শওকত আলীকে নিয়ে বেশ ঝামেলা আছে। কেননা তার স্ত্রীর নাম ঝামেলা বিবি। বিবি বাচ্চা দেওয়ার সময়ে মারা যায়। তারপর থেকে সে অন্ধকারে বসে থাকে। বলে, তার মেয়ের ম্লান মুখ সে দেখতে পারবে না। অন্ধকারে তাই অন্ধ হয়ে বসে থাকে। আর থেকে থেকে বলে, হায় ঝামেলা বিবি--তুমি একি ঝামেলা দিয়ে গেলে।
শওকত আলী এইভাবে বসে থাকার কালে তার মেয়েটিকে দেখতে যায় নি বটে, তবে শুনতে পায়, মেয়েটি জ্যোৎস্নার মতো রূপবতী। ধীরে ধীরে ঠোঁট নাড়ে। আর দীঘল করে তাকায়।
শওকত আলীর বাড়ি নাজিরপুরের ভাইজোড়া গ্রামে। কিন্তু থাকে কদমতলায়। কদমতলা বাজারের পশ্চিমপাশে খালপাড় দেষ্টে সীডস্টোরে। এই সীড স্টোরের নৈশকালীন পাহারাদার হিসেবে শওকত আলী চাকরি করে। সীড স্টোরটি আটান্ন সালে ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খাঁ বানিয়েছিলেন। জমি দাতা শ্রী প্রসন্নকুমার মজুমদার। তার এই জমিটুকুই ছিল সম্বল। তার একমাত্র মেয়ে যখন স্থানীয় সফেদালীর ঘরে গিয়ে ওঠে, এবং কিছুদিন পরে যখন মেয়েটির লাশ বলেশনদীতে ভেসে ওঠে তখন শ্রীপ্রসন্নকুমার মাঝি এই জমিটুকু আয়ুব খাঁ বরাবরে দান করে দেয়। দানপত্রে লেখেন, তার মেয়ের বিয়ে সফেদালীর ছেলের সঙ্গে হলেও তার আপত্তি ছিল না। কিন্তু মেয়েটির মৃত্যুতে তার বেঁচে থাকা নিরর্থক হয়ে গেছে। ফলে তার বসতবাটি আয়ুব খাঁ বরাবরে দান করে গেলেন। এই দানের বিপরীতে তার একটা আর্জি আছে। আর্জিটা হলো-- দেশের মালিক আয়ুব খাঁ তার মেয়ের মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত করে দেখবেন। তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন, মেয়েটিকে ভূতে নেয়নি, কুমিরেও নেয়নি--আত্মহত্যাও করার মানুষ নয় সে। তাহলে তার মৃত্যুতে একটা রহস্য আছে। সদাশয় আয়ুব খাঁ মহোদয় সেই রহস্যটি উদঘাটন করবেন। কোনো খুনের ঘটনা হলে তার যথাযথ বিচার তিনি করবেন।
কদমতলার মানুষ অদ্যাবিধি জানে না আয়ুব খাঁর কাছে এই আর্জিটা পৌঁছেছিল কিনা। তিনি তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিনা। রহস্যটি উদ্ধার হয়েছিল কিনা। তবে শ্রীপ্রসন্নকুমার মাঝিকে এরপর এ এলাকায় আর দেখা যায়নি। হতে পারে তিনি মেয়ের দু:খে দেশান্তরী হয়েছেন। হতে পারে গুম-খুন হয়েছেন। এ পোড়া দেশে সবই সম্ভব।
তবে কদমতলার সবাই আশঙ্কা করেছিল, মৃত মেয়েটির শ্বশুরপক্ষ অচিরেই শ্রীপ্রসন্নকুমার মাঝির বসতবাড়িটি দখল করবে। কিন্তু না। দখল করার কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আগেই বসতবাটিতে আয়ুব খাঁর সরকার একটা সাইনবোর্ড গেড়ে দিল। তাতে লেখা-- সীড স্টোর। সরকারী বীজগুদাম।
এই গুদাম ঘরেই শওকত আলীর অফিস কাম রেসিডেন্স।
তখনো শওকত আলী বিয়েশাদি করেনি। একদিন আবিষ্কার করল, তার দেওয়ালে অস্পষ্ট করে লেখা—
আমি রূপনগরের রাজকন্যা
রূপের জাদু এনেছি--
ইরান-তুরান পার হয়ে আজ
তোমার কাছে এসেছি।।
এই পয়ারটি কে লিখেছে সেটা শওকত আলী উদ্ধার করতে পারে না। হতে পারে-- শ্রীপ্রসন্নকুমার নিজে লিখেছেন। কিন্তু হাতের লেখা মেয়েলি বলে হতে পারে তার মেয়ে লিখেছে। মেয়েটির মাও লিখতে পারে। তবে তিনি বহু আগেই গত হয়েছেন জেনে শওকত আলী বুঝতে পারেন, তিনি এই পয়ারটি লেখেন নাই। কেননা সঙ্গীতের ইতিহাস বলে তার জীবিতকালে পয়ারটি রচিত হয় নি। সে যাই হোক না কেনো--এইদুটি লাইনের পয়ারটিই শওকত আলীর জীবনে নিয়তি হয়ে ওঠে। মাটিভাঙ্গার পরে শৈলদিয়া গ্রামে রাজন্যার মতো একজন রূপবতী কন্যাকে সে বিয়ে করে। বিয়ে করে মাঝে মাঝে পল্লীগায়ক সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের মেয়ে ফেরদৌসী রহমানের গলা নকল করে পয়ারটি গায়--
আমি রূপনগরের রাজকন্যা
রূপের জাদু এনেছি….
কদমতলার লোকজন এই পয়ারগান শুনেই বুঝতে পারে শওকত আলী শাদী মোবারক সম্পন্ন করেছে। লোকজন শওকত আলীকে শুধায়, বিবিকে কবে আনবেন?
শওকত আলী এর উত্তরে কিছু বলে না। একটু মৃদু হাস্য করে। তাতে কদমতলার লোকজন বুঝতে পারে, বিবি এখন আসতে পারবে না। তার গর্ভ হচ্ছে।
ভেবে আনন্দ করে কদমতলার লোকজন। কেউ কেউ এই উপলক্ষে দু খিলি পান বেশি খায়। কেউ কেউ তালের দিনা-রসের তাড়ি খায়। খেয়ে শওকত আলীর কাছে যায়। শুধায়, ছেলে, না মেয়ে?
শুনে শওকত আলী আরো লজ্জা পায়। মাথা নিচু করে। মুখ টিপে আসা হাসিটা লুকায়। বলেশ নদীটির দিকে তাকিয়ে গুনগুণ করে গেয়ে ওঠে,
আমি রূপনগরের রাজকন্যা…
এইটুকু শুনেই কদমতলার লোকজন বলে, ডরো মাৎ। ফিরফার করতেছি। রাজকন্যাই হবে।
তারা দেরি না করে ছোটে ব্রাহ্মণকাঠি। সেখানে মহাব্রাহ্মণস্বরূপ মতি মণ্ডলের থানে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে। কেউ কেউ সিন্নি দয় । কেউ কেউ মোমবাতি জ্বালায়। কেউ কেউ হাতের তালুতে কলকিটা ধরে জোরে জোরে টানতে থাকে। সেই টানে মতি মণ্ডলের বাহ্য ফেরে। চোখ বন্ধ রেখেই বলে, কী চাস তোরা?
