কুলদা রায়ের গল্প : ক্রসফায়ারের পরে যা যা ঘটেছিল


সেদিন আকাশটা ফর্শা হওয়ার আগেই ঘুম টুটে গেল মন্নান মণ্ডলের। তার বাহ্য পেয়েছিল। কী এক ঘোর পেয়ে খালপাড়ে হেঁটে গেল। তখন জল স্থির। হালকা হাওয়া এসে চোখে লাগে। আর তখনই মন্নান মণ্ডল আবছা মতো দেখতে পেলো, নল বন থেকে একটা পা বেরিয়ে এসেছে। তবে সেটা সত্যি সত্যি কোনো পা কিনা তা নিশ্চিত হতে কাছে গেল না। তার ভীতু মন। গা ছম ছম করতে লাগল। সে ছুটে বাড়িতে চলে এলো।

ঘরে তার স্ত্রী মর্জিনা পা জড়োসড়ো করে ঘুমিয়ে ছিল। তাকে ঠেলা দিয়ে উঠিয়ে গো গো করতে লাগল। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে কী হয়েছে বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। তাকে কোনো সুযোগ না দিয়েই মন্নান মর্জিনাকে টানতে টানতে খালপাড়ে নিয়ে এলো।

ভালো করে নজর করতেই মেয়েমানুষটির মনে হলো, এটা ঠিক মানুষের পা নাও হতে পারে -- আবার হতেও পারে। দূর থেকে ঠিক ঠাওর করতে পারছে না। এমনকি এটা হিন্দুদের পূজার মূর্তি টুর্তিও হতে পারে। কেউ হয়তো মন্দির ভেঙ্গে দখল করেছে। মূর্তি টুর্তি খালে ফেলে দিয়েছে। তবে এ গ্রামে হিন্দুরা নেই। যারা ছিল তারা চলে গেছে। মন্দির ফাঁকা পড়ে আছে। মূর্তি নেই।

সে সময় মাঠ থেকে এলাকার ফেলা মোল্লা উঠে এলো। তার বয়স হয়েছে। এক সময় দাঙ্গাবাজ হিসেবে তার নাম দশ গ্রামে বিখ্যাত ছিল। কোর্টকাচারিতে সাক্ষ্য দিতে ডাক পড়ত। আড়ালবাবডাল থেকে মন্নান আর মর্জিনাকে ফেলা মোল্লা লক্ষ্য করে দেখল। তারপর খুব সন্তর্পণে তাদের পেছনে এসে বড়ো করে গলা খাকরি দিল। বলল, কী হইছেরে মন্নান?

মন্নান কী বুঝল কে জানে, মর্জিনার হাত ধরে অল্প অল্প কাঁপতে থাকল। তার মুখে কোনো আওয়াজ নেই। মর্জিনা কপাল মাঝ অব্দি ঘোমটা টেনে নিয়ে বলল, কিছু না চাচা। কিছু হয় নাই।

ফেলা মোল্লা সামনে এগিয়ে গিয়ে জলের দিকে তাকাল। ততক্ষণে সূর্য উঠি উঠি করছে। নলবনের দিকে তাকিয়ে বলল, সর্বনাশ। করছিস কী?

শুনে মর্জিনা উত্তর দিল, আমরা কিছু করি নাই।

--সেটা কইলে তো কাজ হবে না রে মন্নানের বৌ। দেখতেছি তো ওইখানে ঝামেলা একটা আছে।

মর্জিনা এবারে সতর্ক হয়। ফেলা মোল্লার চোখে ছানি পড়েছে বহুদিন হয়। ডাক্তার ছানি কাটার কথা বলেছে। কিন্তু তার সন্দেহ হয়, ছানি কাটতে গিয়ে ডাক্তার তার পুরো চোখ দুটোই না একেবারে তুলে ফেলে। তার শত্রুর অভাব নেই। আবছা হলেও কিছু কিছু তো দেখে। তার শকুনের চোখ। তাতেই সে অন্যদের চেয়ে ভালো দেখে।

মর্জিনা তাকে বলে, কোনো ঝামেলা নাই। উনি বাহ্যে এসেছিলেন। আমি তারে নিতে আইছি। এর বেশি নাই।

বলে মর্জিনা তার খসমের হাত ধরে টেনে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। পা বাড়িয়ে দুপা যেতেই ফেলা মোল্লা মর্জিনার হাত টেনে ধরল। বলল, ওরে তোরা যাসনি। আগে ঝামেলাটা ফয়সালা করে নেই।

মর্জিনার গা রিরি করে উঠল।এই বেহানেশ্বর বেহানে ফেলা মোল্লা ফাঁক বুঝে তার হাত টেনে ধরেছে। সঙ্গে খসম। তার চ্যাতভ্যাত নেই।আছে আপন মনে। এর মধ্যে এলাকার লোকজন দেখে ফেললে বিপদ। মর্জিনা ফোস ফোস করে বলে উঠল, হাত ছাড়েন।

হেসে ফেলা মোল্লা বলল, সেতো ছাড়ব রে নাতিন। তার আগে ক তো দেখি-- কী দেখিস?

মর্জিনা ছাড়া না পেয়ে বলল, ফড়িং। ফড়িং দেখছি।

--আর কী দেখছিস?

--কচুড়িপানা।

-- আর?

-- নলবন।

--সেতো বুঝলাম নাতিন। এরপর কী দেখিস?

এবার মর্জিনার মুখে কোনো কথা সরে না। বুড়ো ফেলা মোল্লার হাড় জিরজিরে আঙুল তার হাতে আরো জোরে চেপে বসে। ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে। সহসা বলে ওঠে, জুতো দেখতিছি।

এবার হাত ছেড়ে দেয় ফেলা মোল্লা। হু। তাইলে তো কাছে যাওন লাগে।

কাছে যাওয়ার জন্য মর্জিনাকে যাওয়ার জন্য বলতে গিয়েও বলল না। মাইয়া ঝুত মানুষ-- তাগো বিশ্বাস নেই। তার বদলে মর্জিনাকে পাঠিয়ে শেখ বাড়ির রহিম শেখকে ডেকে আনল। বেচারী রহিম শেখ বড়ো ভিতু মানুষ। তার উপরে ফেলা মোল্লা। কী ঘটাবে কে জানে। কাচুমাচু করে জানাল, কাল রাত থেকে জ্বর জ্বর লাগছে। আজ জলে নামতে পারবে না।

--সে তো বুঝলামরে শেখের পো, কিন্তু এটা তো মার্ডার কেস লাগে। না নাইমা তো উপায় নেই।

শুনে রহিম শেখ আরো বেঁকে বসল। বলল, তাইলে তো নামাই যাবে না। আগে চৌকিদারকে খবর দেই। সে আসুক। তারপর তার সামনে যা করার করা যাবে।

চৌকিদার এলো চোখ মুছতে মুছতে। কাল একটু গাঁজা টানা বেশি হয়ে গিয়েছিল। তাই পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল। খবর পেয়ে আর দেরী করেনি। ঢুলতে ঢুলতে এসে পড়েছে। এসে ঠিক ঠাওর করতে পারছে না বিষয়টা। একবার সে লোকগুলোকে দেখে। একবার নলবনের দিকে তাকায়। যা দেখে সব ধোঁয়া ধোঁয়া দেখে। তার মনে হয় আরেকবার গাজায় দম দিতে পারলে ধোঁয়া ধোঁয়া ভাব কেটে যেতো। কিন্তু গাজার কলকি আনতে ভুলে গেছে।আরো ভুলে গেছে দড়িদড়া আনতে। জিব কেটে বলল, এই রে। এখন কী করে আসামীকে বাঁধবে? তার কাজ হলো যে কাউকেই ধরে আসামী হিসেবে বেঁধে ফেলা। পুলিশের হাতে সোপর্দ করা। তারপর পুলিশ বুঝবে। সে ছুটল মাঠের মধ্যে গরু খুঁজতে। গরু পেলেই দড়ি পাবে।

তাকে ছুটতে দেখে ফেলা মোল্লা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, যাস কই?

