কুলদা রায়ের গল্প : গন্নিবিবির জুতা-পাখি


১. এক যে ছিল জুতা

আমাদের ঠাকুরদার কোনো জুতা ছিল না। জীবনের শেষ দিকে তিনি প্রায়ই জুতার কথা বলতেন। যেদিন আমাদের পুকুরে ফুট ফুট জ্যোৎস্না উঠত—পদ্ম ফুটতো, সেদিনই ঠাকুরদা চুলে ঘন করে চিরুনি করতেন। তারপর বলতেন, যেদিন আমাগো চরে প্রিন্স অব ওয়েলসের বার্থডে উপলক্ষ্যে ব্যান্ডপার্টি বাইজা উঠল, সিকদার বাবুগো গদিঘরে গন্নিবিবি ঝননে ঝনেন ঝা বলে পা দিয়া দাপানি তুলল—হ্যার আগের দিনই একজোড়া পাম্পসু কেনা হইছিল।

কাহিনী এইটুকু। এরপরে আর খুব বেশী জানা নেই। ঠাকুরদার উপর্যুক্ত ভাষ্য থেকে দুটো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে–

গন্নিবিবি সিকদারবাবুদের গদিঘরে পা রেখেছিলেন। গান গেয়েছিলেন। পা দাপিয়ে নেচেওছিলেন।

এবং একজোড়া পাম্প-সু জুতা কেনা হয়েছিল।

জুতা কেনার সময়টাও বলে দেয়া আছে। গন্নিবিবি যেদিন গদিঘরে গেয়েছিলেন–নেচেছিলেন, তার আগেরদিনই কেনা হয়েছিল জুতাজোড়া।

প্রশ্ন হল, পাম্প সু জুতা কার জন্য কেনা হয়েছিল?

আমাদের গাঁও-গেরামের ভূভারতে কেউ কখনো পাম্প সু পরে নাই। আমার ঠাকুরদাও পরে নাই।। আমার বাবাও না। বংশধারা মানলে আমিও না। সত্য হল সেকালে প্রজাসাধারণের জুতা পরার সামর্থ্য ছিল না। শতকরা ২/১ একজন যাদের কিঞ্চিৎ সামর্থ্য অর্জিত হলেও তাদের জন্য জুতা পরা অনুমোদিত ছিল না। পরলে তাদের জন্য জুত নামক নরক নির্ধারিত ছিল। সর্বোপরি এই জল-কাদার দেশে পা ফাটা দাদ ওয়ালা লোক জুতো পরবেই বা কোথায়? সুতরাং ঠাকুরদার জন্য জুতো কেনার কোনো সুযোগই থাকার কথা নয়।

তাহলে আরেকটি প্রশ্ন ওঠে — কার জন্য এই পাম্প সু জুতা কেনা হয়েছিল–-সিকদার বাবুর জন্য? না, সেন্ট মথুরানাথ সরকারের জন্য?

এই পাম্প সু বিষয়ে আমাদের বাড়িতে তেমন কোনো নথিপত্র কখনো পাওয়া যায় নাই। পাওয়ার কথাও নয়। আমাদের থাকার মধ্যে পুরনো একটি সিন্দুক বড় ঘরের এক কোনে ছিল বটে। রটনা ছিল—জলের তলা থেকে তোলা হয়েছিল সিন্দুকটা। এই হেতু সারা গায়ে জং ধরা। সেটায় বিশ্বকর্মা পূজার দিনই কেবল তেল সিন্দুর পড়ত। আর সারা বছর সিন্দুকটার উপর বসে বসে পা দোলাতে দোলাতে বলেছি, খুল খুল সিম যা। আমাদের পায়ের আঘাতে যেদিন সত্যি সত্যি লোহার সিন্দুকটির দরোজা সামান্য একটু খুলে গেল, আমরা কজন মিলে পুরোটা খোলার জন্য দরোজা ধরে টান মেরেছি, মড় মড় শব্দ করে সেদিন দরোজাটি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। উঁকি মেরে দেখা গেল সিন্দুরটার মধ্যে শুধু পুরনো অন্ধকার—আর কিছু নাই। সেই অন্ধকার একটু সয়ে গেলে বোঝা গেল ওটা ঠিক অন্ধকার নয়, গন্ধের ছায়া। ঠিক ছায়াও নয়–এক ধরনের মায়া। একে আমরা বাসি গন্ধ বলি। আর টিকটিকির ডিমের দুটো খোসা। কোনো নথিপত্র নেই।। তবে একটা জিনিস। সেটা পরে বলব।

তাহলে কি আমার ঠাকুর মার জন্য কেনা হয়েছিল সু-জুতা জোড়া? অথবা অন্য কোনো মহিলার জন্য? ঠাকুরমা ছাড়া অন্য কোনো মহিলা হলে তিনি কে?


২. তার আগে ঠাকুরমা :

আমাদের ঠাকুরমার মাথায় কিছু ঝামেলা ছিল। আর ছিল শাদা কাশফুলের মত চুল। বিষাদপূর্ণ মুখে সারাদিন গজগজ করে যেত। তাঁর অর্থ কোনো ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে এই গজগজানি শুনে আমাদের মা জননী কিছুটা কথাসূত্র আন্দাজ করতে পেরেছিল। তার একটি ছোটো খাটো তালিকা নিম্নরূপ—
সত্যি সত্যি ঠাকুরদা একজোড়া পাম্প সু কিনেছিলেন।
মেইড ইন চায়না। ১০০% লেদার।
প্রাপ্তিস্থান, চিনে বাজার। ক্যালকাটা।
জুতা উইদাউট লেস। ব্লাক। একে জুতা নয়—মোকাসিন বলে।
‘জুতা পরিলে ধুলো লাগিতে পারে’—এই হেতু ঠাকুরদা কর্তৃক জুতা কদাপি পরিহিত হয় নাই।

জুতা জোড়া নিয়ে ঠাকুরদা ঘুমুতে যেতেন। কখনো হাত ছাড়া করেন নাই। আর ‘তার জীবিত ছোটি বহু জাগিয়া থাকিতেন বিছানার পার্শ্বে। তাহার চক্ষু নিমীলিত।‘ ঠাকুরদা জেগে উঠতে পারে এই আশংকায় তার হাত থেকে সেই জুতা জোড়া নিতে ঠাকুরমা পারেন নাই। তিনি জুতা জোড়াকে এক ধরনের দূরত্ব থেকে গভীরভাবে লক্ষ করতেন। কিন্তু ঠাকুরদার হাতের মধ্যে থাকায় জুতা জোড়ার খুঁটি-নাটি পরীক্ষা করার সুযোগ পান নাই। এইভাবে বেশীদিন নহে—মাত্র একযুগ’। জনশ্রুতি আছে ঠাকুমার সিঁথির সিন্দুর অক্ষয় হয়েছিল। তার হাতের নোয়া- শাঁখা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত টিকে ছিল।

এই জুতার জেন্ডার ইস্যু নিয়ে পরে ঠাকুরমার একটা সন্দেহ হয়েছিল। জুতাটা কার ? জুতাটা কি পুরুষের? না, মহিলার? মহিলাদের?—না, পুরুষদের?

যে জুতাটি নিয়ে ঠাকুরদা বিছানায় যেতেন—সে জুতাটি কিন্তু কেউ দেখে নাই। বাবাও না-আমার মাও না। আমাদের ভাইরাও না। বোনরাও না। সবাই একটা অনুমান থেকে কথা বলছে। একালে কে না জানে অনুমান সিদ্ধান্ত হয় না। কিছু অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে প্রমাণে যেতে হয়।

আমাদের কোনো প্রমাণ নেই– সম্বল কেবল আমাদের ঠাকুরদা স্বর্গীয় শ্রী বিদু রায়ের সেই মৌখিক বয়ানটি। গল্পচ্ছলে তিনি একদিন এই বয়ানটি আমাদের বলেছিলেন। তখন তিনি বয়েসের ভারে অনেক ন্যুব্জ। জীবনে অনেক বেদনার ভার তাকে বহন করে যেতে হয়েছে। তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল। কখন কি বলে বসেন ঠিক নাই। ফলে তার কথা আমলে নেওয়ার কোনো কারণ নেই। এই জুতা জোড়া ঠাকুরদাও দেখেছেন কিনা সে প্রশ্নটাও সন্দেহমুক্ত নয়। অথচ জুতাটি না দেখলে ঠাকুরমা জুতাটার জেন্ডারত্ব নিয়ে সন্দেহ করল কিভাবে? কেনো সন্দেহ করল? এ প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুরমার কণ্ঠ থেকে শুধু উদ্ধার করা যেত—হিরি হিরি।

আমাদের এলাকায় প্রখ্যাত বিজিতেন ডাক্তারের কাছে একবার ঠাকুরমাকে নেওয়া হয়েছিল। তিনি ঠাকুরমাকে দেখে শুনে ডায়াগনোসিস করেছিল, নন কিউরেবল মাথা খারাপ। ওরফে ক্লাসিক্যাল ডিপ্রেশন। ডিপ্রেশনের কারণটা ঠিক স্পষ্ট নয়।

সে সময়ে আমাদের গঞ্জ থেকে পাঁচ ক্রোশ দূরে অবস্থিত কলপুরের প্রখ্যাত মহিলা গুণীন কেসির মা ছিলেন সাক্ষাত ধন্বন্তরীর কন্যাসম। তিনিই ছিলেন এই বিল এলাকার মানুষের সত্যিকারের অব্যর্থ সর্বরোগহর চিকিৎসক। কলাটা-মূলাটা ছিল তার ভিজিট। এই কেসির মায়ের জড়ি-বুটিও ঠাকুরমায়ের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল। শেষে তিনি চোখ বুজে বলেছিলেন, হ্যার বাই-লেগেছে। কেসির মায়েদের চিকিৎসা ভুবনে ডায়াগনোসিস কালচারটা নেই। তাদের সব কিছুই ধ্যানে আসে—জ্ঞানে আসে। এই জ্ঞানকে দর্শনে স্বজ্ঞান বলে। ফলে কার কথা আমরা বিশ্বাস করব—হিরি কিরি ঠাকুর মাকে, না স্বজ্ঞানী কেসির মাকে?

তবে এ কথা ঠিক যে, ঠাকুরমার জীবন ছিল জুতাজনিত কারণে দীর্ঘশ্বাসময়। এর তুল্য বিষাদ আর কিছু হয় না।

বি.দ্র. আমাদের মা জননী যে ঠাকুরমার গজগজানি থেকে এই তালিকা উদ্ধার করেছিলেন তা কিন্তু প্রমাণ হয় না। আমাদের মা সে রকম কিছু স্বীকার করেননি। ওটা জনশ্রুতিরই পুনর্বয়ান ধরা যেতে পারে।

কিন্তু অই জনপদের জনচিত্তে এর ঘটনাগুলো চিরকাল গুপ্ত থেকেছে। ঘটনা নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা নাই। শুধু তারা চৈত্র সংক্রান্তির দিনে ঢাক-ঢোলাদির বাদ্যসহযোগে আমাদের বাড়িতে আগমণ করেছে। বাড়ির সাম্নের বটতলায় ছোটোখাটো মেলাও বসেছে। তার নাম ছিল সু-এর মেলা। এ মেলায় আমার ঠাকুরদাকথিত সেই ঐতিহাসিক সু-র একটা কাঠের রেপ্লিকা তৈরি করে দিয়েছিলেন তৎকালীন বিশিষ্ট সমাজসেবক সেন্ট মথুরানাথ সরকার। তার একটিমাত্র শর্ত ছিল– সমাগত পাপীদিগে সদাপ্রভু যীশুখ্রিস্টের সুসমাচার বিনামূল্যে বিতরিত হবে। উইথ চা ও কুড়মুড় ভাজা। খ্রিস্টের কাছে না হলেও সু-জোড়ার কাছে মানত করে কেউ কখনো ব্যর্থ হয় নাই। এ মেলায় কেউ সু বা জুতা পরে না। নগ্ন পদেই ঠাকুর দর্শনে আসে। যদি কেউ ভুল করে জুতা এনে বসে তাহলে সু-এর রেপ্লিকার প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ সেটা বগলে রাখে। তার প্রতি অভক্তি করে এমন অসাধ্যি কারো নাই। দাশুরথী দাসের অনুকরণে একটি পাঁচালীও প্রচলিত আছে এলাকায়–

শুন সবে ভক্তি ভরে করি নিবেদন।
জুতা মায়ের শক্তিধারা করিব বর্ণন।।

৩. মতিবিবির বৃত্তান্ত

সিকদারবাবুর গদিঘরে যে গন্নিবিবি এসেছিলেন মাহফিলের বায়না নিয়ে তার সম্পর্কে সরাসরি কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাকে খুঁজতে হবে মতিবিবির সূত্রধরে।

এক মতিবিবির উল্লেখ আছে সেকালের বটতলার উপন্যাসে –সেকালে ভারত-প্রত্যাগত ইংরেজ নবাবদের আত্মজীবনীতে। মতিবিবি সেকালের বাইজী শ্রেষ্ঠা। মতি বিবির মাসে হাজার টাকা দর ছিল। বৃটিশ ইতিহাসে উল্লেখ আছে– এক ভারতবংশীয় প্রিন্স দ্বারকানাথ তাকে ইংলন্ডে নিয়েছিলেন। সপ্তসিন্ধু পার হয়ে ইংলন্ডে যাওয়ার পরে একদিন ভোরবেলা তিনি নিত্য পূজোয় বসেছেন। এর মধ্যে রাজবাড়ির এক লর্ড এসে হাজির। বলল, বাবুকো বোলাও। বাবুর গেটম্যান লর্ড সাহেবকে সোজা হাকিয়ে দিয়ে বলল, পরে আসো। এখন নো এন্ট্রেন্স।

অন্য লোক হলে লর্ড ক্ষেপে যেত। একটা বিদিকিচ্ছিরি কাণ্ড কারখানা হত। কিন্তু এখানে সেটা করল না। প্রিন্স দ্বারকানাথ বৃটিশ সাম্রাজ্যের মহারাণী ভিক্টোরিয়ার পেয়ারা লোক। মহারাণী তার ব্যক্তিগত ডাইরীতে একবার দ্বারকানাথ প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক বেশ ভাল ইংরেজি বলেন এবং তিনি একজন বুদ্ধিমান ও চমৎকার মানুষ। সুতরাং ভারত বংশীয় নেটিভ বাবু হলেও প্রিন্সকে হেলা করা যায় না।

সেবার বিলেত যাত্রায় প্রিন্স দ্বারকানাথের সঙ্গী ছিলেন ইউরোপীয় চিকিৎসক ডা. ম্যাকগাওয়ান, তাঁর ভাগনে চন্দ্রমোহন চ্যাটার্জী, ব্যক্তিগত সহকারী পরমানন্দ মৈত্র, তিন জন হিন্দু ভৃত্য ও একজন মুসলমান বাবুর্চি। আরও কজন এসেছিলেন। তাদের নাম সুস্পষ্টভাবে লিখিত পাওয়া যায় না।

বিলেতে প্রিন্স দ্বারকানাথকে রাজকীয় সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রবার্ট পীল, বোর্ড অব কন্ট্রোল এর প্রেসিডেন্ট লর্ড ফিটজার্যাল্ড, প্রিন্স এলবার্ট, কেন্ট-এর রাজকুমারী এবং রানী ভিক্টোরিয়া। প্রিন্স ভারত থেকে বিস্তর ভেট এনেছেন। রাজবাড়িতে তাঁর খাতির আগের চেয়েও বেড়েছে। এটা লর্ড জানে। তাই ঝামেলা না করে লর্ড সোজা বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।

ঠিক এক ঘটিকা পার হলে প্রিন্সবাবু দরোজার বাইরে এলেন। হেসে বললেন, আইসেন। আইসেন হে লর্ড মহোদয়। কখন আইসাছেন? অধিক সময় নহে তো?

