একজন লেখকের অপমান


কুলদা রায়
----------------

সাগুফতা শারমীন তানিয়া বাংলাদেশের অন্যতম মেজর কথাসাহিত্যিক। তাঁর গল্পভাষা সুন্দর। ইংরেজি থেকে তাঁর অনুবাদের হাতটিও ভালো। দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী।

তিনি আন্তনিও স্কারমেতার দি পোস্টম্যান উপন্যাসটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন। প্রকাশ করেছে প্রথমা। বইটি পড়ে কবি অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন ১৪ মে, ২০২১ শুক্রবার ফেসবুকে দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস দেন। তিনি সাগুফতা শারমীন তানিয়ার বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগ আনেন--

ক. 
তানিয়া কোন ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন তা জানাননি। এবং যে বিদেশী অনুবাদকের লেখা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদটি করেছেন তার নাম উল্লেখ না করে জোচ্চুরি করেছেন।

খ. 
তানিয়ার বাংলা অনুবাদ হচ্ছে যাচ্ছে তাই ধরনের খারাপ। তানিয়া ব্যাকরণ সম্মতভাবে বাংলা ভাষা লিখতে জানেন না। অনুবাদের মূল মর্মটা ধরতে পারেন না। আক্ষরিক অনুবাদ করে মূল লেখাকে মাটি করে দিয়েছেন।
তানিয়া যে বাংলা ভাষা জানেন না, তার প্রমাণ হিসেবে লালা ও সের শব্দকে হাজির করেছেন।
তৃতীয়ত পরিপার্শ্ব শব্দের বদলে পারিপার্শ শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে তানিয়া প্রমাণ করেছেন বইটি অপাঠ্য।

গ. 
পরিশেষে এক কবি যখন তানিয়ার লেখার প্রশংসা করলেন তখন রাজু আলাউদ্দিন অবলীলায় বলে ফেললেন, তানিয়া আসলে সেই কবির রক্ষিতা।

এই স্ট্যাটাসের পরিপ্রেক্ষিতে ফেসবুকে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। কিন্তু রাজু তার বক্তব্যে অটল থাকেন। যারা তার বক্তব্যের বিরোধীতা করেছেন তাদেরকে তিনি তার বন্ধু তালিকা থেকে ব্লক করে দেন। আমি সেই ব্লক হয়ে যাওয়াদের অন্যতম। একদিন পরে নিজের স্ট্যাটসটি মুছে দেন।কিন্তু নিজের কৃতকর্মের জন্য কোনো অনুশোচনা বা ক্ষমা প্রার্থনা করেননি।

একজন লেখক বা অনুবাদকের লেখা কারো কারো পছন্দ নাও হতে পারে। সেজন্য দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সমালোচনা করা যেতে পারে। দ্বিমত করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা বাতিল করা যায় না। কিন্তু লেখার বদলে লেখককে যখন ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা হয় তখন সেটা আর সাহিত্যের অংশ থাকে না। এক ধরনের অপরাধে পরিণত হয়।

আমি গত কদিন ধরে ফেসবুকেরাজু আলাউদ্দিনের স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াগুলো অনুসরণ করছিলাম। কোনো স্ট্যাটাস দেইনি। তবে নিজের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলা দরকার।
 
আমার কয়েকটি লেখা আমার অনুমতি ছাড়াই রাজু আলাউদ্দিন বই আকারে প্রকাশ করেছেন।
২০১৬ সালে বিডিনিউজ২৪ এর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বিপিএল থেকে আমার ও এম আর জালাল প্রণীত রবীন্দ্রনাথের জমিদারগিরি ও ও অন্যান্য বিতর্ক নামে ৫০০ পৃষ্ঠার একটি বই বের হয় অনিন্দ্য রহমানের তত্ত্বাবধানে।

২০১৭ সালে আমার একজন বন্ধু বাংলাদেশ থেকে জানান, বিপিএল থেকে রবীন্দ্র বিতর্ক—বঙ্গভঙ্গ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটির লেখক চারজন। লেখক্ক্রম—অভিজিৎ রায়, ফরিদ আহমেদ, কুলদা রায় ও এম আর জালাল। বইটির সম্পাদক রাজু আলাউদ্দিন।