-- মার্ডার কেস। বলতে বলতে মাঠের মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ল চৌকিদার।

ফেলা মোল্লা খুব অভিজ্ঞ লোক। এসব জানে। তাই চেয়ারম্যানকে খবর পাঠিয়ে দিয়েছে।

এর মধ্যে বেলা উঠে পড়েছে। বেশ কিছু লোকজনও জড়ো হয়ে গেছে।

চেয়ারম্যান এসে পড়লেন তার ভটভটিতে। তার হুকুমে গ্রামের এক তাগড়াই যুবক মালকোছা মেরে খালে নেমে পড়ল। জল কেটে কিছুদূর আগাতেই একটা জল বোড়া তার দিকে চোখ বাঁকিয়ে সরে গেল। আর তক্ষুণি তার নাক কুঁচকে গেল। আগাবে কি আগাবে না এই নিয়ে দোনামোনাকরতে লাগল।

চেয়ারম্যান চেঁচিয়ে উঠলেন, কীরে থামলি কেনো?

যুবকটি নাকি সুরে উত্তর করল,গন্ধ।

--কী গন্ধ?

--পঁচা গন্ধ। পেট মোচড়াইয়া ওঠে।

শুনে খালপাড়ে উপস্থিত কেউ কেউ নাক টানতে থাকে। তারা অচিরেই আবিষ্কার করে তারাও গন্ধ পাচ্ছে। হয়তো আগেই পেয়েছিল। টের পায়নি। মর্জিনা বিবি একটু ওয়াক ওয়াক করে নাকে আঁচল চাপা দিল। আর কেনো নিজেকে জীবনে প্রথম বারের মতো গর্ভিনী গর্ভিনী মনে হয়। তাকিয়ে দেখতে পেলো, তার খসম আশশেওড়া গাছের নিচে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ।

চেয়ারম্যান তাকে মোলায়েম কণ্ঠে বললেন, তাগড়া জোয়ান তুই, গন্ধে থামলে চলে?

যুবকটি আগালো না বটে, তবে সে নাক চেপে ধরে নলবনের দিকে ভালোভাবে নজর করে দেখতে দেখতে হঠাৎ করে ফিসফিস করে বলল, পাঞ্জাবীর মতো লাগে।

লোকজন একটু নড়েচড়ে ওঠে। চেয়ারম্যান হাঁকেন, কী দেখলি-- পাঞ্জাবী?

-- তাই তো মনে হয়। নকশাদার পাঞ্জাবী।

শুনে চেয়ারম্যান চেঁচিয়ে যুবকটিকে হুকুম দিলেন, আর এগুসনি। ফির‍্যা আয়। কয়দিনের মড়া কে জানে! পুলিশ ছাড়া নলবনের কাছে যাওয়া ঠিক হবে না।

পুলিশের কথায় উপস্থিত লোকজন উসখুস করে ওঠে। কেউ কেউ ভয় পায়। কেউ কেউ চলে যেতে উদ্যত হয়। আবার ফেলা মোল্লা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।

মর্জিনা বিবি এই ঝামেলার মধ্যে জড়াতে চায় না। সে তার খসমের ঘুম ভাঙাতে চেষ্টা করে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওঠো। আর দেরি করা ঠিক হবে না। মন্নান মণ্ডল পিটপিট করে কয়েকবার চোখ মেলে বটে, কিন্তু আবার বন্ধ করে ফেলে। গো গো করে কিছু বলার চেষ্টা করে। তাদের দেখে ফেলা মোল্লা হা হা করে ওঠে।বলে,না। তোমরা কিন্তু যাবার পারবা না। তোমরাই আগে দেখছ। পুলিশ এসে তোমাদের জবানবন্দী নেবে।

ততক্ষণে চেয়ারম্যান থানায় ফোন করবেন বলে মনোস্থির করে ফেলেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে পড়বে।

উপস্থিত লোকজন তখন চিন্তায় পড়ে। তারা ভাবতে চেষ্টা করে যদি এটা ডেডবডিই হয়ে থাকে তবে কার ডেডবডি? আর কীভাবেই জলজ্যান্ত লোকটি ডেডবডি হলো?

একাত্তরে এ এলাকায় পাকবাহিনী বেশ কিছু মানুষকে মেরে ফেলেছিল। সে সময়ে খালটি ছিল বেশ খরস্রোতা। অন্য এলাকা থেকেও গুলিখাওয়া মানুষের ডেডবডি এইখালে ভেসে আসত। পরে চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের সময়ও অনেক মরা মানুষকে ভেসে আসতে দেখা গেছে। মর্জিনা বিবির এক ফুফু সে সময়ে গলায় কলসি বেঁধে খালে ডুব দিয়েছিল। পরে এই নল বনেই তার ডেডবডি আটকে থেকেছিল। একবার সর্বহারা দলের লোকজন কারো কারো গলা কেটে ফেলে রাখত। ফেলা মোল্লার মেজো ভাইকে মেরে লিখে রেখেছিল-- পুলিশের দালালরা হুশিয়ার সাবধান।

তবে, গলাটি কেটে ফেলে রাখলেও সেটা সরানোর অতো হিম্মত কারো ছিল না। শোনা যায় মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে ফেললেও বেশ কিছু সময় ধরে ‘পানি’ ‘পানি’ করে চিৎকার করছিল। তারপর বেলা দুপুর নাগাদ সেই গলার স্বর থেমে গেলেও চোখ চোখ পিট পিট করেছিল। তার সন্ধ্যাকালে সেই মাথাটিকে আর দেখা যায়নি। তবে মাঝে মাঝে মাথাটিকে ভাসমান অবস্থায় এই এলাকায় অনেকেই দেখেছে। মাথাটি এখনো পানি খুঁজে বেড়ায় বলে কেউ কেউ এখনো বিশ্বাস করে।

আরো শোনা যায়, যে গলাকাটা পার্টি তার গলা কেটেছিল পরে তাদেরও গলাকাটা গেছে অন্য কোথাও। এর পছনে কাটা মাথার প্রতিহিংস কাজ করেছে বলে অভিজ্ঞমহলের ধারণা। সে যাই হোক না কেনো এই কাটা মাথার ভেসে বেড়ানো, তাদের প্রতিহিংসা বা গলাকাটা পার্টির নিজেদেরও গলা কাটা যাওয়ার ভজকট কাহিনী এই এলাকায় দীর্ঘদিন চাউর ছিল বলে এরপর এ এলাকায় দ্বিতীয় কোনো ডেডবডি পড়তে দেখা যায় না বহুদিন।

তাহলে আরেকটা সম্ভাবনা থাকতে পারে। সেটা হলো আত্মহত্যা। আত্মহত্যা কেউ করে থাকলে এতোদিনে তা গোপন থাকত না।সাড়া পড়ে যেতো। এমনকি আশেপাশের দু দশ গ্রামের কেউ আত্মহত্যা করলে বা বেঘোরে মারা পড়লে জানা যেতো।

উপস্থিত লোকজনের মধ্যে একজন স্কুল মাস্টার বলে ওঠেন, তাইলে এটা ক্রসফায়ার হতে পারে। তখন সবাই মাথা নাড়ে। তারা টিভিতে প্রায়ই ক্রসফায়ারের খবর শুনে থাকে। পুলিশ বা এলিট ফোর্স কোনো ভয়ানক দুর্বৃত্তকে নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে গেলে আগে থেকে সেখানে ওৎ পেতে থাকা দুর্বৃত্তদের সহযোগিরা পুলিশের উপর গুলি বর্ষণ করায় পুলিশ পাল্টা গুলি ছোড়ে। ঘটনাস্থলে আটককৃত দুর্বৃত্তটি নিহত হয়। একজন পুলিশ সামান্য আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এই বয়ানের পুরোটাই লোকে মুখস্ত বলতে পারে বলে সবাই আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। এভাবে দেশে আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলেও সেই খবরে দাবী করা হয়। তবে এই এলাকায় এখন পর্যন্ত কোনো ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেনি বলে চেয়ারম্যানের মনে একটু উসখুস ছিল।

