কুলদা রায়ের গল্প : গুলাবগুলি


১. রূপকুমারের শ্বশুরবাড়ী

ঘাটকূলে নৌকা এসেছে। সন্ধ্যা ঘুরে গেছে। এইখানে ঘন বাঁশঝাড়। চাঁদ উঠতে দেরী আছে। বেশ অন্ধকার। কয়েকটি ছায়ামূর্তি বসে আছে। নড়ন চড়ন নট।

এখন ভাটা গোন। ঘাট থেকে জল একটু দূরে সরে গেছে। এখানে কোথাও একটা খেজুরগাছ ফেলা আছে। তোতামাঝি ঠাওর করতে পারছে না। একটু জোরে বলে উঠলো, আগে নাইমেন না। কাদার মইদ্যে পইড়া যাইবেন।

এই কাদা মেরীর চেনা। তার তর সইছে না। শাড়িটা একটু জাগিয়ে ধরে নেমে পড়েছে। আর্তনাদ করে বলে উঠেছে, বাবাগো!

একটি ছায়ামূর্তি হাঁটু গুজে বসেছিল। বিকেল থেকে বসে থাকতে থাকতে তার হাফ ধরেছে। এখন ঘুম পাছছে। বাবগো শব্দ শুনে নড়ে চড়ে উঠেছে। হাহাকার করে বলছে, মা মেরী আইছোস!

মেরী কাদা-পায়ে উঠে এসে বাবা যতীন হালদারকে জড়িয়ে ধরেছে।

এর মধ্যে পিদিম জ্বলে উঠেছে। তোতা মাঝি খেঁজুর গাছটি খুঁজে পেয়ে নৌকা বেঁধেছে। ঘাটে গ্রামের আরও দুপাঁচজনও এসেছে। বিভুতি কাকা এগিয়ে গিয়ে জামাইকে হাত ধরে নামিয়ে আনলেন। জামাইটি লাজুক মুখে তাকে প্রণাম করতে যাবে। তার হাত ধরে বললেন, মোর আগে তোমার শ্বশুর মশাইকে প্রণাম কর। তিনি বড় উতলা হয়ে আছেন।

যতীন হালদার বুড়ো মানুষ। চলতে ফিরতে কষ্ট। প্রদীপের অল্প আলোতে চোখে ভালো দেখতে পান না। মেরীকে ছেড়ে দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, মোর জামাই কই গো বিভুতি?

জামাইকে এর আগে দেখেন নি। জামাইটি হালকা পাতলা। মুখটি লবণ্যময়। জামাইকে ধরে কেঁদে উঠলেন। বললেন, কিরণ, কিরণ।

কিরণময়ী মেরীর মা। বছর কয়েক আগে চলে গেছেন। আজ তাঁর জন্য নতুন করে শোক জেগে উঠেছে।

ঘাট থেকে গ্রামের দিকে মাটির রাস্তা। দুপাশে ধান ক্ষেত। তারপর বাগান। শুকনো পাতা পড়ে আছে। একটি মেয়ে পথ দেখিয়ে আগে আগে হাঁটছে। তার গা থেকে মৃদু আলো বেরুচ্ছে। জামাই রূপকুমার সে আলো দেখে এগুচ্ছে।

বাগানে শুপারি নাই। আছে গুলাব। গোল গোল গুলাব গুলি—নাড়ুর মত। শক্ত। লালচে—কোনটা কালো। রূপকুমার আস্তে করে জানতে চাইল, গুলাব দিয়ে কি করে?

প্রশ্নটি শুনে মেয়েটি তার আঁচলের আড়াল থেকে মুখের সামনে তুলে ধরল মাটির পিদিম। লাল আলোতে সোনার মত উজ্জ্বল মুখ। কপালে পরিপাটি সিঁথি। নাকে ছোট্ট একটা নাক ফুল। সোনা নাকি?

মেয়েটি হাসল। বলল, সোনাই তো। মোর নাম সোনা। আপনের শালিক। বলে সোনা একবার শালিক ডাক ডেকে বসল। মেরী একটু পিছিয়ে পড়েছে। বাবার হাত ধরে আসছে। দুজনের অনেকদিন পরে দেখা হচ্ছে। চোখ থেকে জল পড়া থামছে না। জামাইকে তিনি বললেন, তোমার বিভূতি কাগার মাইয়া। সোনা। টেনে পড়ে।

সোনা পিদিমে আঙুল ডুবিয়ে চটচটে তেল মেখে চোখের সামনে ধরল। বলল, এই দ্যাখেন—হ্যারে কয় গুলাব ত্যাল। মোগো পিদিম জ্বলে গুলাব ত্যালে। বলেই নাকে তেল লাগিয়ে দিল। বলল, ত্যালে ঝিয়োরী নাচে/ গ্যালে নায়রী বাঁচে।। কনতো জামাই দাদা, আপনে মেরী দিদিরে লৈয়া বাঁচেন, না– নাচেন?

জামাই বরণ করতে করতে রাত্রি অনেক হয়ে গিয়েছিল। সোনা চলে গেছে। তার পিদিমটি জ্বলছে। যতীন হালদার বারান্দায় হা করে আছেন। আজ তার গভীর ঘুম এসেছে। তিনি স্বপ্ন দেখছেন—মেরীর মা কিরণময়ী তাকে উঠিয়ে দিচ্ছে। মুখের একপাশের ঘোমটা সরে গেছে। বলছে—জামাই আইছে। হাটে যাও।

এখন হাটে যেতে ইচ্ছে করছে না। তিনি পাশ ফিরে শুলেন। বহুদিন পরে তিনি শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন। তার ছোট মেয়ে এতদিন পিসির কাছে পড়ে ছিল। ইচ্ছে হলেও আসতে পারেনি। সব সময় সে যেন তাঁর কানের ভেতরে বলেছে, অ বাবা, তোমারে দেখবার মঞ্চায়।

তিনি আপন মনে বলে উঠেছেন, তাইলে বাড়ি আয়।

মেয়ে বলেছে, আইতে পারি না বাবা।ভয় করে। অ বাবা—আমার ভয় করে।

তিনি ঘেমে উঠেছেন। বহুদিন ধরে মেয়েটা দূরে বসে কাঁদছে। তিনি ঠিক মত ঘুমুতে পারেননি। আজ মেয়েটি এসেছে। আজ তাঁর শান্তি।

এর মধ্যে মেরীর মা বলছে—হাটে যাও। জামাই কি লবণ-ভাত খাইবে?

কিরণময়ীর কথার ধরন একটুও পাল্টায়নি। যতীন হালদার বউকে রাগিয়ে দিতে ভালবাসেন। বললেন, খাইলে মন্দ কি?

–আপনের কুইড়াপনা গেল না। লবণ-ভাত আপনে খান।

যতীন হালদার হা হা করে হাসছেন। তিনি তাঁর মেয়েটার হাত ধরে ছিলেন আজ বহুদিন পরে। তিনি আজ কোথাও যাবেন না। আয়েশ করে ঘুমোবেন। মুখ কালো করে কিরণময়ী সোনার বাবার খোঁজে বের হলেন।

ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। রূপকুমারের ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। মেরী তার নাকের ডগা নাড়িয়ে দিয়ে বলল, গুলাব বাগানে যাবা না। গুলাব বাগানে যাইতে পারবা না। আর কি বলেছিল রূপকুমারের মনে নেই। শুধু ঘুমের কথা মনে আছে। আর ঝিঁ ঝিঁর শব্দ।


২. জামাইবরণ

সকালে সোনা আসে নি। সোনার মা এসেছে। কোমরে আঁচলে পেঁচিয়ে কাঁচা হলুদ বাটছেন। আর বাটছেন গিলা। গিলা বাটা, হলুদ বাটা সরিষা তেলের মধ্যে রেখেছেন। এর মধ্যে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে এঁয়োতি বউ ঝিরা এসে গেছে। কে একজন লক্ষ্মীমতি বউ গড় হয়ে প্রণাম করল। পাশের পিড়িতে মেরী। মেয়েটিকে বলল, ও লক্ষ্মী, বেপারী জেঠি আয়ে নাই?

বেপারী জেঠি আসে নাই। লক্ষ্মীমতি হলুদের বাটি এগিয়ে দিল। সোনা রাজবাড়ি গেছে। ব্যাপারী জেঠিকে সোনা নিয়ে আসবে। সোনার কথাই তিনি শোনেন। সোনার মা জামাইয়ের মুখে তেল হলুদ মাখিয়ে দিলেন। আর তাই দেখে বারান্দা থেকে যতীন হালদার হু হু করে কেঁদে উঠলেন। ছোট পিসি নাড়ু বিতরণ করতে করতে বললেন, অ দাদা, কান্দো ক্যানে। বউদি স্বগ্গে গেছে। তার জন্য জন্য কান্দো ক্যানে। আমরা আছি না।

সোনার মা ঘটি ভরে গায়ে জল ঢেলে দিলেন। আজ তিনি কণে-মা। মেরীর বিয়ে হয়েছে দুবছর। এতদিনে বাড়িতে আসা হয় নি। এ পর্বগুলো বাদ গিয়েছিল। সোনার মা কি বাদ দিতে দেবেন?

