গায়ক খালিদ সাইফুল্লাহ স্মরণে


খালিদ সাইফুল্লাহ হলেন আমাদের খালিদ ভাই। আমাদের পাশাপাশি দু পাড়ায় থাকি। হেঁটে গেলে ৭ মিনিটের দূরত্ব। মডেল স্কুলে একই সঙ্গে পড়েছি। তিনি আমার দু বছরের সিনিয়র।

জলের তল থেকে ভেসে উঠেছিল আমাদের শহরটা। আকারে প্রকারে ছোট। প্রচুর গাছপালার ভেতরে টিনের ঘরদোর। আর হাতে গোনা কয়েকটি ছিল ইটের বিল্ডিং।
আমরা প্রতিদিনই সারাটা শহর হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াতাম। জানতাম কোন বাড়িতে কে থাকে। কোন বাড়িতে কোন গাছটি আছে সেটাও ছিল আমার জানা।
বিএ হেমায়েত সাহেবের একতলা দুটি বাড়ি ছিল চৌরঙ্গীতে। দুটোই সাদা রঙের। রাস্তার পাশের বাড়িটি বেশ পুরনো। আর পেছনে একতলায় পরিবার পরিজন থাকতেন।
আমি যখন সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছি, একদিন রাতে স্বপ্নে আমাকে সাপে কামড়েছিল। বড়দি সকাল বেলা বিএ হেমায়েত সাহেবের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল। পুরো বাড়িটি খুব সাজানো গোছানো। নানা রঙের ফুল গাছ। বেশ কিছু বাবু কবুতরও হয়তো দেখেছিলাম।
বিএ হেমায়েতের স্ত্রী, আমার বড়দির বান্ধবীর মা একটা কাঁসার থালায় কোরান শরীফের আয়াত পড়লেন। তারপর আমার পিঠে থালাটি চেপে ধরলেন। দুটো টোকা দিলেন। থালাটি পিঠে লেগে গেল। বললেন, এই থালা সাপের বিষ শুষে নেবে। তারপর পিঠ থেকে খসে পড়বে।
তিনি আমাকে এক বাটি মুড়ি মেখে দিলেন পিঁয়াজ দিয়ে। আর অন করে দিলেন টিভি। ঝির ঝির করতে লাগল টিভি স্ক্রিনটি। কোনো ছবি নেই। সেই সময় টিভির অনুষ্ঠান শুরু হতো সন্ধ্যাকালে। ফলে কোনো অনুষ্ঠান সেদিন ভোরে হওয়ার কথা নয়। তবুও তিনি আমার জন্য টিভিটি চালু করে রাখলেন। ঝির ঝির করা টিভির স্ক্রিনে ঘণ্টাখানেক আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। সেই প্রথম আমার টিভি দেখা।
এর মধ্যে হাওয়ায় ভেসে এলো একটি গানের সুর। জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখিয়ে একজন বালক উঠোনে হেঁটে হেঁটে গান গাইছেন। এই বালকটিই খালিদ ভাই। কী অসামান্য সুর তার কণ্ঠে।
এরপর একটু একটু করে বড়ো হতে শুরু করেছি, একটু একটু করে একা একা ঘুরে বেড়াতে শুরু করেছি। ক্লাস টুতে প্রতিদিন বিকেল বেলায় নজরুল পাবলিক লাইব্রেরিতে যাই বই পড়তে। তার পাশেই শিল্পকলা একাডেমি। খালিদ ভাই শিল্পকলায় গান গাইতে আসতেন। তিনি গাইতেন এসডি বর্মনের গান। অজয় ভট্টাচার্যের তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে। রবীন্দ্রনাথ নজরুল গীতিও তার গলায় অসামান্য লেগেছে। তার গলায় কিশোর কুমারের গান একদিন পাখি হয়ে উড়ে যাবে যে আকাশে যেদিন প্রথম শুনেছিলাম সেদিন থেকেই আমাদের কাছে পাখি আর সাধারণ পাখি হয়ে রইল না, আকাশটা যেন আর শুধুই আকাশ মনে হলো না। হয়ে গেল অন্য কিছু। এই অন্য কিছুর জন্যই আমাদের বন্ধু প্রতিক সাইফুল কবিতা লিখতে শুরু করল। ছবি আঁকতে শুরু করল। তারপর একদিন সত্যি সত্যি আকাশে উড়ে গেল। তাকে আর দেখতে পাইনি।
খালিদ ভাইই ছিলেন আমাদের বালক বেলার গানওয়ালা। তখন পাড়ায় পাড়ায় বিচিত্রা অনুষ্ঠান হতো। খালিদ ভাই সেসব অনুষ্ঠানের প্রধান শিল্পী। দেখা হলেই অমায়িক হেসে বলতেন, কেমন আছ রায় মশাই।
তিনি ক্রমশ আমাদের জলের তল থেকে ভেসে ওঠা ছোট্ট শহর ছেড়ে ঢাকাতে চলে গেছেন। আমরা শুনতে পাই তিনি ব্যান্ড গড়েছেন। নাম করেছেন। আমরা হারিয়ে গেছি। একদিন হঠাৎ সন্ধেবেলায় টিভিতে দেখতে একটি গান শুনে চমকে গেলাম। আমাদের খালিদ ভাই গাইছেন– নাতি খাতি বেলা গেল শুতি পারলাম না। এ যে আমার এলাকার কথা। এ কথাটি আমাদের মা মাসিরা বলে থাকেন। আর খালিদ এই কথাটিই গেয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। অসামান্য জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
