ওয়াসি আহমেদের সুন্দিকাঠের আলমারি : একটি অনন্য গল্পের টিকিটাকা



কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদ একটি আলমারি নিয়ে গল্প লিখেছেন। নাম সুন্দিকাঠের আলমারি। গল্পটি অতি সাধারণ। কথকের মায়ের নাম রানী। রানী মারা যাওয়ার পরে ছেলেমেয়েরা দেশ বিদেশ থেকে এসেছে। বাবা সব জিনিস ভাগবাটোয়ারা করে দিয়েছেন। নিজে নিয়েছেন একটা আলমারি। এটা রানীর। 


বাবা লোকটি গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকায় আলমারিটা নিয়ে আসেন ট্রাকে করে। কিন্তু আলমারিটা বেডপ সাইজের বলে সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় ওঠানো সম্ভব হলো না। বাইরে কারপার্ক বা গ্যারেজে ফেলা রাখা হলো। পরে ঠিক হলো একজন মিস্ত্রী ডেকে আলমারিটা খুলে ঘরের ভেতরে নেওয়া হবে। তারপর আবার জোড়া দিয়ে আলমারিটাকে আগের চেহারাতেই ফেরত আনা হবে। এই উপলক্ষে একজন মিস্ত্রীও আসে। মিস্ত্রীকে জানানো হয় আলমারিটা বিখ্যাত সুন্দিকাঠ দিয়ে তৈরি। যত্ন নিয়ে যেন কাজটি করে। মিস্ত্রী জবাবে বলে কাঠটি সুন্দিকাঠের নয়-- চাপালিশ কাঠের। 
মিস্ত্রী কাজটি করে না। পড়ে থাকে আলমারিটা। 

আলমারি তৈরির গল্পটি ছেলেকে শোনায় বাবা। কথক বলে তার সহকর্মীকে। আর কথকের মেয়ে সুন্দি কাঠের আলনারির গল্প শোনায় তার বন্ধুদেরকে। 

এ গল্পে আখ্যানে ঘনঘটা নেই। ঘনঘটা যেটা হতে পারত গল্পকার সেদিকে গেলেন না। হতে পারত আলমারিটাকে কেন্দ্র করে প্রেমের গল্প, বিরহের গল্প, মানবিক গল্প, ভুতের গল্প বা খুনের গল্পও হতে পারত। এই আলমারিকে কেন্দ্র করে তিনি অন্য কোনো ঘটনার উন্মোচন করতে পারতেন যার মধ্যে থাকত নানা চরিত্রের সমাবেশ, নায়ক ভিলেন, তাদের দ্বন্দ সংঘাত, উত্তেজনা, চরম উত্তেজনা। এবং শেষ রাখতে পারতেন একটি ইউনিক ট্যুইস্ট-- পাঠকের যেকোনো পূর্বানুমানই ব্যর্থ করে দিতেন। পাঠকের শ্বাস রুদ্ধ করার মতো গল্প হতে পারত এই সুন্দিকাঠের আখ্যানটি। কিন্তু গল্পকার ওয়াসি আহমেদ সেসব ঘটনার ঘনঘটাকে পাত্তাই দিলেন না। চলে এলেন ঘটনার বাইরে-- লিখলেন একটি আলমারিকে কেন্দ্র করে চারটি মানুষের প্রতিক্রিয়া। 

তিনি সাদামাটাভাবে বললেন, ব্যক্তির চেয়ে তার স্মৃতিটাও আসল। স্মৃতির ভেতরেই মানুষ বাঁচতে ভালোবাসে। স্মৃতিটাকে পল্লবিত করে তোলে। যে জীবন পেরিয়ে আসি সে জীবন আসলে অসংখ্য স্মৃতিরই সমষ্টি মাত্র। তার মধ্যে থেকে একটি স্মৃতি বেছে নেওয়ার অর্থ হলো স্মৃতিটি স্পেশাল। তা ইউনিক। নইলে ব্যক্তি স্মৃতিকে কেনো সমষ্টির কাছে প্রকাশ করা হয়? 


২.

সুন্দিকাঠের আলমারি গল্পের বাবা মানুষটির নাম আলতাফ হোসেন চৌধুরী। থাকেন সিলেটের আম্বরখানায়। নিজের বাড়ি আছে। পেশা ডাক্তারি। তার পশার মনে হয় ভালোই ছিল। নিজের চার ছেলেমেয়েকে উচ্চ শিক্ষা দিয়েছেন। দুজন বিদেশে থাকে। আর দুজন ঢাকায়। ঢাকায় ডাক্তারের একটি কেনা ফ্লাট আছে। সেখানে একটি ছেলে থাকে। ছেলেটি বিবাহিত। তাদের একটি স্কুল পড়ুয়া ছোট মেয়েও আছে। এই তথ্যগুলো আলাদাভাবে গল্পকার দেননি। কিন্তু কয়েকটি সংলাপ ও বিবরণীতে পাওয়া যায়। যেমন গল্পের শুরুর দীর্ঘ বাক্যটি লক্ষ করি--

'মা মারা যাওয়ার পর সপ্তাখানেক নানা ঝক্কি-ঝামেলায় কেটে যেতে আমাদের বাবা ডাক্তার আলতাফ হোসাইন চৌধুরী মায়ের পরিত্যাক্ত শাড়ি-গয়না-আসবাবপত্র বিলি-বণ্টনের ফাঁকে হঠাৎই আনমনে বলে উঠলেন, আলমারিটা আমার।'

একটি বাক্যের মধ্যে অসংখ্য তথ্য পুরে দিচ্ছেন।  

১. বর্ণনাকারীর মা মারা গিয়েছেন। 
২. এর মধ্যে সপ্তাহখানেক কাল কেটে গিয়েছে। 
৩. মায়ের অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। সে-কাজগুলো বেশ ঝক্কি-ঝামেলাপূর্ণ ছিল। 
৪. বাবা একজন ডাক্তার। 
৫. বাবার নাম আলতাফ হোসাইন চৌধুরী। 
৬. মায়ের পরিত্যাক্ত শাড়ি-গয়না-আসবাবপত্র বিলিবণ্টন হচ্ছে। 
৭. ডাক্তার সাহেব তার স্ত্রীর আলমারিটা নেবেন বলে ঘোষণা করলেন। 