দুপুরের আগেই বিভুতি কাকা উঠোনে দশা সই একটা বড় রুই মাছ এনে ফেললেন। ইন্দেরহাট থেকে এনেছেন। মাছটিকে ঘিরে গোপালগণের ভীড় জমেছে। নেতাই নামে গোপালটি মাছের চোখ উল্টে পাল্টে দেখছে। আজ ইন্দেরহাটে পাঙ্গাস মাছ ওঠে নি। কাল কাউখালির হাটে যাবেন। পাঙাসমাছ বিনা কি জামাইজনদের ব্যাভার হয় না।

মণ্ডলবাড়ির তিলি বুড়ি দোক্তা বানাচ্ছেন। তিনি হর পার্বতীর গীত গাইবেন। তার নাত বউ লক্ষ্মীমতি রুই মাছের মুড়োর কানসে খুলছে। বিশ্বাসবাড়ির ছোট মেয়েটি হুগলী ধানের চিড়া নিয়ে এসেছে। সোনার মা চিড়া আর রুই মাছের মাথা দিয়ে মুড়ি ঘণ্ট রাঁধবেন।

এতদিন ছোট পিসির কাছে মেরী ছিল। দেখে শুনে রেখেছেন। বিয়েও দিয়েছেন। আজ তাকে বেশ মা মা লাগছে। ছোট পিসি চিড়া বাছতে বাছতে বলছেন তার বড় দিদির বিয়ের গল্পটি। গল্পটি বহুবার বলেছেন। তবু পুরনো হয়না। সবাই কান খাড়া করে শুনছে।

বরের বাড়ি আন্ধারমানিক। জুজখোলা পার হয়ে বাগেরহাট জেলায়। বর এসেছে নৌকায়। নৌকা কালিগঙ্গা থেকে আচি খালে ঢুকতে যাবে –এ সময় ভাটা শুরু হয়ে গেছে। খালের তলা শুকনা। নৌকা চলে না। জোয়ার আসার আগে মাঝি নামাজ পড়ে একটু হেলে পড়েছে। ঘর্ঘর করে নাক ডাকছে। জোয়ার আসতে ছ ঘণ্টা। মাঝির নাক ডাকা বাড়ে—আর বরযাত্রীরও হাই হুই ওঠে। বর কী করে? সবার আগে বর পড়ে পড়ে ঘুমায়। তার নাকের নিচে গোঁফ নড়ে। আর হেলে দুলে মাঝে মাঝে পাশ ফেরে। তারপর একে একে শান্ত। শুনশান। এর ফাঁকে কখন কুল কুল শব্দ হচ্ছে। মাটি ফুঁড়ে জল আসছে। ডাঙা থেকে জল নামছে। নদী থেকে জোয়ার আসছে। বোঝা কঠিন। মাঝি কপালে হাত তুলে বলে—অ বাবুরা, ওঠেন। উইঠা পড়েন। জোয়ার আইছে। খালে পানি খল খল করতেআছে।

আড়মোড়া দিয়ে সবাই দেখে নৌকাটা হালকা হালকা লাগে। আর জলের রঙ কমলা। নৌকায় ছিল কমলা। দার্জিলিং থেকে আনা। জোয়ারে নৌকা সামান্য কাত হতেই কমলা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়েছে জলে। তিন দিন ধরে নদী নালা খালের জলে সেই কমলা ভাসে—কমলা ছাড়া আর কিছু নাই। পানঘুচি নদীর পরে পশুর নদী। সে নদীতে বাওয়ালিরাও সেই কমলা খেয়ে বলেছে—পরাণ জুড়ালো। বরযাত্রীদের একজন রূপবানের গান ধরেছে– অ বাঘ মামা। তোমার বাল্লক এলো বনে। থাকে যেন মনে। এইটুকু গেয়ে হেসে ঊঠে বলে, আয়ো বাঘো, কমলা খাবা নিকি?

তিলি বুড়ি দোক্তা মুখে মাথা নাড়ে। হাচা কথা। সেই কমলা নিয়ে জলাবাড়ির হরিশ সরকার একখান গীত লিখছিলেন। ভাঙা ভাঙা গলায় তার আধখানা ধরল বুড়ি—

কমলার সঙ্গে যাওগো কমলা সুন্দরী।
তোমার বিহনে কান্দি কেমুনে মনধরি।।

কুড়াই শালুক ফুল গোছাই ঝিনুক দুল কেবা পরে কানে।
দুড়াই তালুক কুল পুড়াই ভালুক ভুল কেবা তারে আনে।।
আমি গো সই– সইগো কেমুন করি…

সোনার মা ছাড়া আর সবাই ধুয়ো ধরে বসল। বারান্দায় বসে যতীন হালদার নড়ে চড়ে বসেছেন। তারও ইচ্ছে সুর ধরে। কিন্তু গলায় সুর নাই। কাশি আসে। সুরটা কি মেরীর মা নিয়ে গেল? আর তক্ষুণি পশ্চিমের বাঁশঝাড়ে একঝাঁক বক পাখি বসেছে। তাদের পায়ের ভারে কাঁপছে বাশ বন। পুকুর ঘাট থেকে একটা গুঁই সাপ ভাট ফুলের আড়ালে যেতে যেতে থমকে দাড়াল। এঁয়োতিরা বাটনা বাটতে বাটতে, আনাজ ধুতে ধুতে, মাঝ ভাজতে ভাজতে, সরা খাড়তে খাড়তে এক সঙ্গে গাইছে—আমি গো সই সই গো কেমুন করি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার গাইছে ধুয়াটি। তারপর তিলি বুড়ি আবার সুর ধরেছে–

সইগো তুমি ডুইবা মরো কর্দম মাখা জলে ।
বহুত শান্তি পামু আমি তুমি ডুইব্যা ম’লে ।


৩. উপহারপর্ব

বিকেলে গণ্যমান্য লোকজন এসে গেছে যতীন হালদারের বাড়িতে। বিভূতি কাকা খুব ছুটোছুটি করছেন। তখনো কুদ্দুস চেয়ারম্যান আসেন নাই। খবর পাওয়া গেছে বিশাল গ্রামে কী একটা সালিসে আছেন চেয়ারম্যান। আসতে কিঞ্চিৎ দেরী হবে। সেক্রেটারি জগদীশ মিস্ত্রিকে আগে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ফরাসের উপর লোকজন বসেছে। সামনে থালার উপরে খিলি পান। পাতলা করে কাটা শুপারি। এক থালে কাঁচা শুপারি। আরেক থালে পাকা শুপারি। উত্তর পাড়ার রমজান মাঝি সোনাভানের কিসসা বলতে শুরু করেছেন। বিশালের ফেলু শেখকে দেখা যাচ্ছে না। তাকে পাওয়া গেলে দোহারকি করা যেত। রমজান মাঝি বলছেন—খুব ভোরে রূপবানের ঘুম ভেঙেছে। বাড়িতে বিয়ের বাদ্যি বাজনা বাজছে। দাইমাকে জিজ্ঞেস করল,

ও দাইমা কিসের বাদ্য বাজে গো দাইমা
আমার দাইমা দাইমা গো–

ঢাকো বাজে ঢোলক বাজে গো, আরো বাজে বাঁশি গো
আমার দাইমা দাইমা গো–

বাজাইতে বাজাইতে বাঁশি গো ও দাইমা আসে মোদের বাড়ি গো
আমার দাইমা দাইমা গো—
ও দাইমা, কিসের বাইদ্য বাজে?

দাইমা একগাল হেসে কয়, আজ তর বিয়া। রূপবান অবাক হয়ে কয়, কার বিয়া?

–তর বিয়োগো রূপবান। ছেইলা কিন্তু তগো মতো যে সে লয়—হাচা হাচা বাদশাজাদা। নাম রহিম। বার দিনের পোলা। মুখটি ফোলা ফোলা।

রমজান মাঝি বলেন, বার বছরের মাইয়ার লগে বার দিনের সোয়ামী। বার বছর বনবাসে থাকলে রহিম বাদশা বাঁচবে। কিন্তু বার বছরের বড় রূপবানের কী হইবে তখন? খুব কড়া প্রশ্ন বটে। প্রশ্ন করে রমজান শেখ চারিদিকে তাকায়। কেউ কথা কয় না। সবাই অপেক্ষা করে আছে। রমজান মাঝি মাথা ঝাঁকিয়ে ডান হাতটি সোজা করে ধরল। বলল, উত্তর নাই। দক্ষিণে সমুদ্দুর। ঢেউ তুড় বুড়। আর ঘন বন। গা করে ছন ছন।

কোলে শিশু নিয়ে বনের পথে চলেছে রূপবান। রাত্রি ঘনঘোর। ভুত প্রেত তাইড়া আসে। বলে, খাবো। খাবো। বনের মধ্যে শিশু কান্দে। তার দুধ চাই। দুধ না অইলে শিশু বাঁচে কেমনে? লোকে শুনে মাথা নাড়ে। বলে—কথা ঠিক ঠিক। দুধ বিনা শিশু বাঁচে না। বন্যেরা বনে সুন্দর–শিশুরা মায়ের দুধে। রূপবানের দিশা নাই। এর মধ্যে হা করে বাঘ্র এসে বলে—হালুম।

লোকজন নড়ে চড়ে বসে হালুম শব্দটি শুনে। তাইলে কি বাঘে খাইবে তাগো? খাইবে নাকি? বাঘের দাঁত কিড়মিড়। বাঘের ল্যাজ তিড় বিড়। রূপবান তখন বাঘের সামনে শিশু কোলে গান গাইছে—কি গাইছে? এই খানে এসে রমজান মাঝি থেমে গেলেন। ফেলু শেখ নাই। থাকলে দোহার দিতে পারত। বুইড়া মানুষ গলায় জোর কম। এই গলায় একা কিসসা জমানো কঠিন। স্রোতারা উসখুস। ততক্ষণে লক্ষ্মীমন্ত বউটি সুর ধরে ফেলেছে—

