, “দোষ চাপালে আর কী হবে। গেলে আমার জিনিসই সব যাবে।”
অর্থাৎ জিনিসপত্রের অধিকাংশই সুপ্রীতির।
২.
পরিতোষের নিজস্ব বলতে আছে একটা গরদের পাঞ্জাবি, পৈত্রিক আমলের একখানি শাল। বিয়ের পাওয়া আংটি আর সোনার বোতাম। পরিতোষ কিছুতেই ব্যবহার করে না। ওর নাকি লজ্জা করে। তবে ঘড়ি আর পেনটি সঙ্গে সঙ্গেই রাখে। সুপ্রীতি খোঁচা দিয়ে বলে, “ও-সবও তো গয়না। ওগুলিও তো আমার বাবার দেওয়া জিনিস।”
পরিতোষ জবাব দেয়, “তোমার বাবার দেওয়া সব জিনিসের ওপরই যে আমার বিরাগ একথা, বলতে পার না। “ সুপ্রীতি বলে, “থাক থাক, আর রসিকতা করতে হবে না। তুমি যে কত ভালবাস আমাকে তা জানা আছে।”
এই সরস খুনসুটির মধ্যে দিয়ে গল্প এগোচ্ছে। জানা যাচ্ছে এই আলমারির বাসনাটা সুপ্রীতি করেছে সুচিরাদের বাড়িতে ঘুরে এসে। সেখানে চমৎকার একটা আলমারি দেখে এসেছে। সুপ্রীতি আর সুচিরা দুজনে কলেজমেট ছিল। সুচিরার বাবা বড় ডাক্তার ছিল। আর তার বিয়ে হয়েছে এক মাঝারি ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। ফলে তাদের ফার্নিচারের ঘাটতি নেই। তারা অবস্থাপন্ন। এই যে সুচিরারা অবস্থাপন্ন—এটা গল্পকার বলছেন না। সুচিরার বাবা আর স্বামীর পেশার কথা থেকেই জানা যাচ্ছে।
স্বামী স্ত্রীর এই আলমারি নিয়ে ঝগড়া বা মান অভিমান ব্যপারটি সত্যি সত্যি জটিল হয়ে পড়ল যেদিন সুপ্রীতি দেখতে পেল—তার সাধের বেনারসি আর মুর্শিদাবাদি সিল্কের শাড়ি দুটি পোকায় কেটেছে। ফলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেদেছে সুপ্রীতি। এ রকম কেঁদেছে এরকম কোনো উদাহরণ গল্পে আগে পাইনি। সম্ভবত কাঁদেনি। পরিতোষও দেখেনি। নতুন। তার এই কান্নাটা দেখে তার ৫/৭ বছরের ছেলেমেয়ে দুটি বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। দেওর আর ননদ ভয় পেয়ে গেছে। দাদা পরিতোষকে ঘরে ঢোকার আগেই সতর্ক করতে গেছে। এই বর্ণনা থেকেই বোঝা যায়-- সুপ্রীতির কান্নাটা আর স্বাভাবিক নেই। পরিতোষ আর আগের মতো করে এড়াতে পারছে না। কোনো স্তোক বাক্য দিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার কথা ভাবতে পারছে না। ফলে পরিতোষ স্ত্রীকে বলল, যে করে হোক আলমারি কিনে দেবে। কেনার সামর্থ্য না থাকলেও, এটা তার মান-সম্মানের বিষয় বলে, কিনতে হবে। এভাবে নিম্নবিত্ত পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর মান-অভিমানের পালার মধ্যে একটা টেনশন এসে গেল। আমরা ভাবতে বসে যাই-- কিভাবে কিনবে পরিতোষ? কিভাবে টাকা যোগাড় করবে? নাকি অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে হবে তাকে?