বহির্বাটিতে অবস্থানকালে উৎপাদিত ক্ষোভ লর্ড বিলক্ষণ চেপে গেল। তখন তার নজর গবাক্ষপথে। সেখানে এক রমণীরত্ন দাঁড়িয়েছিল। তাকে দেখে ক্ষণে ক্ষণে তার শিহরণ জেগেছে। এই ধরণের কালো প্রস্তর-মূর্তি কেবলমাত্র ভারতেই দেখা যায়। অনিন্দ্য সুন্দর। স্বপ্নে ছাড়া বাস্তবে দেখা অসম্ভব। কপালগুণে প্রিন্সের বাড়িতে ঢুকতে না পেরে আজ সেই স্বপ্নে দেখা রমণীরত্নের সন্ধান পেয়েছে লর্ড। তার সময় নষ্ট হয় নাই—এ ধরণের রমণীরত্নকে দেখার জন্য হাজার বছর বহির্বাটিতে দাঁড়িয়ে থাকতে কখনো কষ্ট হয় না। এইখানে যুগ হয়ে যায় নিমেষ। এ কারণে লর্ড প্রিন্সের গেটম্যানকে যারপর নাই ধন্যবাদ দিল মনে মনে। লর্ড প্রিন্সের প্রশ্নের উত্তরে বলল, ডোন্ট অরি। আমি এইমাত্র আসিয়াছি।

প্রিন্স একটু হেসে বললেন, সহি বাত। তবে কিনা পূজার সময় আমি দেবদ্বিজেও দেখা দেই না। তারপর মাংস আহার করি। কিঞ্চিৎ মদ্যপান।

সাহেবও হেসে কহে, জানি, জানি হে প্রিন্স। আপনার কোনো কিছুই আমাদের অজানা নাই। আপনি কদাপি দেখা না দিলেও চলিবে। বাই দি বাই, আপনার মিসেস কি আসিয়াছেন?

এই প্রশ্নে প্রিন্স একটু বিস্মিত হলেন। এইভাবে প্রাইভেট বিষয়াদি নিয়ে প্রশ্ন করাটা সুসভ্য ইংরেজ সহবতে থাকার কথা নয়। তবু প্রিন্স নিজের সহবত হারালেন না। বললেন, তিনি আমার সঙ্গে সহবাস করেন না।

এবার লর্ড তার বাপ-দাদার কাছ থেকে অর্জিত জ্ঞানের বান ছাড়ল, সহমরণ তো করিবেন তিনি?

এই প্রশ্নে কঠিনভাবে তাকিয়ে রইলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ। সাহেব তাঁর আদি ক্ষতে দাগা দিয়েছে। তাঁর মদ্য, মাংস ও মহিলা আসক্তির কারণে তাঁর স্ত্রী দিগম্বরী দেবী তাঁর স্পর্শদোষ বাঁচিয়ে চলেন। ফলে প্রিন্সকে আলাদা বাটিতে বসত করতে হয়। অসংখ্য নারী সঙ্গ করেও এই দুঃখ তাঁকে অহর্নিশি তাড়া করে ফেরে। এই দুঃখ ভুলতে তিনি দেশ ত্যাগ করে এই ম্লেচ্ছ দেশে এসেছেন। ঠিক করেছেন, এই জীবনে আর বঙ্গদেশে ফিরিয়া জাইবেন না। ফিরিয়া লাভ কি?

সাহেব কিঞ্চিৎ সহানুভূতিসূচক স্বরে বলে বলল, ডোন্ট অরি, ডোন্ট অরি প্রিন্স মহোদয়। সময় নির্ধারণ করিবে কে কাহার সহিত জাইবে। তবে—

–তবে?

–তবে, আপনার রত্নটির সাক্ষাৎ পাইতে যাঞ্চা করিতেছি। তাহা হইলে আমার আজকের অপেক্ষাজনিত কিঞ্চিৎ ক্লেশ দূর হইবে।

–নিশ্চয়ই। নিশ্চয়ই। আমাদিগের রত্নের অভাব নাই।

‘অতপর প্রিন্সের খানসামা চাকরাদি নানাবিধ মনিমুক্তা হাজির করিল। সাহেব যাহা যাহা দেখে তাহা তাহা দেখে কহে, আর কুছু, আর কুছু।‘

ঘণ্টা খানেক দেখিয়েও যদ্যাবধি লর্ডের কুছু কুছু থামল না, খানসামা ঘেমে গেল, চাকরাদি কম্পিত হল, তখন প্রিন্স খাঁটি প্রিন্সের মত হেসে বললেন, বুঝেছি। মুক্তা নয়, মতি চাহিতেছেন। তিনি একটু থামলেন। অন্দরের দিকে তাকিয়ে প্রিন্স আওয়াজ দিলেন, মতিবিবি আইস।

এইখানে আমাদের গল্পে কোনো হিরে-মোতির মতি নয়—মতিবিবি নাম্মী এক জেনানাকে পাওয়া যাচ্ছে। মতিবিবি উক্ত গৃহের গবাক্ষ পথে ছিলেন। প্রিন্সের আহ্বানে মতিবিবি গবাক্ষ হতে অতিথি কক্ষে নেমে এলেন। কৃষ্ণ-পাথরে খোদিত মূর্তির মত অনিন্দ্য সুন্দরী এই মতিবিবি স্বপ্নের চেয়েও আরো আকর্ষণীয়া। বিদ্যুৎচমকের মত হাসে। বিলোল কটাক্ষ করে। দেখে লর্ডের চেতনা রহিত হল। বুঝে প্রিন্স মুচকি করে হাসলেন। মতিবিবি এই সময়ে গ্রীবা বাঁকিয়ে বাম পা-টি সামনে এগিয়ে এনে নাচের একটিমাত্র মুদ্রা দিলেন। মুদ্রার ভঙ্গীতেই কিয়ৎকাল থেমে রই্লেন অঙ্কিত চিত্রের মত। আর সেই শব্দে প্রিন্সের চেতনা অর্জিত হল। চক্ষু মেলে লর্ড শুরুতেই দেখল—এই পদ্মের ন্যায় পদযুগল নগ্ন। সাহেব বিলেতি সহবত মতে বলে উঠলেন, ও মাই গড।

গল্পের এই পর্যায়ে এসে কিছু দর্শনগত ভেদরেখা দৃষ্ট হচ্ছে। ভারতবর্ষীয় প্রেম মানেই হল রাধা-কৃষ্ণের প্রেম। শাওনে গগণে ঘোরও ঘনঘটার মধ্যে দিয়ে রাধা কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টিপাত হচ্ছে। অদূরে নদী ফুসে উঠেছে। এর মধ্যেও দেখা যাচ্ছে রাধার পদ-যুগল ফাঁকা। কোনো পাদুকা নাই। পাদুকা থাকার কথাই নাই। সেকালে ভারতবর্ষে জুতা বিষয়টি অপ্রচলিত ছিল। অন্তত নারীদের বেলায় ১০০% সত্যি। এই হেতু অভিসারিকা রাধার পা তাই পথ-কাঁটার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। রক্ত ঝরছে। অসহনীয় এই বেদনা। কিন্তু রাধারা তো জানে কৃষ্ণ প্রেমে রক্ত ঝরানো ছাড়া উপায় নেই। কৃষ্ণের সঙ্গে যখন রাধার দেখা হচ্ছে—তখন কৃষ্ণ রাধার মুখ নয়—পদ্মের মত পদযুগলে চুম্বন করছে। বুকের পরে সেই পদযুগল রাখছে। বলছে, অয়ী রাধাময়ী, তুমি তোমার পা দিয়ে আমার বক্ষে আঘাত কর। সে আঘাতের মধ্যে দিয়ে ভালোবাসা প্রাণে অক্ষয় হোক।

কিন্তু পাশ্চাত্যে কোনো রাধা-সুন্দরীরা কখনোই নগ্নপদে থাকে না। তাদের সারা দেহ লোকচক্ষুর আড়াল গ্রহণ করে না। তাহলে পদযুগল? নৈব নৈব চ। পদযুগল চিরকালই পাদুকা-মুড়িত। পবিত্র গ্রন্থে আছে–প্রভু যীশুকে দুই চোরের সঙ্গে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছে একটি টিলার উপরে। মেরী মাগদিলিনী সেখানে লুকিয়ে এসেছে। তখন যীশুর ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। বৃষ্টিতে জলের স্রোতের মত উঁচু থেকে নিচুতে বয়ে চলেছে সে রক্তধারা। তার মধ্যে অপার হয়ে চেয়ে আছে করুণাময় যীশুর দিকে সেই মহিমাময় নারী।। চিত্রে দেখা যাচ্ছে—মেরী মাগদিলিনীর পা সেই রক্তস্রোতের মধ্যেও নিরাপদ। শুকনো। অরঞ্জিত। পশু চর্ম নির্মিত পাদুকায় আভরিত। এই পাশ্চাত্যের কেউ ভাবতেই পারে না কোনো নারী খালি পায়ে থাকতে পারে। এটা কল্পনার বাইরে। এটা পাপেরও অধিক। ফলে মতি বিবির নগ্ন পা দেখে ‘ও মাই গড’ বলাটা লর্ডের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। ফলে প্রিন্স ভারতবর্ষীয় রীতি মেনে মতিবিবির পা উন্মুক্ত রেখেছেন। আবার পাশ্চাত্য রীতি মেনে তার জন্য জুতাও প্রস্তুত রেখেছে্ন। যে কোনো বৃটিশ মহোদয়ের আবির্ভাব হলেই পরিস্থিতি অনুসারে তার পায়ে জুতা পরানো হয়। প্রিন্স একই সঙ্গে ভারতীয় ও ইউরোপীয় ছিলেন।

লর্ডের এই ও মাই গড বলার সঙ্গে সঙ্গেই প্রিন্স চোখের ইঙ্গিত করলেন। তার খাস খানসামা তখন একটি স্বর্ণ নির্মিত থালা নিয়ে এলো। থালাটি মখমল বস্ত্রে আবৃত। বস্ত্র তুলে নেয়া হলে দেখা গেলো— সেখানে নতুন কোনো মণি-মানিক্য নয়, হিরে জহরৎও নয়—এক জোড়া জুতা। জুতা দেখে লর্ডের চক্ষু বিস্ফোরিত হল। হিরে খচিত জুতা। লর্ডের ইচ্ছে ছিল জুতা জোড়া মতিবিবির পদযুগলে সে-ই পরিয়ে দেবে। তারপর সেই জুতা পরিহিত পদোপরে চুম্বন করবে। বলবে, ফর গড শেক, হোল্ড ইয়োর টাং, লেট মি লাভ।

কিন্তু সেটা করার কোনো সুযোগ ছিল না। আরেকজন খানসামা অতি ছন্দ-মন্দ্র হাতে মতিবিবির পদ্মসদৃশ্য পদযুগলে পরিয়ে দিল। সেইকালে ঝিঁঝিঁট্টি রাগে বেহালা ধ্বনিত হল। তখন মনে হয়ে পৃথিবীতে এই পায়ের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। অন্য কোনো পায়ে মানাত না। প্রক্রিতি ও পুরেষের মিলনের মত তারা একে অপরের পরিপূরক। এই ঘটনা অবলম্বনে পরবর্তিকালে প্রিন্সের জমিদারীর অন্তর্গত পুর্ব বঙ্গের বাড়ারা গ্রামে এক অশিক্ষিত বাউল একটি গীত লিখেছিলেন—চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে—আমরা ভেবে করব কি? এই জুতা ও চাঁদের ঘটনার একটি দার্শনিক মীমাংসায় পৌঁছেছিলেন এই বাউল। দর্শন ছাড়া এ জগত অর্থহীন।

জুতা পরিধান সম্পন্ন হলে শামাদানের ইষৎ কম্পিত আলোয় মতিবিবির অঙ্গে ভঙ্গী জাগলো। তার পরণে হিরে মতির সাজ পোষাক। পদযুগল ঝিকিমিকিয়ে ওঠে।