বইটির একটি কপি আমার এক শুভানুধ্যায়ী বাংলাদেশ থেকে নিউ ইয়র্ক নিয়ে এসে আমাকে দেন। দেখে আমি অবাক হই। বইটি প্রকাশিত হয়েছে রাজু আলাউদ্দিন যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সেই প্রতিষ্ঠানের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বিপিএল থেকে। বইটির সম্পাদনা করেছেন রাজু আলাউদ্দিন। তিনি বইটির প্রকাশের আগেপরে আমাকে কিছুই জানাননি। আমার কাছ থেকে কোনো অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। এই বইটি বা অন্য লেখারও রয়ালিটি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

পরে নিউ ইয়র্কে রাজু আলাউদ্দিন এসেছিলেন। আমার সঙ্গে দেখাও হয়েছিল।আমার বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁকে আমি লাগুর্ডিয়া এয়ারপোর্টে ড্রাইভ করে পৌঁছে দেই। কিন্তু তিনি কখনোই বইটি নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেননি। বিদেশে এসেছেন বলে সৌজন্যবশত তাকে আমি কিছু বলিনি।আমার বইয়ের সহলেখক এম আর জালাল বিডিনিউজ২৪ এর সম্পাদক তোহিদ ইমরোজ খালিদীকে বিষয়টি জানান। জনাব খালিদী বিস্ময় প্রকাশ করে রাজু আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। জনাব জালাল মামলাটি করেননি। পরে রাজু আলাউদ্দিন আমাকে বইটির দশ কপি নালন্দা প্রকাশনীর রেদওয়ানুর রহমান জুয়েলের মাধ্যমে নিউ ইয়র্কে পাঠিয়েছিলেন।

এই কাহিনী থেকে কী বুঝলাম? বুঝলাম দেশি ভাষার লেখকের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়ার দরকার নেই। কিন্তু বিদেশি লেখকের অনুমতি অবশ্য অবশ্যই নিতে হবে। না নিলে জোচ্চুরির অপরাধ হবে। বিদেশি অনুবাদকের অনুমতি না নেওয়ার কারণে তানিয়া যদি জোচ্চর হয় তবে আমাদের বিনামতিতে আমাদের বই সম্পাদনা ও প্রকাশ করার কারণে রাজু আলাউদ্দিনকে কী বলা যাবে? ডাকাইত?

আরেকটি প্রশ্ন জেগেছে। রাজু আলাউদ্দিন মাঝে মাঝে বিভিন্ন লেখাপত্র বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। কয়েকটি বিদেশি বইয়ের বাংলা অনুবাদ করেছেন। তিনি কি একটি লেখা বা বইয়ের মূল লেখকের অনুমতি নিয়ে অনুবাদ করেছেন? আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি—না, তিনি কারো অনুমতি নেননি। যে কাজটি তিনি নিজে অনুসরণ করেন না, সেই কাজটির জন্য অন্যকে ধমক দেওয়ার অধিকার কি তাঁর থাকে? আর তিনিইবা ধমক দেওয়ার কে? কে তাঁকে সাহিত্যপুলিশের দ্বায়িত্ব দিয়েছে?

ঘটনা হলো, বিদেশি লেখা অনুবাদ করার ক্ষেত্রে বিদেশি লেখকের অনুমতি নেওয়া একটা রীতি। এই অনুমতি সংগ্রহ ব্যাপারটি অতি জটিল। অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে লেখক প্রচুর বিদেশি মুদ্রা দাবী করেন।
আমাদের দেশে বইয়ের বাজারটি অতি দুর্বল। কোনো ভালো বইয়ের ৩০০-৫০০ কপি বিক্রি হয় কিনা সন্দেহ। এবং আরো নির্মম সত্যি হলো এ সময়ের লেখক একটি বই অনেক খাটুনি করে লেখেন, কম্পিউটারে টাইপ করেন।প্রুফ দেখে দেন। ক্ষেত্রে বিশেষে প্রকাশককে বইটি প্রকাশনার ব্যয়ভার বহন করতে হয়। বইটি প্রকাশিত হলে বইটি বিপনের দ্বায়িত্বটিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখককেই করতে হয়। বইটির কম্পিউটারে কম্পোজকারী, প্রুফ রিডার, প্রেসের মালিক,প্রচ্ছদশিল্পী, বাঁধাইকারী প্রমুখ লোকজন পারিশ্রমিক পান। কিন্তু লেখক বইটির জনক উপাধী ছাড়া আর কিছুই পান না। এই অবস্থায় একজন অনুবাদক মোটা টাকার বিনিময়ে কী করে বিদেশি লেখকের কাছ থেকে লেখার স্বত্ত্ব যোগাড় করবেন? প্রকৃতপক্ষে এটা প্রকাশকের দায়িত্ব হওয়া দরকার।

