কথাসাহিত্যিক সাদিক হোসেনের সঙ্গে আলাপচারিতা

 সাদিক হোসেনের জন্ম ১৯৮১ সালের ১১ ডিসেম্বর। জন্মেছেন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার মহেশতলা অঞ্চলে। গ্রামের স্কুল থেকে কৃতিত্বসহ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। IT নিয়ে পড়াশুনা করেন। কিন্তু এই পড়াশুনা ব্যবহারিক অর্থে বৃথা যায়। পরবর্তীকালে গ্রাফিক ও মাল্টিমিডিয়া চর্চা করে বর্তমানে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত।

সাদিক শুরু করেছিলেন কবিতা লিখে। কিন্তু তিনি কথাসাহিত্যে চলে এলেন। ২০০৭ সালে লিখেছেন দেবতা ও পশুপাশি। এর তিনি বছর পরে লিখলেন সম্মোহন নামে গল্পের বই। আরো তিন বছর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মোমীন ও মোমেনা উপন্যাসটি।

সম্মোহন বইটির জন্য পেয়েছেন ডলি মিদ্যা স্মৃতি পুরস্কার ও সাহিত্য অকাদেমি যুবা পুরস্কার। পেয়েছেন মালঞ্চ সাহিত্য পুরস্কার। 
২০১৪ সালে সাদিক হোসেনের গিয়াস আলির প্রেম ও তার নিজস্ব সময়' গল্পের বইটির জন্য নমিতা চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন ২০১৫ সালে। 
এ সময়কার তিনি অসামান্য কথাশিল্পী। সাদিক শুধু লিখতে আসেননি--লিখতে এসেছেন অভিজ্ঞতা ও লেখার শৈলী জেনেই। এখানেই তাঁর সঙ্গে অন্য লেখকদের সঙ্গে পার্থক্য। তিনি সবার চেয়ে আলাদা। লেখার ক্ষেত্রে নিজের একটি ধরণ আবিস্কার করে নিয়েছেন।
সাদিকের সঙ্গে গল্পপাঠের পরিচয় করিয়ে দেন কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র। তার সঙ্গে ২০১৫ সালের জুন মাসের ১৬ তারিখ কুলদা রায়ের ফোনে কথা হয়। দীর্ঘ দু'ঘণ্টা ফোনের আলাপে সাদিকের নিজের লেখালেখি, তাঁর পূর্সূবরী কথাসাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদার, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, শহীদুল জহিরের লেখালেখি নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেন। নিজের সময়ের লেখক বিনোদ ঘোষাল, শামিম আহমেদের লেখার শক্তি ও দুর্বলতার চিহ্নগুলোও তুলে ধরেন। কথা বলেন বিশ্বসাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে। এর মধ্যে সাদিক হোসেনের প্রিয় শৈলী ম্যাজিক রিয়েলিজম নিয়ে জানান তার কাজ কর্মের হালচিত্র। এমন কি দুই বাংলার ভাষা নিয়ে যে কূটতর্ক আছে সে বিষয়েও নিজের তৃতীয় মতটি অকপটে বলতে কুণ্ঠিত নন।
সে অর্থে এটকে ঠিক সাক্ষাৎকার বলা যায় না। এটাকে এক ধরনের বৈঠকী আলাপচারিতা বলা যেতে পারে।
এই আলাপচারিতাটিঅক্ষরে রূপান্তর করতে সহযোগিতা করেছেন কথাসাহিত্যিক এমদাদ হোসেন এবং সুদেষ্ণা দাশগুপ্ত।

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমার আখ্যানটাই গড়ে উঠেছে মৌখিক ইতিহাস এবং লিখিত ইতিহাসের একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে, তার সঙ্গে আমার উপন্যাস একেবারে সমকালীন রাজনীতির দিকে দৃষ্টিপাত করেছে, যেমন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অবস্থা আর সমকালীন রাজনীতির সঙ্গে বিশ্ব-রাজনীতিও চলে এসেছে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------

কুলদা রায়
লেখালেখির জন্য সময় কীভাবে বের করেন? 