শোনা যায় এই পদাভরণ মতিবিবির জন্য পারস্য দেশ থেকে প্রিন্স অর্ডার মাফিক আনিয়েছেন। জুতার গায়ে নাস্তালিক অক্ষরে লেখা—বানজারান। মতিবিবি বিলোল কটাক্ষে যখন গান ধরল, আ আ আ..আও মে গিরিধারি লাল, তখন সাহেবের কুছ কুছ হোতা হ্যায়। কহিল, গ্রেট। গ্রেট। ইহাতে একঘণ্টা কেন, আপনার দরোজায় এক যুগও দাঁড়াইয়া থাকিতে আমার কোনো রূপ ক্লেশ বোধ হইবে না। জীবন সদর্থক। প্রভুর মহিমা অপার।

মতিবিবির এরপর কী হল–দেশে ফিরেছিল, না কি বিলেতে থেকে গিয়েছিল, তার কিছুই জানা যায় না। শুধু বিলেত হতে একপাটি জরিদার হীরে-মতিপূর্ণ ফিমেল জুতা ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রাখার জন্য ইন্ডিয়ায় এসেছিল। প্রিন্স দ্বারকানাথ দেশে আর ফিরে আসেন নাই। শোনা যায় তিনি লন্ডন শহরের নিকটবর্তি একটি গ্রামে উপাসনারত অবস্থায় সাধনোচিত ধামে গমন করেছিলেন। রাজকীয় জার্নালে লেখা আছে—প্রিন্স অন্তকালে কামনা-শুন্য হয়ে গিয়েছিলেন। কোনো নারী সেকালে তাঁর নিকটে ছিল না। ছিলেন নিঃসঙ্গ।

তবে বিলেত থেকে ইন্ডিয়ায় আগত জুতোজোড়া কোনো মিউজিয়ামে গিয়েছিল বা আদৌ গিয়েছিল কিনা— তার সুস্পষ্ট তথ্য নেই। শুধু কদিন পরে প্রিন্সের পুত্র দেবেন্দ্রবাবুর নিকট টেলিগ্রাম আসিয়াছিল, প্রিন্স এক্সপায়ার্ড।


৪. লক্ষ্ণৌর গন্নিবিবির মুজরো-কথা

উপর্যুক্ত মতিবিবির নাতিন-লো-নাতিন হল আমাদের কাহিনীর গন্নিবিবি।

সেই মতিবিবির নাতিনি-লো-নাতিনি ওরফে গন্নিবিবি যখন লক্ষ্ণৌ থেকে আমাদের পাড়াগাঁয়ে সিকদার বাবুর বায়নায় পাড়া দিলেন, তখন চারিদিকে গগণ ঢুলি ঢেড়া পিটিল, ‘গন্নি আইসাছে। গন্নি আইসাছে।‘

মুকিমপুর পরগণার পত্তনিদার সিকদারবাবুর তখন সবে নতুন দোতলা উঠেছে বিলা অঞ্চলের এই গঞ্জে। তার কার্নিশে ঢেউ খেলানো পদ্মপাতা খাড়া হয়েছে। সিঁড়িতে সিংহচিহ্ণিত আসন। এটা সিকদারবাড়ি। এই এলাকায় এইটাই একমাত্র দালানবাড়ী। গুইড়ে পট্টিতে বিল্ডিংটির অবস্থান হওয়ায় এর সামনে গুড়ের হাট বসে। একজন দুজন করে যেসব হাটুরে সেই হাটবারে এলো বা আসার কথা ছিল তারা দেখতে পেল, সিকদার বাবুর গদিঘর সাফসুতোরো করা হচ্ছে। ঝালর লাগানো হচ্ছে। একটা ঝাড়বাতিও এসেছে। তবে পড়ে গিয়ে ভেঙে যেতে পারে এই আশঙ্কায় ঝাড়বাতিটি গদিঘরে লাগানো হয় নাই। সেটা একটি বাঁশের আগায় ঝোলানো হয়েছিল বাড়ির সামনে। আলো জ্বলত না বলে এক ধরনের ঝনন ঝনন শব্দ হত। একটি লাল শালু টানানো হয়েছিল। লেখা—রাজপুত্র প্রিন্স অব ওয়েলসের শুভাগমন উপলক্ষ্যে মাইফেল। তারিখ ২৩ ডিসেম্বর, ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দ। কোনো হাটুরে এই বাক্যটি পড়তে পারে নাই। সেরকম এলেম তাদের কভি নেভি। তবে লাল রঙের শালু কাপড় দেখে তাদের নির্দোষ কৌতুক জেগেছিল।

এই ঝাড়বাতি দেখে আমাদের বিলা এলাকার লোকজন জীবনে প্রথমবারের মতো শুনেছিল গন্নিবিবি আইছে। তারা শুধাল, গন্নিবিবি কি মাতা বসুমতি?

সিকদার বাবুর ম্যানেজার লালুবাবু বললেন, গন্নিবিবি মাতা বসুমতি নয়। তিনি লক্ষ্ণৌর গন্নিবিবি। তিনি হীরে মতিপূর্ণ। তবে তার পা দুটো নগ্ন নয়। জুতা পরিহিত। কোনো রমনীরত্ন যে জুতা পরিহিত হতে পারে—তা এই এলাকায় ছিল অভূতপূর্ব ঘটনা। কোনো কোনো বুড়ি ঠাকুরমা জুতার নামই শোনে নি। খুব বেশী হলে খড়ম পর্যন্ত দৌড় ছিল তাদের। তারা জুতা-কাহিনী শুনে বলে উঠল, দুগগা, দুগগা। জুতার দিষ্টি হইতে আমাগো রইক্ষা কর গো মা জননী।

এই গাঁও গেরামের হাভাতে মানুষ তাদের বাপ-দাদা চৌদ্দ গুষ্ঠীর কেউ গন্নি বিবির নাম শোনে নাই। তারা খুব বেশী হলে শুনেছে বানারীপাড়ার নট্ট কোম্পানীর যাত্রা পালার কানু রানীর নাম। এখানে প্রকাশ থাকে যে, কানু রানী কোনো ফিমেল নন, তিনি কানু নামে এক যুবক। পালাগানে ফিমেল পার্ট করে বলে কানু রানী নামে আখ্যা-প্রাপ্ত। তাঁর স্ত্রীর নাম বিনোদিনী। বাড়ি কুড়িয়ানা। স্বরূপকাঠী। জিলা—বরিশাল। কানু রানী পাঁচটি সন্তানের জনক।

ফলে লোকে অবাক হয়ে জানতে চায়, গন্নিবিবি কী করে?

লালু বাবু হাতটি ঘুরিরে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, ঝা না না ঝা না না করে।

–এইটা কি জিনিস?

এটা লালু বাবুও ঠিক জানেন না। এটা ব্যাখ্যাতীত।

যে বা যিনি ব্যাখ্যার অতীত সে বা তিনি মনুষ্য নয়—দেবী। দেবী গন্নিবিবি ধা করে লোকের অভাব দূর করতে পারে বলে লোকজনের প্রবল বিশ্বাস উৎপন্ন হল। এইটুকু। এইটুকুতেই এলাকার লোকজন ঢাক ঢোল সহযোগে সিকদারবাড়ির সামনে এসে পড়ল। তাদের এলাকায় গন্নিবিবির আগমণহেতু দুই দিন ঢপকেত্তনের আয়োজন হল। লোকে পথের উপর কলস কলস জল ঢেলে কাদামাটি করে নেচে গেয়ে ফিরে গেল। এই পর্যন্ত। মাইফেলে কারো মতি নাই। তারা সকলে সন্ধ্যাকালে নিন্দ পাড়ে। আর স্বপ্ন দেখে—মা গন্নিবিবি চারি হস্ত বিস্তার করে তাদের অভয় দিচ্ছে। তাই দেখে তারা মাতম তুলে বলে, জয় মা গন্নিবিবি।

সিকদার বাবুর গদিঘরে গন্নিবিবির আসর বসার মত লোক আর পাওয়া গেল না। মাইফেল ব্যর্থ হতে দেখে সিকদার বাবু এলাকার চেতা লোকদের খবর দিলেন। তারা এসে হাত জোড় করে বলল, বাবু, আমরা চাষা-ভুষো মানুষ। আমাগো পোলাপাইন হ্যাগো মা জননীর মাই টাইন্যা বাঁচে। আমরা ভাতে বাঁচি।। অভাবে পড়লে কচু-ঘেচু খাই। কিন্তু বুইড়াকালে পোলাপাইনের কামে শরম লাগে। খ্যামা দ্যান গো কত্তা মশাই। আমাগো ঘরে বৌ আছে। বাইরের মাইয়া মাইনসের কাছে যাওনের সমায় আমাগো কোথায়?

পত্তনিদার সিকদার বাবু যখন পেয়াদা দিয়ে প্রজাদের মাইফেলে হাজির করার হুকুম দেবেন দেবেন করছেন ঠিক তখন স্বামী সিকদারবাবুর ডাক পড়ছে অন্দর মহলে। তিনি হন্তদন্ত করে ছুটে গেছেন। তার ছোটো তরফ ঘরে খিল দিয়েছেন। ভেতর থেকে কিল পেড়ে বলছেন, গন্নিবিবিরে আনছ ক্যান?

সিকদার বাবু কোঁচা সামলাতে সামলাতে জবাব দিলেন, ট্যাকা পয়সা হইছে। এখন বিবি-বাই না আনলে রাজপুত্রের কাছে মান থাকে ক্যামনে?

সিকদার বাবুর ছোট তরফের বাড়ি মাধবপাশা, বরিশাল। অতি সুশ্রী –কিন্তু তার বাপ-ঠাকুরদারা চিরস্থায়ী ঘর জামাই বলে কপর্দক শুন্য। ফলে পরিবারে লেখাপড়া কম। ছোট তরফ সেকালের রাজপুত্র-কোটালপুত্রের গপ্প জানেন বটে, কিন্তু একালের রাজপুত্রের খবর জানেন না। তার কোল জুড়েও এখনো সে রকম কেউ আসেনি। ফলে তিনি একটু ভ্রু কুঁচকে বললেন, রাজপুত্র কেডা?

সিকদার বাবু উত্তর করলেন, মহারানী ভিক্টোরিয়ার বড় পোলা।

ছোট তরফ এই প্রথম ভিক্টোরিয়ার নাম শুনেছেন। কিন্তু তার হাল-সাকিন জানেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাগো বাড়ি কোন গাঁয়ে—কাড়ারগাতি, না, ডোমরাসুর?

–বিলেইত।

–বিলেতে কি আছে?

–সাহেব আছে।

এই সাহেব কথাটিও তার কাছে নতুন। তিনি সাহাদের চেনেন। তারা বড় সুদ খোর। তিনি আবার শুধালেন, সাহেবে কি করে?

–দণ্ড চালায়।

–দণ্ড মানে কি?

–দণ্ড মানে লাঠি।

লাঠির কথা শুনে বউ ঢোক গিলল। বউ সোজা সাফটা বলে দিল, গন্নি বিবিরে আনছ আনছ। তারে মানসে দেখুক। তুমার যাইয়া কাম নাই। অকালে আমি শাঁখা সিন্দুর খোয়াইতে রাজী না।

হুট করে দরোজা খুলে গলে। এবং তখনি সিকদারবাবুসমেত অন্দর বন্ধ হল অনির্দিষ্ট কালের জন্য। । বাইরে যাওয়া নিষেধ।

রুদ্ধ দরোজার বাইরে শুধু সিকদার বাবুর এক জোঁড়া পাম্প-সু দীর্ঘদিন পড়ে ছিল। কেউ তা তুলে রাখার সাহস পায় নাই। তবে কালক্রমে এই পাম্প-সু জুতার কী হয়েছিল সেটা জানা যায় নাই। জমিদার গেলেও তার জুতা ঠিক থাকে। জুতাই তার শাসন ব্যবস্থার প্রতীক হয়ে থাকে। কীর্তিবাস ওঝার রামায়ণে এইরূপ কাহিনী বর্ণিত আছে—রাম বনবাসে গেলে তার সতালু ভাই ভরত রামের জুতাজোড়া সিংহাসনে রেখে রামের শাসন জারী রেখেছিলেন।


৫. সোনারতরী : একখানিসর্পসঙ্গীত

লক্ষ্ণৌর গন্নিবিবি বঙ্গদেশের বিলা পাড়াগাঁয়ে এসেছেন। কিন্তু তার মাইফেলের খবর নাই। তার তবলচিরা পড়ে পড়ে ঘুমায়। সারেঙ্গিদার নাক ডাকে। গন্নিবিবি বজরায় থেকে থেকে ক্লান্ত। মাঝিমাল্লারা বহুদিন পরে পুটিমাছ ধরতে ব্যস্ত। একদিন গন্নিবিবি বজরা হতে বের হলেন। পায়ে মতিখচিত জরিদার জুতা। বাইরে ঝুকি ঝুকি চাঁদ উঠেছে। চারিদিকে থৈ থৈ জল। পদ্ম ফুটেছে। দূরে ধান ক্ষেত। সবকিছু সাফসুতোরো। এর মধ্যে কে একজন গান গেয়ে তরী বেয়ে ওপারে যাচ্ছে। গন্নিবিবি কানটি খাড়া করে শুনলেন, সেই কে একজন গাইছে—

কী সাপে কামড়াইল আমায় রে সাপুড়িয়া
জ্বলিয়া পুড়িয়া মইলাম বিষে
আমার বিষগুণে জ্বলেছে এ বিষ
জুড়াইব কিসে।।

হাসনা হেনা হাসতেছিল সন্ধ্যার আকাশে
দাড়িয়ে ছিলাম কত আমি তার তরে
ও সেই সাপ ছিল সেই রে ঝোপের আড়ে
ওঝার পরে মিশে।।

গাইতে গাইতে অনামা গায়ক তরী বেয়ে ওপারে চলে গেল। আর সেই সুর শুনে গন্নিবিবির সম্মোহন দশা। জলের মধ্যে পা ফেলতে যাবে আনমনে, বিপদ হতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনি বজরার বড় মাঝি বশির খাঁ পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল, মাইজি।

মাইজি থেমে গেলেন। আচমকা থেমে যাওয়ায় তার পা থেকে জলের মধ্যে পড়ে গেল জরিদার মতিচিহ্ণিত জুতা। জলের মধ্যে ভাসতে ভাসতে জুতা ডুবে গেল। বড় মাঝি বশির খাঁ ঘটনাটি বুঝতে পারে নাই। গন্নিবিবিকে স্তব্ধ হয়ে জলের দিকে থাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, আপ তবিয়াত ঠিক তো মাইজী? সেদিকে তাকিয়ে গন্নিবিবি শুধু বলে উঠল, মুঝে সাপ নে কাটা হ্যায়।

–হা ভগওয়ান। সাপ কাটনে সে জীবন খতম। আর্তনাদ করে বড় মাঝি বশির খাঁ এক পাল্লা তাগা নিয়ে নিয়ে এলো। তাগাটা পায়ে বাঁধবে, না, হাতে বাঁধবে দিশা পেল না। শুধু বলল, সাপ কাহা হ্যায় মাইজি?