দীর্ঘ বাক্য দিয়ে অসংখ্য তথ্যের মাধ্যমে গল্প শুরু করতে পছন্দ করেন কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদ। শুরুর বাক্য দিয়েই তিনি পাঠককে গল্পের গভীরে প্রবেশাধিকার দিতে চান। ভেতরের গোপন-অগোপন সর্বত্রই যেন পাঠক সহজে যেতে পারেন। অন্যত্র তিনি এতো দীর্ঘ বাক্য নয়-- মাঝারি বাক্য, কখনোবা অতি ছোট বাক্যই ব্যবহার করেন। 

তাঁর ' নাগাল' গল্পটির শুরুর বাক্যটি--
'সেপ্টেম্বর মাসের শেষ-বিকেলে ঘড়ির কাঁটা পাঁচটা ছুঁই ছুঁই, এমন সময় নিউ এলিফ্যান্ট রোডে নতুন বাটার দোকানের সামনে এত গাড়ি-টারিউ, রিকশা, পথচারীর মধ্যে আনোয়ার এমন একটা পাবলিক ন্যুইসেন্স ঘটবে ব্যাপারটা নিজের কাছেই চরম নাটকীয় আর অবিশ্বাস্য ছাড়া আর কী?' (৩৯টি শব্দ।)

'লেকসার্কাস ডলফিন গলির বেওয়ারিশ কুকুরগুলোকে যেদিন সিটি কর্পোরেশনের লোকজন ট্রাকে চড়িয়ে নিয়ে বিদায় হলো, ঘটনার নির্মমতা ও আকস্মিকতা সত্ত্বেও গলিবভাসীরা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল। (২৩ টি শব্দ।)

গর্তসন্ধান গল্পটির শুরুর বাক্যটিতে রয়েছে ৩৪ টি শব্দ। চক্রবৃদ্ধি গল্পটিতে ২৩, তীরভূমি গল্পে ২০টি, অপুর ধর্মটিচার গল্পে ২৬টি, তেপান্তরের সাঁকো গল্পে ৩০টি, শিঙা বাজাবে ইসরাফিল গল্পে ২৭টি, ভারহীন দৃষ্টিহীন গল্পে ২৭টি, গ্যালারি গল্পে ২২টি, ত্রিসীমানা গল্পের শুরুর বাক্য লিখেছেন ৭৭টি শব্দ দিয়ে। 

ফ্রান্স কাফকার।মেটামরফোসিস নাম বড় গল্পের প্রথম বাক্যটিও দীর্ঘ। ২০টি শব্দের। 

“As Gregor Samsa awoke one morning from uneasy dreams he found himself transformed in his bed into an enormous insect.”

' অনুবাদঃ নানা আজেবাজে স্বপ্ন দেখার পর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে গ্রেগর সামসা দেখল যে এক বিশাল পতঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে সে তার বিছানায় শুয়ে আছে।' 
শুরুর বাক্যের মধ্যেই  স্থান, কাল পাত্র ও বিষয়কে স্পষ্টভাবেই কাফকা বলে দিয়েছেন। কোনো প্রকার গৌরচন্দ্রিকা বা ভূমিকা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি কাফকা। সরাসরি গল্পের ভেতরে নিয়ে এসেছেন। পাঠককে তিনি ঢিমেতালে আগাতে দিতে রাজি নন। এই বাক্যটিই কথাসাহিত্যের জগতে একটি বিস্ময়। এবং প্রচলিত গল্পের জগতটাকে তিনি নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। 

গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মার্কেজের বিখ্যাত উপন্যাস শতবর্ষের নির্জনতার প্রথম বাক্যটিও উল্লেখ করা যায়--

Many years later, as he faced the firing squad, Colonel Aureliano Buendía was to remember that distant afternoon when his father took him to discover ice.

অনুবাদ : বহুবছর পরে কর্নেল আউরোলিয়ানো বুয়েন্দিয়া যখন ফায়ারিং স্কোয়াডের মুখোমুখি হলো ঠিক তখনই তার মনে পড়ল তার বাবা একদিন পড়ন্ত দুপুরে তাকে তুষার খুঁজতে নিয়ে গিয়েছিল। 

ওয়াসি আহমেদও এরকম শৈলীই ব্যবহার করেছেন। বেশি কথা বলার লোক তিনি নন। ফলে বাক্যটি বড় হলেও সেখানে বেশি কথা নেই।প্রয়োজনীয় তথ্যগুলোই এক শ্বাসে বলে দেন। তথ্যগুলো আবার স্থবির নয়। সচল। তীব্র। তিনি গল্পকে টেনে বের করে গতির মুখে ছেড়ে দেন। গল্পটি চলতে শুরু করে রিলে রেসের মতো। যেন এখন নয়, গল্পটি অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। অপ্রয়োজনীয় শিথিল বা অকেজো শব্দ না থাকায় এই দীর্ঘবাক্য মনোযোগ ছিন্ন করে না। তবে কমা ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘ বাক্যগুলো হয়ে ওঠে কয়েকটি উপবাক্য। এই কমাস্থানে পাঠক শ্বাস ফেলেন। একটু থামেন। আগের উপবাক্যটি মর্মার্থ বোখার চেষ্টা করেন। সেই অর্থকে মনে রেখেই পরের উপবাক্যটিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। 

গল্পটির দ্বিতীয় বাক্যটিও দীর্ঘ। ৩৭ টি শব্দ দিয়ে গাঁথা। তৃতীয় বাক্যটি ছোট। ১০ টি শব্দ আছে। চতুর্থ ও পঞ্চম বাক্যটিও ছোট। শব্দসংখ্যা যথাক্রমে 8 ও ৭ টি। প্রথম ও দ্বিতীয় দীর্ঘ বাক্যে যে শ্বাস রোধ হয়েছিল পরের তিনটি বাক্যগুলো যেন শ্বাস ফেলার জন্য ছোট করে লিখেছেন। শব্দসংখ্যা ৩৫। পরের বাক্যটি মাত্র ২ শব্দের। শব্দের মধ্যে পূর্ণ সঙ্গতি আছে। অপ্রয়োজনীয়, অসামঞ্জস্য, গুরুগম্ভীর শব্দ নেই বললেই চলে। আবার তরল শব্দও থাকে না। আমাদের পরিচিত শব্দ তিনি ব্যবহার করেন। এবং সেগুলো বাংলা। হাইফেন, কম, দাড়ির ব্যবহারে তিনি ব্যকরণ অনুসারী। এই শব্দগুলো নির্ভরযোগ্য ট্রেনের মতো মসৃণ ও দ্রুতচালে ঘটনাকে টেনে নিয়ে চলে। 


দুই.