তবে স্বত্ত্ব যোগাড়ের সংস্কৃতি দেশে নেই। কিন্তু এখনি যদি সাহিত্য পুলিশ যদি হুমকি দিয়ে বলেন অনুমতি ব্যতিরেকে কোনো বিদেশি লেখা অনুবাদ করা যাবে না, তবে এ পোড়া দেশ বিদেশি সাহিত্যের কোনো অনুবাদ হবে না। লেখকপাঠক বিশ্বসাহিত্যের প্রবাহমান ধারার বাইরে থেকে যাবে। বাংলাসাহিত্য স্বখাত সলিলে ডুবে যাবে। সেটা নিশ্চয়ই সুখবর নয়।

প্রকৃতপক্ষে এই বিদেশি লেখকের অনুমতি সংগ্রহ বিষয়টি বাস্তবায়িত করতে হলে প্রকাশকদেরকেই প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে। সেজন্য লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে সচেতনা সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষুণি কাজটি হবে না। ধীরে ধীরে হবে। সেজন্য বিদেশি অনুবাদ বন্ধ করা যাবে না।


সাগুফতা শারমীন তানিয়ার অনুবাদকৃত বইটির ভূমিকায় ছাপাকৃত একটি বাক্যে আছে—‘সে পারিপার্শ্বকে চেনে কবিতার দেদীপ্যমান আলোয়।’ এই বাক্যটির ‘পারিপার্শ্ব’ শব্দটি উল্লেখ করে রাজু আলাউদ্দিন অভিযোগ করে বলেছেন-- পারিপার্শ্ব বলে বাংলা ভাষায় কোনো শব্দ নেই। আছে—পরিপার্শ্ব। ফলে রাজু সিদ্ধান্ত টেনে দিয়েছেন অনুবাদক তানিয়া বাংলা ব্যাকরণ জানেন না। বাংলা ভাষাটিও জানেন না।

সাগুফতা তানিয়া দাবী করেছেন বইটিতে ছাপাকৃত ‘পারিপার্শ্ব’ শব্দটি তিনি লেখেননি। ওটা মুদ্রণপ্রমাদ। প্রকাশকের নিয়োগকৃত প্রুফ রিডারের ভুল। প্রুফ রিডারের ভুলের দায় অনুবাদকের ঘাড়ে চাপানোর কোনো অর্থ হয় না।

রাজু আলাউদ্দিন নিউ ইয়র্কে যখন এসেছিলেন তখন তিনি তাঁর লেখা একমাত্র কবিতার বই ‘আকাঙ্ক্ষার মানচিত্র গোপনে এঁকেছি’ বইটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। বইটিতে দশটি ভুল আমার চোখে পড়েছে।

রাজু আলাউদ্দিনের কবিতার ‘বই আকাঙ্খার মানচিত্র গোপনে এঁকেছি’ বইটিতে বেশ কিছু মুদ্রণ প্রমাদ আছে। যেমন—

১. 'এই রাতে আয়াতের মতো ঝরে পরে আমার শরীরে' --এখানে ‘ঝরে পড়া’ শব্দ ঝরে পরা হয়েছে।

২. 'ইচ্ছে হয় দেখে আসি একদান বহুদিন পর নিতান্ত কৌতূহলে নভীযানে চড়ে' বাক্যটিতে একদান শব্দটি ভুল।

৩. সৌন্দর্য্য লিখেছেন--হবে সৌন্দর্য।

৪. 'বাহ, কি চমৎকার পরিণতি আমাদের প্রিয়তম ছেলেটার।' -এখানে ‘কি’ নয়--হবে ‘কী’ শব্দটি।