গন্নিবিবির বক্ষদেশ ফাঁকা। সেখানে নিলা দাগ। সাপ এই বক্ষদেশে দংশন করেছে। সেখানে তাঁগা দেয়ার সুযোগ নেই।

শুধু তার কম্পিত ওষ্ঠ যুগল দেখে বোঝা যায়—তিনি সর্প-বিষে জরজর।

গান গাইতে গাইতে গন্নিবিবির সাপ তরী বেয়ে দূরে চলে যাচ্ছে। বশির খাঁ হঠাৎ খেয়াল করে দেখল, মাইজীর পদযুগল শূন্য—জুতা নাই। দেখে বশির খাঁ আর্তনাদ করে বলল, আপ জুতা কাঁহা হ্যায় মাইজী?

গন্নিবিবির তখন জুতাদশা নাই—সর্প দশায় পেয়েছে। প্রাণই যেখানে সংশয়পূর্ণ, সেখানে পায়ের জুতা দিয়ে কী হবে? তিনি সর্পবিষে নীল হতে হতে দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়া নৌকার গতি পথের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালেন। নৌকাটি ততক্ষণে মিলিয়ে গেছে। জলে শুধু তার ঢেঊ জেগে আছে। তাদের মাইজী গন্নি বিবি চেঁচিয়ে আদেশ করলেন, অই সাপকো বোলাও।

মাইজীর উচ্চকণ্ঠ শুনে তখন তবলচি সারেঙ্গীদাররা ঘুম থেকে উঠেছে। তারা ঠিক বুঝতে পারল না, কাকে বোলাবে?

তাদের এই হতচকিত দশা দেখে বজরার বড় মাঝি বশির খাঁ আরো জোরে চেঁচিয়ে বলল, ওই সাপকে বোলাও।

এই সাপ কোন সাপ—জল ঢোড়া না কেউটে, লাউ ডগা না আজগর সেটা বুঝে নেওয়ার আগেই তবলচি আর সারেঙ্গীদাররা ছুটল সাপকে খুঁজতে। এই সাপটি ছাড়া অন্য কারো সাধ্য নাই বিষ নামানোর।

চারিদিকে জল করে খল খল। চারিদিকে কোনো সাপ নয়–সর্পও চোখে পড়ে না। নদী আর শাপলা ফুটে আছে। খাড়া হয়ে আছে সবুজ ধানক্ষেত। আর কিছু নেই। তাঁদের হয়রাণ হয়ে খুঁজতে দেখে লোকসকল শুধায়, কারে খোঁজেন গো কত্তা?

তবলচি বলে, সাপ ঢুঁড রহি হুঁ।

লোকে বলে, তাইলে নাগপুরে যান। এইহানে ক্যান।

সারেঙ্গীদার কেতা করে বলে, ইয়ে ঠিক সাপ নহি হ্যায়—সর্প-গায়ক।

লোকে হেসে বলে, অ বুজছি। সর্প-গায়করে খুজতেছেন।। উনি আমাগো কৃষ্ণ ঠাকুর। ঢপ কেত্তনে কৃষ্ণ ঠাকুর সাইজা গান করেন। যারা শোনে তারা কৃষ্ণবিষে জর্জরিত হন। আদতে কৃষ্ণ ঠাকুরের নাম…

নাম শোনার মতো তাগোদ নাই তাদের। তবলচি আর সারেঙ্গীদার মথুরার কৃষ্ণ ঠাকুরকে চেনে। পাড়াগার বিদু-সিধু-গেদুদের চেনে না। তারা একটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য জানতে চাইল, কৃষ্ণ ঠাকুর?

লোকে বলে, তিনি পাগল কিসিমের গায়ক। মন চাইলে গাইতে পারেন। আবার গাইতে নাও পারেন। একবার গান ধরলে আর থামাথামি নাই। তিনি গাইলে ঘরে ঘরে রাধাদের নিন্দ টুটে যায়।ঘরে থাকা যায়।

তবলচিরা কী বুঝল কে জানে। তারা লোকদের কথা শুনে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক ঠিক। সারেঙ্গীদাররা বলল, ঘরমে রহে না মুশকিল হ্যায়।

এলাকার চাষা-ভুষো লোকজন খুব খুশি। তারা এই ভীনদেশী লোকদেরকে তাদের নিজস্ব কৃষ্ণ ঠাকুর চেনাতে পেরেছে।

তবলচিরা বলল, ইস কৃষ্ণ ভগবান কো হমারে নাও মে লে আইয়ে। গন্নি বিবি ইন্তেজার কর রহি হ্যায়।

এই গাঁ-গেরামের লোকজন গন্নিবিবির তবলচি-সারেঙ্গীদারদেরকে তথাকথিত কৃষ্ণ-ঠাকুরের কাছে নিয়ে গেল।

কৃষ্ণ ঠাকুর তখন নদীর ঘোপে-ঘাপে চাঁই দিয়ে মাছ ধরার ধান্ধা করছিল। আজ তার দুটো কচুর লতি দিয়ে খাওয়ার হাউস। তার পায়ে কাদা। কোমরে লেংটি। উর্ধাঙ্গ নাঙ্গা। এই রূপে এসে বললেন, কী করণ লাগবে?

ওরা বলল, হাম নে লক্ষ্ণৌ গিন্নিবিবিকা সাথ মোলাকাত করনে হ্যায়।

জল থেকে কৃষ্ণ ঠাকুর চাঁই তুলে ফেলল। গুছিয়ে বলল, তাইলে চলেন যাই।

কৃষ্ণ ঠাকুরের তর সইছিল না। গন্নিবিবির গান শোনার হাউস জেগেছে। যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েই আছে। তবলচিরা তাকে অপাঙ্গে দেখে শুনে বলল, এ্যয়সে লেংটি প্যহনকে আপ জা নহি সক্তে?

কৃষ্ণ ঠাকুর এই লেংটি বস্ত্রের অধিক কিছু জানেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তাইলে কি লেংটি খুইল্যাই যামু?

সারেঙ্গীদাররা চোস্ত স্বরে বলে দিল, রয়েল ড্রেস–রয়েল — কপরা চাহিয়ে । রাজকীয় কপরে কে বিনা গন্নি বিবি কে পাস জা নহি সকতে।

গন্নিবিবির কাছে বিনা রয়েল ড্রে্সে যাওয়া নিষেধ। অনেক খুঁজে পেতে সখের যাত্রার দল থেকে যোগাড় হল রয়েল ড্রেস। মাথার একটা মুকুটও জুটল। তার আগায় হাসপাখির পালক ফরফর করছে। কিন্তু সমস্যা হল, রাজার জুতা প্রজার পায়ে আঁটে না, সাইজে ছোটো কিংবা বড় হয়ে যায়। জুতো ছাড়া রাজবেশে যায় কি প্রকারে! সব দেখে শুনে তবলচিরা বলল, তো কোলকাতা জাইয়ে কৃষ্ণ ভগওয়ান।

কোলকাতায় কখনো কৃষ্ণ ঠাকুর যায়নি। এই নামে একটা শহর আছে বলে এলাকায় জনশ্রুতি আছে। সেখানে সিকদার বাবুর প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় তরফ সন্তানাদি নিয়ে বসত করেন। এই গাঁও গেরামের হাভাতে প্রজাগণের প্রদত্ত ট্যাক্স থেকে তাদের খরচাপাতি যায়। কৃষ্ণ ঠাকুর তাদের জিজ্ঞেস করলেন, জাইলে তো যাওনই যায়। কিন্তু কোলকাতায় যাওনের ট্যাকা দেবে কেডা?

এলাকার লোকজন মুখ চাওয়া করতে লেগেছে। জমিতে ফসল পুড়ে গেছে। গোলা ঘরে ধান নাই। ট্যাকসো দেওয়ার উপায় নাই। সিকদারবাবু অন্দরে আটকা পড়ছেন। সব শেষ ভরসা সেন্ট মথুরানাথ সরকার। মুখে শুভ্র দাড়ি। তার একহাতে বাইবেল—অন্যহাতে ছাই বেল। পেটের পীড়ায় ভুগে তার বেলই ভরসা। ছাইয়ে পোড়া বেল খেতে খেতে তিনি অতি কোমল করে শুধালেন, কী যাঞ্চা করিতে আগমণ?

লোকে খিন্নশীর্ণ কণ্ঠে হাত জোড় করে বলল, জুতা। জুতা। একজোড়া সু-জুতা কিন্যা দেন।

–তোমাদিগের জুতা ক্রয়ের হেতু কি?

–আমাগো কৃষ্ণ যাবে রাধার কুঞ্জে—জুতা ছাড়া যায় ক্যামনে। মান আছে না!

–তাহা কৃষ্ণ ঠাকুরের ব্যক্তিগত সমস্যা। তাহাতে তোমাদিগের সমস্যা কী?

তাহারা উত্তর দিল, ফাদার বাবু, এই যে আমারা হাইলা-জাইলা, আমারা জলে মরি, ঝড়ে মরি। খরায় মরি। সাপে মরি। কুমিরে মরি। রোগে মরি। খাজনায় মরি। মরন ছাড়া আর তো আমাগো কোনো গতিক নাই। আমাগো পরানও নাই—মানও নাই। গানও নাই। কিন্তু কৃষ্ণ ঠাকুর আমাগো কৃষ্ণ কথা শোনায়। আমাগো পরাণ জুড়ায়। কৃষ্ণ ঠাকুর খুশী হইলেই আমরা খুশী। এই কৃষ্ণ ঠাকুর ছাড়া আর আমাগো আছেডা কি?

সেন্ট মথুরানাথ মাথা নাড়লেন। বললেন, ওকে। ডোন্ট অরি। কিন্যা দিতে আছি। শুধু তোমাদিগের প্রভুর মহিমাকীর্ত্তন করিতে হইবে। রাজী?

–রাজী। রাজী।

এই রাজীর কথায় সেন্ট মহাশয়ের মুখে বড় হতাশা জাগে। তিনি প্রভুর কীর্ত্তন করতে সুদুর কোলকাতার ভবানীপুর থেকে এসেছেন। এসে এখানে উপসনালয় খুলেছেন। সেখানে প্রভুর কীর্তন ছাড়াও বিদ্যাচর্চার ব্যবস্থা রেখেছেন। মুক্তহস্তে দরিদ্র প্রজা সাধারণের সাহায্য করেন। শুধু তার দাবী এই আদি পাপে নিমজ্জিত মেষগুলি প্রভুর খোঁয়াড়ে ঢুকুক। শুনে তারা কখনো না করে না। সব বিষয়েই বলে রাজী। কিন্তু তারা ধরা দেয় না। এটা তার কোমল চিত্তে ব্যথা দেয়। তিনি তার উর্দ্ধতন পাদ্রিদের কাছে মুখ দেখাতে পারেন না। তিনি আগত লোকদের বিমর্ষ চিত্তে বললেন, তোমরা তো সকল সময়েই রাজী রাজী। কিন্তু কখনো তো কাজের কাজী হইতেছো না বৎসগণ। প্রভুর কথাতো কেহ বলে না।

শুধু লোকে আরো জোরে বলে, রাজী। রাজী।

সেন্ট মথুরানাথ সরকারের নিকট থেকে জুতো কেনার টাকা পেয়ে কৃষ্ণ ঠাকুর সেই রাজবেশ খুলে রওনা হলেন কোলকাতায়। কিছুটা নৌকায়। কিছুটা হেঁটে। কিছুটা স্টিমারে। তিনি জীবনে এই প্রথম কোলকাতায় গেলেন।

দিন যায়। রাত যায়। গন্নিবিবি বজরায় বাইরে বসে থাকেন। ভেতরে ঢোকেন না। জুতাশুন্য পায়ে নূপুর। মাথার ভেতরে সেই সুর—কী সাপে কামড়াইল রে। আহার নাই। নিদ্রা নাই। তিনি অপেক্ষা করছেন একদিন তার কৃষ্ণ ঠাকুর জরিদার জু্তো পায়ে দিয়ে আসবেন। তার বজরায় বসবেন। তিনি তাকে মুজরো করে শোনাবেন—ক্যা করু সজনি আয়ে না বালাম।

এদিকে কৃষ্ণ ঠাকুরের খবর নাই। শোনা যায়– তিনি তখন চিৎপুর রোডে যাত্রাপালা দেখতে ব্যস্ত। একদিন তাদের সঙ্গে তিনি ভিড়ে গেছেন। তাদের সতী বেহুলা পালায় বিবেক-গায়কের কাজ নিয়েছেন। পালায় শ্রীমতি মিস টুয়েনটি নাইন বেউলা সুন্দরী সাজে। তিনি অদ্বিতীয়।

তারপর আর কোনো তথ্য জানা যায় না। মিস টুয়েনটি নাইনের একটা গান তখন বাজারে প্রচলিত ছিল, কালা তোর তরে কদম তলে চেয়ে থাকি। শুধু কেউ কেউ সন্দেহ করে থাকেন পশ্চিমে সতী বেউলার পালা করতে গিয়ে মিসেস টুয়েন্টি নাইন আর কৃষ্ণ ঠাকুর উধাও হয়ে যান। তাদের বিহনে আর কখনো চিৎপুরের কোনো যাত্রা পালা দলে সতী বেহুলা পালা অভিনীত হয়নি। এই তথ্যটি অধুনার বিশিষ্ট যাত্রা গবেষক ডঃ তপনকুমার বাগচী তাঁর পিএইচডি’র থিসিসে উলেখ করেছেন। থিসিসটি বাংলা একাডেমীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়ে। প্রকাশ থাকে যে,ড: তপনকুমার বাকচি ফরিদপুরের এই বিলা এলাকারই সন্তান। তার তথ্য অন্য যে কোনো গবেষকের তুলনায় অধিক বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচ্য। এর সারবত্তা বিবেচনা করে ড: তপন বাকচী জেমকম সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন।