সাদিক হোসেন
আমি তো সেভাবে লিখতেই পারি না, মানে যেভাবে লেখা উচিত সেরকম তো হয় না আবার অনেকে যেভাবে চেয়ে থাকেন সেভাবে দিতেও পারি না অনেককে, লেখা। 


কুলদা রায়
কেবলমাত্র ছুটির দিনেই লেখেন- সপ্তায় দুইদিন, তাই না?

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ। তাও কখনও কখনও হঠাৎ করে কোনও প্রোগ্রাম থাকে বা অন্যান্য অনেক কাজ থাকে তো রবিবারে, শনি-রবি...


কুলদা রায়
তার মানে যে দিনগুলিতে আপনি কাজ করেন সেদিনগুলোর নানা ব্যাস্ততার ভেতর থেকেই লেখার অন্যান্য কাজ চালু করতে হয়, নাকি?


সাদিক হোসেন
সেটাও ঠিক হয় না। কাজের জায়গা থেকে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে যায়। তারপরে লেখার অবস্থা থাকে না। পরদিন আবার কাজ থাকে। ঘুমিয়ে পড়তে হয়। শনিবার রাতে লিখি। আর রবিবার বিকেলে। সব মিলিয়ে তিন চার ঘণ্টা। তবে এই দুদিনে লিখতে বসলে তাড়াতাড়ি লেখা হয়ে যায় অনেক সময়। আবার কখনো ধীরে ধীরে লেখা এগোয়। সেটা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। সপ্তায় আট ঘণ্টা করে লিখতে পারলেও কাজের দিনগুলোতে কাজের মধ্যে থেকেও লেখার চিন্তা কিন্তু মাথায় সব সময়ই থাকে। বলা যায়, সব সময়ই লেখার মধ্যেই থাকি। কলম দিয়ে লিখতে না পারলেও মগজে লিখতে থাকি।

রাতে কাজ থেকে ফিরে প্রতিদিনই দুই/আড়াই ঘণ্টা পড়াশুনা করি। পড়ার সুবিধা হল, একটা লেখাকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়।


কুলদা রায়
আপনি কি মনে করেন কোনও ভালো লেখা আপনার মধ্যেও আরেকটি লেখার জন্ম দিচ্ছে?

সাদিক হোসেন
সেই ক্ষেত্রে আমার বিভিন্ন বই পড়তে পড়তে, আমার মধ্যে, ধরুন- একটা বিষয় আমার ভেতর জন্ম নিয়েছে,- সেই বিষয়টাকে আরও ক্রিটিক্যালি দেখার জন্য হলেও প্রচুর বই পড়তে হয় বা আমার পূর্বসূরিরা কী ভেবেছেন ওই বিষয়টাকে নিয়ে বা আমি কতটুকু থাকব। আলাদা হতে না পারলে তো লেখার কোনও মানেই হয় না। আবার একই সাথে আমার পূর্বসূরিদের কন্টিনিউটিতেও আমার মনে হয়, কন্টিনিউটির মধ্য থেকেই কাজ করতে হয়।


কুলদা রায়
তার মানে পূর্বসূরিদের পাটাতনের উপরেই আপনি আপনার নিজস্ব ভিতটা তৈরি করছেন, নিজস্ব দেয়ালটা তৈরি করছেন, নিজস্ব ঘরটা তৈরি করছেন, নিজস্ব গল্পটা তৈরি করছেন। 

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ, একদম। 



কুলদা রায়
পূর্বসূরি হিসেবে আপনি কাকে কাকে নিচ্ছেন?

সাদিক হোসেন
আমার প্রিয় লেখক হলেন কমলকুমার মজুমদার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌। শহীদুল জহির, অভিজিৎ সেন আমার খুব প্রিয়। নবারুণ ভট্টাচার্যের শেষদিকের কিছু লেখা আমার ভালো লাগে। সতীনাথ ভাদুড়ী, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, তার ‘অলীক মানুষ’ তো মাস্টারপিস। ‘মায়ামৃদঙ্গ’ ধরণের লেখা না পড়লে তো লেখাও যায় না।


---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কুলদা রায়
এদের মধ্যে বিশেষ কেউ কি আপনার বেশি প্রিয়, যাঁর লেখা থেকে আপনি শেখেন, অনুসরণ করেছেন বা প্রভাব ফেলেছে আপনার লেখাকে, ভাবনাকে, শৈলীকে?

