রুমা মোদকের গল্প ‘প্রসঙ্গটি বিব্রতকর’ নিয়ে আলাপ

 রুমা মোদক বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক। নাট্যকার। অভিনেত্রী। সংসারী মানুষ। থাকেন মফস্বলে। তার পঠন- পাঠনও ঈর্ষণীয়। নানাবিধ ব্যস্ততার মধ্যে নিয়মিত গল্প লিখছেন। তিনি অভিজ্ঞতার ভেতর থেকেই লেখেন। ফলে তাঁর গল্প যেমন সাহিত্যের মান মেনে চলে ঠিক তেমনি সামাজিক ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে।

রুমা মোদক গল্পপাঠে এই ‘প্রসঙ্গটি বিব্রতকর’  গল্পটি দিয়েছেন।গল্পটির আখ্যান আপাতভাবে সরল ভ্রমণের অংশ। কিন্তু গল্পটির প্রতিটি পর্বেই ভয়ঙ্কর জটিল বহুরৈখিক গুপ্ত সত্যকে উন্মোচন করে যা কোনো পাঠকের যে কোনো পুর্ব-অনুমানকে মিথ্যে প্রমাণিত করে দেয়। এরকম চমকপূর্ণ মহৎ গল্প বাংলা সাহিত্যে  খুব বেশি লেখা হয়নি।গল্পটির কলকব্জা নিয়ে গল্পকার রুমা মোদকের সঙ্গে কুলদা রায় কথা বলেছেন। মূল গল্প 'প্রসঙ্গটি বিব্রতকর' পড়ার লিঙ্ক

 
কুলদা রায় : ১/ 
আপনার প্রসঙ্গটি বিব্রতকর গল্পটি লেখার বীজ কিভাবে পেলেন?

রুমা মোদক : ১/ 
 বীজ তো আমাদের দেশের বিগত কয়েকটি দশকের রাজনৈতিক বাস্তবতার মাঝেই বিদ্যমান। আর ঘটনা চরিত্রের কথা যদি বলেন তার পুরোটাই অভিজ্ঞতাজাত। স্কুলে পড়ি তখন। ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশ তখন উত্তপ্ত। আমার এক বান্ধবী গল্প করছিল--ওর ঠাম্মা ওকে বলেছে সবসময় প্যান্টি পরে থাকতে। আমরা তখন সবে এসব ব্যবহারের বয়সে প্রবেশ করেছি।
পরে বুঝতে পেরেছিলাম এই বয়োজ্যষ্ঠ মহিলা তার জীবনে কী ভীষণ সাম্প্রদায়িক প্রতিকূলতার ভিতর দিয়ে গেছেন। ৪৭ এর দেশভাগ,নোয়াখালীর রায়ট,৬৫ এর দাঙ্গা। জীবনের বিরূপ অভিজ্ঞতায় প্রতিকারহীন অসহায়ত্বে তিনি এরচেয়ে বেশি আর কী বা বলতে পারেন?

আর তার আরো প্রায় ১৫/১৬ বছর পর আমার বাসায় বেড়াতে আসা জনৈক অতিথির ব্যবহারের এ জিনিসটি হারিয়ে যাওয়া যাওয়ার একটি ঘটনা ঘটে আর আমার ঘরের গৃহপরিচারিকার প্রতি সন্দেহ করা হয়। ভিন্ন সময়ের ভিন্ন দুটো ঘটনাকে কানেক্ট করে গল্প লেখার ধারণাটি এসেছে বছরখানেক আগে।



কুলদা রায় : ২/ 
 বীজ পাওয়ার পরই কি সরাসরি লিখতে শুরু করলেন? না, বীজটিকে বিস্তার ঘটাতে সময় নিলেন? কোনো খসড়া করে নিয়েছিলে? খসড়া যদি করে থাকেন তাহলে সেই খসড়াটি কি ধরনের হয়েছিল? শুধু কি সার সংক্ষেপ করেছিলেন? নাকি, স্ক্রিপ্ট করে নিয়েছিলেন? কতদিন পরে লিখতে শুরু করলেন? কতদিন সময় নিয়েছিলেন লিখতে?