এদিকে গন্নিবিবির মাথার উপর দিয়ে চাঁদ ওঠে। চাঁদ ডোবে। শিশির ঝরে। তারা খসে। সূর্য ওঠে। গণগণে আগুন ঝরিয়ে সূর্য ডুবে যায়। আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। তবলচিরা সারেঙ্গিদাররা গন্নিবিবিকে চেঁচিয়ে বলে, মাইজি, অন্দর আ যায়ে।
মাইজী ভিতরে আসেন না। মাইজী ভিতরে আসবেন না। বজরার বাইরেই থাকবেন। তাকে কৃষ্ণরূপী কাল-সর্পে কেটেছে। অঙ্গ নীলা হয়ে গেছে। সেই সাপ বিনা এই বিষ জাইবে না। সাপ আসিলে তার ভাও মিলিবে। তিনি তখন ভিতরে জাইবেন। তিনি কাল-সর্পের অপেক্ষা করবেন। তিনি গাইবেন-আওমে গিরিধারী লালা। এই গান শুনে তার গিরিধারী লালা ওরফে কৃষ্ণ ঠাকুর নিশ্চয় আসবে।

এইভাবে গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত, শীত বসন্ত ঘুরে ঘুরে আসতে লাগল। আর বজরাটিও ধীরে ধীরে জলের মধ্যে মাটিবৎ গলে গলে পড়তে লাগল। বজরার লোকজনও কোনো মতে সাঁতরে উঠতে উঠতে ডুবে মরল। কিন্তু গন্নিবিবি জলে ডোবে না– জলের উপরে সেই ভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। দিন যায় আর গন্নিবিবি কায়া থেকে ছায়া—ছায়া থেকে মায়ায় উঠে গেলেন। তিনি নিরালোকে নিরঞ্জন হলেন। লোকে এই দৃশ্য দেখে ধন্যি ধন্যি করতে লাগল। বলল, গন্নি মাইকী জয়।


৬. একটি সম্বাদপত্রের সংবাদ : ১৮৭৬ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখ

গন্নিবিবির সলিল সমাধী শীর্ষক এই ঘটনাটি ঢাকাপ্রকাশ পত্রিকায়ও প্রকাশিত হয়েছিল। স্মতর্ব্য যে এটা ঢাকা শহরের প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ঢাকা প্রকাশ– যা বাংলা তারিখ ২৫ ফাল্গুন, ১২৬৭ (মার্চ ৭,১৮৬১) প্রথম প্রকাশিত হয়।

ঘটনাটি শ্রবণপূর্বক ঢাকাপ্রকাশের সাপ্তাহিকীর সম্পাদক কাম প্রকাশক মহাশয় সশরীরে মুকিমপুর পরগণায় এসেছিলেন। ঢাকা হতে অকুস্থলে পৌঁছাতে পঞ্চ দিবস লেগেছিল। চোখের উপরে চশমার কাঁচ পুটুলীতে ঘষে ঘষে তিনি দেখেছিলেন দূরে দূরে দ্বীপের মত ছাড়া ছাড়া বাড়ি জেগে আছে। আর তার চারিদিকে বাঁকা জল করিছে খেলা। পথ নাই। ঘাট নাই। লোকজন—হাট নাই। তেজা কোনো ঠাঁই নাই। তার মধ্যে গঞ্জ বা বাজার। তার মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দালান বাড়িটি। নাম সিকদার বাড়ি। তিনি প্রশ্ন করলেন, গঞ্জের লোকজন গেছে কোথায়?

কে বা কারা উত্তর করল, তারা সবাই গেছে মধুমতির পাড়ে।

সেবার ঢাকা প্রকাশে লেখা হয়েছিল—মুকিমপুর পরগণার বিলে বজরার সলিল সমাধি। আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা মারফৎ জানিতে পারা গেল, ঐ বিল এলাকায় দীর্ঘদিবসযাবৎ একখানি বজরা নৌকা ভাসিতেছিল। দীর্ঘকাল জলে ভাসিয়া থাকিবার ফলে বজরাটির নাটবল্টু খুলিয়া গিয়াছিল। একদিন নিশীথকালে বজরাটি যাত্রীসমেত জলের মধ্যে খণ্ড খণ্ড হইয়া ভাঙ্গিয়া পড়ে এবং নিশীথমধ্যে তাহা ডুবিয়া যায়। বজরাটিকে আর কেহ দেখিতে পায় নাই। যাত্রীদের পরিচয়ও পাওয়া যায় নাই।

এই খবরটাতে কিছু ঝামেলা আছে। দেখা যাচ্ছে—জুতা বিষয়ে কোনো উল্লেখ নাই।

এমনকি পরিস্কার করে বলা হয় নাই এই কৃষ্ণ ঠাকুর লোকটি কে? কী তার আসল পরিচয়?

আমাদের ঠাকুরদা কৃষ্ণ পালায় কৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করে যৌবনে বিখ্যাত হয়েছিলেন। জনশ্রুতি বিবেচনা করলে কোনো না কোনো ভাবে আমাদের ঠাকুরদা বিদু রায়কেই সেই কৃষ্ণ ঠাকুর ধরা যেতে পারে। তিনি ছাড়া কৃষ্ণপালায় কৃষ্ণ সাজার মত চেহারা বা গানের গলা এই বিলা অঞ্চলে আর কারো ছিল না।

খবরটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৭৬ সালের জুন মাসের ১৫ তারিখ। তখন বর্ষা শুরু হয়েছে। সে সময় এলাকায় কৃষ্ণপালায় কৃষ্ণ চরিত্রে অভিনয়ে খ্যাত আমার ঠাকুরদা বিদু রায়ের জন্ম হওয়ার কথা নয়। সে সময়ে তার পিতাঠাকুর স্বর্গীয় সিধু রায়ের জন্ম হলেও হতে পারে। তবে আমার ঠাকুরদার যে সময়ে জন্ম বলে আমরা অনুমান করে থাকি আর ঢাকা প্রকাশের প্রকাশিত খবরের যে তারিখ আছে তা মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সে সময়ে আমার ঠাকুরদা বিদু রায় নয়, তার ঠাকুরদা সিধু রায়ও নয়, উনি সিধু রায়ের পিতাঠাকুর—অর্থাৎ আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা গেদু রায় হতে পারেন সেই কৃষ্ণঠাকুর। কোষ্ঠী থাকলে এই এই বিভ্রান্তি কাটানো যেত। তবে আমাদের পরিবারে কোনোকালে কোষ্ঠি করার চল ছিল না—এখনো নাই। আমাদের জন্ম যথাতথা, বিয়ে হেথাসেথা, মৃত্যু আধা ধাঁধাঁ। আমরা এমনি এসে ভেসে যাই। সুতরাং এই উল্লেখিত কৃষ্ণ লোকটা যে কে,তিনি ঠিক আমাদের কোন ঠাকুরদার ঠাকুরদা তা ঠিক ঠিক জানা যায় না। যাত্রা গবেষক ডঃ তপন বাকচির অনুমান তার নাম রাম শাম যদু মদুও হতে পারে। লোকমুখে শোনা যায়— এই লোকটি আমার যে ঠাকুরদাই হন না কেন-তাতে কিছু যায় আসে না। তবে এটা নিশ্চিত যে, তিনি ভালো গীত গাইতে পারতেন। তার একটা গীত পরবর্তীকালেও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। জহির রায়হান সাহেব ১৯৭০ সালে তার বেউলা সুন্দরী সিনেমাতে ব্যবহার করেছিলেন। গায়িকার নাম –নীনা হামিদ। গানটি নিম্নরূপ—

কী সাপে দংশিলো লখাইরে হে বিধির কী হইলো…
সুতানলি সাপোরে ছিল
ও তার কৃষ্ণবরণ দেহ
সুতাসম ছিদ্র দিয়া হায় রে
বাসরে পশিল
ও বিধি কী হইল।।

রাত্রি নিশাকালে রে সর্প
ও ঘুমে সুযোগ নিল,
সিথান হইতে কালিয়া নাগ রে
পৈথানে আসিল–
পৈথানে আসিয়া সর্প পতিরে কাটিল
ও বিধি কী হইল। ।

এই গানটি আমার ঠাকুরদা বিদু রায় বেশ মনপ্রাণ দিয়ে আমাদের গেয়ে শোনাত। আমার বাবাকেও গাইতে শুনেছি। আমার বোনসকল ভালোভাবেই গাইতে পা্রে। আমারও কিছু কিছু স্মরণে আছে।

লক্ষ্যণীয় : ‘কী সাপে কামড়াইল আমায় রে সাপুড়িয়া’

এবং ‘কী সাপে দংশিলো লখাইরে হে বিধির কী হইলো’ এই দুটোই সর্পসঙ্গীত। কিন্তু দুরকম। দুরকম হাহাকার। কিন্তু এই ঠাকুরদা পর্বে কোনো জুতা কাহিনীর উল্লেখ পাওয়া যায় না। এটা রহস্যজনক।
অথচ নানা কায়দায় আমরা একটা জুতা কাহিনীই বলার চেষ্টা করছি।



৭. ট্রেজারিতে রক্ষিত আত্মজীবনী থেকে : প্রভু অপার মহিমাময়

সেন্ট মথুরা নাথ সরকারের আত্মজীবনীর একটি হাতে লিখিত কপি ফরিদপুরস্থ কাছারিতে রক্ষিত আছে। ফরিদপুর জেলার জেলাপ্রশাসক (এই নামে কোনো অনুমোদিত শব্দ নাই, উহা ডেপুটি কমিশনার) মুহাম্মদ আহকাম উল্লাহ পাটোয়ারী সাহেবের পারমিশনপূর্বক ডাইরিটি দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছে। ডাইরিটির ১১৯ পৃষ্ঠায় লেখা আছে—

মধুমতী অত্র এলাকার ভয়ঙ্কর স্রোতোস্বিনী নদী। বর্ষাকালে মাঝে মাঝে কুম্ভীরের উৎপাত দৃষ্ট হয়। ইহার অন্তর্গত মানিকদহ এলাকায় একটা ঘূর্ণিস্রোত রহিয়াছে। উহাকে দহ কহে। মাঝেমধ্যে অইখানে নৌকা ডুবিবার খবর পাওয়া যায়। প্রতিবৎসর শস্যহানি হয়। গতকাইল শোনা গিয়াছে, একখানি বিদেশী বজরা নৌকার সন্ধান মিলিতেছে না। জলের উপর হইতে উধাও হইয়া গিয়াছে।

আত্মজীবনীটি লেখা হয়েছিল ১৮৭৬সালে। আর তেমন কিছু জানা যায় নাই। এরপরের পৃষ্ঠায় শুধু লেখা আছে–প্রভু অপার মহিমাময়। তাহার সুসমাচার জগতে ব্যক্ত হোক। তবে ১২০ পৃষ্ঠার পরে আর কোনো পৃষ্ঠা নাই। কালের গর্ভে ছিড়ে গেছে।

সেন্ট মথুরানাথ সরকারের আদি বাড়ি ছিল যশোহরে। জন্ম ১৮৪৩ সালে। ১৮৬০ সালে হিন্দু কলেজ হতে স্নাতক হয়েছিলেন। সে সময়ের ফরিদপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. ওয়ারলেস কলকাতা মিশন কর্তৃপক্ষকে এ এলাকায় একজন মিশনারি পাঠানোর আবেদন জানান। কিন্তু কেউই তখন এখানে এ কাজে আসতে রাজি হন নাই। অবশেষে মথুরানাথ বোস এ গণ্ডগ্রামে আসতে রাজি হন। তিনি কলকাতার ভবানীপুরে লন্ডন মিশনারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে ১৮৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমে নৌকাযোগে রওনা হয়ে পনের দিন পর এই বিল -অঞ্চলের গঞ্জে এসে পৌঁছান। তার পায়ে ছিল মচমচ করা পাম্প সু। আলো পড়লে সেই জুতা থেকে অন্য রকম রোশনাই বের হয়। তাকে কখনো কেউ জুতা ছাড়া কখনো দেখে নাই।

মুকিমপুর পরগণায় দরিদ্র নমশুদ্রপূর্ণ বিল এলাকায় তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন—পাপীতাপীদের উদ্ধারের মানসে। তার ব্যক্তিগত উদ্যোগেই সেখানে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছিল। একটির নাম মিশন স্কুল। এইখানে পরবর্তীকালে ‘শেখ মুজিবর নামে টুঙ্গিপাড়া হইতে একটি কিশোর’ লেখাপড়া করতে এসেছিল। ১৯৭২ সালে সেই কিশোরের নামেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম হয়। মথুরানাথের নামে নয়।

সেন্ট মথুরানাথের স্থাপিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পিছন দেষ্টে একটি সমাধিক্ষেত্র আছে। সেখানে লেখা আছে—সেন্ট মথুরানাথ সরকার। জন্ম ১৮৪৩ খ্রী। মৃত্যু ১৯০২ খ্রী। একটি এপিটাফও ছিল। সেটা মুছে গেছে। তবে সমাধীক্ষেত্র সংলগ্ন উপসনাগৃহে এখন কতিপয় রমণীরত্ন থাকে। তারা গীত করে—আমার যেমন বেনী তেমন রবে চুল ভেজাবো না। পুরোটা মাগনা শোনা নিসেদ। এখানে ছোট্ট সাইনবোর্ড খাড়ানো আছে– ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’।

গান শুনিলে মান বাড়িবে।
নাচ দেখিলে বাঁচ বাড়িবে।।

আমাদের কড়িও নেই। তেল মাখাও নেই। আমরা সখের গবেষক। আমাদের উদ্দেশ্য সেন্ট মথুরানাথ সরকার। তার সাক্ষাৎ পাওয়া গেলে গন্নিবিবি, জুতা রহস্য, বজরার সলিল সমাধি ইত্যাদি বিষয়ক কিংবদন্তির ভেতরবাড়ির ঘটনা প্রমাণসহ পাওয়া যাবে।এই কারণে সেন্ট মথুরানাথ সরকারকে খুঁজতেই সমাধি ক্ষেত্রে আমাদের আগমণ।

তখন সকাল। সমাধিক্ষেত্রটি নির্জন। এখানে অবস্থানরত সকল রমনীরত্নই রাত্রীজাগরণের হেতু ঘুমন্ত। ফলে সহজ অন্বেষণেই সমাধীক্ষেত্রে সেন্ট মথুরানাথকে পাওয়া গেল। তিনি একটু দীর্ঘ বিশ্রামেই ছিলেন। সমাধিক্ষেত্রের ভেতর থেকে উঠে এসেছেন বলে তার চুলে ও দাড়িতে ধুলো মাটি লেগে আছে। মাথার কাছে একটি শতবর্ষী হাসনুহেনার ঝাড়। সেখানে দুটো টুনটুনি পাখি ঘুরছে। একটা কাঠ-বিড়ালী কী ভাম বিড়ালী তার গা বেয়ে উঠছে। আর চিড়িক চিড়িক করছে। মথুরানাথ সরকার আমাদের দেখে নড়ে চড়ে বললেন, কী চাহ বৎস?