--রাজকন্যা। কলকি মুখে রেখেই তারা উত্তর দেয়।
--কী কন্যা?
--রাজকন্যা। রূপনগরের রাজকন্যা, রূপের জাদু…
শুনে মতি মণ্ডল আখিঁ তুলে হাসে। বলে, এখন তো দেশে কোনো রাজাগজা নাই। তাইলে?
একথায় কদমতলার কলকি ধরা লোকজন ইরিকিরি করে বিলে, সেটা তো বুঝলাম, রাজা নাই-- কিন্তু আমাগো আয়ুব খাঁ আছে। তিনি রাজারও রাজা। কেউ রা করার আগেই ঠুস ঠুস। লেফট রাইট লেফট রাইট। জনগনের হালুয়া টাইট…
এই কথায় মতি মণ্ডল ওরফে মহাব্রাহ্মণস্বরূপ জিন্দা পীর একটু কেঁপে ওঠে। বলে, লেফট রাইটের লগে নো ঝামেলা। করলে ঠুস ঠুস…
এরপর মতি মণ্ডল ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খাঁর নামে দোহাই পেড়ে বাক্যি দেন। সেই বাক্যি করপুটে আগলে নিয়ে শওকত আলীর কাছে যায়। সেটা তার হাতে চালান করে দিয়ে মতি মণ্ডল বলে, এইটা নতুন হলুদ সহযোগে বিবিরে ভোর ভোর বাইটা খাওয়াও মেয়া। বিবির কোলে রূপনগরের রাজকন্যা না আইস্যা পারবে নানে।
সত্যি তাই। সাতমাস পরে শওকত আলী বাজারের রামগোপালের দোকানে গরম গরম জিলেপি খায়। সেই জিলেপি খাওয়া দেখে সবাই বুঝতে পারে মতি পীরের বাক্যি ফলেছে। তারা বড় মুখ করে বলে, কইছিলাম না, আপনার ঘরে রাজকইন্যা আসবে!
শুনে শওকত আলীর মুখে মৃদু হাসি ফোটে। কিন্তু চোখ বন্ধই থাকে। লোকে তাকে আরো দুটো জিলেপি এগিয়ে দেয়। এগিয়ে দিতে গিয়ে তারা তার চোখ দেখতে চেষ্টা করে। কিন্তু দেখতে পায় না। বন্ধ রেখেই জিলেপি ধরে। ধরে একটু চাপ দেয়। ঘন চিনির সিরা হাত বেয়ে মাটিতে পড়ে। কয়েকটা পিঁপড়ে ছুটে আসে।
মুখে জিলেপি পুরে রেখেই শওকত আলী কিছু বলতে চায় বটে, কিন্তু তার আগেই লোকে তাকে কাঁধে নিয়ে আয়ুব খাঁর নামে জয়ধ্বনি করে। তারা শওকত আলীকে কাঁধে নিয়েই সারা কদমতলা ঘুরে ঘুরে মিছিল করে। সুর করে বলে—
আয়ুব খাঁয়ের অবদান--
রূপনগরের রাজকইন্যার আগমণ।।
যারা আয়ুব খাঁর কালে মিটিং মিছিল করা যাবে না বলে-- সেই চৌকিদার, পুলিশ লাঠি নিয়ে ছুটে এলেও আয়ুব খাঁর নাম শুনে বলে, এইবার ঠিক আছে। তারাও জিলেপি খেতে খেতে মিছিলের সঙ্গে কদমতলার বাজার ঘোরে। ঘুরতে ঘুরতে তাদের মনে পড়ে এটা আয়ুব খাঁর আমল নয়। এটা জিয়া শাহীর আমল। তিনি আয়ুব খাঁর টুপি পরে আছেন। তারা আয়ুব খাঁর বদলে জিয়ার নাম বলতে যাবে তখন তাদের আবার সন্দেহ হয় এটা লেজে হোমো এরশাদেরর জমানাও হতে পারে। জেনারেল জিয়া ফুটুস। ফলে তারা জিয়ার বদলে সুর করে বলে আর ঘুরে ঘুরে নাচে--
এরশাদের অবদান
রূপনগরের রাজকইন্যার আগমন।
শুভেচ্ছা স্বাগতম।।
আর তখনি কদমতলার লোকজন জর্জ হাই স্কুলের সামনে এসে যায়। তাদের মুখে কোনো কথা সরে না। তারা বুঝতে পারে, এই রূপের সঙ্গে একটা ঝামেলা আছে। সেটা হলো রূপের নিজস্ব আলো আছে। সুঘ্রাণ আছে। ভাষা আছে। প্রাণ আছে। রাষ্ট্র তাকে খপ করে ধরে। ধরে আহার করে। বিহার করে। তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়। বলে, রূপ-- একদম চুপ। রাষ্ট্র মৃদু মানুষের গলা টিপে ধরে-- কথা বলা বন্ধ করে। পাখির মতো গুলি করে মারে।
তবে দিন কয়েকের মধ্যে কদমতলার লোকজন শুনতে পায় নাজিরপুরের ভাইজোড়া গ্রামে কে একজন গৃহবধু মারা গেছে। কিভাবে মারা গেছে সেটা জানা যায় না। তবে এরকম গৃহবধুর মৃত্যু হরহামেশাই হয়। সেগুলো কখনো খবর হয় না। তবে ভাই জোড়া গ্রামের এই গৃহবধুর মৃত্যুতে স্থানীয় সাংবাদিকরা কী করে জানি খবরের গন্ধ পেয় গেছে। তারা নিশ্চিত হতে ছুটোছুটি করতে লেগেছে। কেউ কেউ খবর পাচ্ছে, গৃহবধুটিকে স্বামী শ্বশুড়ি মিলে পিটিয়ে মেরেছে। কেউ কেউ শুনতে পেয়েছে, স্বামী ঘুম থেকে উঠে দেখে তার বউটি অশ্বত্থগাছের ডালে ঝুলছে। কেনো কেউ জানে না। কেউ কেউ বলে, সন্তান জন্মের পরে সূতিকা রোগে মারা গিয়েছে। এরকম। বহু ভাবে মৃত্যুর আশঙ্কার কথা ভাবলেও কদমতলার লোকজন সীডস্টোরে ছুটে যায়। তারা দেখতে পায় ঘরের মধ্যে মাথা নিচু করে শওকত আলী বসে আছে। তারা অনুমান করে, হয়তো সে নি:শব্দ বৃষ্টির মতো কাঁদছে। তারা তখন তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলে, কাঁদে না বাপা। কাঁদে না। বউটা গেছে গেছে-- মেয়েটা তো আছে। তার জন্য তোমাকে শক্ত হতে হবে। তাকে মানুষ করতে হবে। এইসব বলে টলে কদমতলার লোকজন শওকত আলীর হাত থেকে পুরনো ছাতাপড়া জিলেপির খণ্ডটি নিয়ে আসে। বিষণ্ণ মনে ফিরে যায়। যেতে যেতে সেই সদ্য মাতৃহীন মেয়েটাকে মনে করে গান করে—
রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি--
ইরান-তুরান পার হয়ে আজ তোমার কাছে এসেছি।