খাইও না খাইও না বাঘোরে
ও বাঘো খাইও না মোর পতিরে
আমার বাঘা বাঘারে—

লক্ষ্মীমতি বউটির কাছে রূপবান নামের মেয়েটি বদলে গেছে—এসে গেছে আরেক মেয়ে, মালঞ্চমালা। তার বাবা কোটালকন্যা। ভাগ্যদোষে আজ বনবাসী। গান শুনে বাঘ হল বাঘো মামা। বাঘিনী হল বাঘোমামী। বলে—ওরে হতভাগিনী ভাগিনী, তর কুনো চিন্তা নাই। মোরা আছি। তারা দুইজন ফালিয়ে ফালিয়ে মালঞ্চমালার শিশুস্বামীর জন্য দুধ খুঁজতে যায়। পোলা কাঁদে ওয়াও ওয়াও। ঘোলা দুধে খোয়াও খোয়াও।

এইখানে মেরী কেঁদে ফেলে। তিলি বুড়ির গলা জড়িয়ে কাঁদে। ছোটো পিসি বলে, কান্দে না সোনা। তিলি বুড়ি বলে, তুই মোগো রূপবানগো বইন। তরেও মোরা বনবাসে দিছিলাম। শীল-পাটার উপর সোনার মায়ের চোখ থেকে জল পড়ে। এই জল মেশান হলুদ এ গ্রামের মেয়ে-ঝুতরা আজ মুখে মাখবে।

এইটুকু শুনে পুবপাড়ার নিমাইয়ের মনে হল—এরপর বাঁশির সুর না হলে প্রাণ আসে না। বাঁশি আনতে ভুলে গেছে। উঠে দৌঁড়ে গেল বাঁশিটি আনতে। বাড়ির সীমানায় নালাবেড়। জল ফুট ফুট করে। তার উপরে ছোটো বাশেঁর চার। নিমাইয়ের মনে হল—নালা বেড় ফাল দিয়ে পার হয়। আজ সে চান্দকাঠির নিমাই নয়– পবন পুত্র। নিমেষে যেতে পারে তেপান্তর।

সন্ধ্যা ঘনার আগে এ বাড়িতে কুদ্দুস চেয়ারম্যান এসে গেলেন। মুখটি তার ভার। বিশালের খবর খারাপ। শালিস শেষ হয় নাই। সেক্রেটারি জগদীশ মিস্ত্রীর কানে কানে বললেন, বোঝলেন জগদীশদাদা। বিশাল গ্রামের আশা নাই। হ্যারা দাওয়াত নেবে না। কয় মাছুম পোলারে যারা মারছে তাগো লগে মোরা নাই।

জগদীশ মিস্ত্রী জানতে চান, কেডা কয়?

এদিক ওদিক তাকিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, ছক্কু হারামজাদা।

জগদীশ মিস্ত্রী বিরক্ত হয়ে বলেন, হ্যার কথার কি দাম আছে। হ্যায়তো উড়াইয়া ছাই/ টানে মাই। মাইনসে কী কয়?

চেয়ারম্যান বলেন, হ্যারা কি কোনোকালে কিছু কয়?

জগদীশ মিস্ত্রীর মুখটা ভার হয়ে গেছে। এই উৎসব কি পণ্ড হইবে? তাইলে কি জামাইবরণী বন্ধ কইরা দিবার কমু?

তাকে চেয়ারম্যান অভয় দিলেন, এই বাড়িতে কেডা আসবে—কার এতো বুকের পাটা? আমি আছি না।

একটা হ্যাজাগ বাতি ঝোলানো হয়েছে। তেল ভরা রেডি। সলোক কমলেই ম্যান্টেল জ্বেলে দেওয়া হবে। কুদ্দুস চেয়ারম্যান ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে মোলাকাত করে থিতু হয়ে বসলেন। বেশ আয়েশ করে বললেন, জামাই বাবাজীর বাড়ি কুথায়?

জামাই উত্তর করল, ফরিদপুর।

–ফরিদপুর। মোগো পুরনো আত্মীয় লাগে। আপনেগো লোকজন নাও নিয়া আগে আইতে এদেশে অঘ্রাণ মাসে। তারা ধান কাডতে বড় উস্তাদ।

চেয়ারম্যানের কানে কানে সেক্রেটারি জগদীশ মিস্ত্রি আবার ফিস ফিস করে বললেন। শুনে চেয়ারম্যান জিব কাটলেন। বললেন, দাদায়, আগে কইবেন না। মোগো জামাই অপিচার মানুষ। হ্যার একডা ইজ্জত আছে না। মোগো তায়ৈর পোলাও বড় অপিচার। ডিসি অপিচের নাজির। তিনি পকেট থেকে একটা ছোট্ট বাক্স বের করলেন। তার ভিতরে একটা সোনার হার। রূপকুমারের গলায় পরিয়ে দিলেন। বললেন—যেমন মাইয়া–তেমুন জামাই।

বিভূতি কাকা কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। তিনি কী করবেন বুঝতে পারছেন না। মাইয়ার গলা শুন্য। সোনার মা তাকে ইশারায় ডাকলেন। নিজের গলার চেইনটা খুলে দিলেন। বললেন, মাইয়ারে দ্যাও।

–হ্যায় কি আইছে? হে তো রাজবাড়ি।

–মাইয়া কি তোমার একা সোনা? মেরী কি মাইয়া না। হ্যার মায়ে থাকলি দেতো না?

সোনার মার দাঁড়ানোর সময় নাই। আরেক পাতিল পায়েস নামবে। ধলুদার বৌ সুরমতি একা পারবে না। সোনার মা তাকে সরিয়ে দিয়ে বলল—সর সর। তার চোখ ভিজে আসছে। তার জা আজ নাই। মৃত জাকে মনে পড়ছে। আখার মধ্যে ধুম গড়ছে।

চেনগাছা নিয়ে বিভূতি কাকা চেয়ারম্যান সাবের হাতে দিলেন। বললেন, মাইয়ার গলায় পরায় দ্যান। হাত জোড় করে বললেন, মাগো—কী আর দিমু। তোমার গরীব কাগা। তোমার জিনিস—তুমি নেওগো মা।

চেয়ারম্যান খুব খুশী। এক সঙ্গে দুইটা সোনার চেন। খেতে বসার আগে ঘোষণা দিলেন—এ বাড়ির দরোজার নাম হবে—প্রফেসার দরজা। গ্রামের মাইয়া প্রফেসর। আর কোন গ্রামে আছে? টিএনও সাবকে বলে তিনি একটা মেডেল দেওয়ার ব্যবস্থাও করবেন। লোকজন খেতে খেতে জয়ধ্বনি দিল—

ভাত খাইলাম মাছ খাইলাম

আরো খাইলাম কি?

–মেরী রানীর ভি।

কুদ্দুস চেয়ারম্যান কি জিন্দাবাদ।

সেদিনের রুই মাছের স্বাদ খুব ভাল হয়েছিল। তিলি বুড়ি তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে জানাল, এই রকম রুই মাছ তার বড়ো মেয়ের বিয়ের সময় রান্না হয়েছিল। তার পিঠের কাঁটা এখনো তার বেড়ায় গোজা আছে।


৪. সাবেক কীর্তিছাত্রী-সংবর্ধনা

পরদিন বাটনাতলা গার্লস স্কুলে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান। বেশ পুরনো স্কুল। সঙ্গে হোস্টেল। গেটে একদল ছাত্রী মেরীর গলায় ফুলের মালা দিয়ে নিয়ে গেল। জয়ন্তী নামে একটি মেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় গাইল আগুনের পরশ মণি ছোয়াও প্রাণে। আরেকজন পড়ল মানপত্র। এই স্কুলের একটি মেয়ে চাঁদকাঠি থেকে হেঁটে হেঁটে ক্লাসে এসেছে। নিয়মিত বৃত্তি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে। সরকারী কলেজের শিক্ষকও হয়েছে। এই স্কুলের জন্য এটা অত্যন্ত গৌরবের। হেড মাস্টার জানালেন—প্রতি বছর সেই মেয়েটির নামে একটি বৃত্তির ব্যবস্থা হবে।

অনুষ্ঠানের দরোজায় হোস্টোলের রাঁধুনে সুরোচনা দিদি দাঁড়িয়ে ছিল। হাতে তেল হলুদের দাগ। মেরীকে জড়িয়ে ধরল। বলল, মেরী দিদি। তুই আইজ মোর রান্না খাবা না?

মেরী সুরোচনা দিদির হাতে দুটো দশ টাকার নোট গুঁজে দিল। সুরোচনা দিদি জানে আজ হেড মাস্টার স্যারের বাড়িতে মেরীর দুপুরে নেমতন্ন। হোস্টেলে খাওয়ার সুযোগ নাই। তবু বড় আশা এই মেয়েটিকে আজ হোস্টেলের রান্না খাওয়ায়। যখন সে এখানে পড়েছে—তখন নিয়মিত খায় নি। মাঝে মধ্যে উঁকি দিয়ে বলেছে—অ সুরোচনা দিদি, খিদা লাগছে।

মেরী সুরোচনা দিদির হাত জড়িয়ে ধরেছে। আগের চেয়ে দিদি একটু শীর্ণ হয়েছে। বলল, বিয়া করলি কবে?

–দু বছর আগে।

–জানাইলি না ক্যান?

–জানামু ক্যামনে? মুই কি গ্রামে আছিলাম হে সুমায়?

–এই বুঝি জামাই। কাত্তিক ঠায়ুর গো।

সুরোচনা দিদি জামাই দেখবে কী—মেরীর হাতে মধ্যে এক পোটলা গজা গুঁজে দিল। আজ ভেজেছে। বলল, খাইও সোনা।

গজা খেতে ভারী মজা। মেরী সবটা খেল না। হাত ব্যাগে রেখে দিল। পরে খাবে।

বিভূতি কাকা মেরীর সঙ্গে এসেছেন। হাতে দানাদারের হাড়ি। বাটনাতলা থেকে হেঁটে ফিরতে হবে। মাটির রাস্তা। বড় বড় মাঠ। মাঠের মধ্যে নাড়া তুলছেন বুড়ো নীলরতন ঘরামী। লোকজন দেখে একটু থমকে গেছেন। হাতের চেটো চোখের সামনে নিয়ে দেখছেন। হেকে বললেন, কেডা যায়?