তখন চেয়ারম্যান ফোন করলেন থানায়। থানার ওসি ক্রস ফায়ারের কথা শুনে অবাক হলেন। বললেন, তারা এ এলাকায় কোনো ক্রসফায়ার করেনি। তবুও নিশ্চিত হতে তিনি তার অধীন সব ইনস্পেকটর ও সাব-ইনস্পেক্টরদের কাছে ফোন করলেন। অনেক সময় এরাও নানাভাবে কিছু কিছু ক্রসফায়ার করে থাকে উপস্থিত মতে। থানায় জানানোরও দরকার হয় না। শুধু পত্রপত্রিকায় খবর হলেই কিছু ব্যাখ্যা দিতে হয় মাত্র। সেজন্য স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে তারা ঘটনার আগে বা পরে একটু যোগাযোগ করে নেয়। ঝামেলা হয় না। খবরটি কণ পত্রপত্রিকা বা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় না। হলে একটা প্রেসনোট দিলেই সব ঠাণ্ডা।

থানার সব ইনস্পেক্টর ও সাবইনস্পেক্টর ওসিকে মান্য করে। তাকে জানিয়ে শুনিয়ে এরা সব কাজ করে। আদায়কৃত টাকাপয়সার বিলি-ব্যবস্থাতেও শৃংখলা আছে। উপর মহলও তার পরে সন্তুষ্ট। কিন্তু তারা নিশ্চিত করল ওসির নির্দেশের বাইরে কোনো ক্রসফায়ার করেনি তারা। তবে ক্রসফায়ার করতে তারা সদাপ্রস্তুত। নির্দেশ দিলেই হবে। কাকে বা কাদেরকে ক্রসফায়ার করতে হবে সেটা না জানালেও চলবে।

থানার ওসি খুব করিৎকর্মা লোক। তিনি এলিট ফোর্স অফিসে ফোন করলেন। এলিট ফোর্সের স্টেশন কমান্ডার বললেন, গত তিন মাসে তারা কোনো ক্রস ফায়ার করেনি। স্থানীয় এক নিরীহ সাংবাদিক এলাকার মন্ত্রীর ভাগ্নের ভূমিদখল নিয়ে সংবাদপ্রকাশ করেছিল। সেই সাংবাদিককে ক্রসফায়ার করার পরে দেশী বিদেশে হৈচৈ হয়েছিল। তারপর থেকে কিছুদিন দিন অভিযান বন্ধ রেখেছে। তবে তারা না করলেও ঢাকা থেকে এলিট ফোর্স টিম তাদের এলাকার ক্রসফায়ার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

স্টেশন কমাণ্ডার ঢাকায় ফোন করলেন। তারা গত পনেরো দিনে এ এলাকায় পাঁচটি ক্রসফায়ার করেছে। তবে--

--তবে?

--তবে কাগজপত্রে পাঁচটির রেকর্ড নেই। আছে চারটির। আরেকটি যে কোথায় কখন কিভাবে করেছে সে তথ্য নেই।

--কেনো নেই?

এর কোনো জবাব নেই। তবে যে কোনো ক্রসফায়ারের আগে দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত টিম মেম্বররা একটু মদ্য পান করে থাকে। দিন রাতে চার চারটি ক্রসফায়ার করার পরে তারা সেদিন খুব বেশি টায়ার্ড হয়ে পড়ে। সেজন্য তারা আরেকটু পানের ইচ্ছে করে। তবে বোতল ততক্ষণে খালি হয়ে যাওয়ায় দেশি মাল জোগাড় করে খেয়েছে। এজন্য তারা একটু বেসামাল হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় অফিসের লক্ষ্যমাত্রা পুরণের জন্য পঞ্চম ক্রসফায়ারটি করে যথাযথভাবে। কিন্তু অফিসে ফিরে চারটি ক্রসফায়ারের তথ্য লিখতে পারলেও পঞ্চমটি লেখার আগে তারা গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন তারা পঞ্চমটির কথা ভুলে যায়। তার কোনো স্মৃতি তাদের মাথার মধ্যে খুঁজে পায় না। এজন্য তারা দেশী মালকেই দায়ী করে। এবং সিদ্ধান্ত নেয়, সেই দেশি মাল যে লোকটি দিয়েছিল তাকে আগামীতে ক্রসফায়ার করবে।

ওসির কাছে মজা খালের মধ্যে নলবনে মৃতদেহটির কথা শুনে তারা বলল, এটা ক্রসফায়ারই হবে। এবং তারা আরো জানায় সেদিন যে পঞ্চম ক্রসফায়ারটি করে তার তথ্য ভুলে গিয়েছিল সেটা তারাই করেছে। এখন তাদের দিব্যি মনে পড়ছে।

তারা আরো জানায় এই খালপাড়ের ক্রসফায়ারের তথ্য তারা তাদের অফিসিয়াল রিপোর্টে এখন লিখে নিচ্ছে। কিন্তু মৃত লোকটির নাম জানা নেই বলে রিপোর্টে নামের জায়গাটি ফাঁকা রাখছে আপাতত। তাদের টিম এখনই রওনা হচ্ছে সেখানে। লোকটি নাম ধাম জেনে রিপোর্ট ফাইনাল করবে। তারপর পত্রিকায় একটি প্রেসনোট দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। পুলিশ যেন ডেডবডির নাম পরিচয় যোগাড় করে রাখে।

ততক্ষণে পুলিশ চলে এসেছে খালপাড়ে। এ এলাকা খুব নিরিবিলি। কোনো ঝইঝামেলা হয় না বললেই চলে। ক্রিমিনাল রেকর্ড ফর্শা। এ কারণে পুলিশের মন এ এলাকায় নেই।কেস কারবারি না থাকলে পুলিশের চলে না। বসদের খুশি করা যায় না।

এবারে পুলিশের খুশি খুশি ভাব জাগে। তবে আরো খুশি হতো যদি এলিট ফোর্সের বদলে তারাই ক্রসফায়ারটি করতে পারত। পুলিশকে হাসতে দেখে মানুষের মুখ শুকিয়ে যায়।

পুলিশ প্রথমে জলার কাছে যায় না। তারা খোঁজ নিয়ে শুরুতেই জেনে নেয় কে প্রথম লাশটি দেখেছিল। মন্নান মণ্ডল ততক্ষণে নাক ডাকছিল। তার বৌ মর্জনা পাশে বসে তার গা থেকে শাড়ির আঁচল দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছিল। পুলিশকে দেখে সে মাথায় ঘোমটা টানল।

পুলিশ মন্নান মণ্ডলকে ওঠার নির্দেশ দিলে মর্জিনা বলল, হ্যায় কোনো কথা কয় না। যা কবার আমারে কন।

পুলিশ একটু বিরক্ত হয়ে বলল, কথা কয় না, কবে না?

--কইতে পারে না।

--পারবে। দু ঘা পড়লেই পারবে।

বলে ঠেলা মেরে মন্নান মণ্ডলের ঘুম ভাঙালো তারা। সাব ইনসপেক্টর তাকে জিজ্ঞেস করল, বল, কী দেখছিস?

মন্নান কিছু বুঝতে না পেরে গো গো করতে লাগল। মর্জিনা বিবি তার হয়ে বলল, বাহ্য পাওয়ায় তার ঘুম ভেঙ্গে খালপাড়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে নলবনে ঠ্যাং দেখছে।

--কার ঠ্যাং?