আমাদের কৌতুহল ছিল—তাঁর ডাইরীর আত্মজীবনীতে উল্লেখিত ঘটনার বাকী অংশ জানা। দীর্ঘ দিন সমাধী ক্ষেত্রে বসবাসের ফলে তাঁর গলা কিছুটা মাটিচাপা ধরনের বসা ছিল। তিনি জানালেন, গন্নিবিবির ঘটনাটি তিনি শুনেছিলেন। তবে তিনি গন্নিবিবি কিনা স্মৃতি ধুসরতা হেতু নিশ্চিত নন। এলাকায় কথিত আছে—বজরাটি ডুবে যাওয়ার পরে জলের তলা থেকে ভেসে উঠেছিল গন্নিবিবির সেই জরিদার মতিপূর্ণ সু-জুতো। কিছুটা শ্যাওলা লেগে জুতা জোড়া সবুজ হয়ে গেছে। ধরতে গেলে ধরা যায় না। পিছলে পিছলে যায়। দূরে দূরে সরে যায়। ডুবে যায়।

জুতাটি ধরার নিমিত্তে কেউ কেউ মরিয়া হয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নদীকুল হতে ঘূর্ণির নিচে ডুব দিল। সেখান হতে জুতাটি পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল একটি সিন্দুক। তার গায়ে আকা বাঁকা অক্ষরে লেখা—ঝা না না ঝা না না ঝা।

মথুরানাথ বললেন, এই ঘটনায় এলাকার লোকসকল গভীরভাবে মর্মাহত হইল। হইল আশাহত। আমার নিকট তাহারা আসিল। বলিলাম, ওহে প্রভুর মেষশাবক দল, তোমরা আমার নিকট আসিয়াছ কেন? সিকদারবাবুর কাছে যাও। তিনিই তোমাদিগের পত্তনীদার। তোমরা তাহাকে ট্যাকসো দেও। তোমাদের হিত-অহিত দেখিবার ভার তাহার উপরে বর্তায়। তোমাদের যে কোনো সমস্যায় তাহার শরণ নাও।

তাহারা বলিল, সিকদারবাবু অন্দরে আছেন। সদরে আসিবার সামর্থ্য নাই্। আপনিই আমগো নিদান। আপনি আমাগো ব্যাদোনা তাড়ান।

বলিলাম, ব্যাদোনা নহে—উহাকে পাপ কহ। উহা পাপ। পবিত্র গ্রন্থে ইহাকে আদি পাপ হিসেবে উল্লেখিত আছে। এই বলে সেন্ট মথুরানাথ আদি পাপের আদি গল্পটি শুরু করেছেন।

‘সদা প্রভু প্রথম মনুষ্য আদম আর হাওয়া বিবিকে সৃষ্টি করিয়া স্বর্গে রাখিলেন। তিনি তাহাদের বলিয়াছিলেন, শোনো হে মানব-মানবী, এ জগৎ তোমাদের আনন্দার্থেই সৃজন করিয়াছি। যাহা ইচ্ছা তাহা তোমরা ভোগ করিবে। কিন্তু আমি যাহা যাহা করিতে নিষেধ করিব তোমরা তাহা তাহা অবশ্য মান্য করিবে। জানিবা নিশ্চয়–আমান্যকারীকে সদাপ্রভু পছন্দ করেন না।
তিনি আদম-হাওয়াকে স্বর্গদ্যানে একটি সুপক্ক ফলপূর্ণ বৃক্ষ দেখাইয়া কহিলেন ইহার নাম জ্ঞান বৃক্ষ। ইহার ফল ভোজন করিবে না।

উক্ত জ্ঞান বৃক্ষটি ছিল অতি মনোহর। তাহার তুল্য বৃক্ষ আর সেখানে নাই। দেখিলে প্রাণ আকুল হয়। মুখে লালা ঝরে।

তাহারা কিয়ৎকাল পরে তাহারা সেই জ্ঞান বৃক্ষের ফলই ভোজন করিলেন। ইহাতে তাহাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হইল। দেখিল, তাহারা নিজেরা নগ্ন। তাহাদের লজ্জার উন্মেষ হইল। সেই জ্ঞান বৃক্ষের পাতা দ্বারা তাহারা তাহাদের লজ্জা ঢাকিল। শুধু হাওয়া বিবির পদযুগল নগ্ন রহিয়া গেল। হাওয়া বিবি অধোবদন হয়ে রহিলেন।
সদাপ্রভু এই পাপে তাহাদিগকে স্বর্গ হইতে বিতাড়িত করিলেন। এই পাপ আদম-হাওয়া হইতে সকল মনুষ্যের উপর বর্তাইল।

আমাদেরকে এই পর্যন্ত বলে সেন্ট মথুরানাথের চক্ষু হতে অশ্রু নির্গত হতে লাগল। সমাধিক্ষেত্রে মধ্যে তিনি ফোঁফাতে লাগলেন। আবহাওয়া ভারী হয়ে গেল। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন কিনা আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। তাকে বললাম, আর বলার দরকার নেই। আসুন, আমরা অন্য প্রসঙ্গে যাই।

কিন্তু সেন্ট মথুরানাথ আমাদের কথাকে গ্রাহ্য করলেন না। তিনি আবার চলে গেলেন তার যৌবনের সেই দিনগুলোতে—সেই বিল এলাকায়। লোকগুলো তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখ থেকে অশ্রু নয়—কৌতুক জেগে উঠেছে। তাদের একজন তাকে ফস করে প্রশ্ন করে বসল, বাপের পাপ পোলার ঘাড়ে চাপানো কি ঠিক হইল ফাদার বাবু? এই কামডা কি আপনের সদাপরভু ঠিক কইরেছেন?
কঠিন প্রশ্ন। শুনে সেন্ট মথুরানাথ হা হয়ে গেলেন। বুঝলেন এদের অন্তর প্রভুর মহিমা নিতে এখন অপ্রস্তুত। এরা কথায় প্রভুকেও ছাড়ে না। তিনি আরো নমনীয় হয়ে বললেন, ভ্রাতাগণ, সদাপ্রভুর মহিমা বোঝা ভার। কিন্তু তিনি দয়ালু। সকলের পাপ মোচনার্থে তিনি তাহার পুত্রকে পাঠাইলেন। তিনি প্রভু যীশু। প্রভু যীশু সকলের পাপ মোচন করিতে ক্রুশে বিদ্ধ হইলেন।

তোমরা প্রভুর পদতলে আশ্রয় লও। পাপ হইতে তিনি তারণ করিবেন।

তাহারা কাঁদিয়া কহিল, প্রভু কেডা আমরা চিনি না। আপনেরে চিনি। বিপদে আপদে আপনাকে আমরা পাই। সদা পরভুর অন্তরে রাগ আছে। আপনের অন্তরে রাগ নাই। ফুলের নাহান পবিত্র। আপনি বিনা আমাগো গতি নাই।

শুনিয়া তৃপ্তি হইল। তাহাদের হৃদয় সদাপ্রভুর দিকে ফিরিতেছে। বলিলাম,আজ কী প্রয়োজন?

তাহারা কাঁদিয়া বলিল,গন্নিবিবির জুতা আইন্যা দেন।

বড় বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলাম—জুতা দিয়া কী করিবে?

তাহারা সমস্বরে উত্তর করিল—পূজা করব। আমাগো বসুমাতা গন্নি মা নাই। তিনি আমাগো ছাইড়া চইলা গেছেন। ক্ষতি নাই। তার জুতা পাইলেই হইবে। জুতাজোড়া্রেই গন্নিমা জ্ঞানে পূজা করব। ভক্তি করব। তিনি আমাগো ব্যাদনা তাড়াইবেন।

শুনিয়া বড় বেদনা পাইলাম। ইহারা প্রভুর করুণা চাহে না। জুতা চাহে । আহা, অবোধ পাপী-তাপী মেষ শাবকেরা। ইহারা কী কহিতেছে ইহারা বুঝিতেছে না। বুঝিতে পারিতেছে না যে কোনো জুতা কাহারো মুক্তি আনিতে পারে না। এটা স্রেফ পৌত্তলিকতা মাত্র। কহিলাম, গন্নিবিবির জুতা আনিব কি প্রকারে। আমার সাইধ্য নাই। উহা জুতা নহে—ব্ল্যাক ম্যাজিক। ব্লাক ম্যাজিক প্রভুর না-পছন্দ।

লোকেরা একটু ক্ষুব্ধ হইল। তাহারা প্রশ্ন করিল, তাইলে আপনে কী করিতে পারেন?

সেন্ট মথুরানাথ বয়স হেতু এইটুকু বলে দম নিলেন। তারপর আমাদেরকে বললেন, উহারা পাপীতাপী হইলেও উহাদের আত্মাসকল পীড়িত হইয়া পড়িয়াছে। উহাদের প্রভুর পথে আনিতে হইবে উহাদের পৌত্তলিকতার পথ দিয়েই। কহিলাম, তোমাদিগের প্রশান্তির জন্য একখানা কাষ্ঠনির্মিত সু-জুতা নির্মাণ করিবার ব্যবস্থা করিতেছি। আর—

তাহারা কহিল—আর কি প্রভু?

উত্তর করিলাম, আর সঙ্গে প্রভুর ক্রুশকাঠি।

তাহারা আমার নামে জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। উহারা এই বানীতে তুষ্ট। তাহারা মুর্তিতে মুক্তি খোঁজে। ইহাই তাহাদের নিদান। তাই মুর্তির সঙ্গে খ্রীষ্টকে যুক্ত করিয়া দিলাম। প্রভুর ইচ্ছায় খ্রীষ্টই সকলের হৃদয়কে পূর্ণ করিবে। প্রভু অন্তরে প্রবেশ করিলে মূর্তি দূর হইয়া যাইবে।

লোক সকল তখন শুধু আরেকটি দাবি করিল। কহিল, জুতা জোড়ায় একটু রঙ করিয়াও দিয়েন। রঙ আসিলে ঢং বাড়িবে। জল-হাওয়া হইতে রক্ষা পাইবে। টেকসই হইবে।

তখন বাকেরগঞ্জের বিখ্যাত সুতারমিস্ত্রী অনন্ত ঘরামি আসিল। তাহার প্রকৃত বাড়ি পাদ্রী শিবপুর। যথাযথ পরিপক্ক সেগুন কাঠ আনা হইল। সেন্ট মথুরানাথের পাম্প-সু জোড়াকে মডেল ধরিয়া কাঠ কুদিয়া কুদিয়া তৈরী হইল নৌকাসদৃশ সু-জুতা।

সেদিন ছিল প্রভুর পবিত্র ভোজ পরবের দিবস। বহুদিন পরে এলাকার লোক সকলে পেট পুরিয়া চাটিয়া পুটিয়া ভোজন করিল। উহারা সু-জুতা জোড়াকে স্থানীয় বটতলায় স্থাপন করিল। সকলে বটতলায় আসিয়া ধ্বনিতে লাগিল—জুতা মইকী জয়।

সে দিবসে সেখানে প্রভুর ক্রুশপ্রতীকটি লইয়া প্রবেশ করিতে পারিলাম না। বৃদ্ধ বয়সে সর্বত্র যাওয়া করা যায় না। মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখিলাম—জুতা দেখিয়া লোকে আত্মহারা। যেন কোনো জুতা নহে তাহাদের বসুমাতা জাগিয়াছে। বসুমতির কল্যাণে একবেলা ভালোমন্দ আহার জুটিয়াছে। ইহাতে তাহাদের ব্যাদোনা জাইলেও জাইতে পারে। বুঝিলাম প্রভুর স্বরূপ বহুবিধ। তিনি কখনো ক্রুশবিদ্ধ যীশু। কখনো পাদুকাবিহীন রাধা-কৃষ্ণ। আজ এই ভোজ পরবের দিনে জুতারূপে তিনি এইখানে আবির্ভূত হইয়াছেন। পাপীতাপীদের হৃদয়ে শান্তি দিতেছেন। শান্তিই আসল। ইহার মহিমা অপার। আমার চক্ষুদ্বয় হইতে অশ্রু নির্গত হইতে লাগিল। জুতা ঠাকুরের সম্মানে আমিও জুতা পরা পরিত্যাগ করিলাম। শপথ করিলাম—এ জীবনে কদাপি আর জুতা পরিব না। অগোচরে বলিয়া উঠিলাম—জুতা মাই কী জয়।

সেন্ট মথুরানাথ এই পর্যন্ত বলে থামলেন। একসঙ্গে বহু কথা বলেছেন বলে তার গলা ঘড় ঘড় করতে লেগেছে। একটু খুস খুস করে কাশলেনও। বয়স হচ্ছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। আমরা বিস্মিত হয়ে দেখতে পেলাম—সেন্ট মথুরানাথের পদযুগল জুতাশুন্য। কিন্তু হৃদয় শান্তিপূর্ণ।

সেদিন সমাধিক্ষেত্রে সেন্ট মথুরানাথের সঙ্গে আমাদের সাক্ষাতের এই পর্যায়ে তার নির্মিত উপসনাগ্রহে অবস্থানরত রমণীরত্নবৃন্দ বের হয়ে এল। তাদের চক্ষে কাজল টানা। তাহাতে তাকানো মানা। পায়ে একই রকম মতিসদৃশ্য জরিদার জুতা। ঠোটে রং। এই জুতা গুলো ঠিক এদেশীয় নয়–একালেরও নয় বলে মনে হয়। সেই জুতার গোড়ালিতে নাস্তালিক অক্ষরে লেখা আছে—বানজারান। এইরূপ বানজারান জুতা মতিবিবির পায়ে পরানো হয়েছিল ইংলন্ডে প্রিন্স দ্বারকানাথের আদেশে। কৌতুহলহেতু এই রমনীবর্গকে আমাদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হল—আপনারা কী আ আ আ আয়ে গিরিধারী লালা গীতটি করেন? তাদের মধ্যে যিনি প্রবীণা বলে প্রতিভাত হন, তিনি একটু ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন,কী গান?