বিভুতি কাগা বললেন, মোগো মেরী। মেরী আইছে জামাই লৈয়া।

মেরীকে নীলরাতন ঘরামীর চিনতে কষ্ট হচ্ছে। একটু ভেবে বলল, যে মেরী ভয়ে পালাইছেলে? এদ্দিন আছেলে কই?

–ছোট পিসির লগে। নরসিংদি।

এবার নীলরতনের মনে পড়েছে। মাথা নেড়ে দুঃখ করলেন। বললেন, হা ভগবান—এইটুকু মাইয়ারও পলান লাগছে!

--না পলাইয়া উপায় কি? মার্ডার কেসের ভয়।

নীল রতন উঠে এলেন। হাতে কগাছা নাড়া। মাটি লেগে আছে। মেরী প্রণাম করতেই বললেন, অ মেরী– তুইতো দেহি বড় হইয়া গেছিস। তারপর কপালে হাত রেখে বলল, নাতনী—সব মিছা। ভগবান জানে তুই খুন করস নাই।

বিভুতি কাগা তার হাতে দুটো দানাদার দিতে গেল। নীলরতন ধুতির খুঁটে হাত মুছে দানাদার দুটো নিয়ে বললেন, আর দুইডা দেও। সোয়াদ আছে।

মুখে দিতে দিতে বললেন, অ মেরী গাইটা গাভিন হৈছে। বকনা নিবি না?

শুনে মেরী হেসে ফেলল। নীল রতনের কাছে ছোট বেলায় বকনা বাছুরের বায়না ধরেছিল। বহুদিন পরে বুড়ো এখন মনে করতে পারছে।

সর্পন বাড়ির ভিতর দিয়ে যাওয়ার আগেই উলুধ্বনি উঠল। এ বাড়ির বড় বউ ধানদুর্বা দিয়ে মেয়ে জামাই বরণ করে নিল। পথে যেতে যেতে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে লোকজন ছুটে আসছে। মেরীকে ছুঁয়ে দেখছে। আর জামাইকে দেখে ফিসফিস করে বলছে—বাহ। জামাই দেহি টুনির আগায় চৈতা টুপি। পুরা নব কাত্তিক গো।

রূপকুমারের শরম লাগে। মেরীর কানে কানে জিজ্ঞেস করে—টুনি কিরে ভাই? টুনি পাখি?

মেরী হেসে ফেলে। বলে, টুনি পাখি ক্যানে হৈবে। টুনি মানে বাঁশের আগার কঞ্চি। কঞ্চির আগায় টুপি দিছে। চিকন চাকন জামাই।

বিশ্বাস বাড়ির কর্তাবাবু একহাতে গরুর দড়ি আরেক হাতে দানাদার নিয়ে আশীর্বাদ করলেন—বেশ বেশ। সুখে থাক মা। সুখে মা। তিনি এক গোছা ধানের ছড়া হাতে গুঁজে দিলেন। বললেন, রূপেশ্বর ধান মা। রূপে গুণে রূপবতী থাইকো স্বোয়ামী সংসার নিয়া।

কর্তাবাবু খুব সাবধানী মানুষ। মাথায় টাক পড়েছে। তিনি তিনটি বিয়ে করেছেন। তবু নিঃসন্তান। তার টাকে ঝাঁক করে একটা চিন্তা এলো, আগের দিনে তিনি কী কইতেন? কি কইতেন তা তিনি সহসা মনে করতে পারছেন না। সুখে থাক স্বামী পুত্র নিয়া? না—স্বামী কন্যা নিয়া? না-স্বামী সন্তান লৈয়া? কোনটা ঠিক? তারপর তার মাথায় হাঁক করে প্রশ্ন এলো—কেন তিনি সন্তানের লগে সুখী হও মা বলেন নাই? কেন তিনি সন্তান শব্দটি বলতে ভুলে গেলেন? কর্তাবাবুর মাথা ধরেছে। তিনি পুকুরের দিকে গেলেন। এরকম চিন্তা তাঁর আগে ছিল না। এখন আসছে।

দাসবাড়ি থেকে জামাই-বরণ করেছে গোটা চারেক হাসের ডিম দিয়ে। আর কটা আমড়া। পাওয়া গেল দুটো ধুতি। আর গামছা। ধুতি কখনো পরা হয় নি। বিভূতি কাকা মাথা নেড়ে জামাইকে বললেন, নেও বাবা। নিতে হয়। তারপর পাড় নেড়ে চেড়ে দেখলেন। বললেন—মন্দ না। মোরো মানাইবে ভাল।

এ বাড়িতে রঞ্জিতের ঘরে কেউ নাই। তার বউ খুব ভোরে বাপের বাড়ি গেছে। আর রঞ্জিতে থানার ওসি সাহেবের সঙ্গে ফুসুর ফুসুর করে বলে গ্রামে ঠাঁই নাই।


৫. মুসলিম পাড়ায় গমন

এরপর মুসলিম পাড়া—নামে বিশাল। এখানে খাল বেঁকে গেছে। খালের মুখে বড় গোটা কয়েক ছৈলা গাছ জলের উপরে ঝুঁকে পড়েছে। এখানে এসে মেরীদের পা থেমে গেছে। মেরী একবার কাকার দিকে তাকাচ্ছে– আরেকবার গাছগুলোর দিকে তাকাচ্ছে। কাকা আকাশের দিকে। মেরী কাকার হাত ধরে বলল, কি করব কাগা? এই পথে যামু না? ফিইরা যামু?

তার কপালে ঘাম জেগেছে। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। তার কপালে ফ্যার আছে।

বেলা বেশ হয়েছে। বিভুতি কাকা ফিরে যাবে বলে ঘুরে দাঁড়াতেই ছৈলা গাছের আড়াল থেকে নৌকা বেরিয়ে এলো। গলুইতে ছবেদালি চাচা। ফাল দিয়ে নেমে পড়লেন। যেন কোনো মার্ডার কেসের আসামী ধরার জন্য ওৎ পেতে ছিলেন। তাকে দেখে বিভূতি কাকার প্রাণ আঁতকে উঠল। তিনি বিপদ বুঝতে পারছেন। এবার রক্ষা নাই। কী করবেন বুঝতে পারছেন না। ছবেদালি এত কাছে চলে এসেছে যে, দৌড় দেওয়ারও উপায় নাই। মেরী জামাই রূপকুমারের হাত চেপে ধরেছে।

ছবেদালি নৌকা থেকে নামলেন। হাত জোড় করে মেরীকে বললেন, মাগো, ছাওয়ালের বাড়ি না যাইয়া ফিরা যাবা ক্যামনে?

মেরী ছবেদালী চাচার পায়ে পড়ল। তার পায় চোখের পানিতে ভিজে গেজে। তাকে টেনে তুলে বললেন, কাইন্দা আর মোগো গুনাইগার কইরো না। না জাইন্যা তোমারে অনেক পেরেসানি দিছি। এর মাফ নাই।

ছবেদালির পাশে ফেলু শেখ। ফেলু শেখ আজ ছবেদালীর চাচার বাড়ি রূপবানের পালাটি গাবে। তার মনে হল, এই মাইয়া কোনজন–রূপবান না তাজেল? রূপবানের বিয়া হৈল প্রথম যুবতিকালে। মরা স্বামী রহিম তার কোলে। সে এখন মার্ডার কেসের আসামী। স্বামীর বাপে কয়—বিধবা বউয়ের ভাত নাই। সোজা বনবাস। বনবাসে রূপবান। আর তাজেলের বিয়া হইছে জেতা স্বামীর লগে। রূপবান ঘুটে কুড়ানী—তাজেল পাটরানী।

ছবেদালী চাচার ডাকে সাড়া না দিয়ে ফেরা কঠিন। তিনি সবাইকে নিয়ে তার বাড়ীতে ঢুকলেন। বাড়ির দহলিজে দুটো চেয়ার পাতা আছে। চেয়ারে একটি ছোট মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। ছবেদালি চাচা মিটি মিটি হাসছেন। মেয়েটিকে বলছেন, জামাই আইছে—বইতে দ্যাও।

কুটি মেয়ে সালমার নড়ন চড়ন নাই। চেয়ারে শুয়েই আছে। ঘুম বলে কথা।

মেরী কানের দুল খুলে সালমার কানে পরিয়ে দিল। তবু সালমার ওঠার নাম নাই। এ বাড়ীর নসি খালা বদনা ভর্তি পানি এনে রাখল পায়ের কাছে। বলল, মাইয়াতো মোগো। জামাই হইলে পর। হ্যার লাইগা ভাবনা আছে। তারপর সুর করে বলল–

বোনের দুলে
বোনের মন কি ভোলে।
জামাই আনছে কি?
মোহর ভাঙছে নি?

জামাই রূপকুমার সালমার হাতে কটা টাকা গুঁজে দিল। সালমা উঠে তাকে কদমবুসি করে বলল, বসেন গো দুলাভাই।

চেয়ারে বসার আগেই মেরীকে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল মেয়েরা। ছবেদালি চাচা কাকে যেন হেকে বললেন—অ কাশেম, সাক্কর কোরা চাইল নামা। আইজ জামাই ভোজ হইবে।

বিভূতি কাকা গদগদ গলায় বললেন, তাইলে অর বাপেরে খবর দেই।

ছবেদালি বললেন, তোমার চিন্তা নাই। হ্যারে খবর দেওন হইছে। কুদ্দুস চেয়ারম্যানও আইতেয়াছে। মাইয়া কি তোমগো একারই—মোগো মাইয়া না?