সুন্দিকাঠের আলমারি গল্পে স্ত্রীর সঙ্গে ডাক্তার সাহেবের সম্পর্ক কেমন ছিল? ভালো, না মন্দ? সে রকম কোনো তথ্য গল্পকার দিচ্ছেন না। তবে ধরে নেওয়া যায় সম্পর্কটি  মন্দ ছিল নয়। মন্দ ছিল বলে কেউ তো অভিযোগ করেনি। ছেলেমেয়েরা মনে করছে, মায়ের স্মৃতিকে আকড়ে ধরেই বাকি জীবনটা তাদের বাবা কাটাতে চান। সেজন্যই বাবা মায়ের রেখে যাওয়া আর কিছু নয়, ব্যবহৃত সুন্দিকাঠের আলমারিটা নিতে চেয়েছেন। যেন তাদের বাবা এই আলমারির পাল্লা খুলে এর ভেতরে, অন্তহীন উঁকি দেওয়ামাত্র মাকে পেয়ে যাবেন। 

লক্ষ করুন-- 
১. আলমারিটার পাল্লা ডাক্তার সাহেব খুলবেন। একবার দুবার নয়-- অন্তহীন উঁকি দেবেন।
২. যেন প্রয়াত স্ত্রীকে অন্তহীনভাবে পেতে চাইবেন। 

এই একটি বাক্যের মধ্যে দিয়ে ছেলেমেয়েরা তাদের মায়ের প্রতি বাবার গভীরতম ভালোবাসার বিবরণই দিচ্ছে। বাবামায়ের মধ্যেকার গভীর সম্পর্ক ছাড়া অন্য কিছু থাকতেই পারে না বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের ধারণা। তারা একে অপরের পরিপূরক। একের বিহনে অন্যের বাঁচা কঠিন। 

ডাক্তার সাহেব নিজে কিছুই বলছেন না প্রয়াত স্ত্রী সম্পর্কে। শুধু একবার মাত্র বলেছেন প্রয়াত স্ত্রী সম্পর্কে। বলছেন একটি সংলাপে। সাত পৃষ্ঠার গল্পের আর কখনোই স্ত্রীর কথা উচারণ করছেন না। আলমারিটা যখন ট্রাকে চড়ে এলো, বাড়ির সামনে ট্রাক দাঁড়িয়ে, বৃষ্টি হচ্ছে, তেরপলের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে তখন বাবা চারতলা থেকে তড়িঘড়ি করে নেমে এসেছেন। তেরপলের চেয়েও তিনি বেশি ভিজছেন বলে তার ছেলের মনে হচ্ছে। বৃষ্টির ছাটে চশমার কাঁচ ঝাঁপসা হয়ে গেছে। তার মধ্যে ভোরের টাটকা ভেজা আলো। কথক হিসেবে এটা ছেলের বর্ণনা। এই চিত্রকল্পের মধ্যে দিয়ে প্রয়াত মায়ের প্রতিই যেন বাবার ভালোবাসাটা প্রকাশ পাচ্ছে বলে ছেলের মনে হচ্ছে। যেন আলমারি নয়-- সিলেটের আম্বরখানা থেকে এসেছে তার হঠাৎ নাই হয়ে হয়ে যাওয়া স্ত্রী। স্ত্রী মানুষটি সত্যি সত্যি  বেঁচে থাকলে তিনি তো এইভাবেই ছুটে যেতেন ঝড়জল উপেক্ষা করে-- ছুটে যেতেন  তাকে অভ্যর্থনা জানাতে। এ কথা বলেননি গল্পকার ওয়াসি আহমেদ। যেন বলতে গিয়েও গোপনে রেখেছেন। যেন পাঠককে এই গোপনে রাখা কথাটি আবিষ্কারের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। আমরা, পাঠকরা সেটা খুঁজে নেই। খুঁজে নিতে কোনো ক্লান্তি আসে না। 

তারবদলে বলছেন স্ত্রীর বাবার দেওয়া আলমারির কথা। আলমারি তৈরির ঘটনা। ঠিক আলমারিও নয়-- আলমারি যে কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল সেই কাঠের ইতিহাসটি বলছেন। আরেকটি ভিন্ন দেশ থেকে কত কসরত করে আনা হলো সেই ঘটনাপ্রবাহ বলছেন। আলমারিটা আর আলমারি নামক বস্তু রইল না। হয়ে গেল একটি চেতনা। গরীয়ান চেতনা। যদি এই আলমারিটা কোনো ফার্নিচার শপ থেকে কেনা হতো, যদি তার কাঠ সুন্দিকাঠ না হয়ে আরো নামী দামী কাঠের তৈরি হতো, আরো যদি সুন্দর হতো তাতে কিছু তার যায় আসে না। তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হলো তার শ্বশুর তার বিয়েতে এমন একটি উপহার দিলেন যার আকার আয়তনের প্রায় কোনো আলমারিই এ এলাকায় নেই। নিশ্চয়ই বিয়েতে উপস্থিত লোকজন সেটা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। মুগ্ধ হয়েছিলেন। এলাকায় কিংবদন্তী হয়েও ছিল বোধকরি। গল্পকার সেটা বলছেন না। আমরা কল্পনা করে নেই। বুঝতে পারি, বিয়ের দিনে প্রচণ্ড ঝড়জলের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে বাঁশ-টাশসহ প্যান্ডেল ভেঙে পড়ল বরের স্টেজের উপর, প্যান্ডেলের নিচ থেকে টেনে বের করা হলো ভিজে একশা হয়ে যাওয়া বরকে, এর মধ্যেই কণের সম্মতি নিয়ে এসেছেন বরের চাচা, বরের বাবা সাময়িক খেপে গেলেও কল্পনা করে নিচ্ছি বিয়ের আসরের সুরক্ষিত জায়গায় রাখা হয়েছে সদ্য নির্মিত সুন্দিকাঠের আলমারিটি। সেটা দেখে বরের হঠাৎ ক্ষিপ্ত বাবার রাগ গলে জল হয়ে গেছে। তিনি তারিফ করে বলছেন, রুচি আছে বটে বেয়াই সাহেবের। 


তিন. 