কিন্তু লেখক জানাচ্ছেন পরিতোষ তিনশো টাকা যোগাড় করেছেন তার বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে। এজন্য তার বন্ধুদের কাছে কিছুটা হতমান হতে হয়েছে। সুপ্রীতি স্বামীর এই টাকা যোগাড়ের পরিশ্রমটা দেখে বলেছে--থাক না এখন কিনে। পুজোর বোনাস পেলে কেনা যাবে। অন্য সময় হলে পরিতোষ স্ত্রীর কথায় রাজী হয়ে যেত। কিন্তু এখন এটা মান-সম্মানের মামলা। না কিনে উপায় নেই। সে স্ত্রীকে সুখী দেখতে চায়। এছাড়া জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। যে করেই হোক আলমারিটা কিনতে পারলে সেই সুখটি আবার পাওয়া যাবে। টাকা যোগাড় করে স্ত্রীকে নিয়ে আলমারি কিনতে রওনা হয়ে গেছে।
আলমারি কিনতে যাওয়ার বর্ণনাটির মধ্যে একটা আয়োজন করেছেন গল্পকার। পরিতোষ ঠিক যেন আগের পরিতোষ নেই। আলমারি কেনার জন্য পরিতোষ নতুন হয়ে উঠেছে। সেও আভিজাত্য জানে। আলমারি কেনার মধ্যে দিয়ে সেই আভিজাত্যের মধ্যেই প্রবেশ করছে। একে স্মরণীয় করে রাখতে চাইছে। পরিতোষ ট্যাক্সি ভাড়া করেছে। রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে। সুপ্রীতি একটু চমকে উঠেছে। এভাবে টাকা খরচ আগে কখনো করেনি। তাছাড়া আজ তাদের বিয়ে বার্ষিকীও নয়। এভাবে আলমারি কেনার আগেই পথে পথে টাকা খরচ করে ফেললে আলমারি কিনবে কী দিয়ে?
তখন পরিতোষ গুরুগম্ভীর করে বলেছে, “আজ আলমারির জন্মোৎসব। আর সে আলমারি শুধু ইস্পাত দিয়ে তৈরি নয়, আমাদের দু’জনের আনন্দ দিয়ে তৈরি।”
এই কথার মধ্যে দিয়েই প্রকাশিত হচ্ছে পরিতোষ কবির মত করে কথা বলছে। হয়তো সে কবিই। বিয়ের আগে কবিতা লিখত। সে কবিতা পড়ে সুপ্রীতিকে মুগ্ধ করেছিল। এভাবে মুগ্ধ করে তাকে বিয়ে করেছিল। এটা এই গল্পে উল্লেখ নেই। কিন্তু পাঠক হিসেবে অনুমান করতে ভাল লাগে।
তারা দুজনে ট্যাক্সি ছেড়ে হেঁটে হেঁটে নানা ফার্নিচারের দোকানে ঢুকছে। প্রথমে দামী দোকানে। দাম শুনে তারা চমকে যায়। শেষে একটা অপেক্ষাকৃত ছোটো দোকানে এলো। নাম চন্দ অ্যান্ড কোম্পানি। সেখানে বড় দোকানের অনুকরণে তৈরি আলমারি পেল। কিন্তু দামে কম বলে তারা স্বস্তি পাচ্ছে। আড়াই শ টাকায় যেটা পেল সেটা তাদের অপছন্দ নয়। তবুও আরও কিছু কমাতে চেষ্টা করছে। ঠিক তখনি দোকানের মালিক পেছনের অফিস ঘর থেকে তাদের সামনে এলো। গল্পের মধ্যে আরেকটি চরিত্র ঢুকল। তাকে দেখে সুপ্রীতির চেনা মনে হল। ঠিক তাই। তার নাম নির্মল। তিনি সুপ্রীতির চেয়ে বড়। এখানে এসে গল্পকার খানিকটা ব্যাক স্টোরির মত সামান্য একটু পূর্ব ইতিহাস বলছেন। সেখান থেকে জানতে পারা যাচ্ছে—সুপ্রীতির বাবা অঙ্কের প্রফেসর ছিলেন। সুপ্রীতি সে সময়ে সারা রাজশাহী শহরে তরুণদের ভয়ের ব্যাপার ছিল। ঠিক ভয় কি? গল্পকার তা বলছেন না। শুধু বলছেন সুপ্রীতি ভয় পাওয়ার মত তাকে উৎপাত করত।