মাইয়া জামাই দেখতে মুসলিম পাড়া বিশাল গ্রামের লোকজন ছবেদালী চাচার বাড়ি চলে এলো। দুটো ছেলে উঠোনে সামিয়ানা টানিয়ে দিয়েছে। মসজিদের ইমাম সাহেব বাদ এষা এলেন। সঙ্গে গুয়ারেখার মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। তিনি বেশ বড় সড়ো একটা সুতোয় বোনা হাত পাঙ্খা এনেছেন। মাঝখানে লেখা—কীর্তি ছাত্রী মেরী রানীর শুভ পরিণয়।

শেখ বাড়ি থেকে এলো চকচকে তামার বদনা। খাঁ বাড়ির ছমিরউদ্দিনের বউ গামছা বোনে—দুটো গামছা দিয়ে বলল—বড় শান্তি লাগছে। আর পাওয়া গেল ফিনফিনে পাঞ্জাবী। ছবেদালী চাচীর দেওয়া ঝালকাঠির শাড়ি পরে খেতে বসল মেরী। নাকে নথ চাচীর। বললেন—অ জামাই –মোগো মাইয়া কেমুন?

জামাই বলার আগে ছবেদালি চাচা বলেন, মাইয়া মোগো ফাস্টো কেলাস ফাস্ট। হ্যারে মন্দ কয় কেডায়।

সবাই এসেছে। হাকিম মুন্সীর ঘরে তালা। হাকিম মুন্সী নিরুদ্দেশ। নতুন করে নিকে করছে দক্ষিণ দেশে। সেইখানে থাকে।

মেরী বলল, মুন্সী চাচী?

ছেবেদালি চাচি বললেন, আছে, কলাখালি। হ্যার পোলা রহিম যাওয়ার পরে এই গ্রামে আর আসে নাই। বাপের বাড়ী কলাখালির নদীর পানিতে ঘোরে। আর গুলাব গুলি দেখলে চিক্কুর পাড়ে। বলে—রহিম—অরে রহিম, তুই ক্যান গুলাব তুলতি গ্যালি বাপ। হ্যার মাথা ঠিক নাই।

শুনে মেরীর রক্ত হিম হয়ে আসে। মেরী বলে ওঠে, আমি তো রহিমরে মারি নাই। সেদিন বাগানে রইদের মদ্যে একা একা ঘুরতে বারণ করছি। আমি কি তারে নদীতে পাডাইছি?

চাচি বুঝতে পারেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, সবই আল্লার হুকুম। তুমি আমি কিছু না। তোমার কোনো দোষ নাই মাজান। আল্লার হুকুমে রহিমে নদীতে গেইছিলো।

আর আসে নাই মুসলিম পাড়ার ছক্কু মোল্লা। আসার মুখ নাই। ধরা খাইছে হ্যার জারি জুরি। সবাই জেনে গেছে এই সরলা মেয়ের নামে মার্ডার কেসের কিসসা বানিয়েছিল ছক্কু মোল্লা।

বিভূতি কাকা মেরীকে জিজ্ঞেস করল, সেদিন কী বার মা?

মেরী ভয়ে ভয়ে বলল, রবিবার।

সেদিন ছক্কু মোল্লা এসেছিল পুকুরের ধার দিয়ে। তখন বেলা হয়েছে। ব্যাপারী জেঠির বিকার দেখা দিয়েছে। রহিম গোপালের নাম ধরে আর্তনাদ করে চলেছেন। থামাথামি নাই। ছেলে মহিমের কাছে খবর গেছে।

কিরণময়ী ছক্কু মোল্লার দাঁড়ানোর ভঙ্গী দেখে কেঁপে উঠেছে। একটু সরে দাঁড়িয়ে বলছে, মেরীর বাবায় বাড়ীতে আছে।

ছক্কু মোল্লা তখন একটু নিচু গলায় বলল, যতীন দাদায় সাদাসিদা মানুষ। আপনেরেই কই। আপনের মাইয়া হাকিম মুনশির পোলারে মাইরা ফেলাইছে।

শুনে কিরণময়ী হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। বলে—পোলাতো জলে ভাইসা গেছে।

ছক্কু মোল্লা হাসল। বলল, আপনে গো বাগানে পোলাডা গুলাব টুকাইতেছিল। মেরী তারে বাগান থেইকা তাড়ায় দিছে। হেই দুঃখে পোলাডা আত্মঘাতী হইছে। হ্যার মরনের লাইগা আপনার মাইয়াই দোষী। পুলিশ আইতাছে। ফাঁসির লাইগা রেডি হন।

পুলিশ পরদিন এসেছিল। রঞ্জিতে সঙ্গে এসেছে। গুলাব বাগানে ঘুরেছে। নদীর ঘাটেও গিয়েছে। তখন ছক্কু মোল্লা যতীন হালদারকে বলেছে, ট্যাকা পঁয়সা বাইর করেন। পুলিশ ঠেকাই।

যতীন হালাদার তখন মাথা ঘুরে পড়েছে। রঞ্জিতে এসে বলেছে, মুসলিম পাড়ার লোকজন আইতে আছে। রহিমরে মারনের শোধ নেবে।

সেদিন রাতে লোকজন কিছু এসেছিল। তারা লুটপাঠও করবে বলে ঘোষণা দিয়ে গেছে।

সেইরাতেই মেরীকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল নরসিংদী।

এই দুঃখে ছবেদালি চাচা বিভূতি কাকার দিকে চেয়ে গর্জন উঠেন, মোগো এত ভয় পাইছিলা ক্যান? মোরা বাঘ না ভাল্লুক? ছক্কুর ভয়েই তোমরা মাইয়ারে দ্যাশ ছাড়া করলা। মোগো একবার জিগাইলাও না। এইদেশে কি ছক্কু ছাড়া আর মানুষ নাই? ফেরেব্বাস ছক্কুরে তোমরা চেনো না? রঞ্জিতেরে জানো না? হ্যারা কত মাইনসের সব্বোনাশ করছে?

বিভুতি কাকা ছবেদালির দুহাত চেপে ধরল। তারা ভুল বুঝেছিল। ছবেদালির ভয়ে পুরো মুসলিম পাড়াকেই শত্রুপক্ষ মনে করেছিল। আশঙ্কা করেছিল রহিম হত্যার দায়ে তারা মেরীর উপরে প্রতিশোধ নেবে।

সেদিন ঘুমুতে যাওয়ার আগে রূপকুমারের হাত মেরী হাত চেপে ধরল। ফিস ফিস করে রূপকুমারকে বলল, গুলাব গাছের নিচে যাবা না।


৬. গুলাব বাগান

খুব ভোরে রূপকুমারের ঘুম ভেঙে গেল। মেরী অঘোরে ঘুমোচ্ছে। মাঝখানের ঘরে মেঝের উপর ছোট পিসি। পাশের বাড়ির দুটো মেয়ে। আর লক্ষ্মীমতি বউটি খোকা কোলে ঘুমিয়ে আছে। লতিবুড়ির মাথার কাছে দোক্তা রেখে চক্ষু মুদে আছে। বারান্দায় শ্বশুর মশাই যতীন হালদার। পাশ ফিরে বললেন—দুর্গা। দুর্গা।

এ বাড়ির বেশ বড় উঠোন। শিউলীতলায় সোনা বসে আছে। ফুল কুড়োচ্ছে। ফিক করে সোনা হেসে ফেলল। ব্যাপারী বাড়ির সেজ কাকী উঠোনে গোবর ছড়া দিয়ে গেছেন।

উঠোনের পাশে গাদা ফুল গাছ। তারপরে বেগুন আর আনাজের ক্ষেত। বেশ কয়েকটা কড়াইগাছ উঁচু হয়ে আছে। একটা বড়ো সড়ো আমগাছের ডালে ডালে পরগাছা। তার মধ্যে ঘুঘু পাখি চুপ করে বসে আছে। লতি বুড়ির ঘুম ভাঙলে ঘুঘু পাখি ঘুঘুর ঘুঘুর করে ডাকবে। বলবে, অ বুড়ি গান গাও।

বুড়ি বলবে, কি গান গামু বেহানেশ্বর বেহানে?

–শুক সারির গান গাও।

–তুই গা। মুই দোক্তা কুটি।

ঘুঘু পাখি চেয়ে আছে। সে পাখি মানুষ। নাকি ফানুষ? কী গাইবে? লতি বুড়ির সামনে কি আর কেউ গাতক আছে?

এই বাড়ীর শিউলী তলার পাশে তুলশী বেদি। সাদা মাটি দিয়ে লেপা হয়েছে। সাজির মধ্যে রাখা হয়েছে মরিচ জবা। শিউলী ফুল তুলে সোনা দুর্বা তুলতে শুরু করেছে। কাকপায়া আর ভাদলা ঘাসের ভিতর থেকে দুর্বা বেছে বেছে রাখছে। সোনার পরনে নীল ডুরে শাড়ী। একটা মরিচ জবার বৃতি তুলে ফেলে বলল, অ জামাইদাদা, মধু খান।

মরিচ জবার গোড়ায় মধু আছে। ঠোঁটে দিয়ে চুষে খেয়ে দেখিয়ে দিল। ফিক করে হেসে বলল, জামাইদাদাগো– মধু খান। মধু বিনা বঁধু নাই । স্বাদু চিনে কদু খাই।

এ কদিন সোনা আসে নাই। রাজবাড়ী থেকে ব্যাপারী জেঠীকে নিয়ে এসেছে। আজ সূর্য ওঠার আগে এসেছে। চরাচার সোনা সোনা হয়েছে। ফুলে মধু দেখা দিয়াছে। মধু নয় গো সোনা।

বাগানের মধ্যে সোনা কাপড়টা একটু উঁচিয়ে হাঁটছে।বলছে, জামাইদাদা, দেইখা হাঁইটেন। চিনা আছে।

রূপকুমার জানতে চাইল, চিনা কি?