গল্পের প্রথম বাক্যটিতে একটি সংলাপও আছে। ‘মায়ের পরিত্যাক্ত শাড়ি-গয়না-আসবাবপত্র বিলি-বন্টনের ফাঁকে হঠাৎই আনমনে (বাবা মানুষটি) বলে উঠলেন, আলমারিটা আমার। সংলাপটি ছোট। মাত্র দুটি শব্দ। কিন্তু এই সংলাপটি কার উদ্দেশ্যে বলা তা সুনির্দিষ্ট নয়। মনে করতে পারি সেখানে তার ছেলেমেয়েরা আছেন। থাকতে পারেন ঘনিষ্ট আত্মীয়স্বজ্ন। বন্ধুবান্ধব। বাবা মানুষটির বলা এই ছোট সংলাপটির উত্তরে কেউ কোনো কথা বলছেন না। কোনো প্রশ্নও করছেন না। যেন আরেকটি সংলাপ বলার দরকার নেই। এটা একটা সিদ্ধান্তমূলক বাক্য। অন্যদের বলার কিছু নেই। ফলে সংলাপটি আর সংলাপ থাকে না। হয়ে ওঠে আখ্যান বর্ণনারই অংশ। 

তৃতীয় প্যারাতেও আরেকটি ছোট সংলাপ বাবা বলছেন, আলমারিটা সুন্দিকাঠের। 

এরও কোনো প্রতি উত্তর নেই। প্রতি উত্তরের আশাও করছেন না বক্তা বাবা। তিনি একটু থেমে থেমে আরও কয়েকটি সংলাপ বলেছেন। বলেছেন আলমারিটার নির্মাণ ইতিহাস। ফলে গল্পকার এটাকে আর সংলাপ হিসেবে রাখতে চাননি। বর্ণনার ভেতরে নিয়ে গেছেন। 

‘আমরা কতটা শুনলাম, শুনলেও কী বুঝলাম, সেদিকে না গিয়ে থেমে থেমে যা বলে গেলেন, তা এই : আসামের হাউকা পাহাড়ের জঙ্গলে সুন্দিকাঠের ছড়াছড়ি, রূপে-গুণে মেহগনির সমতুল্য এই গাছ বার্মা থেকে ব্রিটিশরা এনে লাগিয়েছিল।…’

এভাবে আরো একটি দীর্ঘ বাক্য দিয়ে বাবার বয়ানটি উল্লেখ করছেন বর্ণনাকারি। 

এটা যদি প্রচলিত সংলাপের মতো করে গল্পকার ব্যবহার করতেন তবে তা হয়ে উঠত বক্তা ও শ্রোতার দ্বিরালাপ। বক্তা যেমন বলছেন, শ্রোতাও তাতে অংশ নিয়ে পালটা সংলাপ বলতেন। যেমন--

বাবা বললেন, সুন্দিকাঠ কোথা থেকে এসেছে তোরা জানিস?

ছেলে বলল, আগে নাম শুনিনি। এটা কি বিদেশ থেকে এসেছে? 

-- ঠিক ধরেছিস। এটা আসাম থেকে আনা হয়েছে। এটা আসামের হাউকা পাহাড়ের জঙ্গলে অনেক পাওয়া যায়। আসামে আগে ছিল না।

--তাহলে কীভাবে আসামে এলো? 

বাবা এবারে একটু হাসলেন। বললেন, এটা বার্মাতে পাওয়া যায়। ব্রিটিশরা বার্মা থেকে চারা এনে আসামের হাউকা পাহাড়ের জঙ্গলে লাগিয়েছিল। এটা রূপেগুণে মেহগনির সমতুল্য। 

এইভাবে সংলাপ গড়েন অনেকে। তাতে গল্পের পরিসর বেড়ে যায়। যেমন গল্পকার যে কথা একটি বাক্যে বলেছেন সেটা এখানে বলা হলো 12টি বাক্যে। মূল গল্পে এই একটি বাক্যে গল্পকার ব্যবহার করেছেন 17 টি শব্দ। আর আমি যে দ্বিরালাপ প্রদর্শন করে যেসব বাক্যবন্ধ তৈরি করে দেখালাম তার শব্দসংখ্যা হলে গেল-62টি। ইচ্ছে করলে আরো বাড়ানো কমানো যায়। কিন্তু গল্পকার করবেন না। তিনি সংলাপ দিয়ে গল্পকে টেনে বড়ো করতে চাননি। তিনি এক বাক্যেই যা বলার তা বলে দিয়েছেন। তাতে গল্পটির কোনো ক্ষ্মতিবৃদ্ধি হয়নি। যে কথা 12 টি শব্দে বলা যায় তাকে 62 টি শব্দে বলার কোনো দরকার নেই। কারণ তিনি উপন্যাস নয়-- গল্প লিখছেন। গল্পও নয়-- লিখেছেন ছোট গল্প। স্বল্প পরিসরে আখ্যান বলতে হয় ছোট গল্প বলতে হয়। নইলে ছোট গল্প বলা হবে কেনো?

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মারকেজের আমি শুধু একটি ফোন করতে চেয়েছিলাম গল্পটির বর্ণনারীতি এ ধরনের। মারিয়া নামের মেয়েটি বাড়িতে ফেরার পথে গাড়িটি নষ্ট হয়ে যায়। তার স্বামীর কাছে যাওয়ার তাড়া ছিল। তাই সে পথে চলা গাড়ির লিফট পাওয়ার চেষ্টা করছিল--

একটি বাস থামল। মারিয়া তার তার ঝামেলার কথাটি পেশ করল। অনুরোধ করল তাকে লিফট দেওয়ার জন্য। রাজিও হলো ড্রাইভার। তাজে শুধু স্মরণ করিয়ে দিল সে অতদূর যাবে না। মারিয়া রাতেও রাজি হলো। এটাকে মার্কেজ লিখছেন-

ঝড়ের চেয়েও জোরে ছুটে যাওয়া গাড়ি-লরিগুলোকে থামানোর ব্যাকুল প্রয়াস ঘণ্টাখানেক ধরে চালানোর পর একটা ভাঙাচোরা-বিধ্বস্ত বাস ওকে করুণা দেখাল। যদিও বাসের ড্রাইভার ওকে আগেভাগেই জানিয়ে দিল যে তারা কিন্তু বেশি দূরে যাচ্ছে না। “এটা কোনও ব্যাপার নয়’,--মারিয়া বলল। ‘আমি শুধু একটা টেলিফোন করতে চাই।”

এটা যদি নাটক হতো তবে লেখা হতো--
“বাসগাড়ির থামতেই মারিয়া ছুটে গেল। ড্রাইভারকে বলল, 

খুব বিপদে পড়েছি। আমার স্বামী বাড়িতে অপেক্ষা করছেন। সন্ধ্যা সাতটায় সে একটি জায়গায় যাদু দেখাতে যাবে। আমি তার সহকারি। যেতে না পারলে খুব ক্ষতি হবে। প্লিজ, আমাকে লিফট দিন। 