৫. উদবাস্তু লিখেছেন--হবে উদ্বাস্তু।

৬.উসকে লিখেছেন—হবে হসন্তযুক্ত ‘উস্‌কে’। কারণ অন্যত্র তিনি কোন্‌ লিখেছে হসন্ত দিয়ে। একইভাবে মহাত্মন লিখেছেন--লেখা উচিত ছিল মহাত্মন্‌।

৭. বাদিক লিখেছেন--হবে বাঁদিক।

৮. রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন তুহুঁ মম স্যাম সমান লিখেছেন। কিন্তু উদ্ধৃতি চিহ্ন দেননি।

৯. "আমার আবেগ তাকে জানিয়েছি 'প্রিয়তমা' বলে প্রখম প্রথম।" --এখানে প্রখম বলে শব্দ কোথায় পেলেন? হবে প্রথম প্রথম।

১০. দর্পন লিখেছেন। হবে দর্পণ।

১১. লিখেছেন 'শক্র’। হবে ‘শত্রু’

তানিয়ার বইয়ে পরিপার্শ্ব নামে একটি শব্দের ভুলের কারণে তানিয়াকে যদি ভাষাজ্ঞানে মূর্খ হিসেবে রাজু আলাউদ্দিন প্রতিপন্ন করেন তবে কবিতার বইয়ে ১০ টি ভুলের জন্য রাজু আলাউদ্দিনকে কী বলা যায়?


সাগুফতা তানিয়ার অনুবাদকৃত বইয়ে ‘লালা’ ও ‘সের’ নামে আরো দুটো ভুল আবিষ্কার করেছেন রাজু আলাউদ্দিন।
বইটিতে লেখা হয়েছেন--
“মারিও হিমেনেজ প্রায় এক গেলাস লালা গিলে ফেলে চেঁচিয়ে উঠল, 'আরে কী সাংঘাতিক!”

এখানে লালা শব্দটি হবে না বলে দাবী করেছেন রাজু আলাউদ্দিন। থুথু হবে।

লালা আর থুথু একই জিনিস। এটা লালাগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। সাধারণত থুথু ঘৃণা অর্থে ব্যবহৃত হয়। থুথু গেলা হয় না। বাইরে ফেলে দেওয়া হয়। আর লালা শব্দটির সঙ্গে কামনা-বাসনা বিষয় জড়িত। যেমন তেঁতুল দেখে লালা নির্গত হয়। ফলে থুথুর বদলে লালা গিলে ফেলাটার মধ্যে কোনো ভুল আছে বলে মনে হয় না। যে পরিমাণ লালা গিলেছে তা মাপলে গেলাস পরিমাণ হবে।

দ্বিতীয়ত আরেকটি বাক্য উল্লেখ করেছেন রাজু আলাউদ্দিন। সেটা হলো--'প্রতিদিন উনি সেরকে সের চিঠি পান।' চিঠির পরিমাণকে সের বলাটা হাস্য বলে উপহাস করেছেন রাজু আলাউদ্দিন। তার মতে এখানে গাদা গাদা হওয়াটাই বাঞ্চনীয়। কথা হলো পোস্টম্যান লোকটি পিঠে করে চিঠির বস্তা নিয়ে পাহাড় বেয়ে ওঠে। তার ভারে তাঁর পিঠ বেঁকে যায়। এইখানে বস্তার এই ওজোনকে সের কে সের হওয়াটাই সঠিক। আবার যিনি চিঠির প্রাপক পান গাদা গাদা।

বাংলা ভাষায় অসংখ্য সমার্থক শব্দ আছে| ফলে এক শব্দে পড়ে থাকতে হবে কেনো? আর কবি কথাসাহিত্যিকদের অন্যতম কাজ হলো শব্দের নতুন অর্থদ্যোতনা সৃষ্টি করা। নইলে ভাষায় জড়তা আসে। মনে করুন রবি ঠাকুরের গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির পথ গানিটির কথা। সেখানে কবি লিখেছেন-- ও যে কেড়ে আমায় নিয়ে যায় রে যায় রে কোন্‌ চুলায় রে। এখানে চুলায় শব্দটির ব্যবহার লক্ষ করুন। কবি কি আগুনের চুলায় পড়ার কথা বলেছেন? না আস্থানা শব্দটির সমার্থ হিসেবে বলেছেন? সে হিসেবে গেলাশ, সের শব্দের বিষয়টি মিলিয়ে দেখুন।

এরকম শব্দ ব্যবহারকে আপনি হয়তো পছন্দ না করতে পারেন। সেটা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। কিন্তু টিকাটিপ্পনি উপহাস করে লেখককে বাতিল করে দেওয়ার কোসেস করবেন—এই সাহিত্য-পুলিশির অধিকার কে দিয়েছে রাজু আলাউদ্দিনকে?