–জোঁক। চিনা জোঁক। রক্ত খায় চুক চুক কইরা। খুব সাবধান হে।

আমগাছের নিচে এসে সোনা একটা লাফিয়ে উঠে আমপাতা পাড়তে লেগেছে। ডাল একটু উঁচুতে। নাগাল পাওয়া ভার। এদকি ওদিক তাকিয়ে বলল—জামাইদাদা—আপনে অখন ঘরে যান। গাছে উঠুম।পঞ্চপল্লব পাড়ুম।

রূপকুমার বলল, উইঠা পড়ো। অসুবিধা কি?

–মুই ডাঙর মাইয়া। পুরুষ মাইনসের সামনে গাছ বাই কেমুন কইরা? নিন্দে হইব না!

রূপকুমার পা বাড়ালে সোনা বলল, যাইবেন না জামাই দাদা। ডালটা একটু নিচু কইরা ধরেন।

আমগাছের ডাল থেকে গুলঞ্চ লতা ঝুলছে। বেশ মোটা কাছি দড়ির মত। তার একটা লতা ধরে উঁচু হতেই আমডাল নাগালে পাওয়া গেল। ডালটা নিচু করতেই সোনার হাতে আমপাতা। সোনার হাতে বেল পাতা।

বাগানের পরেই পথ। পথের পাশে নালাবেড়– বাড়ির চারিদিকে সীমানা চৌহদ্দি। জোয়ারের জল এসেছে বেড়ে। এটা পার হলেই বেপারী বাড়ি। গোটা তিনেক জুবুথুবু ঘর। একটি ঘরের সামনে উঠোনে দাড়ি কাটছেন প্যান্টুলুন পরা লোক। সোনা চিনিয়ে দিল—ব্যাপারী বাড়ির মহিম দাদায়। ব্যাপারী জেঠিমার পোলা। ডাক্তার।

–এ গ্রামে ডাক্তারও আছে নাকি?

–থাকবে না ক্যান। আছে। আবার নাই।

খিল খিল করে হাসে সোনা। বলে, উনি ব্যাপারী জেঠির পোলা—কিন্তু ব্যাপারীগো পোলা নয়। বোজঝেন কিছু?

সোনা ফিস ফিস করে বলে, ছি ছি ছি। কি কই আপনেরে। কানে দিয়েন না। এ তল্লাটের সবাই জানে। জন্মের আগে মহিম দাদার বাপে স্বর্গে গেছে। পেট মোছা ছাওয়াল। লোকে কত কিছু কয়! এই ছাওয়াল আছে বইলাই ব্যাপারী জেঠি বাঁইচা আছে।

একদিন সোনা ছিল না। আজ এসেছে বলে এসব গুহ্য কথা সোনা গেল। সোনার কথার কোনো পাপ নাই। সবই স্পষ্ট কথা। ততক্ষণে সোনা ফুলের সাজিটি রেখে মাটি থেকে গুলাব গুলি কুড়োতে শুরু করেছে। কুড়িয়ে কোচড়ে রাখছে। গুলাব ভেঙে তেল হবে। তেলে পিদিম আঙাবে। সোনা গান ধরে–

শুনো তাজেল তাজেল গো
মন না জেনে প্রেমে মইজো না
তুমি তাজেল সর্বনাশা গো

এইটুকু গেয়ে সোনা রূপবান অথবা মালঞ্চমালার কিসসাটা থামায়। বলে, হ্যার চেয়ে গুলাব কুড়াই গো জামাইদাদা। গুলাবের সের দুই টেকা। টেকায় ঠেকা আছে।

বলেই সোনা দুহাত দুদিকে ডানার মত উঁচিয়ে গুলাব বাগানে পাখির মত ঘুরে ঘুরে ছুটতে লাগল। আর থেকে থেকে শালিক ডাক ডাকতে লাগল।

বাদুড় বাদুড় ছায়া/মোরে একটা গয়া। গয়া ভ্রমে বাদুড়গুলি ফল কুটুর কুটুর করে কামড়ায়। আর গুলাব বুইঝা নিচে ফেলায়। ইহারে কয় গুলাব গুলি।

বাগানে যুথি করে এক সারি চিকন চাকন গাছ। পাতা আমপাতা জামপাতা। হৃষ্টপুষ্ট সবুজ। ডালে ডালে গুলাব ধরে আছে। এটা গুলাব গাছ। গুলাব গাছ দেখে প্রাণ উড়ে যায়।

এ সময় ঘুম ভেঙে মেরী ছুটতে ছুটতে আসে। হাত ধরে টেনে নিতে নিতে বলে, তোমারে কইছিনা, গুলাববাগানে যাবা না। গুলাব বাগানে যাবা না।

মেরীর চোখ ফেটে বেরিয়ে এসেছে মেরীর। নাক ফুলছে। বুক দুলছে। ঘন শ্বাস ফেলছে। ভয়ে মেরী ঝড়ো কাক।

ছোট পিসি মেরীকে ধরেছেন। ঘরের মধ্যে নিয়ে গেছেন। লতিবুড়ি ঘ্যান ঘ্যান করে চলেছেন। অ মেরী, অহনও তর ডর গেল না। মাইয়া মাইনসের এতো ডর থাকলি চলে? হ্যার ডর থাকন লাগে শুধু সোয়ামির লাইগা, শাউড়ির লাইগা, শওরের লাইগা আর ভাসুর নন্দের লাইগা। হ্যার পরে আর কুনো ডর নাইগো মা। মাইয়া মাইনসের পরান—কচু পাতার পানি।

এর মধ্যে শিউলি তলায় সোনা ফুলের সাজিটি রেখেছে। আজ মাইয়া-জামাইয়ের গঙ্গা পূজা। একটি ঘটে তেল সিন্দুরে খাড়তে হবে। পুরান তেঁতুল ঘষতে হবে। কাঁসার ঘটিটি সোনার মত চকচকে হবে। সোনা জানে। সোনার কোচড়ে গুলাব গুলি। চাচর চুলে ভোরের নিশির। ঘুঘুটি ডাকছে ঘুঘুর ঘুঘুর। ও লতি বুড়ি—গান করো। লতি বুড়ি গান করে না। দুপা ছড়িয়ে ঠক ঠক করে দোক্তা বানায়। ভাঙা ভাঙা গলায় বলে, কপালের নাম গোপাল—গোপাল যে কহন আসে যায় –কহন যায়, হ্যার কি ঠিক আছে? মা যশোদা কি হ্যারে খালি খালি বান্দে? মা রাধা কি খালি খালি কান্দে? কে বাঁচে—কে বা মরে হেইডা কি গোপাল হালায় কেউরে কইছে কুনো দিন? তুই আমি কেউ না। কেউ নারে দিদি। কেউ না। তিনি হাসেন হাসি—মোরা তাহার দাসী। জনম ধইরা পরছি গলায় ফাঁসি।


৭. শাপমোচন

একটু বেলাবেলিই গঙ্গাপূজার জন্য গঙ্গা যাত্রা শুরু হল। আগে চলেছেন সোনার মা বিভুতি কাকীমা। হাতে সোনার ঘট। আমপাতা, দুর্বাশ্যামদল, ফুল আর ধান্যদানা। পাঁচ সিকার বাতাসা।এক শিশি তেল। আর এক কৌটো সিন্দুর। আর মাটির পিদিম। জ্বলছে দীপ শিখাটি। গুলাব তেলের পিদিম।

এই গুলাব তলা দিয়ে মেরী বহুদিন যায় না। আজ সে পথেই যাবে। যতীন হালদার মেরীর হাত ধরে আছেন। মেরী রূপকুমারের হাত। বিভুতি কাকার সঙ্গে ছোট পিসি। লক্ষ্মীমতি বউটির কোলে তার ন্যাংটা গোপাল। গোপালের হাতে সোনার সোনার খাড়ু। পায়ে মল। কোমরে ঝুনঝুনি। মুখের মধ্যে গোপাল আঙুল পুরে গো গো করছে। ছবেদালি চাচা আগেই এসে গেছেন। ইমাম সাহেবকে শুপারি গুলাব বাগান ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন। ইমাম সাহেব শব্দ করে সুরা ইয়াসিন পড়ছেন। মাথায় সাদা পাগড়ী। পাগড়িতে একটি গঙ্গা ফড়িং উড়ে বসেছে। চোখে সুরমা।