এটুকু শোনার পর মনে হল এবার হয়তো আমরা একটি প্রেমের আখ্যানে যাচ্ছি। একটা ক্লাইমেক্সে মুখোমুখি হচ্ছি। নির্মলদা আর সুপ্রীতি নামের এই তরুণী বধুটি পরস্পরের পূর্বকালে প্রেমে পড়েছিলেন। এই প্রেমের দায় যতটা নির্মলদার—তার চেয়ে বেশি ছিল সুপ্রীতির। কিন্তু বিয়েটা হয়নি। তার আগে নির্মলদা চলে গেছেন বিদেশে। এর মধ্যে সুপ্রীতির বিয়ে হয়ে গেছে। কোথায়, কার সঙ্গে, কিভাবে-এসব কিছুই তার অজানা। কিন্তু এসব আবার আমাদের অনুমান করে নিতে হচ্ছে। গল্পকার সরাসরি কিছু বলছেন না। কোনো বিষাদপূর্ণ সংলাপ আমরা দুজনের মধ্যে শুনতে পাছি না। দীর্ঘশ্বাস বুঝতে পারছি না। না পাওয়ার বেদনার ভারে চোখের জলও পড়ছে না কারো। বরং নির্মলদা একটু সতর্কতার সঙ্গে পরিতোষকে সুপ্রীতি সম্পর্কে বলছেন—রাজশাহী শহর সুদ্ধ লোক ওর জ্বালায় অস্থির ছিল। অর্থাৎ এই মেয়েকে নিয়ে নির্মল যে পাগল হয়েছিলেন বা হতে পারেন সেটাকে যেন বিশেষভাবে পরিতোষ না নেয়। যেন কোনো সন্দেহ না জাগে। হয়তো তার জ্বালানোটা অন্য রকম ছিল। অস্থিরতাটা অন্য রকম ছিল। হয়তো নির্দোষ ছিল। স্বামী হিসেবে পরিতোষকে এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। পরিতোষ এই পর্যায়ে এসেই নির্মল এবং সুপ্রীতির মুখের দিকে বিশেষভাবে আতিপাতি করে খুঁজে দেখল। দুজনের মুখেই বিশেষ চিহ্ন নেই। সন্দেহ করার মত কিছু নেই।
তারা একটা আলমারি কিনল। গল্পটি আলমারি কেনার। টাকা যোগাড় করেই নিয়ে গেছে পরিতোষ। দামটাও আয়ত্বের মধ্যে। স্ত্রী পছন্দও হয়েছে। মালিক পরিচিত বলেই বিশ্বাসযোগ্য। মালে ফাঁকি দেবেন না। তাদের ঠকাবেন না। ফলে না কেনাটা আর কোনো সমস্যা নয়। কেনাটা যখন হয়েই গেল তখন আর গল্প থাকে না। এখানে এসে আমরা যে ক্লাইমেক্সের সন্ধান পেয়েছিলাম সেটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। এবার খুশি মনে আলমারি নিয়ে পরিতোষ আর সুপ্রীতি বাড়ি ফিরবেন। কাপড় চোপড় গয়না গাটি যা কিছু আছে—তা রাখা যাবে। পরিতষ একটা টুলে বসে আলমারির আয়নায় দাড়ি কাটতে বসবে। আর এর ফাঁকে এসে সুপ্রীতি কপালের টিপটা ঠিক করে বসিয়ে নেবে। এটা একটা সুখের ছবি। এই সুখটা পাওয়ার জন্যই এই আলমারি কেনা।
কিন্তু গল্পটা শেষ হয়েও শেষ হয় না। আলমারিটা কেনার পরে নির্মলদা তার দাম নিলেন না। এই দাম না নেওয়ার ব্যাপারটাই গল্পের একটা বাঁক এনে দিল। পরিতোষ এতোটা আশা করেনি। তার চমকে ওঠার পালা। চমকটা প্রকাশের আগেই সুপ্রীতি খুব স্বাভাবিক করে দিল তাকে। দাম দেওয়ার খুব চেষ্টা করল। কিন্তু নির্মলদা এটাকে আমল দিলেন না। পরিতোষের দিকে চেয়ে বললেন, “ওর বিয়ের সময় দেশে ছিলাম না। তখন কিছুই প্রেজেন্ট করতে পারিনি। আজ এটা ওকে দিলাম।”