এই মেয়েটাকে দেখভাল করার জন্য কদমতলার লোকজন বুঝতে পারে একজন বুঝদার মেয়েলোক দরকার যে তাকে দুধ খাওয়াবে। স্নান করাবে। আঁখিতে কাজল দেবে। গান গেয়ে গেয়ে ঘুম পাড়াবে। তারা নানা জায়গায় এরকম দুগ্ধবতী মেয়েলোক খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে তারা যখন জেরবার হয়ে উঠেছে, তখন তারা শুনতে পায় কে একজন মেয়ে বা মহিলা তাকে কোলে তুলে নিয়েছে। তাকে দেখে দেখে মাতৃহারা মেয়েটি হাসে। নিন্দ পাড়ে। চোখের আড়াল হলেই তারস্বরে কান্না করে। তখন কে বা কাদের বলতে শোনা যায়, নিজের মাতৃস্থানীয় ছাড়া দেখভাল করা মহিলাটি অন্য কেউ না হয়ে যায় না। তারা কেন যেন বলে,তিনি শিশুটির খালা লাগেন। লাগে শওকত আলীর বড়ো শ্যালিকা। নাম জমেলা খাতুন। সবে ক্লাশ টেন। এবং আরও জানা যায়, শওকত আলী এই শ্যালিকাকে বিয়ে করেছে। এছাড়া ছোট মেয়েটিকে বাঁচানোর অন্য কোনো পথ নেই।
তারা দেখতে পায় শওকত আলী আবার নড়েচড়ে উঠেছে। মুখে আবার হাসি ফুটেছে। বলেশ নদীর পাড় দিয়ে কেউ কেউ তাকে হাঁটতেও দেখছে। হাওয়ায় শিউলী ফুলের ঘ্রাণ ভাসছে। পায়ে ঘাস থেকে শিশির লাগছে। জুল্ফির কয়েকটি চুল মৃদু কাঁপছে। এর মধ্য সূর্য উঠছে। শওকত আলী গুণগুণ করে রূপনগরের রাজকন্যার গানটির প্রথম প্যারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাইছে।
এর মধ্যে শিশু মেয়েটি ডগডগিয়ে বেড়ে ওঠে। কাক দেখে সে কা কা ডেকে ওঠে। কে একজন বাড়ির নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দেখে চেঁচিয়ে বলছে, কাকা কাকা, আমারে নিয়া যাও। সে হাঁটে যাবে। কোনো একদিন কেউ কেউ দেখেছে তাকে-- অরবরই গাছে ডালে পা সে ঝুলিয়ে বসেছে। ক্রোড় থেকে বের করেছে লবন আর মরিচ মেখে অরবই খেতে খেতে ভেবে নিচ্ছে কাল মাকে লুকিয়ে পদ্মপুকুর থেকে সাঁতরে শাপলা তুলবে। রান্না করতে করতে জমেলা খাতুন অনেক ক্ষণ মেয়েটার সাড়াশব্দ পায় না। বদলে বাড়ির বাইরে কুকুরের ডাক শুনতে পেয়ে তার মনে কু ডাক ডাকে! ভাতের হাড়িতে তখন সবে বলোক দিতে শুরু করেছে। হাড়ি নামিয়ে রেখে মেয়েটার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ছুটে যায় পুকুর ঘাটে। দেখতে পায় পুকুরের মাঝখানে শাপলার নালে আটকে পড়ে খাবি খাচ্ছে মেয়েটি। কালবিলম্ব না করে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে মেয়েটিকে কুলে টেনে নিয়ে আসে। কয়েকবার হেঁচকি দিয়ে সে স্বাভাবিক হয়ে বলে ওঠে, আমার রাঙা শাপলা।
তখন দেখা যায় পুকুরে মাত্র একটিই শাপলা ফুল ফুটে আছে। আর সব পাতা। হাওয়ার তিরতির করে কাঁপছে। আর একটি ফড়িং উড়ে উড়ে কোথাও বসার চেষ্টা করছে।
মেয়েটি সেই ফুলটিকে চাই বলে কান্নাকাটি শুরু করলে, জমেলা খাতুন আবার পুকুরে নামে। তাকে আর উঠতে দেখা যায় না। শোনা যায় জমেলা খাতুন মারা গেছে। তার মৃতদেহটি দেখে যাতে শিশুটি ভয় না পায় সেজন্য লুকিয়ে দাফন কাফন করা হয়েছে। কেউ জানে না। কেউ কেউ বলে, জমেলা খাতুন মারা যায়নি। ঘর ছেড়ে চলে গেছে। দূরে। অন্য কোথাও। আবার কেউ কেউ বলে, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। ফলে সেই পুকুরের জল থেমে গেছে। শাপলা ফুলটা ঢলে পড়েছে। আর ফড়িংটাকে দেখা যায় না। কখনো দেখা যাবে না। প্রকৃত ঘটনা কী-- তার সাক্ষী এই ফড়িঙ্গটা।
ঘটনা যাই হোক না কেনো, কদমতলার লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা ছুটে গিয়ে দেখতে পায় পুরনো সীড স্টোরে শওকত আলী হাঁটু গেড়ে পড়ে আছে। দুহাত দিয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে লেগেছে। আর থেকে থেকে হায় হায় করছে। সেটা জমেলা খাতুনের জন্যে, নাকি তার দ্বিতীয়বার মা-হারা শিশু মেয়েটির জন্য সেটা বোঝা যায় না। তবে শিশু মেয়েটি যে মা মা করে জমেলা খাতুনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, বারবার পুকুরঘাটে ছুটে যাচ্ছে, সেটা দেখে সবার অশ্রুপাত হচ্ছে। কী করে এই মেয়েটিকে বাঁচানো যায় সেটা ভেবে সবাই আবার গভীর চিন্তায় পড়ে যায়।
পরে শুনতে পায়, জমেলা খাতুনের বুড়ো বাবামা এসে গেছেন। সঙ্গে তাদের ছোটো মেয়ে। সবে ক্লাশ নাইন। তিতির পক্ষীর মতো মেয়েটির দুটো চোখ--মায়াময়। নাম কামেলা বেগম। কেউ কেউ বলে, না এর নাম কামেলা নয়--ঝামেলা বেগম। কামেলা বেগম আসলে শওকত আলীর প্রথম স্ত্রী লাগে। তারা এতো কাল তাকে ঝামেলা বেগম নামেই ভুল ভেবে এসেছিল। কেউ কেউ বলে, প্রথম বিবির নাম কামেলা কি ঝামেলা তাতে কিছু যায় আসে না। তার চেয়ে আগে দরকার মা-হারা শিশুটির দেখভালের জন্য আরেকটি মা। ফলে তাকে পেয়ে রূপনগরের রাজকন্যা তার কচি হাত দুটো দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। কান্না থেমে আসে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে কামেলা কি ঝামেলা বিবি গুণগুণ করে রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি--গানটি গাইতে থাকে। সেটা শুনে মেয়েটির শ্বাস ঘন হয়ে আসে। ঘুমিয়ে পড়ে। সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচে। বলে, আর চিন্তা নেই।