ইমাম সাহেব দুহাত তুলে মোনাজাত ধরেছেন। তিনি আয়ত গম্ভীর স্বরে বলছে—ইয়া হাবিব, তুমি পরওয়ার দিগার। তোমার ইশারা বিনা এ দুনিয়ার একটাও পাতা নড়ে না। তুমি জানো ইয়া মামুদ, এ গ্রামের মুহাম্মদ হাকিম আলী মুন্সীর একমাত্র পুত্র মুহাম্মদ রহিমউদ্দিন মুন্সি একদিন দুপুরর রইদে গুলাব বাগানে ঘোরাঘরি করছিল। তুমি জানো—এ গ্রামের যতীন হালদারের মাইয়া মেরী রানী হালদার অতিশয় কৃতি ছাত্রী, স্নেহহেতু মুহাম্মদ রহিমরে কইছে–ও পোলা এই রইদে তুমি মোগো গুলাব বাগানে আসিও না। হে খোদা, সেই নাবালেগ মুহাম্মদ রহিম কি বুইঝা কইছে—আর আসুম না। মুই আর আসুম না মেরী ফুফু। সেই মাছুম পোলার গুলাব বাগান থিকা চলে গেইছে। হে রহমানুর রহিম, তোমার অজানা নয়—এই মেরী মায়ে তারে হাচা হাচা গুলাব বাগান থিকা যাইতে কয় নাই। রইদে ঘুরতে মানা করিছে। তার মনে দোষ নাই। হে দো জাহানের মালিক, মহিম ব্যাপারীর মায়ে কালিগঙ্গার ঘাটে যাইতে আছিল গোসলে। রহিম তার লগে রওনা করিল হে খোদা। অসীম দয়ালু তুমি হে খোদা, মোগো এই মেরী মায়েরে তুমি মাফি করিয়া দ্যাও। হ্যার কুনো দোষ নাই। আর সেই মাছুম পোলা মুহাম্মদ রহিমউদ্দিনরে তুমি জান্নাতবাসি কর। তোমার দয়ার সীমা নাই—হে রহমানীর রাহিম।

ছবেদালি চাচা দুহাত চোখ মুছে বললেন, খোদা মেহেরবান। আমেন আমেন।

আমিন আমিন ধ্বনিটি গুলাবগাছের পাতা ভেদ করে বহু দূরে ছড়িয়ে গেল। দূরে কলবাড়ির চোঙে গিয়া ঠুন করে লাগল। আর কলটি ধুপ ধুপ করে শব্দ করে উঠল। বাঁশ বাগানের মাথার উপরে যে বক পাখিটি এসে মাঝে মাঝে বসে, সে হঠাৎ করে পাখা মেলল। আর একটি গুঁই সাপ সুড়ুৎ করে পুকুরের মধ্যে ফাল দিয়ে পড়ল। ছবেদালি চাচা এগিয়ে এসে মেরীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার কুনো দোষ নাই গো মা। তোমার কোনো কসুর নাই।

মেরী বিহ্বল হয়ে বলল, আমার কোনো দোষ নাই চাচা?

–নাই মা। আল্লাহ মেহেরবান—আল্লাহ পরম দয়ালু। তিনি তোমাকে দয়া করেছেন। তিনি সকলকে দয়া করেন।

তারপর খুব ধীরে ধীরে বললেন, ছক্কু মোল্লা তুমার নামে মিছা কথা রটাইছেলে। হ্যার লুটপাটের হাউস আছেলে। পারে নাই। লগে বাটনাতলার রঞ্জিতেও আছেলে। ওগো ক্ষমা কইরো মা।

লক্ষ্মীমতি বউটির কোলের গোপালটি মুখের ভিতরে হাতটি আবার পুরে দিয়েচে। গাল বেয়ে লাল পড়ছে। বেশ শব্দ করে বলছে—গা গা গা।


৮. রহিমবাদশার পুরনো কিসসা

গুলাব বাগান পেরিয়ে আম বাগান। তারপর কড়ুই গাছের সারি। এর মধ্যে দিয়ে নালা বেড়ের মাটি তোলা পথ।এই পথ থেকেই দেখা যায়– ব্যাপারী বাড়ির জেঠিমা বহুদিন পরে বাপের বাড়ি থেকে এসেছিলেন। সাধ গঙ্গা স্নানের। স্নান শেষে আবার ফিরে যাবেন বাপের বাড়ি। বিধবা বলে এ বাড়িতে তখন আর শক্ত ঠাঁই নাই। তখন ভরা ভাদর। তাল পড়ে ঠাস করে। ছনকুলু পাখি ডাকে। এর মধ্যে সেদিন রোদ উঠেছে। বেলী ফুল ফুটেছে। কোলে কাঁখে সামনে পিছনে একগাদা নাড়ু গোপাল। তিনি স্নানে যাচ্ছেন। সোনার মা আসতে দেরী করছে। সোনা আগে চলে এসেছে। গুলাব বাগানে রহিম গুলাব টুকাচ্ছিল। মেরীর ধমকে বাগান থেকে সরে এসে বাড়ির কোলে সিরিষ গাছের শেকড়ে আগডুম বাগডুম খেলছে। জেঠিমাকে দেখে খেলা ফেলে বলছে—অ জেঠি, মুই যামু তুমার লগে।

জেঠি বললেন, তর মায়ে কই?

–হাসু খালার বাড়ি ঢেঁকি পারায়।

–তর বাপে?

বাপের কথা সে জানে না। ঘাটে যেতে দেখে রহিম বায়না ধরে, মুই তুমার লগে গোসলে যামু ব্যাপারি জেঠি।

ব্যাপারী জেঠি কোলে কাখে গোপালগণসহ স্নানে যাচ্ছেন। হালদার বাড়ি পেরিয়ে হারু খাঁর বাড়ি। সে বাড়ির জোড়া মেয়ে– হাসি আর খুশি। গোপালগণের হা হা হি হি শুনে বেরিয়ে এসেছে। সোনার সঙ্গে আজ গোসল করবে। খুশি আবার মাছ ধরার ছাবিটা হাতে নিয়েছে। কলবাড়ির সামনে টুলু আকন ছিদেম ঘরামীর ধান ভানছিল। টুলু আকন ব্যাপারী জেঠিকে বলল, অ বৌদি, তোমার পোলার খবর কি?

জেঠি বলেন, হ্যায় তো মামা বাড়ি। ডাক্তারী পড়ে। বইরশ্যালে।

শুনে টুলু আকন খুশি হয়েছে। দুহাত তলে বলে, আল্লা মেহেরবান। তিনি তোমার পানে চক্ষু মেইল্যা চাইছেগো বউদি।

না চেয়ে উপায় কি? পোলা হওনের আগে হ্যার বাপে মরছে। তার গায়ে গতরে লাঞ্ছনা গঞ্জনা। বারদিন বয়সী পোলা লইয়া তিনি বাড়ি ছাড়ছেন। পথে পথে ঘোরেন। পেটে ভাত নাই। বুকে দুধ নাই। আঘাটে বাঘাতে ভুত প্রেত। বনে বাঘ। কে তারে বাঁচায়। আল্লা ছাড়া আর আছে কে এ ভুবনে?

কলবাড়ির সামনে ঘাটকূল। কালিগঙ্গা এইখানে একটু বাঁক ধরে ভারাণী খাল হয়ে ঢুকেছে। তারপর বাটনাতলা। জামিরতলা। রোঙ্গাকাঠি। ব্যাসকাঠি। শেষে রাজবাড়ি। রাজবাড়ির আগায় সন্ধ্যা নদী। ওপারে জলাবাড়ি।

এই ভারাণী খালে তখন ভাটা গোন। হাটু জল। ব্যাপারী জেঠিকে ছেড়ে গোপালগণ হাঁটু জলে নেমে পড়েছে। হৈ হৈ রৈ রৈ রবে ফালাফালি করছে। ব্যাপারী জেঠি এর আগে সবার আগে নিমপাতা আর কাচা হলুদ বাটা মাখিয়ে দিয়েছেন। তিনি জোড় করে গঙ্গা তর্পন করলেন। আর চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন—অরে অ গোপাল, তরা বেশি দূরে যাসনে। মোরে ধইরা থাক। তিনি সকাল শিশুর গা মাজন করছেন। তিনি তাদেরকে স্নান করাবেন। স্নান শেষে মিষ্টান্ন বিতরণ করবেন। আজ তিনি মা যশোধা। এইসব ননী চোরা ছাড়া তার আনন্দ কী?

খুশি মেয়েটা ছাবি পেতেছে খাল পাড় ঘেষে। বাঁশের কঞ্চির আগায় মশারীর এক টুকরো কাপড় বাঁধা। ভিতরে দিয়েছে খুঁদ কুড়ো। জলে ডুবিয়ে জল ছিটিয়ে দিতে দিতে বলছে—আইল বাইলি কাইলি হাঁক—আইসা পড়রে মাছের ঝাঁক। হারে কারে রে রে রে রে।

হাসি আর সোনা ছাবির দিকে ঝুঁকে চেয়ে আছে। আর তিনজনে মাঝে মাঝে বলছে– হারে কারে রে রে রে রে। মাছ সগোল আয় রে। বেলা যায় রে।

মাছ আসছে। কল বাড়ির শব্দ হচ্ছে। জোয়ার আসছে। ব্যাপারী জেঠি গোপালগণকে ঠেলে ঠুলে পাড়ে তুলেছে। গোপালগণ অতি চপলমতি। তারা একদিকে পাড়ে ওঠে—অন্যদিকে ঝপ করে জলে নামে। কেউ তারা থামে না। ব্যাপারি জেঠি চেঁচিয়ে বলছেন—অ সোনা, অ হাসি, অ খুশি—তরা অগগোরে ওডা। মুই তো একা সামলাতে পারি না গো মা।

ধানকলের ধুপ ধুপ শব্দ বাড়ছে। জোয়ার বাড়ছে। বুক সমান জল উঠছে। ব্যাপারী জেঠি গোপালগণের গাত্র মোছন করছেন। মোছন দিতে দিতে গুণছেন—এক গোপাল, দুই গোপাল, তিন গোপাল। আবার কি মনে করে গুণতে শুরু করেন—চার গোপাল, পাঁচ গোপাল…।

তার গায়ে জল লেগে আছে। তবু ঘেমে গেছ্নে। তিনি রহিম গোপালকে দেখছেন না। রহিম গোপাল গেল কই?