ভিন্নমত প্রকাশ করার কারণে রাজু আলাউদ্দিন আমাকে দুইবার ফেসবুক থেকে ব্লক করে দিয়েছেন। তিনি ভিন্নমতকে সহ্য করতে পারেন না। এটা এক ধরনের মৌলবাদীতা।

আরেকজন কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ সাগুফতা শারমীন তানিয়ার লেখার প্রশংসা করলে রাজু আলাউদ্দিন তানিয়াকে সুব্রতর রক্ষিতা বলেছেন। এটা রাজু আলাউদ্দিনের একটি চরম পুরুষতান্ত্রিক নোংরা মানসিকতার উদাহরণ। তিনি কবির মুখোশের আড়ালে একটি লোলচর্ম নারীবিরোধী ধর্ষক পুরুষের মুখের অধিকারি এটা বহুদিন পরে প্রকাশ করে দিলেন।

সুব্রত রাজুকে গাধা বলে গালি দিয়েছেন। সেজন্য রাজু সুব্রতকে গরু বলে গালি হয়তো বা দিতে পারেন। কিন্তু তানিয়া তাকে কোনো গালি দেননি। তাহলে তানিয়াকে গালি দেওয়ার অর্থ কি? আর গালিটা আর দশটা নিরীহ গালি নয়। সোজা রক্ষিতা বলে ঘোষণা দেওয়া। তিনি কি সুব্রতকে বা অন্য পুরুষকে রক্ষিত বলে গালি দিতে সাহস করতেন? মনে হয় না। মেয়ে বলেই পেরেছেন। মেয়েদেরকে যৌনত্মকভাবে অপমান করাটা প্রতিক্রিয়াশীল পুরুষদের জন্য অতি সহজ কাজ। হেফাজতে ইসলামীর শফি হুজুরদের চেয়ে রাজু আলাউদ্দিন কি কোনো অংশ কম নারী বিরোধী মৌলবাদী?


রাজু আলাউদ্দিনকে আমি পছন্দ করতাম। তিনি মফস্বল শহর থেকে এসে নিজের উদ্যোগে পড়াশুনা করেছেন। নিজেকে সাহিত্যের ক্ষেত্রে গুরত্বপূর্ণ করে তুলেছেন। ভালো বাংলা লিখতে পারেন। বিভিন্ন ভাষায়ও তার দক্ষতা ভালো। স্প্যানিশ ভাষায় তার অনুবাদগুলো বেশ কাজের। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। ফলে তিনি দায়িত্ব জ্ঞানহীন লোকের মতো যাখুশি তাই বলতে পারেন না। স্প্যানিশ ভাষা জানেন বলে অন্য কেউ সেই ভাষার কোনো অনুবাদকর্ম করতে পারবেন না, করলে তিনি খড়গ হস্ত হবেন, তার অনুমতি নিয়ে স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করতে হবে এই ধরনের কর্তৃত্ব তিনি নিলেন কিভাবে?

আমার ধারণা রাজু আলাউদ্দিন সাগুফতা শারমীন তানিয়াকে পরিকল্পনা করে অপমান করেছেন। এটা নতুন নয়। তানিয়ার বইপত্র বের হলেই তিনি অপমান করে আসছেন। এটা এক ধরনের উন্মাদ রোগে পরিণত হয়েছে। এটা একটা বড়ো ধরনের শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কোনো সভ্য মানুষ হলে রাজু আলাউদ্দিন ফেসবুকে ভুল স্বীকার করতেন। অপরাধ করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। এর কিছুই তিনি করেন নি। তিনি তাঁর স্বৈরাচারী পুরুষতান্ত্রিক অবস্থানকে ধরে রেখেছেন।