এবং কদমতলার লোকজন এরমধ্যেই ধরে নেয়, ঝামেলা বেগমই মৃত কামেলা খাতুনের প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে। সেই মেয়েটির প্রকৃত জননী। শওকত আলীকে আবার হাসি হাসি মুখ করে সীড স্টোরের সামনে খোলা জায়গায় বেগুন, লালশাক, টমেটো গাছ লাগাতে দেখা যায়। খানাকুনিয়ারি গ্রামের বুড়ির মার বাড়ি থেকে লম্বা কদুর চারা এনে এক কোণে রুয়ে দেয়। বহুদিন পরে হাসি হাসি মুখ করে। নিয়ম করে জল দেয়। মাটি খুঁচে দেয়। কাঠি পোঁতে। ডগডগিয়ে মাঁচার উপর লতিয়ে ওঠে। কচি লাউয়ের বর্ণ দেখে বিস্মিত হয়ে হয়তো বুঝতে পারে নয়া বিবি ঝমেলা বেগমের গায়ে এরকম চেকনাই আছে।
এটা দেখে কদমতলার লোকজন কিছুটা চিন্তায়ও পড়ে। ঝামেলা বিবির এই চেকনাই যদি আশনাইয়ে গড়ায় তবে রূপনগরের রাজকন্যার দেখভাল ঠিকঠাক হবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে।এর মধ্যেই পাড়ায় পাড়ায় উঠতি বয়সের ছেলেরা ঘুরে বেড়ায়। মেয়েদের দেখতে উঁকিঝুঁকি মারে। শিস দিয়ে ওঠে। গুণগুণ করে গান গায়। কেউ কেউ আবার বাড়ির আনাচ কানাচ দিয়ে ঢুকেও পড়তে চায়। লোকে বলে, বাড়ির চারিদিকে বেড়া দাও।
দেখতে দেখতে বেড়া ওঠে। বেড়ার উপরে সুপারিগাছের খোল দিয়ে ঢাকা পড়ে বাড়ির অন্দর। হাওয়া এলে সড় সড় করে আওয়াজ ওঠে। সে আওয়াজে ছুটে আসে রূপনগরের রাজকন্যা। এসে খোলপাতার ফাঁকা দিয়ে বাইরে তাকায়। সেটা দেখে ঝামেলা বিবি ছুটে আসে। মেয়েকে টেনে নিয়ে বলে, দেখে না মেয়ে। দেখে না।
মেয়ে বড় হচ্ছে। তাকে নিয়ে সবাই চিন্তায় পড়ে যায়। গ্রামের ছানিপড়া মোছলেম মোহরিও বলে, হাওয়ার লগে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। পাড়ায় পাড়ায় বলে, এই মাইয়ারে রাখন দায়। দিনকাল খারাপ।
দিনকাল খারাপ বলেই মোছলেম মুহুরি কদমতলার হাটে এসে শওকত আলীর সন্ধান করে। শুরুতে কিছু বলে না। দাঁতে কাঁচা সুপারি কাটে। তারপর একটু সাদা তামাক খোঁজে। সুপারিপট্টির লোকে তাকে নতুন করে কিছু সুপারিও দেয়। সঙ্গে সাদা তামাক আর গৌরনদীর পান। তারা এই সাদাপাকা চুলদাড়ির মোহরি লোকটির দিকে কৌতুহল ভরে তাকায়। নিজেরা বিড়বিড় করে বলে, এ আবার কোন ঝামেলা নিয়া আইলো।
সেটা শুনতে পেয়ে কি না পেয়ে মোছলেম ব্যাপারি পিক ফেলে বলে, ঝামেলাই বটে।
বলে কয়েকটি নতুন পুরাতন দলিল দস্তাবেজ সকলের সামনে খোলে আবার বন্ধ করে। হুমড়ি খেয়ে সবাই দলিল দস্তাবেজ দেখতে চেষ্টা করে। তখন সেটা হাত ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে মোছলেন মোহরি।
ব্যাগের দিকে চোখ রেখেই উত্তর করে, কেস…।
--কেস?
--কেস কারবারিই বটে।
শুনে সবাই একটু চুপ মেরে যায়। তারা নিজেরা কিছু বলে না। মোছলেম ব্যাপারির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের জুলফির কয়েকটা চুল সামান্য ওড়ে। মোছলেম ব্যাপারি আবার একখিলি পান তামাক মুখে পোরে। ভালো করে চিবিয়ে একটু পিক ফেলে। বলে, কেস কারবারি তো হবেই। থামানো যাবে না। মার্ডার কেসও হইতে পারে।
তারপর সীড স্টোরের দিকে হাঁটা দেয়। খালপাড়ে দাঁড়িয়ে সীড স্টোরের দানপত্রটি উচ্চারণ করে পড়ে। দুতিনবার গলাখাকরি দেয়। সীড স্টোরের বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করে। কী ভেবে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এ সময়ে কদমতলা টু খানা কুনিয়ারি গ্রামের মাটির রাস্তায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে হাটতে দেখা যায় শওকত আলীকে। মাথার চুল উলুকঝুলুক। চোখ লাল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
লোকে তখন সন্দেহ করে শওকত আলীর বাড়িতে ভয়ানক কিছু একটা ঘটেছে। হয়তো তার তেশরা বিবি ঝামেলা বিবির মতিগতির ঠিক নেই। হয়তো বিবিকে দিনের পর দিন উঠতি বয়সী মেয়েটিকে দেখতে হচ্ছে বলে শওকত আলীর সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তার নিজেরই কোনো সন্তান নেওয়ার সুযোগ ঘটছে না বলে ক্ষিপ্ত হচ্ছে। হয়তো একারণে কোনো পরপুরুষের সঙ্গে কিছুটা যোগাযোগ করেও ফেলেছে। তার সঙ্গে চলে যাওয়ার ধান্ধা করছে।
লোকে তখন ফিসফাস করে বলে, ঝামেলা বিবিকে কদমতলায় নিয়ে এলেই হয়। ভাইজোড়া গ্রামে রাইখা লাভ কি!