--হ্যায় তো জানি না।

--জানিস। জানিস।এখন কবি না। দু ঘা পড়লেই কইয়া ফেলবি।

শুনে মন্নান মাথা ঝাঁকায়। আর মর্জিনা বিবি তাকে ধরে রাখে। বলে, হ্যায় পাগল কিসিমের মানুষ। হ্যারে কিছু জানে না স্যার।

উপস্থিত লোকজন সেটা সমর্থন করে মাথায় নাড়ায়।

--তাইলে কে জানে? বলে পুলিশ উপস্থিত লোকজনের দিকে তাকায়। তারা কিছু বলে না। তারা ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকায়। ফেলা মোল্লার দিকে চোখ পড়তেই সে বলল, এই গ্রামে কোনো লোক মারা পড়েনি। যদি হয় তো অন্য গ্রামের কেউ হতে পারে।

শুনে পুলিশ ভ্রু কুঁচকে থাকে। গ্রামের লোকজনের দিকে ঘুরে ঘুরে তাকায়। তাদের কেউ কেউ মাথা নাড়ায়। কেউ কেউ নাড়ায় না। যারা নাড়ায় তারা ফেলা মোল্লার কথাকে সমর্থন করে। যারা নাড়ায় না, পুলিশ কী বুঝতে কী বোঝে--তাতে তাদের কোনো সমস্যা হতে পারে ভেবে চুপ করে থাকে।

চৌকিদার একটু পিছনে দাঁড়িয়ে সামান্য ঝিমুচ্ছিল। পুলিশ তার দিকে ফেরে। তাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে পুলিশ বলে, তুই কী জানিস?

চৌকিদার একটু হাসে। হেসে উত্তর করে, ফেলা মোল্লার কথার উপরে কথা নাই স্যার। হ্যায় সব জানে।

শুনে অবাক হয় পুলিশ। ধমক দিয়ে বলে, চৌকিদার তো তুই। ফেলা মোল্লা না। তুই ই তো সব জানবি।

এবার মুখ খোলে ফেলা মোল্লা। বলে, তার চাকরি প্রায় শেষ। আর বছরখানেক আছে। এ এলাকায় কোনো ঝামেলা হয় না বলেই ও এই রকম করে দিন পার করছে। ওরে ছাইড়া দ্যান স্যার। আমার মনে হয়……

--পুলিশ এবারে মনোযোগী হয়। বলে, কী মনে হয়?

--মনে হয়, ফেলা মোল্লা জানায়--

পাশের গ্রামের হানিফ কোবরেজের ছেলে মানিক মুন্সি ওরফে মাইনকা বেশ কিছুদিন ধরে বাড়িতে এসেছে। সে কোথাও যায় না। বাড়িতেই থাকে। সে খুলনা কি চিটাগাং ছিল। সেখানে কী করত বা করে সে সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায় না।

এটা শুনে উপস্থিত লোকজনের কান খাড়া হয়ে ওঠে। তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে। এ সময় মন্নান মণ্ডলের কানে মর্জিনা বিবি ফিসফিস করে শোনায়, চিন্তা কইরো না। হ্যারা আমাগো বাদ দিয়া আরেকজনের কথা তুলতেছে। মন্নান মণ্ডল মাথা ঝাঁকায় একটু জোরে জোরে। সেটা খুশিতে কি ভয়ে বোঝা যায় না।

ফেলা মোল্লা আরো জানায়--

তবে ঐ গ্রামের কিছু লোকজন সম্প্রতি দশটি কালভার্ট নির্মাণ নিয়ে অভিযোগ করেছিল। কালভার্টের ঠিকাদার স্থানীয় এমপির ভাগ্নে। অভিযোগটি শুনে গ্রামের লোকজন জানায় তারা সেটা করেনি। কালভার্টটি তাদের গ্রামে দরকার ছিল না। তাদের দরকার মজাখাল পুনঃখনন। ঠিকাদারের লোকজন তখন জানায় মাইনকাই অভিযোগটি জানাতে পারে। সেজন্য মাইনক্যাকে এমপি সাহেব দেখা করার এত্তেলা দিয়েছিলেন। কিন্তু মাইনকা দেখা করেনি। এজন্য মাইনকার উপর এমপি সাহেব খুব খেপে গিয়েছিলেন। তিনি ওসিকে বলেছিলেন ছেলেটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতে। ওসি তাকে বলেছিলেন কেসটা তিনি দেখবেন। সে রকম কিছু দেখলে তাকে ইয়াবা ড্রাগ বা ডাকাতির কেসে নাম ঢুকিয়ে দেবে।

ফেলা মোল্লার এই তথ্য শুনে পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর বেশ অবাক হয়। এতো কাণ্ড হয়েছে অথচ তারা জানেই না। শুনে তার কনস্টেবল একটু আড়ালে নিয়ে বলে, এটা হইতে পারে। হইতে পারে আগের দারোগার আমলে। ঝামেলাটা আর নাই দেখে তিনি আর কাউকে কন নাই। তিনি কিছুদিন আগে বদলি হইয়া গেছেন।

ফেলা মোল্লা আরো জানান, তবে কালভার্টের বিষয়ে তদন্ত কমিটির রিপোর্টে জানা যায়, গ্রামে দশটির জায়গায় দুটি কালভার্ট হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল তা সত্যি নয়। গ্রামে দশটি কালভার্টই তারা দেখেছেন।

সেজন্য ওসি সেসময়ে মাইনকার বিরুদ্ধে কোনো এ্যাকশন নেয়নি। এমপি সাহেবও সেটা ভুলে গেছেন।

তবে হয়তো এলিট ফোর্সের কাছেও তখন এমপি সাহেব অভিযোগ করে থাকতে পারেন। লিস্টে নাম থাকায় হয়তো মানিকের এই ক্রস ফায়ারটি হতে পারে।

মানিক ছেলেটা পাশের গ্রামের হলেও এ এলাকা তার অচেনা নয়। তার বাবা হানিফ কবিরাজ বিশিষ্ট হাজাম হিসেবে আট গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে সুপরিচিত ছিলেন। সঙ্গে গো চিকিৎসাও করতেন। কিছু কিছু ইউনানি কবিরাজিও করতেন। একটা বয়স পর্যন্ত বাপের পিছনে পিছনে ছেলেটা বাড়ি বাড়ি যেতো। সে ছিল ভীষণ লাজুক। আর মনটা ছিল নরম। বাপের খুব ইচ্ছে থাকলেও মানিক ছেলেটি হাজামগিরিতে যেতে চায়নি। রক্ত দেখলে তার ভয় করে-- চোখে অন্ধকার দেখে। স্কুলের পড়াশুনা শেষ করার আগেই তার বাবা হানিফ ফকির মনে দু:খ নিয়েই চোখ বোজেন। তবে শেষবার ছেলে মানিককে দেখার আশায় বড়ো বড়ো চোখ করে কয়েকবার তাকিয়েছিলেন বটে। কিন্তু মানিক ততদিনে এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। শোনা যায় তার সেজো মামু তাকে একটা ভালো চাকরিতে ঢুকিয়েছিল। সেটা কোথায় ফেলা মোল্লা তা জানে না। সেখানে তার মান বেড়েছে।আয়ও বেড়েছে। তার মা সফুরা বিবি এখনো গ্রামে গ্রামে ঘি মাখন বিক্রি করে। বহুদিন করছে বলে ব্যবসাটা ছাড়তে মন চায় না।

পুলিশ লাশটিকে দেখবে বলে একজন তাগড়া যুবককে জলায় নামতে হুকুম দিল। যুবকটি নামার আগেই ফেলা মোল্লা পরামর্শ দিলো এলিট ফোর্স আসার আগে লাশটির কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। তারা এতে কী মনে করে কে জানে। হয়তো তারা পছন্দ নাও করতে পারে। তারা ক্রসফায়ার করেছে। তারাই সবকিছুর দেখভাল করবে। এরমধ্যে অন্যকারো কেদ্দারীতে রেগে গেলে গণহারে ক্রসফায়ার করে দিতে পারে। কে পাবলিক আর কে পুলিশ তারা কেয়ার করে না। তার চেয়ে প্রবীণ মানুষ ফেলা মোল্লার কথাকে মান্য করাই ভালো। পুলিশ একটা কাগজে মানিক ওরফে মাইনক্যার নামটি লিখল। লিখল, জলার ধারে মৃতদেহটির নাম মানিক। পিতা হানিপ কোবরেজ। হানিপ না হানিফ লিখবে এই নিয়ে একটু দোনামোনা করতে দেখে ফেলা মোল্লাই সেই যুবকটিকে বলল, মাইনকার মা চৌধুরীদের বাড়িতে দুধ দিতে এসেছে। তাকে ডাকলেই হয়।