একজন সহলেখক হিসেবে পুরুষ হিসেবে মানুষ হিসেবে সাগুফতা শারমীন তানিয়া,আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি বোন।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------


সংযুক্ত ১.
ফেসবুকে রাজু আলাউদ্দিনের লেখা স্ট্যাটাস

বিরতিহীন জোচ্চুরি ও ভ্রান্তিবিলাস

ঈদের উপহার হিসেবেই এক বন্ধু বইটি দিয়েছিল। আর বিশেষ করে এই বইটিই দেয়ার পেছনে মূল কারণ, আমি স্প্যানিশ সাহিত্যের অনুরাগী। নেরুদা সেই অনুরাগের শীর্ষে-- সেটাও সে জানে। যদিও বইটি স্প্যানিশে আমার আগেই পড়া ছিল, সিনেমাটিও দেখেছি। কিন্তু বাংলা তর্জমায় বইটি পড়তে গিয়ে হতাশ হতে হলো দুটো কারণে। এক, বইটি প্রথম থেকে বেরিয়েছে যারা বিদেশি বই প্রকাশ করে মূল লেখক এবং ইংরেজি অনুবাদকের অনুমতি না নিয়ে এবং তাদেরকে প্রাপ্য সম্মানি থেকে বঞ্চিত করে। এই বইটির ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। যেই প্রথম আলো গাল ফুলিয়ে, ডঙ্কা বাজিয়ে, বাংলার অলিগলিতে চিৎকার করে বলে আলোর কথা, ন্যায়ের। কথা, আর বলে বিবেকের কথা-- সেই প্রথম আলোর ভগ্নি-প্রতিষ্ঠান প্রথমা হয়ে উঠেছে প্রতারণার পরাকাষ্ঠা। এবার তারা প্রকাশ করেছে পাবলো নেরুদাকে নিয়ে আন্তনিও স্কারমেতার বিখ্যাত বইটি। একের পর এক বিদেশি বই তারা অনুমতি ছাড়া প্রকাশ করে যাচ্ছে | নির্লজ্জভাবে। এই অপরাধের পাশাপাশি আছে তাদের অনুবাদকদের জোচ্চুরি। তারা বাংলা অনুবাদে বইটির পরিচিতি পত্রে লিখেছে : ‘মুল বই আরদিয়েন্তে। পাসিয়েন্সিয়ার(১৯৮৫, চিলি)ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য পোস্টম্যান'। কিন্তু বইটির কোথায়ও উল্লেখ নেই এটির অনুবাদক সাগুফতা শারমীন তানিয়া মূল স্প্যানিশ থেকে নাকি ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় তর্জমা করেছেন। বইটির কোথায়ও মূল লেখক বা ইংরেজি অনুবাদকের স্বত্বের উল্লেখ নেই, নেই ইংরেজি অনুবাদকের নামটিও। কিন্তু কথায় বলে, মূলার চেয়ে দেরা বড়, তাই মূল নয়, ওই দেরা-ই অনুবাদস্বত্ব অধিকার করে বসে আছে।

আর অনুবাদও যাচ্ছে তাই। | প্রথম পৃষ্ঠাটি নিতান্ত কৌতুহলবশত অনেক কষ্টে যদিও বা পেরিয়ে গেছি, দ্বিতীয় পৃষ্ঠা থেকে শুরু হয়েছে বিপত্তি। দুটো উদাহরণ দেই। এক: মারিও হিমেনেজ প্রায় এক গেলাস লালা গিলে ফেলে চেঁচিয়ে উঠল, 'আরে কী সাংঘাতিক!

দুই : তুমি ভাবছ কাজটা দারুণ? প্রতিদিন উনি সেরকে সের চিঠি পান।

প্রথমটি সম্পর্কে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, লালা হয়তো নয়, খুব সম্ভবত মুখের ভেতরে জমা থুথু বিস্ময়ে, অভিভূত হয়ে গিলে ফেলেছেন মারিও। কিন্তু অনুবাদক বলেছেন ‘লালা'। স্প্যানিশ, মানে মূলে শব্দটা ছিল Saliva, এর অর্থ থুথু। কিন্তু লালা হচ্ছে মুখ থেকে ঝরে পড়া লালা, যেমন শিশুদের মুখ থেকে লালা ঝরে। সুতরাং ওটা লালা নয়, হওয়া উচিত থুথু'। দ্বিতীয়ত এক গেলাস তিনি কোথায় পেলেন? মূলে বলতে চেয়েছে মুখে জমে থাকা সবটা থুথু তিনি গিলে ফেলেছেন। কিন্তু এক গেলাস দিয়ে বুঝাবার মতো হাস্যকর অভিব্যক্তি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য ও শোভন হতে পারে না। বাংলা অভিব্যক্তিতেও ওটা স্বাভাবিক নয়।