পরিতোষের এখানে কোনো কথা নেই। কিন্তু সুপ্রীতি আর নির্মলদা যেন কথা বলছেন। কথা বলে পরিতোষের কাছে নির্দোষ সম্পর্কের সূত্র হাজির করছে। এ এক জটিল খেলা হয়ে উঠছে। পরিতোষ এ খেলার একমাত্র দর্শক। সুপ্রীতির এই দোনামনা শুনে নির্মলদা দুটো তথ্য দিলেন।
১. যদি দিতেই হয় তবে যেন তাদের বাড়িতে গিয়ে সে তার মায়ের কাছে দাম দিয়ে আসে। তার মা বলতে নির্মলদার মা। জানা যাচ্ছে সুপ্রীতিত তাকে মাসিমা বলে ডাকতো। তাদের মধ্যে ভাল সম্পর্ক ছিল। সম্পর্ক এমন যে তা কোনো মূল্যে নিরুপিত হয় না।
২. একটি তথ্য গোপন করে গেলেন গল্পকার। সেটা হল—পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়ষ্ক নির্মল চন্দ নামে সুদর্শন ধনী বিদেশ প্রত্যাগত যুবক বিয়ে করেছেন কিনা অথবা তার স্ত্রী আদৌ আছে কিনা—এ তথ্যটি গল্পে কোথাও বলছেন না। সুপ্রীতিও জিজ্ঞেস করছে না। পরিতোষও নয়। সে কিছুটা এড়িয়ে যেতে চাইছে। একটু দূরত্ব রাখছে। আবার কান খাড়াও রেখেছে। মন দিয়ে শুনছেন—সুপ্রীতি কি বলে। নির্মলদা বিবাহিত হলে তিনি হয়তো বলতে পারতেন যে সুপ্রীতি তুমি আমার বাড়িতে গিয়ে তোমার বউদির হাতে টাকাটা দিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারো। এটা বলাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্ত্রীর উপস্থিতি না বলার মধ্যে দিয়ে, শুধু মায়ের উল্লেখ করার মধ্যে একটা কথা হয়তো বলতে চাইছেন তিনি, নির্মল চন্দ নামের এই যুবকটি কোনো না-পাওয়ার বেদনায় বিয়েই করেননি। এটাও গল্পকার আমাদের অনুমান করে নিতে বললেন। শুধু আলমারি কেনা হল বলে তিনি একটা আনন্দের গল্প বলতে চাইছেন। সুখের কথা বলতে চাইছেন। একটি অসামান্য দাম্পত্য প্রেমের ঘটনা বলতে চাইছেন। সেটা বলেও ফেলেছেন। গলকার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে এই আলমারি কেনার ঘটনাটি পরিতোষের জন্য আরও আনন্দ দায়ক ব্যাপার এজন্য যে তাঁর আড়াই শো টাকা বেঁচে গেল। তাকে ধার করা টাকার জন্য আর দুশিচন্তা করতে হবে না। সে খুব সহজেই ফেরত দিতে পারবে তার বন্ধুদের কাছে। তাদের কাছে হতমান যতটুকু হয়েছিল ঠিক ততটুকু মান আবার পুনরুজ্জীবিত হতে পারবে।
এখানে এসে আমরা একটা পরিতৃপ্তির শ্বাস ফেলি। বুঝতে পারি গল্পটি শেষ হয়ে গেছে। আর পরিতোষ তখন নিঃশব্দে রাস্তায় নেমে এল। ধার-করা টাকাগুলি এবার সে অনায়াসে শোধ দিতে পারবে। কিন্তু অত বড় আলমারিটা যে ঘর জুড়ে থাকবে তাকে ভুলবে কী করে?