রুমা মোদক : ২/ 
 না, বীজটি মাথায় নিয়ে ঘুরেছি বছরখানেক। লিখবো লিখবো ভাবছি।এরকমটা আমার সব লেখার ক্ষেত্রেই হয়। লেখার প্লট মাথায় আসার পর আঙ্গিক প্রকাশভঙ্গি নিয়ে অনেক অনেকদিন ভাবি। হয়তো লিখতে সময় নেই খুব কম। ঈদুল ফিতর সংখ্যার জন্য লেখা চাইলো রাইজিং বিডি ডট কমের সাহিত্য সম্পাদক তাপস রায়। আমি তখন মাথায় নিয়ে ঘুরতে থাকা প্লটটি কাগজে কলমে প্রাণ দেয়ার কথা ভাবলাম। ঘর সংসার চাকরি সন্তান থিয়েটার নানান ব্যস্ততা। কয়েক দফা কাগজ নিয়ে বসলাম। হলো না। লেখা পাঠানোর ডেডলাইন চলে গেলো। তাপস আর নক করে না। ভেবেছে, বোধহয়-- অবহেলা করে দিচ্ছি না। এরকম তাড়াময় জীবনের ফাঁকে ফাঁকে খসড়াটা তৈরি করলাম। পরে একদিন গভীর রাতে বসে এক বসাতেই গল্পটি চূড়ান্ত করে ফেললাম। আমি এখনো কাগজে কলমে লিখি। কম্পোজ করে আমিই তাপসকে নক করলাম। লেখা শেষ। ঈদ সংখ্যায় দিতে চাই। তাপস রিপ্লাই দিলো- এখনতো আর হবে না দিদি। গেট আপ দেয়া হয়ে গেছে। দেরি করে ফেললেন। তারপর হয়তো ভদ্রতা বশত আবার বললো- আচ্ছা পাঠান দেখি। কিছু করতে পারি নাকি। গল্পটি পড়ার পর ইনবক্সে ও খুব উচ্ছসিত হয়ে লিখলো- দিদি বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য গল্প সংযোজিত হলো। গল্পটি রাইজিং বিডি ডট কম ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হলো।

কুলদা রায় : ৩/ 
 লেখার আগে কি কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন বা কোনো ফিল্ড ওয়ার্ক করেছিলেন?

রুমা মোদক : ৩/ 
না গল্পটি কোনো তথ্য ভিত্তিক নয়। এটি লিখতে কোনো গবেষক বিশ্লেষক এর সাথে আলাপ করার প্রয়োজন পড়েনি।


কুলদা রায় : ৪
 গল্পটির যে চরিত্রগুলো কি গল্পের বীজের সঙ্গেই এসেছিল? না, খসড়ার সময়ে? নাকি লিখতে লিখতে এসে গেল?

রুমা মোদক : ৪/ 
এই গল্পের চরিত্রগুলি কেঊই গল্পের বীজের সাথে সম্পর্কিত নয়। চরিত্রগুলি আমার ব্যাক্তিগত ভাবে চেনা নয়। আবার অচেনাও তো নয়। আমি বাংলাদেশের প্রান্তিক অঞ্চলের হিন্দু ধর্মাবলম্বী ঘরের মেয়ে। শিক্ষা সামাজিকতা সাংস্কৃতিক যে প্রয়োজনেই ঘর থেকে বের হয়েছি নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। নানা শ্রেণি পেশা সাংস্কৃতিক অভিরুচির মানুষের সাথে প্রতিদিন দেখা হয়েছে। আসলে মানুষের আচরণ পরিবর্তন পরিবেশকে দেখার কিংবা বিশ্লেষণ করার দৃষ্টিভঙ্গি সবার তো এক নয়। পারিবারিক শিক্ষা, পরিবেশ, পাঠের জগত নানা কিছু প্রভাব বিস্তার করে। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আপাত চেনা জগত থেকে চরিত্রগুলো খুঁজে নিয়ে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তৈরি করে নিয়েছি।

লেখার ক্ষেত্রে এটা আমার দুর্বলতা বলুন বা অক্ষমতা বলুন-- অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে আমি কিচ্ছু লিখতে পারি না। হয়তো লিখি খুব কম। কিন্তু আরোপ করে লেখার চেষ্টা একেবারেই করি না। তাই বলে যা লিখি সবই হুবহু অভিজ্ঞতার বয়ান নয় কখনোই।


কুলদা রায় : ৫/ 
 গল্পটিতে দুটি পর্যায় আছে। একটি হল বাংলাদেশের নির্বাচনকালে সংখ্যালঘুদের উপর যে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ণ-নির্যাতন নেমে আসে সেটা। এবং দ্বিতীয়টি হল-- পরবর্তীকালে একটি উচ্চ বিত্ত হিন্দু পরিবারে তিনজন মেয়ের ভ্রমণ। এই পরিবারের কেউ সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কিনা জানা যায় না। কিন্তু এ বাড়িটিকে কেন্দ্র করে আখ্যান বর্ণিত হচ্ছে। এ বাড়ির কেউ এই সাম্প্রদায়িক ঝামেলা নিয়ে কথাও বলে না। কিন্তু এটাই এ গল্পের কী পয়েন্ট। এটা কি প্লান করে করেছেন? গল্পটি লেখার আগেই প্লান করে নিয়েছিলেন? না, লিখতে লিখতে প্লানটি এসে গেছে?