কিন্তু বিবিকে আনলে রূপনগরের রাজকন্যাকেও আনতে হবে। তখন মেয়েটির সঙ্গে স্বামী শওকত আলীকেও দেখভাল করতে হবে। তাতে মেয়েটির যত্নের ঘাটতি হবে। সেটা তার সহ্য হবে না। থাক। থাক। আরো কিছুদিন থাকুক এভাবে ভাইজোড়া গ্রামে। মেয়েটি বড় হবে। পড়াশুনা শেষ করবে। দেখেশুনে একটি ভালো ঘরে বিয়ে দেবে। তারপর ঝামেলা বিবিকে নিয়ে কদমতলায় পাকাপাকি আসতে পারবে শওকত আলী। অথবা নিজেই চাকরি ছেড়ে বাড়ি গিয়ে থাকবে। এটা ভেবে কদমতলার লোকজনের মনে কিছুটা চাপ বাড়ে। বাড়িতে দুজন মানুষ। একজন পরিণত যুবতী মহিলা। আরেকজন ডগডগিয়ে ওঠা সদ্য কিশোরীতে তরুণী। আর কেউ নেই। বাইরে মালঞ্চের বেড়া। হাওয়া এসে দোলা দিয়ে যায়। তাতে ঘুম টুটে যায়। বুঝতে পারে কয়েকজন অন্ধ মানুষ ঘাড়ের উপরে শ্বাস ফেলছে। কেউ কারো দিকে তাকায় না। পরদিন একজনের রান্না করতে দেরি হয়ে যায়। আরেকজনের ক্লাশে বারবার ঘুম পায়। পাশের বান্ধবীটি অপাঙ্গে হাসে। ফিসফিস করে শুধায়, কীরে, ঘটনা কদ্দুর?
--কোন ঘটনা?
--জানো না বুঝি? কচি খুকি। ভাজা মাছ উলটে খেতেও জানে না। কপট ভঙ্গিতে বলে গায়ে আলতো করে ঠেলা দেয় বান্ধবীটি। তারপর ছোট্ট হাত ব্যাগ থেকে একটা৷ ভাঁজ করা কাগজ বের করে। খুলে দেখায়। লেখা--
রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি
ইরান তুরান পার হয়ে আজ তোমার কাছে এসেছি।
কাগজের সঙ্গে দুটো শুকনো গোলাপ পাপড়ি রয়েছে।
এই ঘটনাটি হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। একথাও কয়েকজন ফিসফাস করে যে, ক্লাশ পালিয়ে রূপনগরের রাজকন্যাকে এলাকার একটি ফটো স্টুডিওর দিকেও যেতে দেখা গেছে। সে এসেছিল মাথায় ওড়না দিয়ে। হয়তো মুখ ছিল ঢাকা। স্টুডিও ঘরে উঠতে গিয়ে একবার হোঁচট খেয়ে পড়তে যায়। পড়তে পড়তে হোঁচটটা সামলে নেয়। তবে হোঁচটের ফলে মুখ থেকে ওড়নাটা সরে যায়। আর তখনি সেই মুখটা সে-পথের দুএকজন পথচারী দেখে ফেলে। একটু অবাক হয়ে। অজান্তে নিজেকেই নিজে বলে, এ দেখি আমাদের শওকত আলীর ডাঙ্গর মাইয়াডা।
এ কথাটি তারা বাড়িতে ফিরে ঘুমের আগে চিন্তা করে। একবার তার তার স্ত্রীকে বলবে কিনা ভাবে। ভাবতে গিয়ে ক্লান্তি হেতু তারা ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে বুঝতে পারে তাদের স্ত্রীগণ অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। আঙিনা ঝাড় দিয়ে রাঁধতে বসেছে। তাদের মুখগুলো একইটু বিষাদময়। তা সত্বেও সেইসব সদ্য জাগ্রত লোকগুলোর অকস্মাৎ মনে হয়, কাল যে স্টুডিওতে শওকত আলীর মেয়েটিকে ঢুকতে দেখেছিল, এখন নরোম ভোরে বাঁশপাতা থেকে উড়ে আসা স্নিগ্ধ হাওয়ায় আলস্যঘুমের আড়ালে ঝুঁকে পড়তে গিয়ে সেই সব লোকগুলোর মনে হয়, মেয়েটি আসলে শওকত আলীর পেয়ারা মেয়ে তো নয়ই, অন্য কোনো মেয়েও নয়। হয়ত স্টুডিও ঝোলানো মাধুরী দীক্ষিত নামে কোনো এক ইন্ডিয়ার নায়িকার নৃত্য দৃশ্যই হবে হয়তো। তারপর বেলা একটু বাড়তেই সেইসব লোকজনের ধুমপানের পিয়াস লাগে। আকিজ বিড়ি টানতে গিয়ে মাথাটা ফর্সা হলে তারা বুঝতে পারে স্টুডিওর কোনো ঝোলানো ছবি নয় সে।
আরো একটা বিড়ি টেনে দু গ্লাশ তালের রস খেতে গিয়ে তাদের মনে পড়ে এ এলাকায় কোনো ফটো স্টুডিও নেই। একটা ছিল বটে। সেটা শান্তিবাবুর মনিকুন্তলা ফটো স্টুডিও-- পশ্চিমপাড়ার মাদ্রাসা থেকে ফটো তোলা হারাম বলে একদিন মিছিল করলে শান্তিবাবু রাতের আঁধারে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। বেনাপোল দিয়ে সোজা ইন্ডিয়ায়-- বনগাঁয় এখন আলুপটলের দোকান করে। অথবা এমনো শোনা যেতে পারে শাল্লা দিরাইয়েও তাকে দেখা যায় মাঝেমধ্যে। তাতে লোকজন তেমন কোনো সমস্যা বোধ করে না। কেননা এর মধ্যেই দেশে ডিজিটাল ক্যামেরা এসে গেছে। যে কেউই ফস করে ছবি তুলতে পারে। ফলে এইসব ঝিমু ঝিমু লোকজন সহসা বুঝতে পারে এটা হয়তো তাদের খোয়াব ছিল। খোয়াবে তারা দেখতে পেয়েছে শওকত আলীর পরীর মতো মেয়েটিকে। শুনতে পেয়েছে পায়ে নূপুরেরও ঝুমঝুম শব্দ। সেই শব্দ করে মেয়েটি হাওয়ায় ভেসে ভেসে কোনো ফটো স্টুডিওতে ঢুকতে গিয়েছে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে তার হোঁচট খাওয়ার শব্দ শুনতে শুনতে তার করুণ শঙখের মতো মুখটিও দেখে ফেলেছিল। সেই মুখ দেখে তারা অজান্তে গেয়ে উঠেছিল-- রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি….।
এই গানটি গাইতে গাইতে তাদের গলা ধরে এসেছিল। সেটা মনে করে আজ এই ক্ষণে পাপবোধ ঘিরে ধরে। সেই পাপবোধ থেকেই তারা নিজ নিজ স্ত্রীদের পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আর প্রবলনদীর মতো কান্নার স্রোতধারা তাদের চোখ থেকে নেমে এসে ধুলোমাখা পায়ের পাতা ভিজিয়ে দিতে লেগেছে। আর এই স্ত্রীগণ সহসা হাওয়া থেকে পদ্মঘ্রাণ পেতে শুরু করেছে। সেই গন্ধে তাদের মনে হয় তারা আজ আর বহুগর্ভধারী শিথিল স্ত্রীগণ নয়। তারা সবাই অনাঘ্রাতা কিশোরীরত্নে পরিণত হয়ে গিয়েছে। আর তাদের পদতলে নত হওয়া লজ্জিত কিশোরটির প্রতি স্নেহ মমতা এবং ভালোবাসা বোধ করতে করতে ছায়ার মতো নরম করে নিজেকে মেলে দেয়। কয়েকটি শিশুর জন্মসূচনাধ্বনি সব কিছু ভেদ করে চারিদিক প্লাবিত করেছে।
সেদিন অথবা পরদিন কিংবা কোনো একদিন হয়তো এই সদ্য গর্ভিনী নারীগণ শওকত আলীর বাড়ির বেড়ার উপরে ঠক ঠক করে আঘাত করে। রূপনগরের রাজকন্যা ঘর থেকে একাকী বেরিয়ে এলে তাকে শুধায়, জননী, তোমার মা কোথায়?