আলমারিটা? না, নির্মলদা? কে ঘর জুড়ে থাকবে? এই প্রশ্নে আমরা চমকে উঠি। বুঝতে পারি গল্পটি এতক্ষণ যা শুনে এসেছিলাম, তা শেষ লাইনটিতে এসে খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়ল। আমাদেরকে চমকে দিল। গল্পটি বলার নামে পাঁচ পাতা জুড়ে গল্পকার যা বলেছেন, যা মন্ত্রমুগ্ধর মত বিশ্বাস করে এসেছি—তা আসলে গল্পকার এই গল্পটিতে বলতে চাননি। তিনি শেষ লাইনে থেকেই মূল গল্পটি শুরু করেছেন। এই গল্পের বাকিটুকু পরিতোষ সারাজীবন ধরে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের মধ্যে বুনে যাবে।
নরেন্দ্রনাথ মিত্রেরএই আলমারি গল্পটিতে একটিও বাড়তি শব্দ নেই। বাড়তি বাক্য নেই। বাড়তি চরিত্র নেই। বাড়তি চরিত্র নেই। ফালতু আলাপ নেই। গল্পকে টেনে লম্বা করার প্রবণতা নেই। এমনকি কোনো মেসেজও নেই। ছোট ছোট বাক্যে সহজ সরল করে আলমারি, পরিতোষ, সুপ্রীতি আর শেষদিকে এসে কোনো এক নির্মলদার গল্প বলছেন। নির্মলদা যখন এলেন, এলেন তো এলেন, তাতে আবার আলমারিটির দশ বছর আগেকার সুপ্রীতি নামের মেয়েটির বিয়ের উপহার হিসেবে গছিয়ে দেওয়ার দরকারটাই বা কী? আর দিলেন তো দিলেন, বেচারা পরিতোষ আলমারিটি সোজা বাড়িতে নিয়ে আলমারি ভর্তি অসুখ পুরে দিলেন, যে অসুখটি পরিতোষের গোপনে পুষে রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকল না! শুনে আমরা বলি, হায়।
আখ্যান বলার ভঙ্গিটি সহজ সরল বলেই আকর্ষণীয়। যে কোনো পাঠককে কোনোভাবেই বিব্রত, ক্লান্ত, বিরক্ত করে না। পাঠক গল্পের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েন। বুঝতেই পারেন না যে এটা একটি গল্প বলা হচ্ছে। কোনো মেলোড্রামা নেই। চমক আছে সেটা—মনস্তাত্বিক চমক। সে চমকটি খুব বেশি তীব্র, তীক্ষ্ণ, সূচিমুখী, অন্তর্ভেদী বলে তা গল্পের গুপ্ত সম্পদ হিসেবে মূল চরিত্রের মনের আলমারিতে সুরক্ষিত হয়ে পড়েছে। তাকে প্রতিদিনই রক্তাক্ত করবে। ফলে গল্পের অন্য কোনো চরিত্র তার সন্ধান টের পাচ্ছেন না। টের পেতে দিচ্ছেন না গল্পকার। যে আলমারিটি পেতে চেয়েছিল সুপ্রীতি তাই সে পেয়েছে। আর সেটা দিতে ও হেনরির গিফট অফ মেজাই গল্পের মত আত্মত্যাগের পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছিল পরিতোষ। নিজের মহত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। চিরায়ত আনন্দের উত্থান ঘটাতে চেয়েছিল। গল্পটি যখন পূর্ণপাঠ হল, তখন আমরা পাঠক সমাজ বুঝতে পারছি—সে আনন্দ আসলে অনন্ত বেদনায় পরিণত হয়েছে। আত্মত্যাগ নয়—আত্মবেদনার ভারে জর্জরিত হয়েছে পরিতোষ। মহত্বের বদলে হীনমন্যতার জন্ম হচ্ছে। সন্দেহজাত বিষাদ বৃক্ষের উদ্ভব হচ্ছে। তাতে শাখা-প্রশাখা হবে। পাতা হবে। ফুল ফুল ফুটবে। ফল ধরবে। এটাই তার নিয়তি।