খবরটি শুনে মাইনকার মা সফুরা বিবি আছাড়িবিছাড়ি খেয়ে ছুটে আসে খাল পাড়ে। লোকজন তাকে জানায় তার ছেলেকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে। তখন সুফরা বিবি ছুটে যেতে চায় লাশটির কাছে। কিন্তু পুলিশ তাকে বাঁধা দেয়। জানায় এলিট ফোর্স আসার আগে লাশটির কাছে কেউ যেতে পারবে না।

তাকে সাব ইনস্পেকটর জিজ্ঞেস করে, মাইনকা তোমার ছেলে?

সফুরা বিবি কেঁদে ওঠে। বলে, হ স্যার। আমার পেটপোছা এক মাত্র পোলা। হ্যার আগে চার চারটা পোলা আমার মইরা গেছে। ফুরফুরার পীরসাবের কাছে সিন্নির মানত করছিলাম। তার বরকতে এই পোলারে পাইছি।

এ কথাগুলোর প্রতি পুলিশ কোনো আগ্রহ দেখায় না। তারা জিজ্ঞেস করল, পোলার বাপের নাম কী?

পোলার বাপের নাম মুখে আনার রীতি নেই। শুধু বলে, পোলার বাপের নাম ফল্লা কোবরেজ।

--ফল্লা কোবরেজ! চমকে ওঠে পুলিশ। এই নাম তো আগে শুনি নাই! তাইলে এই হানিফ কোবরেজ কে?

--হ, হ, উনিই আমার পোলার বাপ। নাথা নেড়ে বলে, ঠিকই কইছেন, উনির নাম ফল্লা কোবরেজ।

তখন ফেলা মোল্লাই আবার বলেন, ওনার নাম হানিফ কোবরেজই। ফল্লা নয়। স্বামীর নাম নাম মুখে আনতে নাই। সেইজন্য উনি হানিফের বদলে ফল্লা কইছে। আদতে ফল্লা নয়--হানিফ।

উপস্থিত লোকজন এ কথায় সায় দেয়। তখন সফুরা বিবি আবার বলে, পোলা আমার এরকম কিছুর সঙ্গে জড়িত নয়। সে সৈয়দপুরে শুটকি মাছের আড়তে কাজ করত। সেখান থেকে সে ফিরে এসেছে। হাবে ভাবে শুনেছি লায়লী খানম নামে এক বিহারী মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। মেয়েটির বাবামা জাদুটোনা করে তার মাথা বিগড়ে দিছে।

পুলিশ একথারও কোনো উত্তর দিল না। শুধু উদাস মুখে বলল, এলিট ফোর্স আসতেছে। হ্যারা তোমার পোলারে ক্রসফায়ার করছে দুই দিন আগে।

শুনে সফুরা কান্না থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, তা কী কইরা হয় গো বাজান। কিছুক্ষণ আগে পোলারে আমি ঘুম থেকে উঠাইলাম। পোলা কয় খুদভাত খাবে। খুদ ভাতের লগে ডাঁটা শাক ভাজি করছি। খাইয়া কইল, খুব মজা হইছে। কাইল আবার রাইন্দো গো মা। তারপর তারে রাইখা আমি দুধ দিতে আসলাম।

পুলিশ শুনে হাসে। বলে পোলার শোকে বুড়ির মাথা আউলায়া গেছে। ও বুড়ি, তুমি ভুল কইছ। আজ তুমি পোলারে খুদ ভাত খাওয়াও নাই। খাওয়াইছ তিনদিন আগে।

গ্রামের মানুষের কাছে পুলিশের এই কথাটা বিশ্বাস হয়। বুড়ো বয়সে এই রকম ভুলভাল কথা বলে লোকজন। নিজের পোলাপানরে চিনতে পারে না। কেউ কেউ বাপ তো বাপ-- নিজের নামটাও ভুলে যায়।

ফলে মর্জিনাবিবিই সবার আগে সফুরা বিবিরে এসে ধরে। বলে, কাইন্দো না খালা। পুলিশ যখন কইছে তখন আর ভুল নাই। মুর্দা সামনে রাইখা কাইন্দো না খালা। তাতে মুর্দার কষ্ট হয়।

সফুরা বিবি তখন তার হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে চায়। ছুটে গিয়ে নামতে চায় জলার কাছে। নলবনে গিয়ে দেখতে চায় তার মুখখানা। নিশ্চিত হতে চায় সে তার পোলা কিনা।

পুলিশ তাই দেখে বলে বুড়ি ছেলের শোকে পাগল হয়ে গেছে। ক্রসফায়ারের মতো গুরুতেপূর্ণ ঘটনার মধ্যে বুড়ি যাতে কোনো ঝামেলা বাঁধাতে না পারে সেজন্য বুড়িকে এখান থেকে সরিয়ে নিতে মর্জিনাকে ইশারা করল। মর্জিনা আর দেরি করে না। মওকা পেয়ে বুড়িকে পাঁজা কোলে করে তাদের বাড়ির দিকে চলে গেল। মন্নান মণ্ডলও তার পিছু নিল।

আর তখনই বুড়ি সফুরার মনে হলো সত্যি সত্যি সে তার ছেলেকে আজ নয়--- তিনদিন আগে খুদভাত রেঁধে খাইয়েছে। এরপর তাকে আর দেখেনি। এবার ছেলে হারানো শোকে বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারায়। জ্ঞান হারাতে হারাতে বিনবিন করে বলে—ওরে বাপ আমার। তিন দিন ধরে মইরা আছিস। এখনো দাফন কাফন হইল না। একি আজাব রে খোদা।

জ্ঞানহারা বুড়িকে নিয়ে মর্জিনাবিবি ছুটতে ছুটতে গ্রামের বাইরে চলে যায়।

এলিট ফোর্স আসার আগেই পুলিশকে তাদের রিপোর্ট লেখা শেষ করতে হবে। সাব ইন্সপেক্টর উপস্থিত লোকজনকে কেউ এই ক্রসফায়ারের ঘটনা জানে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করে।

এই প্রশ্নে সবাই নীরব থাকে। তারা কেউ কিছু দেখেনি। নীরব থাকা ছাড়া উপায় কি।

ফেলা মোল্লাই নিরবতা ভেঙ্গে প্রথম কথা বলে ওঠে। জানায়, তিনদিন আগে মাঝরাতে তার ঘুম ভাঙ্গে। তখন বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল। শান্ত হয়ে এসেছিল হাওয়া। সেই সময়ে দূর থেকে একটা শব্দ কানে ভেসে আসে।

শুনে একজন যুবক তাকে জিজ্ঞেস করে, কীসের শব্দ?

--গাড়ির শব্দ। সড়ক থেকে মাটির রাস্তায় গাড়িটা আসতেছে।

--কোন মাটির রাস্তায়?

-- খালপাড়ের মাটির রাস্তায়। উত্তর দিয়ে যুবকটিকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে ফেলা মোল্লা বলে চলল, ভিজে মাটির রাস্তায় গাড়ি চলা মুশকিল। কিন্তু জিপগাড়ি দিব্যি গড়গড়াইয়া চলে।

যুবকটি এবার মরিয়া হয়ে আবার প্রশ্ন করে-- এ এলাকায় কারো জিপগাড়ি নাই। তাইলে এইটা কার গাড়ি হইতে পারে?

