চিরকুট : মহাভারত-- যুধিষ্টির

 ঘটনাটা ছিল মহাভারতের। কৌরব আর পাণ্ডব--এই দুপক্ষে যুদ্ধ হচ্ছে। কৌরবদের পক্ষে সেদিন সেনাপতি ছিলেন দ্রোণাচার্য। তিনি দুপক্ষেরই গুরু। তিনি এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে—তার হাতে অস্ত্র থাকলে কেউ তাকে পরাজিত করতে পারবে না। ফলে পাণ্ডবরা হয়রান হয়ে গেল।

পাণ্ডবদের নেতা যুধিষ্টিরকে তাদের বুদ্ধিজীবি পরামর্শ দিলেন—দ্রোণাচার্য তার ছেলে আশ্বত্থামাকে খুব বেশি ভালোবাসেন। যদি তাকে অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ দেওয়া যায় তবে তিনি জীবনে বেঁচে থাকার আর কোনো কারণ খুঁজে পাবেন না। বিতশ্রদ্ধ হবেন। এবং অস্ত্র ত্যাগ করবেন। তখনই তাকে নিরস্ত্র অবস্থায় মারা যাবে।
কিন্তু সত্য হল আশ্বত্থামা বেঁচে আছেন। যুধিষ্টির ধর্মপুত্র। সত্যনিষ্ট। তিনি কখনো মিথ্যে বলেননি। সুতরাং এই যুধিষ্টির যদি যুদ্ধের সময় দ্রোণাচার্যকে অশ্বত্থামার ভুয়া মৃত্যু সংবাদও দেন—তবে তিনি তা বিশ্বাস করবেন।এবং তখন পাণ্ডবদের বিজয় সম্ভব হবে।
যুধিষ্টির রাজী হলেন না এই মিথ্যে সংবাদ বলতে। তখন তার পরামর্শদাতারা বললেন, ওকে। আপনাকে মিথ্যে কথা লাগবে না। আমরা অশ্বত্থামা নামে একটি হাতীকে মেরে ফেলব। তখন আপনি—অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ বলবেন।
তিনি বললেন, এটাও সম্ভব নয়। কারণ তিনি শুধু অশ্বত্থামা মারা গেছে বললে দ্রোণাচার্য বুঝবেন হাতী নয়—মারা গেছে তার ছেলে। এটি প্রতারণা করা হবে। বললে আমি বলতে পারি—অশ্বত্থামা নামে একটি হাতী মারা গেছে। তাতে তিনি মোটেই অস্ত্রত্যাগ করার মত দুঃখ পাবেন না। হাতির মৃত্যু আর ছেলের মৃত্যু এক নয়। তাহলে?
তার পরামর্শক তখন বললেন। ওকে—আপনি বাক্যটি একটু আগে পিছে করে বলবেন। বলবেন--অশ্বত্থামা মারা গেছে। এইটুকু বলবেন জোরে জোরে। তারপর খুব আস্তে করে বলবেন—অশ্বত্থামা নামে একটি হাতি মারা গেছে। বুড়ো হয়েছেন দ্রোণাচার্য—কানে শুনতে পাবেন না। ফলে তার ছেলে অশ্বত্থামা মরে গেছে ভেবে অস্ত্র ত্যাগ করা ছাড়া আর তার কোনো উপায় থাকবে না।


কিন্তু যুধিষ্টির বললেন—আস্তে বলার কারণেও তো তার কাছ থেকে আসল সত্যিকে লুকনো হবে। মিথ্যে বলা হবে।
পরামর্শক উত্তর করলেন, আপনি বলবেন কথার কথা হিসেবে। সত্যি হিসেবে তো আর বলছেন না। আর সত্যিটাও বলছেন—সেটা ধরতে না পারলে আপনার কি? আপনার দরকার দ্রোণাচার্যকে মারা। তাকে বাঁচানো নয়। ঠিক কিনা বলেন?
যুধিষ্টির জিজ্ঞেস করলেন, সেটা তো বুঝলাম, কিন্তু কথার কথা কি জিনিস?
পরামর্শক উত্তর করলেন, নিজের দরকারে যে কোনো আধা সত্যিকে পূর্ণ সত্যি করে তোলাকেই কথার কথা বলে। এতে সাপও মরে। আবার লাঠিও বাঁচে। যে কোনো অপরাধ করে ফেলা যায়। এবং সেই অপরাধের দায় থেকে আড়াল করার বিপুল সুযোগ থাকে। কথার কথা হল অপরাধীদের অপরাধ করার সেলফ-পারমিট।
যুধিষ্টির আর কিছু বললেন না। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে দ্রোণাচার্যকে জোরে চেঁচিয়ে বললেন, গুরু, অশ্বত্থামা মারা গেছে।
ধর্মপুত্র যুধিষ্টিরের মুখ থেকে এইটুকু শুনেই দ্রোণাচার্য একে কথার কথা হিসেবে ধরলেন না। সত্যি বলেই মনে করলেন। তিনি অস্ত্র ত্যাগ করলেন। তিনি মারা পড়লেন। এর মধ্যে যুধিষ্টির হাতী মরার কথাটিও বলেছিলেন। তবে জোরে নয়। খুব আস্তে।
তাহলে কথার কথা হিসেবে বলার কারণে একজন ইনোসেন্ট মানুষ মারা গেলেন। এই কথার কথাটা খুনের কারণ হিসেবে কাজ করল। তাহলে যুধিষ্টির কি হলেন?
উত্তর--খুনি।
আর কেউ না জানুক—মহাভারতের ঈশ্বর জানতেন। ঈশ্বর তাকে নরকে পাঠিয়েছিলেন এই খুনের দায়ে।




Post a Comment

0 Comments