শুনে ড্রাইভারের দয়া হলো। তবে তাকে বলল, আমি তো অতদূর যাব না। তোমাকে কিন্তু পথে নামতে হবে। তারপর অন্য কোনো গাড়ি ধরতে হবে। 

--ঠিক আছে। মারিয়া খুব কৃতজ্ঞ হয়ে বলল, এটা কোনো ব্যাপার নয়। আমি ম্যানেজ করে নেবো।”

কিন্তু মার্কেজ গল্প লিখছেন। নাটক নয়। নাটকের ঘটনা এগোয় পাত্রপাত্রীর সংলাপের উপর। সেখানে আলাদা কোনো বর্ণনাকারি থাকে না।গল্পে বর্ণনাকারী থাকে। তিনিই গল্পটি বলেন। গল্পে সংলাপ অনিবার্য নয়। বর্ণনার একঘেয়েমি যাতে না আসে সেজন্য বর্ণনাকারি পাত্রপাত্রীদেরকে হাজির করেন। তাদেরকে সংলাপের মধ্যে দিয়ে গল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যান। গল্পে সংলাপ আসলে বর্ণনারই অংশ। তবে সেটা হতে হবে পরিমিত। সংলাপকে পরিমিতভাবে ব্যবহার করতে বা পারলে সেটা আর গল্প থাকে বা। হয়ে ওঠে নাটক। মার্কেজের ‘আমি শুধু একটি ফোন করতে চেয়েছিলাম’ গল্প থেকে--

“মারিয়া গুটিসুটি মেরে বসে বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম ভাঙার পর মারিয়া দেখল আঁধার নেমেছে আর ঝড় থেমে গিয়ে শুরু হয়েছে তুষারপাত। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে অথবা পৃথিবীর কোন প্রান্তে আছে--এ বিষয়ে মারিয়ার কোনও ধারণা নেই। পার্শ্ববর্তিনী ওকে খুঁটিয়ে দেখছেন।

“আমরা কোথায় এলাম”,-মারিয়া প্রশ্ন করল। 

'আমরা পৌঁছে গেছি',--মহিলা জবাব দিলেন। অন্ধকারাচ্ছন্ন এক বিশাল বাড়ির পাথর বাঁধানো উঠোনে বাসটা ঢুকছে।”

আবার শক্তিশালী গল্পকার একটিও সংলাপ ব্যবহার না করেও পুরোপুরি কথকের বর্ণনায় ছোট গল্প লেখেন। ওয়াসি আহমেদের ডলফিন গলির কুকুরবাহিনী গল্পটি সেরকমই সংলাপবিহীন সার্থক ছোট গল্প। 

আরেকটি বিষয় হলো কারো সংলাপের উদ্ধৃতি দিতে দিতে হুট করে কথক পাঠককে সংলাপের বাইরে নিয়ে আসেন আনায়াসে। একটু বর্ণনা দিয়ে আবার ফিরে যান আগের বলা সংলাপের ভেতর। কোথাও কোনো ছন্দ পতন হয় না এজন্য। 

মনে হয় না তিনি কোনো গল্প লিখেছেন, যেন তিনি গল্পটি বলছেন, আমরা কথকের সামনে বসে আছি। আমাদেরকে শোনাচ্ছেন গল্পটি। 

“মিশুর গলায় বার কয়েক ‘তারপর তারপর’ শোনার পরও বাবা মাথা নিচু করে ধীরেসুস্থে কয়েক চিমটি খিচুড়ি মুখে পুরলেন। এক সময় মুখ তুললেন, তার চোখ দেখলাম আমার দিকেই তাক করা। গল্প শোনার যত আগ্রহই মিশু দেখাক, তিনি ঠিক করেছেন তার সরাসরি শ্রোতা হতে হবে আমাকেই, অন্যেরা শুনবে শুনুক। মুখের খাবার চিবিয়ে এক ঢোক পানি খেয়ে বললেন, আলমারিটা সুন্দিকাঠের প্রথমে বুঝতে পারিনি। (কেউ কথা বলল না।) বাবা এগোলেন, আসামের হাউকা পাহাড় বড় বন্য প্রাণী, মানে বাঘ-টাগ ছিল না।…..”

এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, বাবা লোকটি যখন তার বিয়ের গল্পটি বলবেন, সেদিনটি হবে বৃষ্টিমুখর। এই ঝুম বৃষ্টির দিনে খিচুড়ী খাওয়ার স্বভাব আছে আমাদের। এমন বৃষ্টির দিনে মানুষের মন খুলে যায়-- কোনো গোপন কথাটিও অনায়াসে বলা যায়। যেন সব সংকোচ উবে যায়। এই স্বল্পভাষী বাবা লোকটিও তাই যেন মুখর হয়ে বলছেন তার বিয়ের গল্পটি- বলছেন তার ছেলেকে। বলছেন ছেলের স্ত্রী আর তার নাতির উপস্থিতিতে। এই বৃষ্টিমুখর খিচুড়ি খাওয়ার দৃশ্যটি গল্পকার গল্পে হাজির করছেন পূর্বরাগের মতো-- ঠুমরিগানের বন্দিশের মতো করে। তিনি বলবেন তার বিয়ের দিনের গল্প। সেদিনটি ছিল প্রবলবৃষ্টিস্নাত। সেজন্য বর্তমান দিনটিকে করে দিলেন বৃষ্টিভেজা।  পুরনো দিনের বৃষ্টির দৃশ্যের সঙ্গে নতুন দিনের বৃষ্টির মধ্যে একটি সম্পর্ক স্থাপন করে দিলেন। 


চার.