জলের দিকে তাকালেন। জল ছল ছল করে। জল খল খল করে। জলে নাই। রহিমের গলা শুনতে পারছেন না। চেঁচিয়ে তিনি বলছেন—অ সোনা, সোনা, দ্যাখতো—রহিম গোপাল গেল কই?

খুশির ছাবিতে মাছ উঠেছে। ছোট ছোট চেলা মাছ। আর গোটা কয়েক কুচো চিংড়ি। সোনা মাছ খাবলে তুলে কোচড়ে রাখছে। খুশি বলছে–কোচড়ে রাইখো না। ভাইসা যাইবেআনে।

সোনা বলে, বুক দিয়া আগলাইয়া রাখুম। যাইবে কই।

সোনা, হাসি—খুশি হেসে ওঠে। জলের স্রোত তীব্রতর হয়। ধানকলের শব্দ পাল্লা দিয়ে বাড়ে। ব্যাপারী জেঠি দেখেন—জলের স্রোতে টগরপানা ভেসে আসে—টানে দূরে চলে যায়। ডাবের খোসা ভেসে যায। পাক খেতে খেতে কী একটা মরা বন বেড়াল ভেসে মিলিয়ে যায়। মাছির ভ্যান ভ্যান শব্দ শোনা যায় না।

ব্যাপারী জেঠি জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন জল মাথার উপরে চলে গেছে। সাঁতরে সাঁতরে এপার ওপার করেন। রহিম গোপালরে তিনি দেখতে পান না। তাকে ঠেলে ভাসিয়ে দিতে চায় কালিগঙ্গার ফণাতোলা স্রোত। তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

এদিকে দেরী দেখে খুশির মা ডাকতে এসেছে। হাসি মায়ের বোল শুনে উঠে গেছে। ছাবিটাকে বাঁহাতে নিয়ে খুশি রওনা হয়েছে। সোনার সঙ্গে চলেছে মাছ নিয়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে চলেছে গোপালগণ। জলে গোপাল নাই। কুলে গোপাল নাই। জলে পাক খেতে খেতে,অ গোপাল অ গোপাল বলে হাঁক দিতে দিতে দিশাহীন ব্যাপারী জেঠি জল থেকে উঠে পড়েন। টুলু আকন বের হয়ে বলে, অ বৌদি, হ্যারা তো সগোলে বাড়ীর দিকে গেল।

ব্যাপারী জেঠি ব্যাকুল হয়ে বলেন, মোর রাম গোপাল? মোর রহিম গোপাল?

–হ্যারা সগগোলে গেইছে। আপনের চিন্তা নাই।

চিন্তাশূন্য হয়েই তিনি বাড়ির পানে ছুটলেন। গোপালগণ তখনো ফালিয়ে গালিয়ে ছুটছে। সঙ্গে সোনা। সোনা রূপবানের পালা গুণ গুন করতে করতে যাচ্ছে—

একটি পুত্র দেরে আল্লাহ,
একটি পুত্র দে,
কামাই খাইবার সাধতো নাইরে
মাটি দিবো কে?

সোনা যায় মাটিতে পায়ের জলছাপ ফেলে ফেলে। গোপালগণ যায় আগে পিছে। ব্যাপারী জেঠি তাদের পিছনে ছুটতে ছুটতে গোণেন—এক গোপাল, দুই গোপাল, তিন গোপাল। কী মনে করে ফের গুণতে শুরু করেন—চার গোপাল, পাঁচ গোপাল…।

আবার গোণেন। চেঁচিয়ে ওঠেন–মোর রহিম গোপাল কই? রহিম গোপাল কইরে সোনা?

সোনা বলে, হ্যায় গেছে বাড়ি।

–বাড়ি গেছে! হ্যায় বাড়ি যায় একা একা। একা একা আসে। একা একা যায়। রহিমের ভয় ডর নাই। একা যাইতে পারে গো জেঠি মা।

ব্যাপারী জেঠি রহিম গোপালদের বাড়ির উদ্দেশ্যে ছোটে। বাড়ির দরোজা বন্ধ। এক পাল কুড়হা কুক কুক করছে। উঠোন ফাঁকা। একাপাশে কিছু গুলাব শুকোতে দেওয়া আছে। একটা বিড়াল দাওয়ায় কুকড়ে মুকড়ে ঘুমিয়ে আছে। তিনি চেঁচিয়ে ওঠেন—অ রহিম গোপাল? রহিম গোপাল, বাড়ি আইছস বাপ?

রহিম গোপাল কোনো কোনো গুলাব গাছের নিচে থাকতে পারে। কোন গুলাব গাছের তলায়? এ বাড়িতে তো গুলাব গাছ নাই। তাইলে কোথায় যাই? একটি জাম্বুরা গাছের নিচে ধপ করে বসে পড়েন ব্যাপারি জেঠি। দূর থেকে শুনতে পান কলবাড়ির শব্দ– ধুপ ধুপ ধুপ।

দুপুর গড়িয়ে গেলে রহিমের আম্মা হাসু খালার বাড়ি থেকে ফেরে। কাখালে আধ ধামা চিড়া। কিছু চিড়া ভাজতে হবে। রহিম খেতে ভালবাসে। ঘরের বারান্দায় ধামাটা রেখে দেখতে পেল—আলু থালু বেশে ব্যাপারী জেঠি বসে আছে জাম্বুরা তলায়। তার চক্ষু থরথর। ছূটে এসে বলে, অ দিদি, দিদি?

অনেক ক্ষণ পরে ব্যাপারী জেঠি ঘোলাটে চোখে বলে, রহিম গোপাল কই? মোর রহিম রহিম গোপাল কই?

ঘুমন্ত বিড়ালটি লেজ তুলে উঠে আসে। বলে ম্যাঁও।


৯. ইমাম সাহেবের গল্প

আজ কলবাড়ির ঘাটে ভাটা গোন। খালের মধ্যে জাগনা কাদামাটি জেগে আছে। ফাঁকে ফাঁকে বালি। মাঝখানে সোতা। সোনার মা জলে ও কাদায় থালাটি রাখেন। থালার উপরে ঘট। ঘটের ভিতরে জল। জলের মধ্যে পঞ্চপল্লব। আর বেল পাতা। ধান ও দুর্বা তিনি জলে দেন। দেন কিছুটা তেল আর তেলে উপরে সিদুর। তেল সিঁদুর জলে দিতে দিতে গুলাব পিদিমটি জ্বেলে দিল মেরী। জল বাড়ছে। পিদিমটি কাঁপছে। পিদিমটি ভাসছে। পাড়ে ছবেদালি চাচার কাছে ফেলু শেখ বসে আছে। সে রহিমের মায়ের সন্ধানে কলাখালি গিয়েছিল। কলাখালি ঘুরে তার আসতে দেরী হয়েছে। একটি আলম বিড়ি ধরিয়েছিল। আঙুলের ফাঁকে বিড়িটি নিভে গেছে। রহিমের মায়ের কোনো সন্ধান সে করতে পারে নাই। লোকে বলে, মাঝে মাঝে রহিমের মা গুলাব গাছের তলায় ঘোরে। ঘরে আসে না। জলে জলে রহিমরে খুঁজে বেড়ায়। ফেলু শেখ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। রহিম বাদশার নামে নতুন একটা নয়া পালা মনে মনে লিখতে শুরু করল।

ঘাটে তিলি বুড়ির আসার সাধ ছিল। বুড়ির ঘুম পেয়েছে। ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে গান গায়–ওগো বন বিবি, তোমার বাল্লক এলো বনে, থাকে যেন মনে। দোহাই মা বরকদের। দোহাই মা বরকদের।

এই গান গাইতে গাইতে তিলি বুড়ি বারান্দায় মাটির উপরে শুয়ে পড়েছে। মাথার কাছে দোক্তা। উঠোনে একটু কুকুর লেজ তুলে ঘুরছে। বাঁশ বাগানের ভিতর থেকে কট কট শব্দ হচ্ছে। ব্যাপারী বাড়িতে সোনা ব্যাপারী জেঠিকে আগলে রেখেছে। তার পেটপোছা পোলা মহিম গোপাল সবার সঙ্গে আলাপ সারছে। তারা ফাঁকে ফাঁকে গুড়ুক খাচ্ছে। আর তুড়ুক তুড়ুক করে বলছে—তুমি মোগো ডাক্তার পোলা। তর উপ্রে কথা নাইরে বাপ। শুনে পোলার হাই ওঠে। জেঠিমা রূপসুন্দরী দাসী সোনার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলে—অ গোপাল। মোর রহিম গোপাল গেলে কই?

তার চোখ উদ্ভ্রান্ত। এই দশা তার কাটে না।

সোনা জেঠিকে ধরে আছে। সোনা জানে–তাকে ধরে থাকতে হবে। তারপর জেঠি এলিয়ে পড়বেন—ঘুমিয়ে পড়বেন সোনার কোলে। সোনার কোল ছাড়া আর কি আছে এই ভবে? এই কোল থেকে কে কেড়ে নেয় গো দাইমা, দাইমা গো।

এই পথ দিয়ে ইমাম সাহেব বাড়ি যাবেন। তার বাড়ি রায়েন্দা। কালিগঙ্গা নদী পার হলে বলেশ্বর। তারপর পানঘুচি। তারপর কচা। তারপর রায়েন্দা। ইমাম সাহেবের চোখে সুরমা। মাথায় পাগড়ী। তিনি কোনো এক বিপদনাশি সুরা পড়ছেন। পড়ে তিনি একবার আকাশ পানে চাইলেন। হাততালি দিলেন। আকাশে এক ঝাঁক বক পাখি। তিনি নদীর দিকে যেতে যেতে বলছেন—হক মওলা। আল্লা মেহেরবান।

Post a Comment

0 Comments