একটু ঢোঁক গিলে আমরা বললাম, ক্যা করু সজনি/ আয়ে না বালাম। শুনে রমণিরত্নদের মেজাজ বিগড়বাই হয়ে গেল। তাদের হাতে চুরি ঝন ঝন করতে করতে বলল, বৎসগণ, এইখানে তোমরা ফাও আড্ডা মাইরা আমাগো বিজিনেস মাটি করতি পারো না। যাও। কাটো।

অতঃপর তাহাদের সমবেত লাস্যময় গীতধ্বনী সমাধীক্ষেত্র প্লাবিত হল। এখন ঢাকা হতে পানের লঞ্চ আসার সময় হয়েছে। অনেক যাত্রী নামবে। তাদের মধ্যে কারো কারো রমণীরত্নের সেবার প্রয়োজন হতে পারে। তারা সেটা জানে বলেই প্রভুর উপসনা গৃহটিতে ছোট ছোট খুপরী ঘর তৈরি আছে। ফলে প্রভুর নাম ভজনা করতে করতে সেন্ট মথুরানাথ সমাধীক্ষেত্রে নিস্ক্রান্ত হলেন। শুভ বিদায় বলারও অবসর পেলেন না। শুধু কোনোক্রমে তার ঠোঁট নড়তে দেখা গেল। রমনীরত্নবৃন্দের সমবেত কণ্ঠে শোনা গেল তাদের নিজস্ব সঙ্গীত—চারা গাছে ফুল ফুইটাছে/ ডাল ভাইঙ্গো না রে মালি/ ডাল ভাইঙ্গো না। অদ্যাবধি এই সমাধীক্ষেত্র এবং উপসনাগৃহটি প্রাচীন ইষ্টক নির্মিত। এতো মজবুত যে কোনোরূপ ঝড়ে-বন্যায় ভাঙ্গে নাই। সেখানে কোনো চারা গাছই নাই। সকল গাছই প্রবীণ। তাদের পুষ্পকাল নিবারিত হয়েছে। কোনো চারাগাছের ডাল ভাঙ্গবার আশঙ্কা নাই।


৮. সিন্দুকপর্ব

সেন্ট মথুরানাথ সরকারের সমাধীক্ষেত্র ওরফে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেলগৃহ অথবা উপসনাগৃহের অদূরেই নদী। নদীর নাম মধুমতি। মধু না মতি। জ্যোৎস্না উঠলে মতির মত ঝকমক করে। তার মধ্যে শ্রীযুক্তবাবু বিজয়কুমার সিকদার এন্ড কোং বাটি থেকে দশধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে রাস্তায়। এখানে অরিজিনাল অর্গানিক আলু পটল উচ্ছে ঝিঙ্গে কুমড়োর হাট বসে। কিছু ঢেপের খই। আর বসে গুড় ও দীঘা ধানের চিড়া। ঠিক সামনেই মোটা খিলান ঘেসে আইকা অলা বাঁশে পুরনো জুবুথুবু মার্কা একটা ঝাড়বাতি ঝোলে। আর পতপত করে ওড়ে লালশালু। একটু খেয়াল করলেই ঠাওর করা যায়—শালু কাপড়ে কিছু বাক্য লেখা ছিল। কালের মত্ততা হেতু আজ তা ধুসর। গদি ঘরে এখন মাছের আড়ত। জলের আষটে গন্ধ। লোকে বলে অন্দরমহলটি এখনও বন্ধ। সিকদারবাবু আর কখন তার অন্দরমহলের বাইরে আসেন নাই। কিছুদিন চুড়ির শব্দ পাওয়া গিয়েছিল। তারপর থেমে গেছে। এর মধ্যে রানী ভিক্টোরিয়া প্রয়ান করেছেন। প্রিন্স দ্বারকানাথের ছোট নাতি একটা বই লিখে নোবেল পেয়েছেন। মাউন্ট ব্যাটেন ইন্ডিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। বরিশালের নমশুদ্র যোগেন নমোশুদ্র মণ্ডল জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে দোস্তী করেছিলেন। সেই মথুরানাথ স্থাপিত মিশন স্কুলের সাবেক ছাত্র শেখ মুজিব জিন্নাহ সাহেবের চেলা ইয়াহিয়াকে পুর্ব পাকিস্তান ছাড়া করেছেন।

কথিত আছে সেন্ট মথুরানাথের কাছে ধর্ণা দেওয়ার আগে লোকসকল সিকদার বাবুর বাটির সামনে কিছুদিন ঘোরাফেরা করে কালো মুখে ফিরে এসেছিল। অন্দর মহল থেকে আর বের না হওয়ার কারণে তারা কখনো সিকদার বাবুর দর্শন পায় নাই। তাঁর ম্যানেজার লালাবাবু একটু গম্ভীর গলায় উত্তর দিয়েছিলেন, বড়লোকদের বড় বড় ব্যাপার। তোমরা ছোটো ছোটো লোক। সব কিছু বুঝতে চাইও না। বাবু নাই তো কি তোমাগো খাজনা আদায় কি বাদ বাদ পড়ছে? আমরা আছি না? আমরা কি বইসা বইসা আঙ্গুল চুষতেছি। তাদের কাহিনী এইটুকু।

অধিক কিছু জানার ইচ্ছা করলেও এই কালে সেন্ট মথুরানাথ সরকারের সমাধীক্ষেত্রে আর ঢোকা যাবে না। সেখানে রমণীরত্নর সংখ্যা বেড়ে গেছে। সেখানে আরো লাস্যময় সুরের ধারায়’ চুল ভেজাব না’ সঙ্গীত নৃত্য-বাদ্যাদি সহকারে চলছে । তারা বিনা কড়িতে আর আমাদের মত সখের গবেষকদের সুযোগ দেবে না। সেন্ট মথুরানাথও আমাদের উদ্দেশ্যে সাক্ষাৎকার প্রদানের নিমিত্তে পুনরুত্থিত হওয়ার সুযোগ পাবেন না। মাটির নিচে থাকতে থাকতে তার সর্দি-কাশি বেড়ে গেছে। উপরে-নিচে ওঠা-উঠি নিষেধ।

এই পর্যায়ে এসে আমাদের সখের গবেষণা বন্ধ করে রাখতে হয়। আমরা মন খারাপ করে বাড়িতে বেকার থাকি। বাল্যকালের স্বভাব বশতঃ মাঝে মাঝে বাড়ির সিন্ধুকটির উপরে বসি। পা দোলাই। সে দোলানি সিন্ধুকের দরজাতে আঘাত করে। শব্দ হয়। এর মধ্যেই একদিন বয়স্কতা হেতু আমাদের পায়ে আঘাতটা একটু জোরেই হয়। তখন পুরনো সিন্দুকটির বন্ধ দরোজা সামান্য খুলে যায়। এর পরে একটু টান মারতেই দরোজার পুরোটাই খুলে যায়। জংধরা হেতু লোহার দরোজাটি খুলে আমাদের ছোটো ছোটো হাতের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। মড় মড় করে দরজা ভেঙে যাওয়ার শব্দ হয়।

শব্দ শুনে রান্না ঘর থেকে আমাদের জননী ছুটে এসেছে। একটু অবাক হয়ে চেয়ে দেখছে— এতো কালের দরজা বন্ধ হয়ে থাকা সিন্দুকটি একবারে খোলা। সিন্দুকটিকে কেউ এর আগে খোলা দেখেছে বলে কোনো ইতিহাস নেই। এর কোনো চাবিও ছিল না। আর সিন্দুকে রাখার মত কিছু সহায় সম্পদ ছিল না। এই একটি মাত্র সিন্দুক ছিল এই গঞ্জ এলাকায়। লোকে এ কারণে সিন্দুকটিকে মান্য করে। বছরে একবার বিশ্বকর্মা পূজার দিনে তেল সিঁদুর পড়ে।

দেখা গেল–সিন্দুকটার মধ্যে কিছু পুরনো অন্ধকার। ঠিক অন্ধকারও নয়—গন্ধের ছায়া। জননী এই ছায়া দেখে মাথা নাড়ে। আর বলে, সবই মায়া। আর টিকটিকির দুটো খোসা কাঁপতে কাঁপতে সিন্দুকের বাইরে এসে পড়ে।

এর মধ্যে সিন্দুক ভাঙ্গার শব্দ শুনে আমাদের পাগল ঠাকুরমা পুকুর পাড় থেকে ছুটে এসেছে। কাঁপতে কাঁপতে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসে সিন্দুকের উপর হামলে পড়েছে। ভিতরটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখছে। পায়ের পাতায় আলতা রঙের মত রক্ত এসেছে। দেখে আমাদের বোন চেঁচিয়ে বলে, অ ঠাকুরমা, কি করতিছো। ওটার মদ্যি মাথা দিও না।

শুধু মাথা কেন,পারলে ঠাকুরমা নিজেই সেঁধিয়ে যেতে চাইছে সিন্দুকের মধ্যে। মা জননী ঠাকুরমার হাত ধরে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। ঠাকুরমাকে সরানো গেল না। নিজেই সরে এলো। কপালের একপাশটা ছুলে গেছে। মুখে কালিঝুলি। দুহাতে কালো কালো গুড়ো। সেগুলোকে দেখিয়ে বহুদিন পরে সুস্থ মানুষের মত আমাদের পাগোল ঠাকুরমা কথা বলে উঠল। মাকে একটু হিন্দুস্তানী টোনে শুধাল, দেখতো বউমা, এগুলার মধ্যে জরি দেখতি পাইতিছো?

ঠাকুরমাকে কথা বলতে দেখে মা জননী দুর্গা দুর্গা বলে কেঁদে উঠেছে। শোনা যায় ঠাকুরদার সঙ্গে পশ্চিম থেকে চলে আসার পরে ঠাকুরমা এই বাড়িতে আর কথা বলে নাই। গুমরে গুমরে থেকেছে।

ডঃ তপন বাকচি ‘যাত্রাপালার ট্রাজেডী কুইন মিস টুয়েন্টি নাইন’ শীর্ষক প্রবন্ধে এ সংক্রান্ত আরো কিছু তথ্য উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, পুবের বিলাঞ্চলে প্রেমিকের হাত ধরে যেদিন মিস টুয়েন্টি নাইন তার যাত্রা পালার জীবন-যাপন আর অর্জিত জনপ্রিয়তা–সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এলেন,সেদিনই তাঁর মেজ জা লীলাবতী দেবী কানে কানে কয়ে দিলেন, ওলো নটির বেটি নটি, তুই কী জানিস, তোর লাঙ কৃষ্ণ ঠাকুর গন্নি বিবির লগে আসনাই করতি যাওয়ার লাইগা নিজের পায়ের জন্যি জুতো কেনবার গেছিল কোইলকেত্তায়? তোর লাঙের একটা নয়রে নটি—শতেক নটি আছে।

আরও গলা খাটো করে লীলাবতী দেবী তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, পুরুষ মাইনসের একটু আধটু মাইয়া মাইনের দোষ থাকে। কিন্তু তাই বইলা জমি-জিরেত বেইচা জুতা কিন্যা বাবু সাইজা বাইজী বাড়ী যাইস কোন সাহসে? তুই তো আর সত্যি সত্যি মথুরার শ্রীকৃষ্ণ না। তুই হইলি আমাগো বিলা এলাকার হাইলা-জাইলা নমোশুদ্দুর। কৃষ্ণপালা গাইলিই কি আর আসল কৃষ্ণ ঠাকুর হওন যায়?

তখন পাশের বাড়ির রাঙ্গা বৌদি মাছ কুটছিল। সে অকাল বিধবা। এই রাঙ্গা বৌদি লীলাবতীর দেবীর কথা শুনে হাত না ধুয়েই ছুটে এল। মিস টুয়েন্টি নাইনকে বলল, আমাগো ঠাকুরপো মানুষ খারাপ না। কারো দিকে কু দৃষ্টি দেয় নাই। কোনো মাইয়া মাইনসের জন্যি ছুইটা যায় নাই। তার মনে কোনো পাপ নাই। বড় খাঁটি মানুষ। হ্যারে ভুল বুইঝো না বইন। তোমার ঠকায় নাই। তোমারে সারা জীবন মাথায় কইরা রাখবে।

লীলাবতী দেবী তখনি রাঙ্গা বৌদিকে এই উঠোন থেকে হটিয়ে দিল। টুয়েন্টি নাইনকে চেঁচিয়ে বলল, অর কথা শুনিস না। এই রাড়ীর লগেও তোর কৃষ্ণ ঠাকুরের আসনাই আছে। অই রাঙ্গা বৌ বিটিই তারে কইছিল—অই গন্নিবিবি কাছে রাজা-বাদশা ছাড়া কেউ যাইতি পারে না। আইজ তোমারে সেই নিজ থেইকা ডাইকা বইছে। সাদা লক্ষ্মী পায়ে ঠেইলো না। লাগলে ঘটিবাটি বেঁইচা দেও। ভিক্ষা করো। তবু জুতা কেনো। জুতা পায়ে দিয়া রাজা সাইজা গন্নিবিবির কাছে যাও। যাইয়া বোঝো মাইয়া মাইনসের মনটা কেমন। নাইলে তুমি বুঝবা কেমন কইরা নারী জনম ক্যান এক পুরুষের লাইগা মাথা কুইটা মরে। আর তোমারে রাজা-সাজে দেখতি আমার হাউস হতিছে। বুইঝা দেখ!