গল্পের শুরুতে সদ্য স্ত্রীবিয়োগে কতোটা ব্যথিত সেটা জানা যায় না। কথকের জবানিতে যতোটা বোঝা যায় তাতে মনে হয় তিনি খুব বেশি ভেঙ্গে পড়েননি। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া উপলক্ষে ছেলেমেয়েরা এসেছে। সব কাজ শেষ হয়েছে। বাড়ির সব কিছুতে স্ত্রীর ছোঁয়া রয়েছে। যদি গভীরভাবে শোকগ্রস্থ হয়ে পড়তেন তবে তিনি বাকি দিনগুলো এই বাড়ি, স্ত্রীর রেখে যাওয়া জিনিসপত্রকে আঁকড়ে ধরেই কাটাতে পারতেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হওয়ার পরপরই তিনি এই বাড়ি ছেড়ে ছেলের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি কি এতোই অসুস্থ যে একা চলতে পারবেন না? সেটা মনে হয় না। তিনি যথেষ্ট ফিট। শারীরিক কোনো অক্ষমতার কোনো ক্লু দেননি কথক। বরং তিনি ঢাকায় ছেলের বাড়িতে যাওয়ার পরে আলমারির ট্রাক আসার খবর শুনে দুড়দাড় করে চারতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসেছেন। বৃষ্টিতে ভিজছেন। জ্বর বা কাশি কিছু হয়নি। বৃষ্টির জন্য ছেলে-বৌ খিচুড়ি রেঁধেছেন। তিনি খেতে খেতে গল্প করছেন। নিজের জামাকাপড় সাবান দিয়ে কাঁচছেন। এই শারীরিক ফিটনেস থাকা সত্বেও তিনি স্ত্রীর স্মৃতিবিজড়িত মফস্বলের বাড়িতে থাকতে পারবেন না বলে কথক জানাচ্ছেন। এমনকি অবলীলায় স্ত্রী রেখে যাওয়া কাপড়চোপড় বা অন্যন্য জিনিসপত্র লোকজনকে বিলিয়ে দিচ্ছেন। কিছুই রাখছেন না স্মৃতিস্বরূপ। শুধু একটি আলমারি নিচ্ছেন। সেটা কি স্ত্রীর স্মৃতির জন্য? ছেলেমেয়েরা স্মৃতির জন্যই আলমারিটা বাবা রাখছেন বলে মনে করলেও গল্পটি শেষ পর্যন্ত পড়লে তাদের সমর্থনে হ্যাঁ বলাটা কঠিন। মনে হয় স্ত্রী নয়, স্ত্রীর স্মৃতি নয়, আলমারির কারণে যে আভিজাত্যবোধটা তার মধ্যে গেঁথে আছে-- সেই আভিজাত্যবোধটা জিঁইয়ে রাখার জন্যই তিনি আলমারিটা রাখছেন। আসাম থেকে নদীনালা দিয়ে আনা, বৃটিশ ছাঁদে বানানো, এবং স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড়ো করে বানানোর কারণে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ হয়ে উঠেছে, অন্য কোনো বাড়িতে এ ধরনের আলমারি পাওয়া যাবে না- এটা নিয়ে দীর্ঘকাল নানা মানুষের কাছে গল্প করা যায়, তাদেরকে মুগ্ধ করা যায়, তাদের কাছে থেকে সমীহ আদায় করা যায়। কিন্তু এটা যদি সাধারণ কোনো কাঠের আলমারি হতো, যদি এর কাঠ বাজারচলতি কাঠ হতো বা প্রচলিত ডিজাইনেই বানানো হতো- তবে সেটা অবলীলায় দান করে দিতেন বলেই মনে হয়। এখানে স্ত্রী বা তার স্মৃতি মূখ্য নয়। 

গল্পের শুরুতে জিনিসপত্র বিতরণের সময়ে বাবাকে কিছুটা আনমনা লাগছে। কিন্তু পরদিন ভোরবেলা চনমনে রোদ উঠেছে। ডিসেম্বরের হীম বাতাস জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকেছে ঠিক তখনই বাবার আনমনা ভাবটি কেটে যেতে দেখা যাচ্ছে। তিনি গোপন তথ্য ফাঁস করার মতো করে গলা নামিয়ে আলমারির ইতিহাসটি বলছেন। এই গোপন কথা বলার মতো ব্যাপারটির মধ্যেও তার চনমনে ভাবটি বোঝা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে স্ত্রীর বিয়োগ ব্যাথা তার কাছে ক্রমশ সহনীয় হয়ে আসছে। তিনি ক্রমশ নিজের ভেতরে স্থির হতে পারছেন। ভেঙ্গে পড়ার মতো কোনো চরিত্রই তিনি নন। 

অথচ তার ছেলেমেয়েরা ঠিক উল্টো ভাবছেন। তারা মনে করছেন- - মা নেই, কিন্তু তাদের বাবা মানুষটি তাদের মাকে হারাতে চান না। পাহাড়প্রমাণ আলমারিটির পাল্লা খুললেই যেন তিনি তার মৃত স্ত্রীকে জলজ্যান্ত রূপেই পেয়ে যাবেন। কিন্তু তাদের বাবা তাদের মাকে নিয়ে কোনো স্মৃতি চারণ করছেন না। বলছেন সগৌরবে আলমারির গল্প।

আলমারিটি যখন ঢাকায় ট্রাকে করে এলো কিন্তু সেটার বেঢপ সাইজের জন্য সিঁড়ি দিয়ে চারতলায় ওঠানো গেল না, রাখা হলো কারপার্কে, তখন তার ছেলে-ছেলেবৌ মনে করছেন এতে তিনি অস্থির হয়ে উঠবেন-- হবেন হতাশ। এটা মনে করে ছেলেবৌএর রীতিমত খারাপ লাগতে লাগল। বাবার আপেক্ষ হতে পারে ভেবে চিন্তিত হলো ছেলে, মনোকষ্টে ভুগতে পারে। কিন্তু বাবার এসব কিছুই হলো না। তিনি শান্তভাবে ভাত খেলেন।খেয়েদেয়ে পত্রিকা পড়লেন। বিকালের ঘুম দিলেন। ফুরফুরে মেজাজ হলো তার। গল্পকার অতি নিরীহভঙ্গীত গল্পটিতে চরিত্রের বৈপরীত্য নির্মাণ করেছেন। কিন্তু এই বিপরীত চরিত্রের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব- সংঘাত নেই, ঘটনার উত্থানপতন নেই। চমক নেই। সবাই শান্ত। সুন্দর। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি স্নেহ মমতা রয়েছে। সবার প্রতিই মান্যতা রয়েছে। কোনো ক্ষোভ বিষাদ বা ঘৃণা নেই। বৈপরত্যের মধ্যে একটা ঐক্য রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গল্পকার প্রচলিত আখ্যান-নির্মাণের প্রচলিত রূপটিকেই ভেঙ্গে দিচ্ছেন।