রুমা মোদক : ৫/ 
 ঠিক প্ল্যান করে বলা যায় কিনা জানিনা। বলতে পারি অভিজ্ঞতালব্ধ অভিজ্ঞান। দুটি পরিস্থিতির প্রথমটি এদেশের নির্বাচন কালীন বাস্তবতা যা ভূমিকার মতো যুক্ত করেছি। মূল গল্পের অন্তর্নিহিত বক্তব্যটা পাঠক মনোযোগের কেন্দ্রতে নিয়ে আসার জন্য এই ভুমিকাটুকু সংযোজন আমার কাছে প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে।

আর মূল গল্পে একটি উচ্চবিত্ত পরিবারে যে তিনটি মেয়ের ভ্রমণ তারা সবাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এ দেশে তো হিন্দু মুসলমানে সামাজিক এ সম্পর্ক খুবই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দু পরিবারটির আপাত ভালো থাকার সাথে প্রাথমিক পরিচয় ঘটছে মেয়ে তিনটির। প্রকাশ্যে নিজেদের অসহায়ত্ব নিরাপত্তাহীনতা প্রকাশের চর্চা কিংবা প্রতিরোধ স্পৃহা এদেশের হিন্দুদের মধ্যে একদমই নেই। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে ভিতরে ভিতরে তারা প্রতিনিয়ত নিজস্ব সংস্কৃতি সংস্কার বিচ্যুত হবার শঙ্কায় বিপন্ন জীবন যাপন করে। এ শঙ্কা যে সবসময়ই যৌক্তিক তাও কিন্তু নয়। সম্ভবত সর্বত্রই এটা সংখালঘুদের মাঝে দৃশ্যমান। এবং বিষয়টা পুরোপুরি হীনমণ্যতা জাত। আর এই নির্যাতন মূর্তিভাঙা মন্দিরভাঙা এসব তো মোটাদাগের ব্যাপার। খালি চোখে সবাই দেখতে পায়। অন্তর্গত ব্যাপারগুলি সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না।

এখানেও মূল চরিত্র মোনা হিন্দু পরিবারটির আচরণগত সংস্কার বা অসংগতিগুলো যেভাবে দেখছে,বাকী দুজন কিন্তু সেভাবে দেখছে না। মোনা দেখছে, কারণ সে দেখতে চাইছে। অন্তরংগের সাম্প্রদায়িকতা বা সংকটটা তার নিজের জন্য তলিয়ে দেখাটা প্রয়োজন ছিলো। এখন আমি যদি এ গল্পের সিক্যুয়েল লিখতে চাই, তবে অভিজ্ঞতায় হয়তো দেখবো পরিবারের বড় ছেলেটি একটি মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করে ফেলতে পারে ভেবে রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে ভারত চলে গেছে। যাদের উপর আদতেই কোনো সাম্প্রদায়িক অত্যাচার করা হয় নি তারা কেনো দেশ ছাড়লো? মূলত মানসিকতায় এ সমাজ কিন্তু এখনো আধা সামন্ততান্ত্রিক। সম্পূর্ণ পুঁজিবাদী কিংবা স্ব স্ব বিশ্বাস সংস্কার সংস্কৃতি নিয়ে নির্বিবাদে সহাবস্থান করার মতো সভ্য সংস্কৃতিমান কোনটাই এ সমাজ এখনো হয়ে উঠেনি।


কুলদা রায় : ৬/ 
 গল্পটির চরিত্রগুলো খুবই ঠাণ্ডাপ্রকৃতির মানুষ। সেভাবে কেউই উত্তেজিত হয় না। কোনো মেলাড্রামাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। প্রকাশ্য কোনো কনফ্লিক্ট দেখতে পাইনা যাচ্ছে না। কিন্তু অন্তরপ্রবাহী কনফ্লিক্ট পাওয়া যায়। সেটাই গল্পের আকর্ষণ হয়ে দাঁড়ায়। পাঠককে টেনশনে ফেলে দেয়। এই যে মনস্তাত্ত্বিক কনফ্লিক্ট খুবই পরিণত একটা ক্রাফট। এটা আয়ত্ত করার জন্য কি কি করতে হয়েছে আপনাকে?