--এলিট ফোর্সের হইতে পারে। এদিক ওদিক তাকিয়ে উত্তর দিল ফেলা মোল্লা। তারা যেকোনো জায়গায়ই গাড়ি চালাইয়া যাইতে পারে। তাগো অসাধ্যি কিছু নাই।

এটা শুনে সবাই চুপ করে গেল। কোনো একটা গাছে হঠাৎ করে একটা ঝিঁঝিঁ পোকা নিস্তব্ধতা ভেদ করে ঝিঁঝিঁ করে উঠল। সেই শব্দ ক্রমশ এতো তীব্র হয়ে উঠল যে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা হলো।

সেটা সহ্য করতে না পেরে বোধ করি কিছুক্ষণ পরে যুবকটির পাশ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক লোক হাউসি ছেড়ে ফিসফিস করে বলল, আমার একটি গরু সেই মাঝরাতে হঠাৎ করে হাম্বা হাম্বা করে ডাক পাড়ছিল। তখন গোয়াল ঘরে যাওয়ার সময় মনে হয় দেখছিলাম একটা গাড়ির মতো কী একটা খালপাড়ে থাইমা আছে। তার ভেতর থেইকা তিন চারজন লোক বারাইয়া একজনরে টাইনাহেচড়া করে পাড়ের কিনারে নিতেছিল। ভুত টুত হইতে পারে ভাইবা আমি সেদিক থেইকা চোখ ফিরায় আনি। চোখ বন্ধ করে সোজা ঘরে ঢুইকা পড়ছি। আমার আবার ভুতের আছর আছে ছোটকাল থেইকা। বলা যায় না কী থেকে কী হয়। ইন্নি কুন্তু সোবহানকা...

এবার আরো দুতিনজন বলে উঠল, তারাও সেরাতে দেখতে পেয়েছে কয়েকজন লোক খাল পাড়ের দিকে যাচ্ছে।

একজন যুবতী নারী বলে উঠল, হ আমারো মনে পড়তেছে-- কয়েকটা গুলির শব্দ কানে শুনলাম। তাতে ঘুম পাতলা হয়ে গেছিল।

যুবতীর কথায় ঝিঁঝিঁ পোকা হুট করে থেমে গেল। সবাই অবাক হয়ে যুবতী নারীর দিকে তাকিয়ে রইল। তারা বুঝতে চেষ্টা করল এতো রাতে এই বেগানা যুবতী নারী কেনো জেগে ছিল? তাদের মনে কু ডাকতে চায়।

যুবতী আরো জানালো যে, সঙ্গে সঙ্গে কে একজন আল্লাগো বলে চেঁচানি দিছিল।

--কী শব্দ?

--আল্লা গো---।

আবার ঝিঁঝিঁ পোকারা তীব্রভাবে গুলিবৃষ্টির মতো সমস্বরে ডাকতে লাগল। আর সবাই চুপ করে রইল।

ফেলা মোল্লা তখন 'আমি আবার গাড়ি চইলা যাওনের শব্দ পাইছিলাম' বাক্যটি জানাল।

দেখা গেল উপস্থিত সব লোকজনই ঘটনাটি দেখেছিল বা গুলি আর আল্লাগো শব্দ শুনতে পেয়েছিল। অজান্তে দুর্বল চিত্তের কয়েকজনের গা শিউরে উঠল। সেটা থামাতে কি না কে জানে তারা সশব্দে বলে উঠল, আল্লাগো।

তাদের এই বলাবলির মধ্যে পুলিশ রিপোর্টে লিখল--

অত্র এলাকার দুর্ধর্ষ দুর্বৃত্ত মাদক ব্যবসায়ী নারী ধর্ষক মাইনকা ওরফে মানিক পিং হানিপ কবিরাজ ওরফে হানিফ কবিরাজের মৃতদেহ খালপাড়ের নলবনে দেখিতে পাওয়া যায়। এলাকার লোকজনের ভাষ্যমতে এটা একটা ক্রসফায়ারের ঘটনা। রিপোর্টে পুলিশ তিনদিন আগের তারিখ বসায়। বসিয়ে তাদের মনে ফুর্তি আসে। সাব ইনস্পেক্টর একটা সিগারেট ধরায়। আয়েস করে টানে। এক গাল ধোঁয়া ছেড়ে গুণগুণ করে গেয়ে ওঠে, ‘লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোলো—’

এই গানের গুণগুণানি শুনে একটি ১২-১৪ বছরের বালক তখন মনে করতে পারে কাল সে পাশের গ্রামে মামাবাড়ি থেকে ফিরছিল। পথে কোবরেজ বাড়ি। বাড়ির সামনে এক সারি শুপারিগাছ। একটি শুপারিগাছের আগার দিকে চেয়ে আছে মাইনকা ওরফে মানিক। আর গুণগুণ করে 'লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোলো-- গানটা গাইছে। তাকে দেখে গান থামিয়ে কয়েকটি শুপারি পেড়ে দিতে বলল। তার চোখে তখন জল টলমল করছে। তার গলায় এমন কিছু ছিল যে বিনাবাক্যে বালকটি এই সকালে শিশিরে ভেজা গাছ বেয়ে উঠল। অন্য কারো কথায় পিছল গাছে উঠত না। উঠে শুপারি পেড়ে দিল। তার হাটুর নিচে চামড়া একটু ছড়ে গিয়েছিল। মাইনকা যশুরেলতার পাতা এনে হাতে ডলে তার ছড়ে যাওয়া জায়গায় লাগিয়ে দিল। বলল, কাল আবার শুপারি পাইড়া দিস রে ভাইস্তা। শুপারি টুপারি নিয়া লাইলীগো বাড়ি সৈয়দপুর যাব। পান শুপারি পাইলে হ্যার মা আর না করবে না।

কে লাইলী আর তার মা কেনোইবা রাগ করে তা বুঝতে পারে না বালকটি। বুঝতে পারে মাইনকা ওরফে মানিক আবার শুপারিগাছে র আগার চোখ রাখে। আবার গুণগুণ করে, লাইলী তোমার এসেছে ফিরিয়া মজনু গো আঁখি খোলো---

বালকটির কী মনে হলো সে খালপাড় থেকে ছুটতে ছুটতে পাশের গ্রামের কোবরেজবাড়ি চলে এলো।

তখনো শুপারীগাছে নিচে মাইনকা ওরফে মানিককে দেখা গেল। তবে দাঁড়িয়ে নয়--মাথায় হাত দিয়ে গাছের গোড়ায় বসে আছে। পাশ থেকে লতিয়ে এগিয়ে এসেছে মানিপ্লন্টের ঝাড়। তার মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে একটি বিড়াল। বিড়াল বিহ্বল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর মাইনক্যা ওরফে মানিক সে চোখের দিকে চেয়ে চেয়ে গাইছে,

‘প্রিয়তম! এতদিনে বিরহের

নিশি বুঝি ভোর হলো।।

মজনু! তোমার কাঁদন শুনিয়া মরু-নদী পর্বতে

বন্দিনী আজ ভেঙেছে পিঞ্জর বাহির হয়েছে পথে।’