এবার দ্বিতীয় উদ্ধৃতি লক্ষ্য করুন; 'প্রতিদিন উনি সেরকে সের চিঠি পান।' একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকলেই আমরা বুঝতে পারবো যে উনি প্রচুর চিঠি পান-- এই কথাটাই বুঝাতে চেয়েছে। সেরকে সের'-এর এই আক্ষরিক অভিব্যক্তি এড়িয়ে বাক্যটিকে আরও নিকটবর্তী ও স্বাভাবিক করে বলা যেত প্রতিদিন উনি গাদা গাদা ঠিঠি পান। বাক্যটি আসলে একথাই বুঝাতে চেয়েছে। অনুবাদক যদি মূল থেকে করে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে উনি মূল ভাষার শব্দার্থই শুধু জানেন, কিন্তু শব্দ ও বাক্যের সত্যিকারের অভিব্যক্তি সম্পর্কে মোটেই অবগত নন। অনুবাদক পোনে দুই পৃষ্ঠার একটি ভূমিকা লিখেছেন। তাতে ভাষিক গোলমালের একটি নমুনা দেখলেই বুঝতে পারবেন, অন্য ভাষা তো দূরের কথা নিজের ভাষাটিও ঠিকমত জানেন না। তিনি লিখেছেন 'সে পারিপার্শ্বকে চেনে কবিতার দেদীপ্যমান আলোয়,'। আমরা জানি ‘পরিপার্শ্ব' বা 'পারিপার্শ্বিক' শব্দ। কিন্তু পারিপার্শ্ব কি ব্যকরণসম্মত?

এই বইটির মাধ্যমে প্রথমা প্রকাশনী প্রতারণা, জোছুরি ও | ভ্রান্তির ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করে তুললো।

-------------------------------------------------------------------------------------------------------------

সংযুক্ত ২.
সাগুফতা শারমীন তানিয়ার স্ট্যাটাস

রাজু আলাউদ্দিন আমার অনূদিত বইয়ের আলোচনা করতে গিয়ে তাঁর অশালীন এবং সুইপিং কমেন্টে ভরা পোস্টে স্বপ্রণোদিত হয়ে আমাকে যা যা বলেছেন তা নিম্নরূপঃ

১. অনুবাদক অসৎ
২. অনুবাদক জোচ্চর

৩. অনুবাদক "অনুবাদক পোনে দুই পৃষ্ঠার একটি ভূমিকা লিখেছেন। তাতে ভাষিক গোলমালের একটি নমুনা দেখলেই বুঝতে পারবেন, অন্য ভাষা তো দূরের কথা নিজের ভাষাটিও ঠিকমত জানেন না।" (ভাষিক গোলমাল হিসেবে তিনি 'পরিপার্শ্ব'কে পারিপার্শ্ব লিখবার কথা উল্লেখ করেছেন। আমি আজ জিমেইলে ঘেঁটে দেখলাম, আমার দিকের অ্যাটাচমেন্টে আমার টাইপে 'পারিপার্শ্ব' নেই, পরিপার্শ্ব আছে। এই শব্দ আমি জানি এও প্রমাণ করতে হচ্ছে, হায়। এই একটি টাইপোর প্রেক্ষিতে আমার ভাষাজ্ঞান নাকচ হয়ে যাচ্ছে, এবং নাকচ করছেন রাজু, হায় হায়।)