রুমা মোদক : ৬/
 'মনস্তাত্বিক কনফ্লিক্ট' আমার লেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে আগ্রহটার জন্ম। আমার গল্পে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সংকটে নানা শ্রেণির মানুষের মানসিক টানাপোড়েনকেই স্পর্শ করতে চাই বারবার। এবং এক্ষেত্রে আমার নিজস্ব একটা থিউরি আছে। আমি যাকে জানি বা চিনি,যাকে নিয়ে লিখতে চাই, আমি আমাকে আমার বাস্তবতা থেকে বিচ্যূত করে পুরোপুরি তার জায়গায় প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করি। অনেকটা ধ্যানীর মতো পর্যবেক্ষণ করতে চাই সেই পরিবেশ পরিস্থিতি আচরণ।


কুলদা রায় : ৭/ 
 আমরা সচরাচর যে সব গল্প পড়ার সুযোগ পাই বাংলাদেশে সেখানে সাম্প্রদায়িক নির্রযাতন নিপীড়ণের আখ্যান খুবই কম পাওয়া যায়। এক ধরনের এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা আছে গল্পকারদের। এটা অনেকটা সেলফ সেনসরের মত স্বভাব। যদিও কেউ সাহস করে লেখেন সেটা এক ধরনের এক রৈখিক আখ্যান হয়ে ওঠে। একপক্ষ ভিলেন, আরেকপক্ষ নায়কের মত ব্যাপার। ভালোমন্দের দ্বন্দ্বের পুরনো স্টাইল। এটা মেলাড্রামাটিক হয়ে যায়। পাঠক শেষে তৃপ্তি পায়। নতুন কোনো উন্মোচন থাকে না। কিন্তু এই কাহিনীতে আপনি ভিন্ন পারস্পেকশন থেকে আখ্যানটিকে নিয়ে এসেছেন। সেখানে সাম্প্রদায়িকতার নতুন একটি দিক উন্মোচন করেছেন। বহিরাঙ্গের চেয়ে অন্তরঙ্গের সাম্প্রদায়িকতাকে সামনে এনেছেন। এটা করার পেছনে আপনার উদ্দেশ্য কি ছিল?


রুমা মোদক : ৭/ 
 এ নিয়ে আমার আরো কাজ করার ইচ্ছে আছে। ক্ষুদ্র জীবনের বহুল বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা। একজন লেখককে তো একরৈখিক হলে চলে না। তাকে নিরাসক্ত হয়ে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। উপস্থাপনের ক্ষেত্রে হয়তো দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ ঘটে।

হ্যা দেশের যা অবস্থা তাতে তো আমাকেও সেল্ফ সেন্সরশিপের মধ্যে থাকতে হয়। তা মোটেই পক্ষপাতমূলক বা আপোষকামিতা নয়।

আর আপনি যা বললেন " ভিন্ন পারফেকশন " বা "অন্তরঙ্গের সাম্প্রদায়িকতা" ব্যাপারটি তো সচেতন ভাবেই করতে চেয়েছি। পাঠক হিসাবে কিংবা সমালোচক হিসাবে বিষয়টি যদি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে তবে লেখক হিসাবে আমি সামান্য তৃপ্তি পাই এই ভেবে যে উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এখানে নিম্নবিত্ত হিন্দু মেয়েটি- পার্বতী,মুসলিম মেয়ে মোনার প্যান্টি চুরি করে নিজের ইজ্জত বাঁচানোর আকাঙ্ক্ষায়।একটি প্রতীকী ব্যঞ্জনা ও এখানে দিতে চেয়েছিলাম।

কুলদা রায় : ৮/ 
 পার্বতী বাড়িটির পরিচারিকা। গল্পের শেষ দিকে তার প্যান্টি চুরি করার মধ্যে দিয়ে দরিদ্র মানুষের সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের নির্মম পরিস্থিতিটি পাওয়া যায়। কিন্তু উচ্চবিত্ত হিন্দু পরেবারের কেউই এই বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতার কথা বলে না। তাহলে কি দেশে নিম্নবিত্ততের মানুষই সাম্প্রিদায়ক নির্যাতনের প্রধান শিকার?