এবং গল্পকার খুব সযত্নে বাবা মানুষটির মধ্যে একজন আধুনিক মানুষকেই এঁকেছেন। তার কাছে স্ত্রীর চেয়ে আলমারিটা গুরুত্বপূর্ণ।স্ত্রীর চেয়ের তার স্মৃতিটা বড়। আরো বড় স্মৃতির চেয়ের গৌরবময় আলমারির মিথটাই। সে মিথটা সত্যি হোক বা মিথ্যে হোক-- তাতে কিছু যায় আসে না। মিথটা তিনি নির্মাণ করেছেন। কাঠমিস্ত্রী মিথটার মূল সত্যিটাকে ভেঙ্গে দিতে পারলেও তিনি তাতে বিচলিত নন। সৃষ্টি করে নিচ্ছেন সুন্দিকাঠের মিথের আরেকটি মিথ -- সেটা হলো ‘সুন্দির আসল গুণটা কিন্তু কাঠে না।… সুন্দির আসল যা বৈশিষ্ট্য তা এর গায়ের গন্ধ--পাকা জামরুলের ঘ্রাণের মতো একটা মিষ্টি গন্ধ থাকে কাঠে। পালিশ-বার্নিশের পরও ঘ্রাণটা মুছে যায় না।’ 

তিনি,এই গল্পের প্রোটাগোনিস্ট বাবা, ডা: আলতাফ হোসাইন চৌধুরী, নিজে মানুষের চেয়ে মিথকে নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হননি, তাকে বিশ্বাস করেছেন। তাকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছেন। সেটা করতে সক্ষমও হয়েছেন। মিথটা বংশপরম্পরায় সম্প্রসারিতও হয়েছে। অবজেক্টিভ ন্যারেটিভকে তিনি কবজির জোরে অবলীলায় সাবজেকটিভ ন্যারেটিভে রূপান্তরিত করেছেন এই গল্পটিতে। এটা সহজ কথা নয়। ইউনিক কাজ। 

আলতাফ হোসেনের চারজন ছেলেমেয়ে। দুজন বিদেশে থাকে। এ দুজন মায়ের মৃত্যুতে দেশে এসেছে। অন্ত্যেষ্টক্রিয়া শেষে ফিরে গেছে। গল্পে এদের এইটুকু উপস্থিতি ছাড়া আর কোনো ভূমিকা নেই। গল্পকার তাদেরকে ভূমিকা দিতে চাননি। ছেলে বৌ নাজমা খুব মমতাময়ী। শ্বশুরকে ভালোবাসে। শ্বশুর যাতে মনোকষ্ট না পান সেজন্য তার চেষ্টার ত্রুটি নেই। বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি রাঁধেন। যত্ন করে খাওয়ায়। তেমন কোনো সংলাপও তার নেই। 

আলমারিটা চারতলায় ওঠানো গেলো দেখে আলতাফ হোসেন চশমা কাচ মুছলেন বটে, কিন্তু তাকে অস্থির ও উত্তেজিত হতে দেখা গেল না। কিন্তু ছেলে বৌ মনে করছে তিনি খুবই কষ্ট পাচ্ছেন। তার স্বামীকে চুপি চুপি এক ফাঁকে বলল, আব্বার জন্য খারাপ লাগছে। রাতে ঘুমানোর সময়েও এই সংলাপটা বলেছে। আর একবার স্বামীর কথায় আরেকটি সংলাপ বলেছে। এই টুকু। এই চরিত্রটি আছে বলেই আমরা বুঝতে পারি প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী স্বাভাবিকভাবেই নিশ্চয়ই ভেঙ্গে পড়েন।।গভীরতম বেদনা পান। সে বেদনা অন্যদেরকেও স্পর্শ করে। কিন্তু এই গল্পে সে ধরনের কোনো বেদনা বিপত্নিক স্বামীর মধ্যে দেখতে পাই না। তিনি নিরাবেগ স্ত্রীর প্রতি। কিন্তু তার আলমারিটার যে কাঠটা নির্মিত হয়েছে সে কাঠের ইতহাস নিয়েই বেশি বেশি আলোড়িত। 

ছেলের 12 বছরের একটা মেয়ে আছে। নাম।মিশু। সেও খুব শান্ত। সরল। দাদাজানের প্রতি খেয়ালও আছে। দাদাজানের বলা গল্পগুলো সে আগ্রহভরে শোনে। দাদাজান যখন একটু থামে তখন ‘তারপর’ ‘তারপর’ বলে গল্পের প্রতি মিশুর ব্যাকুলতা প্রকাশ পায়। আলমারিটি চারতলায় ওঠাতে ব্যর্থ হয়ে কারপার্কে রাখা হলে। সে দুপদাপ পায়ে নিচ থেকে সরেজমিনে দেখে এসে বলে, ‘দাদা কি তাঁর কাপড়চোপড় এখন থেকে কারপার্কে রাখবেন?’ এই প্রশ্নের মধ্যেই দিয়েই প্রয়াত দাদীর জন্য দাদাজান কতোটা স্মৃতি কাতর ধরে নিয়েছে তার বাবামায়ের মতো। এর বাইরে মিশুকে অন্য কোনো ভূমিকা পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো তার কিছু ছেলেমানুষী ছিল। দাদাজানের কাছে আব্দারও থাকতে পারে। অভিমানও থাকা অস্বাভাবিক নয়। নয়তো দাদার মন ভালো করার জন্য কিছু কাজের উদাহরণও দেখানো যেতে পারত। এগুলো গল্পকার দেখাননি। দেখানোর প্রয়োজন বোধ করেননি। তিনি গল্পের প্রয়োজনে যতটুকু দরকার ততটুকুই আনছেন। গল্পে টেনে লম্বা করার প্রতি আগ্রহ বোধ করেন না। শৈলীর প্রশ্নে তিনি আপোষহীন। তাই এই শিশুটিকে দিয়েই গল্পটি শেষ করেছেন। অন্যত্র তার ভূমিকা অতি নগণ্য হলেও শেষে এসে গল্পের ইতির ভূমিকায় তাকেই দেখানো হয়েছে। 

দুজন কাঠমিস্ত্রী বা ছুতার আছে এই গল্পে। একজন সিলেটের বিখ্যাত ছুতার ভরত চান্দ।কিন্তু গল্পকার বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে চান চরিত্রটিকে--আখ্যানটিকে। সেজন্য জানাচ্ছেন--নাইওরপুলে ভরত চান্দের একটি শো রুম ছিল। ভরত চান্দ আলমারিটির গড়ার কাজ পেয়ে খুশি হলো-- আবার কিছুটা ঘাবড়েও গেল। কারণ আলমারিটা ভেতরটা হবে খাস ইংলিশ চেস্টের ডিজাইনে। কিন্তু স্বাভাবিক আলমারির চেয়েও বড়ো। ভরত চান্দ জানে এটা হবে খাপছাড়া আলমারি। বেশ কিছু ঝামেলে হতে পারে এটাকে নিয়ে। এরকম বানানো ঠিক নয়। কোনো ভালো মিস্ত্রী একাজটি করবেন না। করলে তার নিন্দা হতে পারে। কিন্তু ভরত চান্দ ঢাকার ছুতার নয়। মৃদু আপত্তি তুললেও প্রভাবশালী ডা আলতাফ হোসেনের ইচ্ছের বাইরে যেতে পারেনি। আলমারিটি নির্দেশ মোতাভেক বানিয়েই দিয়েছে। 