তার গান যখনই শুনেছি তখনই মনে হয়েছে তার গানের পেছনে একটি সুচিন্তা আছে। সুনির্বাচন আছে। আমাদের চিরায়ত গান, লোক গানই যেন তার কণ্ঠে অন্য মাত্রা পেতো। এমনকি তিনি ব্যান্ডে যেসব গান করেছেন সেগুলোর কথা, সুরও যেন বাংলা গানের ধারার মধ্যেই ঘোরাফেরা করেছে। ফলে তিনি আশি বা নব্বই দশকের শিল্পী হলেও এই সময়ের তরুণদের মধ্যেও তার জনপ্রিয়তা আছে।
—--------
খালিদ ভাই বেশ কয়েক বছর আগে নিউ ইয়র্কে আসা যাওয়া করেছেন। তাঁর স্ত্রী ও এক মাত্র ছেলে এখানে থিতু হয়েছেন। ভাবী শামীমা জামান একজন লেখক, কথাসাহিত্যিক। মানুষটিও চমৎকার। এখানে চাকরি করেন। ছেলে স্কুলে যাচ্ছে। ছোট থেকে বড় হচ্ছে।
করোনা যখন কমে আসছে তখন শামীমা ভাবী জীবনের খাদের কিনারে একেবারে পৌঁছে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ দেড় বছর লড়াই করে মৃত্যকে জয় করে ফিরে এসেছেন। এসময় খালিদ ভাই দেশে ছিলেন। ছেলেকে কখনো প্রতিবেশির কাছে রেখে একা একা হাসপাতালে ছিলেন ভাবী। কখনো ছিলেন রিহ্যাবে। যখন একটু একটু করে হাঁটতে পারছেন ঠিক তখনি আবার ছেলেকে নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। আরেকটু সুস্থ হলেই ফিরেছেন চাকরিতে। কখনোই কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করেননি। দৃঢ় পায়ে নিজের পায়েই এগিয়েছেন। তিনি চিন্তা ও কাজে অনেক পরিচ্ছন্ন, আধুনিক, মানবিক ও সৃষ্টিশীল। কোনো গোড়ামি তার মধ্যে নেই।
যেদিন খালিদ ভাই পাখি হয়ে উড়ে গেলেন, ভাবীকে ফোন করেছিলা্ম। তিনি কথা বলতে পারছিলেন না। তাঁর গলা বুজে আসছিল। তাও সামলাতে চেষ্টা করছিলেন। তখন তিনি সবে অফিসে পৌঁছেছেন। ছেলে স্কুলে। সেই সময়টিতেই বাংলাদেশ থেকে খালিদ ভাইয়ের খবরটি আসে।
তিনি ভেঙে পড়তে পারতেন। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। তিনি বুঝে নিয়েছেন এ সময়ে শক্ত হয়ে থাকতে হবে। ছেলের উপর অনেক দ্বায়িত্ব রয়েছে তার।
ছেলেটি দেখতে খালিদ ভাইয়ের মতোই। বয়সের তুলনায় বাড়বাড়তি অপেক্ষাকৃত ভালো। নম্র, ভদ্র। গান করে। আবার ব্যক্তিগতভাবে ধর্মও পালন করে। কিন্তু ধর্মে গোঁড়া নয়। যে ছেলেটি স্কুল বয়সে মাকে দেখেছে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে দীর্ঘ সময় ধরে, যেকোনো সময়েই সে মাকে হারাতেও পারত– সে সময়ে সেও একটি ভয়ঙ্কর ট্রমার ভেতর দিয়ে চলছিল। সে আশ্রয় নিয়েছিল সৃষ্টিকর্তার। এ ছাড়া সে কীইবা করতে পারত! এর মধ্যে কোনো দোষ দেখি না। ছেলেটি তো এই ধর্ম অন্যের উপর চাপিয়ে দেয় না। ব্যক্তিগতভাবে পা্লন করে মাত্র। ধর্ম পালন বা না-পালন করার অধিকার যে কারোরই আছে।
খালিদ ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ছেলেটিফিরছিল মায়ের অফিসে। এ সময়ে ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছিলেন তার বাবারই একজন বন্ধু। সেটা ভিডিও হয়েছে। ছেলেটির চোখে ছিল চশমা। খুব শান্ত স্বরে কথা বলেছে। বলেছে তার প্রয়াত বাবার জন্য দোয়া করতে।
এটা যখন ফেসবুকে প্রচারিত হয়েছে বেশ কয়েকজন লোক ছেলেটির চোখে চশমা রেখে শান্ত সুরে কথা বলাটাকে নেতিবাচক অর্থ করেছে। ট্রল করেছে।
চোখে চশমা রেখে হাউমাউ করে কান্নাকাটির ভিডিও দেখতে চেয়েছিলেন হয়তো এই ট্রলকারীরা। কিন্তু সবার প্রকাশভঙ্গী তো এক রকম হয় না। কেউ চিৎকার করে কাঁদে। কেউ কেউ গোপনে গোপনে কাঁদে। হয়তো শব্দহীন কান্নার সঙ্গে জল বেরিয়ে আসছিল তাই আড়াল করতে খালিদ ভাই্য়ের একমাত্র ছেলেটি কালো চশমাটি আর খোলেনি। কান্না দেখিয়ে একালে লাভ কী? কান্না দেখানোর জিনিস নয়--অনুভবের। কান্না দিয়েই তাকে ছুই।
যার কান্না তাকেই কাঁদতে দিন। কাঁদতে দিন তার মতো করে। কে কীভাবে কাঁদবে তাও যারা ঠিক করে দিতে চান তারা ঠিক স্বাভাবিক মানুষ নন।
সব কান্নার অর্থই এক। তা হলো বেদনা। বেদনা ছাড়া আর কি!

Post a Comment

0 Comments