রুমা মোদক : ৮/
 পার্বতীরা যে শ্রেণির সে শ্রেণির মেয়েরা সাম্প্রদায়িক কারণে স্যাক্সুয়ালি এবিউজড হয় বেশি। আর উচ্চবিত্তরা বেশি নিপীড়নের স্বীকার হয় অর্থনৈতিক ভাবে। এ দেশের এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানে চাঁদা না দিয়ে কোনো হিন্দু নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারেন। এটা একটা উদহারণ মাত্র।



কুলদা রায় : ৯/
 এই গল্পটি লিখতে গিয়ে কি রাইটারস ব্লকে পড়েছিলেন? পড়লে সেটা কিভাবে কাটালেন? নাকি টানা লিখেছেন?


রুমা মোদক : ৯/ 
 রাইটার্স ব্লক কী জিনিস কতো প্রকার ও কী কী তা বোধহয় আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। আমি আসলে নিজেকে রাইটার ভাবার দু:সাহস করিনা। আপনি জিজ্ঞেস করলেন তাই বলছি, আমার টেবিলে এখন যে লেখাটি পড়ে আছে তাতে আমি কী বলতে চাই,কটা চরিত্র সব আমার প্ল্যান করা,কিন্তু আমি গত তিনবছর ধরে এটা লিখতে পারছি না। এ গল্পটাতে অবশ্য এমন হয়নি। আমি আগেই সেটা উল্লেখ করেছি।


কুলদা রায় : ১০/ 
গল্পটির ভাষা পরিমিত। নাটকের মত সংলাপ প্রধান নয়। অথচ আপনি নাটকেরও মানুষ। নাটক ও কথাসাহিত্য এক নয়। কিভাবে এই নাটক ও কথাসাহিত্যের মধ্যেকার দূরত্বটি ঘুচিয়ে নিলেন?

রুমা মোদক : ১০/ 
 আমি আগে পাঠক পরে লেখক। ছোটবেলা থেকেই প্রচুর পড়ার অভ্যাস আমার। হাতের কাছে যা পাই তাই পড়ি। আমার বাবা ও মা দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। শিক্ষিত পরিবারের সন্তান হিসাবে উত্তরাধিকার সূত্রেই বেশ কিছু বই যেমন ম্যাক্সিম গোর্কির মা,পৃথিবীর পাঠশালা, শরত রচনাবলী,রবীন্দ্র রচনাবলী, ভারতের দেশ, প্রগতি প্রকাশনের উদয়ন এর মতো সাময়িকী, দৈনিক পত্রিকা হাতের কাছেই পেয়েছি। বাবা শহরের পাবলিক লাইব্রেরী থেকে রেগুলার বই এনে দিতেন। ফলে হয়েছে কী সাহিত্যের শাখাগুলো আমি চিহ্নিত করতে শিখেছি। বাংলা সাহিত্যে পড়াশোনা করেছি, এটাও তো লেখক সত্তায় প্রভাব রেখেছে। আর আমি তো আগে থেকে লিখেছি গল্প কবিতা। নাটক লেখা শুরু করেছি অনেক পরে। যদিও নাটক আমাকে পরিচিতিটা দিয়েছে বেশি। একটা সময় শুধু মঞ্চ নিয়েই ভেবেছি। আর যখন ভেবেছি তখন এ নিয়ে পড়াশোনাও করতে হয়েছে। ফলে কথাসাহিত্যের ধারাগুলোকে আলাদা করা আমার জন্য খুব কঠিন বোধ হয় না।


কুলদা রায় : ১১/ 
গল্পটি যখন লিখেছিলাম তখন আপনি একই সঙ্গে কি কি কাজের মধ্যে ছিলেন যেমন, ঘর সংসার, কাজ, কোন কোন বইপড়া, নাটক পড়া, গান শোনা, কোন ঘরে বা টেবিলে বসে লেখা ইত্যাদি। অর্থাৎ গল্পটি যখন লিখছেন সে সময়ে গল্পকার রুমা মোদক কোন কোন ব্যক্তিগত ঘটনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, এর মধ্যে থেকেই গল্পটি এগোচ্ছিল, সেই গল্পলেখার ক্ষণগুলো নিয়ে লিখুন।