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই কটি লাইনই গাইছে। আর চোখ থেকে কী এক অসহ্য যাতনায় জল ঝরছে। কাছে কোথাও হাসনুহেনা ফুটেছে। তার ঘ্রাণ ভেসে আসছে। আর এর মধ্যে তার চুলের উপরে পড়েছে কিছু শুপারী ফুলের রেণু। আর কিছু রোদ্দুর। বালক সেই রোদ্দুর দেখে লোকটির শরীরের ছায়াটি খুঁজবে। লোকটির ছায়া না পড়লে বুঝতে পারবে তিনি জীবিত নন--মৃত। ভুত। ভুতেদের শরীরের কোনো ছায়া পড়ে না। খালপাড়ের মানুষজন যে মানুষটিকে মৃত বলে মনে করছে, সেই মানুষটি এখন তার সামনে শুপারীগাছের নিচে বসে অশ্রুপাত করছে-- এর মধ্যে রহস্য আছে। ছায়াটি পড়েছে কিনা সেটা দেখতে গিয়ে তার চোখ মুদে গেল। যদি ছায়াটি না দেখতে পায় তবে ভুতটিকে দেখতে হবে। তার ঘাড় মটকে দিতে পারে। চোখ বন্ধ হলেও তাই কান্না জড়িত গানের সুর কানে এলো। মনে হলো এ গানের তুলনা নেই। যে বা যিনি গানটি গাইছেন তিনি মানুষ কি ভুত যাই হোক না কেনো তাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বালকটি তাই চোখ খুলল। কিন্তু তার ছায়া দেখতে পেল না। রোদ্দুর সরে গেছে। ছায়াটি আছে কি নেই সেটা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাচ্ছে না।

তার চেয়ে দরকার মাইনকা ওরফে মানিককে খালপাড়ে নিয়ে যাওয়া। নিশ্চিত হওয়া দরকার কার মৃতদেহ সেটা। সময়টা খুব কম।

বালকটি মাইনকা ওরফে মানিকের কাছে গিয়ে চাচা চাচা বলে ডাক দিল। তাতে তার ঘোর কাটে না। তখন তার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল। সেই জলভরা চোখ নিয়ে মাইনকা ওরফে মানিক বলে উঠল, লাইলী আইছে?

--কোন লাইলী? এ প্রশ্নটি করতে গিয়ে বালকটি থেমে যায়। বোঝে মাইনকা ওরফে মানিক এ জগতে নেই। ঘোরের মধ্যে, চোখের জলের মধ্যে, দীর্ঘ বিষাদের মধ্যে ডুবে আছে। সেখান থেকে তাকে বের করা যাবে না। তাই সে কী মনে করে তার হাত দুটি ধরে বলে, চলেন। আর বইসা থাইকেন না।

--লাইলী আইছে তাইলে? আবার বিহ্বল কণ্ঠে শুধায়।

তার চোখের দিকে তাকিয়ে বালকটি বলে, হ আইছে। আপনার জন্যে খাড়ায় আছে।

--কোন খানে?

--খালপাড়ে।

বলে বালকটি মাইনকার হাত ধরে টান দিল। দিয়ে ছুটতে শুরু করল পাশের গ্রামের উদ্দেশ্যে। তার সঙ্গে ছুটতে শুরু করল মাইনকা ওরফে মানিক। ‘লাইলী আইছে লাইলী আইছে’ বলতে বলতে ছুটতে লাগল।

ততক্ষণে এলিট ফোর্স চলে এসেছে। তাদের জীপ গাড়িটি দেখে উপস্থিত লোকজন নিশ্চিত হয় তারা সেদিন রাতে কোনো খোয়াব দেখেনি। সত্যি সত্যি তারা এই গাড়িটিই দেখেছিল। তারা দেখেছিল গাড়ি থেকে এইসব এলিট ফোর্সের লোকজনেরই গায়ে ছিল কালো উর্দি আর কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল তাদের মাথা। কে একজন গ্রামের বাহাত্তুরে বুড়ো তাদের দেখে বলে ফেলল, ও বাবা, এ দেখি মোহাম্মদী বেগ!

--মোহাম্মদী বেগ আবার কেডা? এই প্রশ্নটি তার পাশের লোকটি কৌতুহল ভরে শুধালো। তার উত্তরে বাহাত্তুরে বুড়ো বলল, আরে মোহাম্মদী বেগ হইল গিয়া নবাব সিরাজদৌলার পালিত ভাই। নবাবরে খুন করছেল। যাত্রাপালায় দেখছি।

খুন শব্দটি শুনে ফেলা মোল্লার কান খাড়া হয়ে যায়। ছুটে এসে বাহাত্তুরে বুড়োর মুখ চেপে ধরে। বলে, চুউউপ। আর একটা কথা কইলে তুমি খুন হইবা মিয়া। সোজা ক্রসফায়ার।

এই কথার পরে বাহাত্তুরে বুড়ো আর দাঁড়ায় না। চুপ করে খালপাড় ছেড়ে চলে যায়।

এলিট ফোর্সের কাছে পুলিশ রিপোর্টটি হস্তান্তর করে। সেটা দেখে এলিট ফোর্সের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তারা তখন স্মরণ করতে পারে, এই রিপোর্টটিতে উল্লেখিত লোকটির নাম তারা পেয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। তারা তদন্ত করেও দেখেছে, মাইনকা দীর্ঘদিন যাবৎ কক্সবাজারের মাদক সম্রাট ইয়োবা বদির সঙ্গে জড়িত। মায়ানমার থেকে বড় বড় চালান তার মাধ্যমে রাজধানীর দিকে যায়। চারবার এই লোকটি পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছিল। কিন্তু সে বদির কল্যাণে ছাড়া পায়। কিছুদিন ধরে সে আলাদা করে ব্যবসা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। সেজন্য এই এলাকাকে সে বেছে নিয়েছে। তাই তারা মাইনকাকে ক্রইস ফায়ারে দিয়েছে। সেই রিপোর্টটি তারা লিখতে ভুলে গিয়েছিল। আজ তারা রিপোর্টটি লিখে ফেলল। দেরী না করে হেডকোয়ার্টারেও রিপোর্টটির ইমেজ ফোনে পাঠিয়ে দিলো। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই পত্রিকাগুলোতে প্রেসনোট পাঠিয়ে দেবে। প্রয়োজনে প্রেসকনফারেন্সও করে ফেলবে।

লাশটি তখনো দেখা সরেজমিনে দেখা হয়নি। সবাই এলিট ফোর্সের জন্যই অপেক্ষা করছিল। তারা মনে করেছে এলিট ফোর্স অনুমতি দিলেই লাশটি জল থেকে তুলে আনা হবে। পোস্ট মর্টেম হোক বা না হোক, তারা লাশটিকে দাফন করতে চায়। মুর্দার বাবা এলাকায় গণ্যমান্য লোক ছিলেন। বেচারা বহুদিন হলো নেই। বুড়ি মা-টির আর কেউ থাকল না। বাবার কবরের পাশে ছেলের কবর হলে বুড়ি মনে শান্তি পাবে। কদিনইবা আর বাঁচবে।

এ সময় একটা জোর হাওয়া আসে। সে হাওয়ায় আবার জলের উপর দিয়ে পঁচা দুর্গন্ধ উড়ে আসে। কেউ কেউ নাকে হাত চাপা দেয়। এলিট ফোর্স তখন গাড়ির দিকে যায়। যেতে যেতে পুলিশকে বলে, এই পঁচা লাশের পোস্ট মর্টেম করার দরকার নেই। তারা যা রিপোর্টে লিখেছে সেটাই ফাইনাল। কোনো সন্দেহ করার সুযোগ নেই। লাশটি তুলে মাটি চাপা দিলেই হবে।

পুলিশ তখন তাদের আশ্বস্ত করে, চিন্তা করবেন না, আমাদের চৌকিদার আছে। সে-ই ব্যবস্থা মাটি দেওয়ার করে ফেলবে। শুনে চৌকিদার মাথা চুলকে হাসে। ফেলা মোল্লাকে ইশারা করে। ফেলা মোল্লা মাথা নেড়ে উত্তর দেয়, কোনো ঝামেলা নেই। হয়ে যাবে।

কিন্তু ততক্ষণে একটা ঝামেলা হয়ে যায়। বালকটির পেছনে পেছনে মাইনকা ওরফে মানিক খালপাড়ে চলে আসে। ছুটতে ছুটতে এসেছে বলে হাঁপাতে থাকে। হাঁপাতে হাঁপাতে চারিদিক নজর করে দেখতে থাকে। লোকজন তাকে দেখে চমকে ওঠে। যারা বসেছিল তাদের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে যায়। আর যারা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের কেউ কেউ ধপ করে বসে পড়ে। কারো কারো পশম খাড়া হয়ে যায়। কেউ একজন বলে ওঠে, এ দেখি মরা মানুষ আইসা পড়ছে!