এর পরে মিস টুয়েন্টি নাইন দিন চারেক আহার নিদ্রা করে নাই। বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেছে। এই সময় বিড়বিড় করেছে—তার মজনুন তার সঙ্গে বেইমানী করেছে। রঙ্গিনী নটিনি জেনানাকে পেয়ার করেছে। সে জেনানার সঙ্গে দেখা করার জন্য নিজের পায়ের মাপে পাম্প-সু জুতা কিনেছে। এই ঘটনা তার কাছে গুপ্ত করছে। তাকে কৃষ্ণ সেজে যাত্রা পার্টি থেকে ভাগিয়ে এনেছে। কানের কাছে অষ্ট প্রহর গুণ গুণ করেছে—মিস টুয়েন্টি নাইন, তোমা বিনা এ জাহানে আমি আর কাউকে পুছি না। তোমা বিহনে এ জিন্দেগী বৃথা। তুমিই মামার পেরথম—তুমিই আমার শ্যাষ।

লীলাবতীর কাছে এই জুতা কেনার কাহিনী শুনে মিস টুয়েনটি নাইনের সব ঝুটা হয়ে গেছে। তার পেয়ারকে আর সাচ্ছা মনে হচ্ছে না। মাথা ঠুকে ঠুকে বলছে, সহি নেহি। গাদ্দার ইনসান।

এইরূপ দূর্ভাবনায় তার মাথায় ক্রমশ বাই-রোগ দেখা দিল। বাক বন্ধ হয়ে গেল। শুধু গলার মধ্যে গজ গজ করে শব্দ করে—হিরি কিরি। তার কোনো অর্থ নাই। তার জীবন অর্থহীন হয়ে পড়েছে।
ফরিদপুরের প্রখ্যাত ডাক্তার বিজিতেন ঘোষ মহাশয় পরীক্ষা করে বলেছিলেন, নন কিউরেবল মেন্টাল ডিসঅর্ডার। কলপুরের গুণীন কেশীর মা কী সব গাছ-গাছড়া খেতে দিয়েছিলেন। তবে কিছুদিন পরে গলা খাটো করে বলেছিলেন, দিনকাল খারাপ বাবাসগোল। ধন্বন্তরী নিদ্রা যাতিছেন। এখন কোনো নিদানে আর কাজ হতি চায় না। গোলারগাতীর বাবুরাম পাগল বায়সবিদ্যা জানতেন। তিনি নক্ষত্র গুণে গেঁথে রায় দিয়েছিলেন, চিন্তা করিও না, তিনি সুস্থ হবেন। মঘা নক্ষত্রে রাহু-কেতুর মিলনহেতু তিনি বাহ্যজ্ঞান প্রাপ্ত হবেন। সেটা কবে, কখন—কোন বৎসরে ঘটবে সে সম্পর্কে তার আদৌ কোনো ইশারা ছিল না। বাবুরাম পাগোল শুধু বলেছিলেন,জানিও কোনো কোনো নিদান ইশারা ছাড়াই ঘটে।

এই ঘটনার পরে গন্নিবিবি কথিত কৃষ্ণ ঠাকুর আর কখনো কৃষ্ণ-গীত গাইতে অন্য কোনোখানে খ্যাপে যান নাই। মন মরা হয়ে বাড়ির আশেপাশেই ঘোরাফেরা করেছেন। চুলে চিরুণীও দেন নাই। তার কালো টেরিকাটা ঢেউ খেলানো চুলে জটা পড়েছিল। মুখ সত্যি সত্যি কৃষ্ণবর্ণ হয়েছিল। তার এই উৎসন্ন দশা দেখে তার বৌদি লীলাবতী দেবী মুচকি হেসে বলেছিলেন, ঠাকুর পো, দরকার হইলে আরেকডা বিয়া কইরা ফালাও। পাগলের জন্যি জীবন নষ্ট কইরা লাভ কী?

মিস টুয়েন্টি নাইন পাগল হয়েও এ বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যায় নাই। একটা দূরত্ব রেখে কৃষ্ণ ঠাকুরকে ঘিরে ছিল। অথবা কৃষ্ণ ঠাকুর তাকে ঘিরে ছিলেন।

তবে কোনো কোনো বিদ্বজ্জন বলেছেন, এই বিল প্রদেশ থেকে ফিরে যাওয়ারও কোনো উপায় জানা না থাকায় মিস টুয়েন্টি নাইন এখানেই থেকে গিয়েছিলেন। তবে তার সুললিত কণ্ঠস্বর আর কেউ কখনো শুনতে পারে নাই। লোকে বিস্ময়ে বলে, কৃষ্ণ ঠাকুররূপী বিদু বাবু শেষকালে একটা বোবা মাইয়ারে বিয়ে করে আনলো! দেশে কি আর ভালো মাইয়া ছিল না?

এই ধরনের আরও কিছু রটনা প্রচলিত আছে। সেটা বড় মহলের কথা। আমরা ছোট মানুষ। তাদের নিয়েই আমাদের সকল কথাবার্তা। এই ডঃ তপন বাকচির ট্রাজেডী কুইন মিস টুয়েন্টি নাইনের উল্লেখিত ক্ক্রিষ্ণ ঠাকুর আর মিস টুয়েন্টি নাইনের ঘটনার সঙ্গে আমাদের নিজের ঠাকুরদা আর পাগল ঠাকুরমার জীবন অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। যারা উদারপন্থী তারা নিশ্চিতভাবে স্বীকার করবেন—এ কাহিনী আমাদের পারিবারিক কাহিনীই। আমাদের একান্ত পারিবারিক ইতিহাসের পুনর্বয়ান মাত্র। সুতরাং ডঃ তপন বাকচির থিসিসকে আমরা এখন বিদায় দিচ্ছি। আমাদের বাড়িতে ফিরে আসি।

বাড়িতে সিন্দুকটি সবে ভাঙ্গা হয়েছে। আমাদের ঠাকুরমার হাতে তখন সিন্দুকের ভেতর থেকে বের করে আনা কালো কালো কিছু গুড়া। হাতের কালো এই গুড়াগুলো দেখিয়ে ঠাকুরমা আমাদের মা জননীকে শুধালো, দেখতো বউমা, জরি দেখতি পাইতিছো?

আমরা জরি দেখতে চেষ্টা করি। জরি কোথায়– শুধু কালো কালো গুড়ো চোখে পড়ে। মা কিছু বলে না—ঠাকুরমাকে গভীরভাবে দেখতে চেষ্টা করে।

ঠাকুরমা বলে, কোনো মতি দেখতি পাইতিছো?

আমরা হিরে-মতির মতি খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। মতির বদলে দেখি কালো কালো গুড়ো।

ঠাকুরমা চেঁচিয়ে বলে—জরিদার মতিপূর্ণ সু-জুতা দেখতি পাইতিছো?

ঠাকুরমা হাতে শুধু কালো কালো গুড়ো। জরিও দেখা যায় না। মতিও না। সু-জুতার লেশমাত্র নাই। কোনোকালে ছিল কিনা বলা মুশকিল। থাকলেও শত বছরে সিন্দুকের মধ্যে থেকে থেকে কালো হয়ে গুড়ো হয়ে চিহ্ণহীন হয়ে গেছে। কিন্তু ঠাকুরমা আমাদের দিকে গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। যেন আমাদের একটি জবাবের উপর নির্ভর করছে তার জীবন অথবা মরন। যেন আমারা সত্যি সত্যি সু-জুতাটিকে দেখতে পাচ্ছি। ঠাকুরমা কথিত এই জুতাজোড়াই সিন্দুকে এতোদিন আটকা পড়ে ছিল।

মা জননী ঠাকুরমার দুহাত ধরে হাসি হাসি মুখে বলে, হ্যা মা, ওটা জুতা। সু-জুতা। আমরা জুতার উপরে জরি দেখতি পাইতিছি। মতি দেখতি পাইতেছি। একটা জুতা দেখতি পাইতেছি।

ঠাকুরমার হাতে তখন আর সিন্দুকের কালো গুড়াগুলো আর দেখা যায় না। গুড়াগুলো ততক্ষণে একজোড়া জুতার আকার পেয়েছে। সত্যি সত্যি জুতা হয়ে উঠেছে। জরি আর মতিতে ঝলমল করছে।

মা জননী জুতা-জোড়া নিজের হাতে নিল। আঁচল দিয়ে একবার মুছেও দিল। তাতে জুতার জৌলুস আরও বেড়ে যায়। আলো ঠিকরে পড়ছে। কপালে ঠেকিয়ে তিনবার প্রণামও করে।

ঠাকুরমা গভীর আগ্রহে আবার জানতে চায়, এটা পুরুষ মাইনসের, না, মাইয়া মাইনসের জুতা?

মা জননী বলে, ওটা মাইয়া মাইনসের জুতা। মা জননী আরও স্পষ্ট করে বলে, জুতাজোড়ার গোড়ালিতে বানজারান লেখাও দেখতি পাইতেছি। জুতাজোড়া গন্নিবিবির জুতা। কোনো ভুল নাই।

ঠাকুরমা চমকে ওঠে। বলে, গন্নিবিবির বানজারান জুতা। তোগো ঠাকুরদার জুতা না। তাইলে তোগো ঠাকুরদা নিজের জন্যি জুতা কেনে নাই। জুতা পইরা গন্নি বিবির লেগে দেখা করতে যায় নাই। আমার আগে-পরে অন্য জেনানাকে পেয়ার করে নাই। আমারে ফাঁকি দেয় নাই। তিনি আমারই সহি মজনুন ছিলেন। দুর্গা। দুর্গা। মেরা মজনুন সহি মজনুন হ্যায়। কোই ঝুটা নেহি।

ঠাকুরমা একটি বড় করে শ্বাস নেয়। তার বুক থেকে বহুযুগের চেপে থাকা একটা পাথর নেমে গেছে। তার মন থেকে সন্দেহ চলে গেছে। এইবার ঠাকুরমার কাঁপুনি থেমে যায়। বহুদিন পরে তার মুখ থেকে বিষাদচিহ্ন মুছে গেছে। মাধুর্য্য জেগেছে। তাকে হাসতে দেখা যায়।

হাসতে হাসতে জুতা জোড়া আমাদের মা জননীর হাত থেকে আবার নিজের করতলে গ্রহণ করে। এক অদ্ভুত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় জীবনে প্রথমবারের মত এই বানজারান জুতা পূর্ণরূপে নিজ চোখে দেখে। দেখে তার আশ মেটে না। আরো গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করে। এই গভীরভাবে দেখার মধ্যে থেকেই জুত জোড়া একটু একটু কাঁপতে থাকে। উষ্ণ হয়ে ওঠে। দুপাশ থেকে হালকা রূপালী রঙের ডানা দেখা যায়। ডানা ফর ফর করে নড়ে ওঠে। ঠাকুরমা হেসে ওঠে সেই রাধা-কৃষ্ণের রাস-লীলার রাধার মত করে। বলে, এতো জুতা না—এইটা দেখি পাখি। আমাদের জননী তাকে সায় দিয়ে বলল, হ্যা মা, জুতা হইবে ক্যান। অই দুইটা পাখি। পাখি দুইটারে মাইনসে জুতা কইয়া আপনেরে ভুল বুঝাইছে।
শুনে ঠাকুরমা হাহাকার করে উঠল, পাখি দুইটারে একটা জুতা মনে কইরা সারা জীবন যাতনা পুইষা রাখলাম! হা কপাল!
তিনি পাখিদুটোকে চোখ ভরে দেখতে থাকলেন। তার আর অবিশ্বাস থাকল না। এই জুতার বদলে জলজ্যান্ত পাখি দুটোকে নিজের হাতের উপর দেখতে পেয়ে তার সব যাতনা উবে গেল। পালকের উপর গভীর মমতায়, স্নেহে আর ভালোবাসায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আর পাখি দুটোও প্রকৃত পাখির মত মাথাটা কাত করে মানুষের গলায় কথা বলে উঠল—বৌ কথা কও।

ঠাকুরমার চোখে জল এলো পাখির কথা শুনে। মাথার উপর ঘোমটা টেনে দিল। নিজেকে বৌ বৌ লাগছে। তার এখন একটু লজ্জাও করতে শুরু করেছে। লজ্জায় মুখটা লাল হচ্ছে। বলল, কী কথা কবো রে পাখি?

–গানের কথা কও।

–কী গান?

–গিরিধারী লাল। গিরিধারী লালের গানের কথা কও। কৃষ্ণকথা গাও।

ফলে ঠাকুরমার আর না করার সুযোগ নাই। ঠাকুরমা বহুদিন পরে মতিবিবির মত একটু হাওয়া খেলিয়ে গন্নিবিবির মত গুন গুন করে মিস টুয়েন্টি নাইনের গলায় গেয়ে ওঠে—আও মে গিরিধারী লাল। এই মধুরতর সুরে আকাশে জ্যোৎস্না ওঠে। পুকুরে পদ্ম ফোটে।
পাখি দুটো এই গানের মধ্যেই ডানা ঝাড়ে। তাদের গা থেকে কিছু কালো কালো গুড়ো ঝরে পড়ে হাতের উপর। আঙ্গুলের ফাঁকা দিয়ে মাটিতে পড়ে। কিছু হাওয়ায় ভেসে যায়। দূরে।

জুতা-পাখি ততক্ষণে ডানা মেলে। একটি একটু করে হাওয়ায় ভর করে ওড়ে। উড়ে গিয়ে তার কাঁধে বসে। কাঁধ থেকে উড়ে গিয়ে সফেদ চুলের উপরে বসে। আকাশে উড়ে যায়। তাদের আর দেখা যায় না।

Post a Comment

0 Comments