রুমা মোদক : ১১/ 
 দাদা আমি আগে একবার বলেছি,নিজেকে লেখক পরিচয় দেয়ার দু: সাহস করতে পারি না এখনো। লিখে যাই, লিখতে চাই। যদি কোনদিন ' লেখক' ভাবার সাহস অর্জন করতে পারি তবে জীবনের সব তিক্ত- মধুর রূঢ় বঞ্চনা তা যতোই অপমানকর হোক নিশ্চয়ই দ্বিধাহীন বলবো। সবটুকু বলার সময় হয়ে উঠেনি। তবে এটুকু বলি যাপিত জীবনটা খুব মসৃণ নয়। বর্তমানে আমাকে সকাল বিকাল ঘড়ি ধরে দিনের একটা দীর্ঘ সময় মাস্টারগিরি করতে হয়। আমার দুটি যমজ সন্তান। ৩২ সপ্তাহে জন্ম নেয়া দুটি প্রিম্যাচিউর বাচ্চা নিয়ে কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছে বেশ কটা বছর। এখন যে বয়সের সীমায় এদেশে সাহিত্য পুরস্কার টুরস্কার ঘোষণা করা হয়, সে বয়সটাতে আমি সৃজনশীলতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। দু তিন বছর ধরে আবার ফিরে আসতে পেরেছি আমার স্বামী আর আমার মায়ের সহযোগিতায়। তবু খুব মসৃণ নয় চর্চাটা। আমার স্বামী থিয়েটার কর্মী। নিজেকে বিপন্ন করে থিয়েটার করেন তিনি। ফলে সংসারের অর্থনৈতিক চাপ থেকে শুরু করে গার্হস্থ্য সবটুকু চাপ আমাকে সামলাতে হয়। তারপর থিয়েটার রিহার্সেল অনেকখানি সময় নিয়ে নেয়। এতো ইতিহাস গাইছি কারণ এই যে আপনি জানতে চাইলেন কী পরিবেশের মধ্য দিয়ে গিয়েছি তার একটা ধারণা দিচ্ছি। আমি প্লট মাথায় এলে, আংগিক নিয়ে ভাবনা গুছাতে পারলে ছেলে মেয়েকে হোমওয়ার্কে বসিয়ে, চুলায় ভাত চাপিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে খসড়া তৈরি করি। আর হয়তো সেটা রাখার জন্য পড়ার ঘরে ঢুকে লেখার টেবিলের কাছে যাবার সুযোগ পাই কখনো সখনো। সেটা যখন লিখি তখন। গান শোনা টিভি দেখা একেবারেই অনিয়মিত। শুধু ঘুমানোর আগে নিয়ম করে ঘন্টা খানেক পড়ি।

খসড়া লেখাগুলো পরে হয়তো কোনো গভীর রাতে বসে চূড়ান্ত করি। এতে যেটা হয় কোনো লেখা নিয়ে তৃপ্ত হতে পারি না। সবসময় মনে হয় আরো একটু শ্রম ও সময় দিলে লেখাটা আরো ভালো হতো।

এই গল্পটি লেখার সময় আমি এ সংক্রান্ত কোনো লেখা পড়েছিলাম না। পড়ছিলাম নৃসিংহ ভাদুড়ির ' মহাভারতের প্রতিনায়ক' আর 'মহাভারতের ভারত যুদ্ধ ও কৃষ্ণ'। কারণ এ সম্পর্কিত একটা নাটক লিখার কাজ করছিলাম।

আমার একটা ব্যাপার হলো আমি যখন লিখি তা হোক ১০ মিনিট, আমি নিজেকে চারপাশ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। লেখার বিষয় চরিত্র পরিবেশে পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার চেষ্টা করি। বাস্তবতার তাড়ায় বেশিরভাগ সময় পারি না বলেই হয়তো খুব বেশি লিখতেও পারি না।


কুলদা রায় : ১২/ 
 এই গল্পটি নিয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট? 

রুমা মোদক : ১২/ 
 এটা নিয়েও অসন্তুষ্টি আছে। মনে হয় আরো কিছু কথা বলা যেতো। কিন্তু এটা আর রিরাইট করবো না। এ বিষয় নিয়ে আমার নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আরো লেখার ইচ্ছে আছে।



কুলদা রায় : আপনাকে ধন্যবাদ।
রুমা মোদক : আপনাকেও ধন্যবাদ। 



পরিচিতি : 
রুমা মোদক

পিতা: প্রিয়তোষ মোদক,মাতা : দীপ্তি রাণী মোদক।
 পেশা: শিক্ষকতা,
স্বামী : অনিরুদ্ধ কুমার ধর, সন্তান: অদ্বিতীয়া ও অভিজ্ঞান।
প্রকাশিত গ্রন্থ: ব্যবচ্ছেদের গল্পগুলি,বইমেলা২০১৫, প্রকাশক-- ঐতিহ্য প্রকাশনী।

Post a Comment

0 Comments