কোনো শব্দ না করে অনাঘ্রাতা কিশোরী মেয়েটি মথা নাড়ে। সেটা দেখে তারা বলে, নাই?
আবার মাথা নাড়ে। এবার ছোট্ট করে বলে, নাই।
--কোথায় গেছে?
আবার মাথা নাড়ে। জানে না।
শুনে তারা মেয়েটিকে নিজ নিজ বুকে চেপে ধরে আশ্বাস দেয়, ভয় নেই মা। আর কোনো ভয় নেই। মা নাই তো কী হয়েছে-- আমরা আছি।
সব ভয় চলে গেছে।
তাহলে মেয়েটির মা ঝামেলা বেগম কোথায় গিয়েছে? কেউ জানে না। কবে গিয়েছে? তাও জানে না এরা কেউ। হয়ত আজ। হয়তো কাল অথবা পরশুও হতে পারে। গেল সপ্তায় তাকে দেখেছে কিনা সেটা কেউ মনে করতে পারে না। মাসখানেকের মধ্যেও কারো কারো চোখে পড়েনি। আবার কেউ কেউ মনে করার চেষ্টা করে বোঝে গত এক বা দুই বছরের মধ্যে তাকে দেখেনি। আবার দুএকজনকে পাওয়া যায় যারা আদৌ ঝামেলা বেগমকে দেখেনি। এ গ্রামে আসেওনি। তার নামও শোনেনি। তাহলে এই রূপনগরের রাজকন্যাকে এতকাল পেলেপুষে কে রাখছে? সেকি হাওয়ার উপরে বড়ো হচ্ছে?
দূর থেকে কদমতলার লোকজন হয়তো এইসব টের পায়। টের পায় সীড স্টোরে শওকত আলী ছটফট করে। বারবার ঘরেবাইরে করে। হয়তো মেয়েটি একা একটি বাড়িতে আছে। মাঝে মাঝে পাড়াতুতু ফুফু কিম্বা খালা এসে থাকে। তার শেষ মা-টিরও কোনো সন্ধান নেই। সন্ধান পাওয়া যাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
এই যখন আবস্থা ঠিক তখনি মোসলেম ব্যাপারি গেল কোথায়, আদৌ এ কদমতলায় এসেছিল কিনা, অথবা সত্যি সত্যি এই নামে কেউ আছে কিনা -- এইসব প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে সন্দেহবাতিক লোকজন সহসা একদিন দূর থেকে দেখতে পায়-- কে একজন উলুক ঝুলুক চেহারা নিয়ে কদমতলায় বাস থেকে নেমেছে। নামতে গিয়ে তার বগলে থাকা একটা ফাইল পড়ে যায়। কিন্তু গতিজড়তার কারণে ফাইল থেকে বেশ কয়েকটি পাতা ফরফর করে হাওয়ায় ওড়ে। ঢেউয়ের দোলায় নৌকার মতো দুলতে দুলতে ওড়ে। কে বা কারা ফিসফিস করে বলে, এই লোক মোসলেম ব্যাপারি। মোসলেম ব্যাপারি ছাড়া আর কেউ নয়। যেন মোসলেম ব্যাপারি আসবে জেনেই এরা সবাই অপেক্ষা করছে।
কয়েকজন বালক দৌড়ে গিয়ে সেই সব উড়ন্ত কাগজ হাওয়া থেকে ধরে ফেলে। ধরে কাগজগুলো মোসলেম ব্যাপারির কাছে ফেরত দিতে গিয়ে দেখে, মোসলেম ব্যাপারি বলে কেউ নেই। হয়তো ছিল। হয়তো ছিল না। তাদের মনে হয় মোসলেম ব্যাপারি না থাকলেও ক্ষতি নেই। তার বগল ফসকে যাওয়া কাগজগুলো আছে। তাতে আঁকা বাঁকা অক্ষরে লেখাজোঁকা আছে। সে লেখাজোঁকা এতো অস্পষ্ট যে তা পড়া যায় না। এলাকার বিশিষ্ট প্রবীণ পত্রপাঠক আতশ কাচ রেখেও তার অর্থ উদ্ধার করতে গলদঘর্ম হয়। শেষে অপেক্ষমান লোকজনের উদ্দেশ্যে কিছু না বলে-- তার সুনাম নষ্ট হতে পেরে ভেবে বলে,সমবেত লোকজনের উদ্দেশ্যে পড়তে শুরু করে,
মোসলেম ব্যাপারি লিখেছে—
“নাজিরপুরের ভাইজোড়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী শওকত আলীর কাছে অভিযোগ এসেছে তার সদ্য কিশোরী মেয়েটির কাছে রাত বিরেতে একটি উঠতি বয়সী যুবককে গোপনে আসাযাওয়া করতে দেখা যায়। কোনো কোনো দিন তরুণটিকে অতি প্রত্যূষেও মালঞ্চ বেড়া টপকে ফিরে যেতেও কেউ কেউ দেখা গেছে। এটা নিয়ে এলাকায় অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
মেয়েটির মা নেই। বাবা সরকারি কাজে কদমতলা বাজার সংলগ্ন সরকারি সীড স্টোরে থাকে। অত্যন্ত শান্ত ভদ্র প্রকৃতির এই লোক মেয়েটিকে দেখভাল করার জন্য আরেকটি বিবাহ করার প্রস্তুতি নিয়েছে। নতুন কন্যাটি তার কনিষ্ঠ শালিকা। ইতিপূর্বে এই লোকের কাছে তার অগ্রজা তিন বোনকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাদের দুজন মারা গিয়েছে। একজন নিরুদ্দেশ। তাকে বিয়ে করলে তারও একই রকম পরিণতি হতে পারে ভেবে কনিষ্ট শ্যালিকা হুমকি দিয়েছে-- এই বিয়ের আয়োজন করলে সে আত্মঘাতি হবে। শুধু হুমকি দিয়েই থেমে থাকেনি। সঙ্গে ইঁদুর মারা ভয়ঙ্কর বিষ সঙ্গে রেখেছে। সেই বিষের প্যাকেট মাঝে মাঝে বের করে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে শব্দ শোনায়। শওকত আলীর শ্বশুর হাতজোড় করে জামাইকে বলেছেন, বাবারে--এইবার কিছু করতে পারছি না। মাপ করে দিওরে বাবাজীবন।
ফলে গ্রামের কোনো এক দূর সম্পর্কের শওকত আলীর এক অনাথা খালা বিকেল হলেই লাঠি ভর দিয়ে আসে। খালার বয়েস হয়েছে। চোখে ছানি পড়েছে। সন্ধে হলেই তার হুঁশ থাকে না। ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ঘোরে মাঝে মাঝে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে, অ, নাতিন-- ভয় পাইস না। আমি জাইগা আছি।