৪. অনুবাদক মানবেন্দ্রর বই টুকলি করে এ বই করেছেন।
৫. অনুবাদক কান্ডজ্ঞানহীন

অন্যান্যরা এ পোস্টের প্রতিবাদ করতে থাকলে রাজু সেইসব পোস্ট গায়েব করে দেন এবং পোস্টদাতাদের ব্লক করে দেন। সুব্রতদা রাজুকে প্রতিভাহীন বলায় রাজু ক্ষিপ্ত হয়ে অতঃপর অনুবাদক এবং এইরকম মেয়েরা যাদের সুব্রত অগাস্টিন প্রশংসা করেন, তাদের 'সুব্রতর রক্ষিতা' বলেছেন। (এরশাদের আমলে আমরা একটা খবর শুনতাম প্রায়ই, 'উত্তেজিত জনতা পুলিশের বন্দুক কেড়ে নিতে গেলে পুলিশ গুলি করতে বাধ্য হয়'।) একুনে--

৬. অনুবাদক রক্ষিতা।

এবার আসি তাঁর বের করা 'ভুল' প্রসঙ্গে।

রাজু থুতু আর লালার তফাত বুঝিয়েছেন ওঁর পোস্টে। উপন্যাসিকার এই অংশটা কমিক, ফলে অতিশায়ন আছে, ‘প্রায় এক গেলাস লালা’র কথা সেকারণেই এসেছে। সদ্যতরুণ মারিও তার লোভনীয় চাকরির বিবরণ শুনছিল এখানে, প্রলুব্ধ একজন মানুষ লালাই গেলে, ক্ষুব্ধ লোকে থুতু ফেলে। জুবায়ের মাহবুবের পোস্ট থেকে ধার নিয়ে জানাচ্ছি—

Un litro de saliva (original)
- A quart of saliva
- এক গেলাস লালা

Kilos de correspondencia (original)
- Tons of mail
- সেরকে সের চিঠি।

একজন ডাকপিয়নকে বোঝানো হচ্ছে তাঁকে প্রতিদিন কী পরিমাণ চিঠির বোঝা পিঠে করে পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই সাইকেলে পার হয়ে নেরুদার কাছে পৌঁছতে হবে, সেখানে ‘গাদা-গাদা’ না বলে কোয়ান্টিফাই করা হবে, তাই তো স্বাভাবিক। সেই পরিমাপের বেলায় সের হবে না টন হবে এ তর্কের বাইরে আরো বহু দুরূহ দিক ছিল এ বইয়ে। তবে এই দু’টি ‘ভুল’ ধরতে পেরে উল্লসিত রাজু আর বাকি বইটি পড়েছেন কি না আমার সন্দেহ আছে। বায়াস থাকলে লোকে এমন করে, আগে পাশ করাবে না ফেল করাবে মনস্থির করে, পরে লাগসই কিছু বের করার চেষ্টা করে।

রাজু আলাউদ্দিন আমার প্রথম বই বের হবার পর লিখেছিলেন--"সুব্রত সাগুফতা শারমীনকে সার্টিফিকেট দিয়ে সাহিত্য করতে নিয়ে এসেছেন।" এগার বছর পর তাঁর লৈঙ্গিক সহিংসতা আরো মাত্রা পেয়েছে। এবারের পোস্টটি তিনি লিখেছেন আমাদের ঈদের দিনে, আমি মনে করি না এটা কাকতালীয়, বিস্মিত হবো না ভেবেও আমি তাঁর ভায়োলেন্সে বিস্মিত হয়েছি। যখন একাধিক মানুষ রাজুকে এই ব্যবহারের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেন এবং বলতে থাকেন, তখন পোস্ট গায়েব করে দিয়ে তিনি আরেকটি পোস্ট দিয়ে জানান-- ভদ্রতার স্বার্থে তাঁকে পোস্ট গায়েব করতে হলো।

যে প্রশ্ন পাবলিকেশনকে করার কথা তাতে তিনি বারবার আমাকে- আমার সততা এবং নিষ্ঠাকে জড়িয়েছেন। আমি তাঁকে শুধু একটিই প্রশ্ন করতে চাই--বোর্হেস-ইয়োসা এবং টেড হিউজের যে সাহিত্য তিনি অনুবাদ করেছেন তা কপিরাইটের আওতাধীন বলেই আমি জানি (আমার জানা আমার ব্যাকরণজ্ঞানের মতোই ঠুনকো হতে পারে।), তিনি কি এই বইয়ের লেখক-কবিদের পারমিশন নিয়েছিলেন?

Post a Comment

0 Comments