গল্পে আরেকজন ছুতার আছে। তাকে অবশ্য গল্পকার ছুতার বলছেন না। বলছেন কাঠমিস্ত্রী। রাজধানীর মিস্ত্রী বলেই ছুতারের বদলে কাঠমিস্ত্রী পদবী এসে গেল। তাকে আনা হয়েছে সিঁড়ির সাইজের চেয়ে বড় আলমারিটি খুলে চারতলায় নিয়ে যাবার জন্য। আবার নাটবল্টু জুড়ে আলমারিটি আগের মাপেই বানিয়ে দেবে। চেহারা একই থাকবে। কিন্তু এই মিস্ত্রী ঢাকার বলেই ভরত চান্দের মতো মিনমিন করা লোক নয়। সে প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছে খুচরা মুচরা কাজ করার লোক সে নয়। খুব বেশি হলে আলমারিটি কেটে ছোট করে বানিয়ে দিতে পারে। 

এবং সে জানায় আলমারির কাঠ বেশ পুরান। আহামরি গোছের কাঠ নয়। সেটা চাপালিশ কাঠ। এটা এই দেশের সব জায়গায়ই পাওয়া যায়। 

সে ডা: সাহেবের সঙ্গে একটু তর্কও করে। তার গড়া বার্মা বা আসাম থেকে আনা বিখ্যাত সেই সুন্দিকাঠের মিথটাকে ভেঙে দিতেও সফল হয়। এবং কাজটি না করেই চলে যায়। দুজন ছুতার দুরকম মেজাজের। 

গল্পটির কথক উত্তম পুরুষ। গল্পকার নিজেই বলছেন। তবে উত্তম পুরুষে লেখা গল্পে সাধারণত খুব বেশি আমির প্রাধান্য থাকে। কিন্তু এই গল্পে আমি চরিত্রটি কথক হলেও- -তাকে রেখেছেন বেশ দূরে। আখ্যানকে নিয়ন্ত্রণ করছেন না। গল্পের ভাগ্য নির্ধারণ করার দায় নিচ্ছেন না। যেন গল্পটি যে সত্যি, বানানো নয়--একান্ত পারিবারিক ঘটনা সেটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতেই যেন উত্তম পুরুষে বলার শৈলীটি গল্পকার নিয়ে। সত্যি হোক মিথ্যা হোক গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাই একজন শক্তিশালী গল্পকারের কাজ। ফলে উত্তম পুরুষে হলেও মনে হয় সর্বজ্ঞ কথকের স্বভাবটিই প্রাধান্য পেয়েছে। মনেই হয়না এটা কোনো উত্তম পুরুষে লেখা। 

গল্পের শুরুর বাক্যটিতে আমির বদলে আমাদের শব্দটি ব্যবহার করছেন। ‘মা মারা যাওয়ার পর সপ্তাখানেক নানা ঝক্কি-ঝামেলায় কেটে যেতে আমাদের বাবা ডাক্তার আলতাফ হোসাইন চৌধুরী মায়ের পরিত্যাক্ত শাড়ি-গয়না-আসবাবপত্র বিলি-বণ্টনের ফাঁকে….’ একপৃষ্ঠা পর শুধু একবার ‘আমি’র দেখা পাওয়া যায়। সেখানে বলা হচ্ছে মায়ের মৃত্যুর পর সবাই একত্রিত হয়েছিল। কাজ মিটে যাওয়ার পরে সবাই সিলেটের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে যার যার বাড়ির উদ্দেশ্যে। তখন সবাই সিঙ্গেল হয়ে পড়ছেন। ফলে এখানে আমরার বদলে আমি শব্দটি এসে পড়ছে। লালমাটিয়া ডি-ব্লকের ফ্লাটে বাবাকে নিয়ে স্ত্রীকন্যাসহ কথক আমি পৌঁছে গেছেন। তখন আবার যুথবদ্ধতা। ফলে এখানেও আরেকটি ইউনিটের আমরা শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে বাবা দাঁড়িয়েছেন বাড়ির সামনে- ট্রাকের প্রায় ঘেষে। এটা দূর থেকে চুপিসারে দেখছেন কথক। এটা তার একার দেখা। সেজন্য এখানে আমরার বদলে আমি। আলমারিটা সিঁড়ি দিয়ে চার ফলায় উঠানো গেল না। পড়ে রইল নিচে কারপার্কে। তখন স্ত্রী নাজমা চুপি চুপি এসে বাবার জন্য তার মনে দু:খ হওয়ার কথাটি বলছেন কথককে। এটা স্বামী স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত আলাপ। সেজন্য একক ব্যক্তি হিসেবে কথা বলছেন দুজনে। আমরা নয়। কিন্তু যখন তারা খেতে বসেছেন বা পরিবারের সবার উপস্থিতিতে বাবা গল্প বলছেন, বাকি তিনজন শ্রোতা তখন আবার আমি নয় আমরা। এভাবেই চরিত্রগুলো কখনো আমরা,কখনোবা আমি বা নাজমা, মিশু। বা মিস্ত্রী। তবে পুরো গল্পটি অনুসরণ করলে বোঝা যায় গল্পকারের প্রধান ঝোঁক আমির বদলে আমরা’তে চলে যাওয়া। কথকতার ঢং। ব্যক্তির অভিজ্ঞতাকে সমষ্টির মধ্যে চালান করতে চান যেন। মৃদু স্বরটাই বহুস্বরে ধ্বণিত হয়ে আমাদের মাথার ভেতরে গুঞ্জন তোলে। গুঞ্জরণ তোলাই যেন ওয়াসি আহমেদের কাজ। এভাবে তার যে কোনো গল্পই নির্মোহ আখ্যান হয়ে ওঠে। অনন্য হয়ে ওঠে। 


-----------------------------------------------
* গল্পটি পড়ার লিংক ঃ সুন্দিকাঠের আলমারি

Post a Comment

0 Comments