এই জাগা না জাগার মধ্যেই বেগানা মেয়ের কাছে মালঞ্চ বেড়া টপকে কে বা কারা অনায়াসে আসা যাওয়া করতে পারে। সুনির্দিষ্টভাবে স্থানীয় পাঞ্জেগানা মসজিদের মোয়াজ্জিন শওকত আলীকে একটি তরুণের নামও উল্লেখ করে পত্র লেখে। জানায়--এভাবে চলতে দিলে এলাকায় ধর্ম বিপন্ন হবে। জেনার শাস্তি হিসেবে পাথর ছুড়ে তখন তার মেয়েটিকে মেরে ফেলা ছাড়া উপায় থাকবে না।
এই হেতু শওকত আলী নড়ে চড়ে। একদিন কদমতলা থেকে কাঁপতে কাঁপতে চলে আসে ভাইজোড়া গ্রামে। রূপনগরের রাজকন্যা যখন স্কুলে চলে যায় ঠিক তখনি মালঞ্চ বেড়ায় ইলেকট্রিকের উন্মুক্ত তারের জড়িয়ে রাখে। তাতে ইলেকট্রিক সংযোগ দেয়। তারপর বিকেল বেলায় মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কদমতলার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। প্রকৃতপক্ষে বাসযোগে পরের স্টপেজেই নেমে পড়ে। অন্ধকারে গোপনে হেঁটে হেঁটে তার বাড়ির কাছে পৌঁছায়। ঝোঁপের আড়ালে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে।
রাত্রি দ্বিপ্রহরে চারিদিক নিঃশব্দ হয়ে যায়। মাঝেমধ্যে দুএকটা রাত্রিচর পাখির ডানার শব্দ দূর থেকে ভেসে আসে। দূরে মিলিয়ে যায়। কখনোবা শিয়ালও হেঁকে ওঠে। থেমে যায়। গাছ থেকে শিশির ঝরে পড়ে টুপটাপ। এরমধ্যে হঠাৎ করে ঝরে পড়ার পাতার উপর পায়ের শব্দ শোনা যায়। তখন শওকত আলী কান খাড়া করে। তার বাড়ির মধ্যে সব আলো বহু আগেই নিভে গিয়েছে বলে কোনো কিছু ঠাওর করতে পারে না। তবে পাতার উপরের খসখসানি শুনে বুঝতে পারে পায়ের শব্দ তার বাড়ির বেড়ার কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বেড়ার কাছে দাপাদাপির শব্দ শোনা যায়। দাপাদাপি থেমেও যায় এরপরে। বুঝতে পারে রাত্রিচর আর জীবিত নেই। ইলেকট্রিক তারের শকে তার ইন্তেকাল হয়ে গেছে। সেটা বুঝে শওকত আলী ছুটে গিয়ে তারের সংযোগ কেটে দেয়। তারপর ছুটে যেতে চায় লাশটির কাছে। কেউ জানার আগেই লাশটিকে তুলে আনতে হবে। তাকে মাটির মধ্যে লুকিয়ে ফেলতে হবে।
যখনই যেতে পা বাড়ায় ঠিক তখনি খুট করে একটা শব্দ হয়। তার ঘরের দরোজা খুলে যায়। দেখা যায় একটা আলগা বাতি হাতে করে তার রূপনগরের রাজকন্যা বাইরে এসে এসেছে। এসে বেড়ার কাছে এগিয়ে যাচ্ছে।
এরপর সেখানে আর দাঁড়ানোর কথা ভাবতে পারে না শওকত আলী। তার মেয়ে কিছু বোঝার আগেই সে আগানবাগান ভেদ করে ছুট লাগায়। কানে হাত দিয়ে রাখে যাতে মৃত যুবকটির জন্য ভেঙ্গে পড়া তার মেয়েটি কান্নার শব্দটি শুনতে না পায়।”
মোসলেম আলী মোহরীর লেখা এই পর্যন্ত। আর নেই। হয়তো ছিল। হয়তো মুছে গেছে। হয়তো লেখা ছিলই না। এলাকার প্রবীণ পত্রপাঠক আতশ কাচ দিয়ে কোনো অক্ষরই দেখতে পাননি। যেরকম করে কোনো কোনো চিঠিতে দীর্ঘ বয়ান না থাকলেও বানিয়ে বানিয়ে বলে যান কদমতলার বুড়ো বাবামা অথবা দাদাজানের কাছে। যা শুনলে বুকে ভরসা আসে, মনে শান্তি আসে সেকথাগুলো তিনি তাদের পড়ে দেন। ঠিক সেরকম করেই তিনি মোসলেম মোহরির কাগজগুলো পড়ে শোনান। শুনে কদমতলার লোকজনের ভরসা উড়ে যায়। শান্তি টুটে যায়। আর দেরি না করে তারা ছুটে যায় সীডস্টোরের দিকে।
সীড স্টোরটি তখন বেশ শুনশান। কোনো শব্দ নেই। অদূরে সোতা খালে জোয়ার আসতে দেরি হবে। দুটো ঘুঘু একটি আমলকি গাছের ডালে চুপ করে বসে আছে। তাদের চোখের পলক পড়ছে ন।
সীডস্টোরের জানালাগুলো বন্ধ। দরজাও বন্ধ। কেউ কেউ শওকত আলীর নাম ধরে ডাক দেয়। ডাকের উত্তর না পেয়ে কেউ কেউ দরজায় কান পাতে। কোনো শব্দ শুনতে না পেয়ে কেউ কেউ দরোজায় করাঘাত করতে করতে চিৎকার করে বলে, শওকত মেয়া, বাড়ি আছেন? বাড়ি আছেন শওকত আলী।
তারও কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে এ-ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগে। কাল শওকত আলীকে দেখেছে কিনা তা কেউই বলতে পারে না। মোড়ের যে চায়ের দোকান থেকে নৈশপাহারা শুরুর আগে এক কাপ চা কিনে খায় সেই চায়ের দোকানদার ফজল আলী ওরফে ফজা সাফ সাফ জানায়, না- কাল চা খেতে আসেনি সে। লোকে ফিসফিস করতে লাগে। আর সীডস্টোরের দালানবাড়িটার চারিদিকে দেয়াল ঘেষে ঘুরতে থাকে। শেষে কি শওকত আলী আত্মঘাতি হলো নাকি-- ভেবে কেউ কেউ ভয়ে শিউরে উঠতে থাকে। কেউ কেউ এইসব কাউতুলি সহ্য করতে না পেরে পাশের বাড়ির দিকে ছোটে। তাদের হিজলগাছের ঢেঁকিটা তুলে নিয়ে আসে। দিরজার দিকে ঢেঁকিটা নিয়ে এগিয়ে যায়। ভাঙার জন্য বন্ধ দরজায় আঘাত করতে যাবে ঠিক তখনি তারা একটি শোরগোল শুনতে পায়।
--এসেছে। এসেছে।
--কে এসেছ?