একজন ফোকলা দাঁতের বুড়ি মাইনকা ওরফে মানিকের হাতটা ধরে। ধরে বলে, মরা কোথায়, এতো জ্যান্ত মানুষ। ধ্বক ধ্বক করে নাড়ি ফাল পাড়ে।

মাইনকা ওরফে মানিক বালকটিকে জিজ্ঞেস করে--লাইলী কই? লাইলী কই?

কিন্তু বালকটি সেখানে ছিল না। কী জানি কী হয় ভেবে সে সরে পড়েছিল। অদূরে একটি ঝোঁপের আড়াল নিয়েছিল। বালকটিকে না দেখতে পেয়ে সে কেমন দিশেহারা হয়ে পড়ে। কাঁপা কাঁপা গলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে লাইলীর নাম ধরে ডাকতে শুরু করে।

পুলিশ তার কাছে এগিয়ে আসে। ভাবগতিক সুবিধার নয় বলেই তাকে ঘিরে ধরে। কড়া গলায় তার নাম জিজ্ঞেস করে। মাইনকা ওরফে মানিক শুধু বলে, লাইলী।

পুলিশ বিরক্ত হয়ে তার গালে একটা চড় মারে। চড় খেয়ে মাইনকা ওরফে মানিক শান্ত হয়। গালে হাত চেপে ধরে উত্তর দেয়,নাম মজনু।

--কোন মজনু?

--লাইলীর মজনু।

শালার লাইলী মজনু ছাড়া আর কথা নাই। বলে পুলিশ আরেক গালে দিল আরেক গালে। সেই চড় খেয়ে মানিক একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল। মুখে কোনো কথা সরে না। তাই দেখে ফেলা মোল্লা উঠে এলো। পুলিশের কানে ফিসফিস করে করল, এই ব্যাটাই মাইনকা ওরফে মানিক।

--কোন মাইনকা?

--যে মানিকরে স্যার এলিট ফোর্স ক্রসফায়ার দিছে।

শুনে পুলিশ প্রমাদ গুনল। বলে উঠল, সে কি? তাইলে ওই ডেডবডিটা কার? সে কি মাইনকা ওরফে মানিক নয়?

--তাই তো মনে হচ্ছে। আমরা তো এখনো ডেডবডিটা দেখি নাই। দেখা গেলে বলা যেত।

পুলিশ এবারে মাইনকা ওরফে মানিককে ঠেলে খালের কিনারে নিয়ে এলো। জলে মাইনকার বড়ো ভয়। সে নড়ে না। গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চায়। কিন্তু পুলিশ সেটা মানতে চাইবে কেনো। তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলতে গেল। তখন ফেলা মোল্লা তাদের থামালো। বলল, খাড়ান। আমি দেখতেছি।

বলে মাইনকা ওরফে মানিককে বলল, তুই লাইলীরে দেখতে চাইছিস তো?

সে মাথা নেড়ে বলল, লাইলী এসেছে ফিরিয়া। তারে ছাড়া আর কারেও দেখব না এ জীবনে।

ফেলা মোল্লা তাকে জলা দেখিয়ে বলল, ওই যে নলবনে তোর লাইলী।

শুনে মাইনকার জলের ভয় কেটে গেল। সে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল খালের মধ্যে। জলের মধ্যে লাফিয়ে দাপিয়ে ছুটল। চেঁচিয়ে বলল, লাইলী কোথায়? তারে তো দেখতি পাইতিছি না।

ফেলা মোল্লা চেঁচিয়ে বলল, অই যে পা দেখা যায়।

সেদিকে লাইলী লাইলী বলতে বলতে এগিয়ে গেল মানিক। সেখানে, পুলিশ যার নাম মাইনকা ওরফে মানিক হিসেবে রিপোর্টে লিখে বসে আছে, উপস্থিত লোকজন যাকে ভুত বা প্রেত বলে শ্বাস রোধ করে চেয়ে আছে—ফেলা মোল্লা যাকে মাইনকা ওরফে মানিক নামে চিহ্নিত করেছে, সেই কথিত মানিক ওরফে মানিক নলবনে আটকে থাকা ডেডবডির কাছে গেল। জল থেকে কী একটা ধরে খালপাড়ের দিকে ছুড়ে মারল। সেটা কোনো মানুষের ডেডবডি নয়। একটা মরা বিড়াল। পঁচে গেছে। মুহূর্তে চারিদিকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে গেল। সবাই আবার নাক চেপে ধরল।

তখনো নলবনে পাদুটি দেখা যাচ্ছে। সেটাকে কোলে তুলে পাড়ের দিকে এগিয়ে এলো মানিক। সবাই অবাক হয়ে দেখতে পেল, সেটা সত্যিই একটা ডেডবডি। মানুষের। তাকে কোলে ধরে মাইনকা ওরফে মানিক অঝোর ধারায় কান্না করছে।

এলিট ফোর্সের গাড়ি তখনো ছেড়ে যায়নি। তারা ডেডবডি দেখতে এগিয়ে এলো। বলল, ডেডবডি যখন পাওয়া গেছে তখন একটা ছবি তুলেই নেই।

তারা ক্যামেরা বাগিয়ে মাইনকা ওরফে মানিকের কাছে গিয়ে দেখতে পেল, সেটা প্রকৃত মানুষ নয়। কাপড়ের মানুষ। পুতুল নাচের খেলনা মানুষ। উপস্থিত লোকজন স্মরণ করতে পারে, তিন গ্রাম দূরের নয়াগাঁয়ে কিছুদিন আগে পুতুল নাচের দল এসেছিল। এ পুতুলটি তাদেরই একটি। কী করে পুতুলটি এই জলার ধারে এসেছে সেটা নিয়ে তাদের মনে কোনো প্রশ্ন এলো না। তারা হাফ ছেড়ে বাঁচল। উৎফুল্ল হয়ে উঠল-- তাদের এলাকার বিখ্যাত কবিরাজের পাগল পাগল ছেলেটা মরেনি। বেঁচে আছে। এ সময়ে যে কোনোভাবে জীবনে বেঁচে থাকতে পারার মতো আনন্দময় ঘটনা আর নেই।

বালকটি মহাআনন্দে মাইনকা ওরফে মানিকের মাকে সংবাদটি দিতে ছুটল।

কিন্তু পুলিশের মন খারাপ হয়ে গেছে। এলিট ফোর্সের কাছে তাদের মুখ ছোট হয়ে গেছে ক্রসফায়ারের ভুল খবরটি দিয়ে। এখন আবার রিপোর্টটি বদলাতে হবে। ছিঁড়ে ফেলতে হবে।

পুলিশকে মনমরা দেখে এলিট ফোর্স বলল, কুচ পরোয়া নেই। তারা যে রিপোর্টটি লিখেছে সেটা ফাইনাল। সেখানে ক্রসফায়ারে নিহতের যে নামটি লিখেছে সেটাও ফাইনাল। সেটা বদলানো বা ছিঁড়ে ফেলার দরকার নেই। ঘন ঘন রিপোর্ট পাল্টানো তাদের মেজাজের সঙ্গে যায় না। শুধু রিপোর্টটিকে সত্যি করে ফেললেই হবে। নো ঝামেলা।

তারা হাসি হাসি মুখ করে গাড়ির দিকে গেল। টাকিলা নামের মদের বোতলটির মুখ খুলল।
উপস্থিত লোকজন তাদের কান চেপে ধরল। আর আয়াতুল,কুরসি সুরাটি জপতে লাগল—

আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল ক্বিয়্যুম লা তা--খুজুহু সিনাত্যু ওয়ালা নাউম...




Post a Comment

0 Comments