ছোট গল্প তো এরকমই। বিন্দু হয়ে ওঠে সিন্ধু । সুখের গল্পের মধ্যে দিয়ে অসুখ বের হয়। অসুখের মধ্যে দিয়ে সুখের সাক্ষাৎ মেলে। আমরা, পাঠকরা আগে থেকে বুঝতে পারি না। যখন বুঝতে পারি তখন টের পাই এটা এক যাদুকরের কব্জির খেলা। আমরা বিমুগ্ধ দর্শক মাত্র। তিনি শুন্য থেকে আনছেন গোলাপ ফুল। গোলাপটি হাওয়ার উপরে বসিয়ে দিচ্ছেন। আমরা দেখছি গোলাপটি হাওয়ায় নয়—আছে জলের উপরে। তিনি হাত নাড়ছেন। আমরা অবাক হয়ে দেখি—গোলাপের ওপর একটি পরীর মত ছোট্ট মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার ঠোঁট নড়ছে। হেসেও উঠছে। আমরা মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলছি। আবার যাদুকর হাত নেড়ে দিলেই মেয়েটি শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। তার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। যাদুকর কাঁদেন না। তিনি নিরাবেগে এই যাদুটি দেখাচ্ছেন। যা দেখাচ্ছেন তাই দেখতে পাচ্ছি। কোনো কিছুই মিথ্যে মনে হচ্ছে না। সত্যি হয়ে উঠছে। এবং এটা যে সত্যি—কারো বানানো নয় এর প্রমাণ হল—যাদু দেখার সময়ে আমরা যাদুকরের উপস্থিতিটা ভুলে যাচ্ছি। তার উপস্থিতি থাকলে যাদুটি আর যাদু থাকতো না। সেটা কৃত্রিম বলে মনে হত। আমরা নির্মাতাকে দেখি না। দেখি তার নির্মাণকে। তিনি পাষাণ। আর আমরা গলে যাই। আমরা কাঁদতে বসি। এ কান্না করতে কেউ জোর করেন নি। ভেতর থেকে এসে পড়ে। এভাবে গল্পের শেষে দেখতে পাই—সুপ্রীতি নেই। নির্মলদাও নেই। পরিতোষও নেই। শুধু তার অনন্ত হাহাকারটি জেগে আছে। সেটা অসহনীয় বলে আমরা আকুল হয়ে গল্পকারকে খুঁজতে চেষ্টা করি। দেখি—না, তিনিও নেই। তিনি সবার আগে চলে গেছেন। তিনি কোনোকালে কথক হিসেবে গল্পটি বলতে শুরু করেছিলেন তার কোনো প্রমাণও নেই। গল্পটি নিজের মত করেই নিজেকে বর্ণিত করেছে মাত্র। গল্পটি কোনো গল্পকারের হাতে নয়—নিজেই নির্মিত হয়েছে নিজের মত করে যাকে আমরা সত্যি বলে জানি।
গল্পটি লেখা হয়েছে ৫৯ বছর আগে। কিন্তু একটুও বয়স্ক মনে হয় না। মনে আজই লেখা হয়েছে। লিখেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র নামের এক গল্পকার। তার বয়স মাত্র ৪০। অথচ এ বছর তিনি ১০০ পার হচ্ছেন। আরো ১০০ পার হবেন। কিন্তু গল্পের মধ্যে বেঁচে থাকবেন।
মূল গল্পটি পড়ুন
আলমারি
গল্পকার : নরেন্দ্রনাথ মিত্র
1 Comments
অসাধারণ লেখা। মুগ্ধ করল আপনার আলোচনা। শ্রদ্ধা রইল।
ReplyDelete