--হয়তো শওকত আলী। আলী ছাড়া আর কে আসবে।
তাহলে দরজা ভাঙার দরকার নেই। ঢেঁকি ফেলে
সীড স্টোর ছেড়ে কদমতলার লোকজন বাস স্ট্যান্ডের দিকে ছুটে যায়। বাস থেমে আছে। বাস থেকে লোকজন নামছে। কিন্তু শওকত আলীকে নামতে দেখা যায় না। সবাই হতাশ হয়ে সীড স্টোরের দিকে ফিরে যাবে কিনা ভাবতে থাকে ঠিক তখনি বাসটা একটু এগিয়ে গিয়ে আবার থেমে যায়। কী হইছে ওস্তাদ বলে হেল্পার ড্রাইভারের দিকে বলে উঠতেই বন্ধ দরজা খুলে যায়। সবাই দেখে একজন বুড়ো লোক কাঁপতে কাঁপতে নামছে। আর তাকে খুব যত্ন করে ধরে একটি অপরূপ মেয়ে নামিয়ে আনছে।
লোকটি ঠিক শওকত আলী কিনা তা ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। কিছুটা চেহারার সঙ্গে মেলে। কিছুটা মেলে না। না মিলুক। তাতে কিছু যায় আসে না। লোকজন তাকে শওকত আলীই ভাবতে পছন্দ করে। সঙ্গের মেয়েটিকে রূপনগরের রাজকন্যা। এই রূপের কখনো রূপান্তর হয় না। মায়াময়। তার গা থেকে হেমন্তের চাঁদের আলো গলে গলে পড়ছে। পড়ে এই দিনের বেলায়, পড়ন্ত রোদের বেলায়, গুটি গুটি করে ছায়া ঘন হয়ে আসার বেলায় তার গা থেকে গলে পড়ে--ঝরে পড়া চঁদের আলোর টুকরোগুলো গোলাকার হীরকখণ্ডের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে লাগল চারিদিকে।। আর তাই দেখে কোনো এক বাড়ির বারান্দায় ঝোলানো ময়না পাখি ‘মায়াবতী’ ‘মায়াবতী’ বলে শীস দিচ্ছে।সে বারান্দার বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে অশিতিপর বুড়ি মানুষটি পথের উপরে লুটিয়ে পড়ে বিড়বিড় করে বলছে-- রাধা মাইকি জয়। আর একটি শিশু মায়ের কোলে দুধ খেতে খেতে হঠাৎ করে থমকে গেছে। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে দেখছে।
আর কদমতলার লোকজন বিস্ময়ে দেখতে পাচ্ছে, বুড়ো লোকটি-- অন্ধ। সেই অন্ধ চোখের ভেতর থেকে রক্ত চুয়ে চুয়ে পড়ছে। এই চোখ অন্ধ ছিল না একদিন। কেউ সেই চোখ দুটো তুলে নেয়নি। তুলে নিয়েছে নিজেরই দুই হাতে। নিজের পাপের ফল নিজেই হাতে নিতে চেয়েছে।
কেউ কেউ ফিসফিস করে বলে, রূপনগরের রাজকন্যার প্রিয় মানুষটিকে ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে মেরে ফেলার পরে শওকত আলী বাসে উঠে পড়েছিল। কেউ জানার আগেই লুকিয়ে কদমতলায় ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু কদমতলা স্টপেজের অনেক আগেই কইয়ের আগা গ্রামের রাস্তায় নেমে পড়েছিল। কেউ দেখার আগেই রাস্তা থেকে দ্রুত ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়েছিল বনতুলশির ঝোঁপে। মেয়ের কান্নাভেজা বিষাদ মুখ সহ্য করতে পারবে না বলে নিজের হাতে নিজেই অন্ধ হয়ে নিল।
কেউ কেউ বলে সেই কইয়ের আগা গ্রাম থেকেই বাবাকে খুঁজে নিয়ে এসেছে রূপনগরের রাজকন্যা। তার মুখে কোনো বিষাদচিহ্ন নেই। শোক নেই। রাগ নেই। শান্ত। স্নিগ্ধ। নিজের হাত দিয়ে জড়িয়ে রেখেছে এই আঁতুর ন্যূব্জ ভঙ্গুর বাবাটিকে বিড়বিড় বলছে, কাঁদে না। কাঁদে না সোনা।
বুড়ো বাবাটি কাঁদে। সত্যি সত্যি কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি ওঠে। মেয়েটি তার বুক ডলে দেয়। বিড়বিড় করে বলে, কাঁদে না।
এ সময়ে হয়তো আরো কিছু বলছে বিড়বিড় করে। এতো বেশি ধীরে ধীরে বলছে যে সেকথা কেউ শুনতে পায়না। সে কথা শুনতে হলে আঁতশ কাচের মতো কোনো শ্রুতিযন্ত্র প্রয়োজন। তবু কদমতলার লোকজনের মনে হয়, রূপনগরের মেয়েটি তার বাবাকে বলছে, সেদিন মজনু নামের ছেলেটি নয়-- ইলেকট্রিক তারে শক খেয়ে মরেছে একটি শিয়াল। তুমি যে তাকে মেরে ফেলার কায়দা করছ গোপনে সেটা টের পেরে আমি মজনুকে এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করেছি। সে তাই আসেনি। সে মারা যায়নি। তাকে তুমি মারতে পারোনি। তুমি পাপী নও।
শওকত আলী শুনতে পেয়েছে কি পায়নি রূপনগরের রাজকন্যার কথাগুলো, সেটা অনুমান করা না গেলেও সবাই বুঝতে পারে, শওকত আলীর একটানা কান্না চলছে। এই কান্নার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই শওকত আলীর শব্দবিশ্বে।! বিনবিন করে এই কান্নার সুর হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সামনে এগিয়ে চলছে। সেই সুরের পথরেখা ধরে একজন রূপবতী মেয়ে আর শওকত আলী যেতে যেতে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে।
কদমতলার লোকজনের কে বা কেউ বলে ওঠে, সীড স্টোরের বন্ধ দরোজা খুলেছে। সেখান থেকে বের হয়েছে প্রকৃত শওকত আলী। তার চোখ জলেভেজা। কোনো কথা নেই। কে বা কারা তাকে দেখে চমকে বলে ওঠে, মেয়েটির সঙ্গে যে বুড়ো লোকটি আগে চলে গেল কাঁদতে কাঁদতে, সে আসলে কে? সে কি শওকত আলী নয়? সে কি অন্য কেউ? অথবা সেই আসল শওকত আলী? আর সীড স্টোরের দরজা থেকে বেরিয়ে লোকটি তাহলে অন্য কেউ? শওকত আলী নয়। এসব তর্কের কথা থাক। আমরা এই দূর থেকে--অতি দূর থেকে শুনতে পাই, কদমতলার লোকজন মৌমাছির গুঞ্জনের মতো সমস্বরে গেয়ে চলেছে,
রূপনগরের রাজকন্যা রূপেরজাদু এনেছি।
ইরান তুরান পার হয়ে আজ তোমার কাছে এসেছি...।
0 Comments