সাদিক হোসেন
আমার লেখালেখি একটু অন্যরকমভাবে শুরু হয়েছিল। প্রথমে আমি কবিতা লিখতে শুরু করি। পরে বুঝতে পারি লিরিকে আমি ঠিক স্বাচ্ছন্দ্য পাচ্ছি না। তারপরে আমি দুই তিনটা গল্প লিখি। তখন ঠিক করি আমি একটা উপন্যাসে হাত দেব। এই সময়ে আমার উপরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাব প্রবলভাবে ছিল। আর আমি প্রচুর প্রভাবিত হয়েছি বিদেশি সিনেমা থেকে। বার্গম্যান, লা ভন্টেইয়ার, পাসোলিনি, তারকাভস্কি'র সিনেমাগুলো আমাকে অনেক প্রভাবিত করেছে।

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------

কুলদা রায়
সেজন্য আপনার লেখার ভঙ্গি, লেখার বিষয়বস্তু সিনেমা স্ক্রিপ্টের মতো চলে আসে! আপনি কি গুন্টার গ্রাসের টিন ড্রাম, 'দি আর্টিস্ট অ্যান্ড দ্য মডেল' সিনেমাটি দেখেছেন?

সাদিক হোসেন
না। দেখিনি। দেখে নেব।


কুলদা রায়
গান কেমন পছন্দ করেন?

সাদিক হোসেন
গান শুনি। সঙ্গীতের ব্যাকরণ আমি জানি না। কিন্তু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুনতে ভালো লাগে। 

কুলদা রায়
আমিও জানি না। কিন্তু গান নিয়মিত শুনি। কোন কোন শিল্পী আপনার প্রিয়?

সাদিক হোসেন
হেমাঙ্গ বিশ্বাস, কবীর সুমন আমার খুব প্রিয়। একটা সময় বব ডিলান, ডেনভার খুব শুনতাম। রবীন্দ্রসঙ্গীত সব সময়ই প্রিয়। পশ্চিমবঙ্গে নজরুল গীতি লোকজন আগের মতো অতোটা শোনে না বা চর্চা সেই অর্থে খুব বেশি নেই। শুনতে পাই বাংলাদেশে নজরুল গীতির ব্যাপক চর্চা আছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভালো চর্চা পশ্চিমবঙ্গে হচ্ছে। গীতা ঘটক, দেবব্রত বিশ্বাসের গলায়, কণিকা, সুচিত্রা মিত্রের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে ভীষণ ভালো লাগে।


কুলদা রায়
গানের সুর, বাণী কি আপনার লেখায় কোনো প্রভাব ফেলে? আপনার লেখার মধ্যে কোনও গান আসে?

সাদিক হোসেন
গানের সুরের একটা ঘোর লেখাতে থাকে, সুরে একটা বিমূর্ত ব্যাপার থাকে। কিন্তু ঐটুকু। একটি গানকে অবলম্বন করে আমি কোনোদিন গল্প লিখিনি বা ভাবিওনি কোনোদিন। একটা গানের শরীরের মতো করে একটা গল্প লেখা- এরকম করিনি এখনও কিন্তু পরে, জানি না, হয়তো হতে পারে। গানের সুরেলা প্রবাহ আমার লেখায় থাকে অবচেতনভাবে, কিন্তু সচেতনভাবে সেটা আনতে চেষ্টা করিনি। গানের অন্তরা, মধ্যমা, সঞ্চারির মত করে গল্পের শৈলী কীভাবে করা যেতে পারে সেটা আমি কোনোদিন ভাবিনি। গানের এক ধরনের সুর কানে বাজে লেখার সময়, লাইনগুলি যখন তৈরি হয় তখন এক ধরনের শব্দ মূর্ছনা থাকে আমার মাথায়।


কুলদা রায়
তারাশঙ্করের গল্পে, উপন্যাসে গানের অসামান্য ব্যবহার আছে।এই গল্প নিয়ে নির্মিত সিনেমা যখন আমরা দেখি তখন তা আলাদা একটা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। মানিকের উপন্যাস ‘পুতুল নাচের ইতিকথায়’ও গান আছে। আবার ধরেন- অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী কবিতা, ছড়া, লোকজ গান, পয়ার ব্যবহার করেছেন। এ জাতীয় ব্যাপারগুলো আপনার কেমন লাগে? এগুলো কি আপনি ব্যবহার করেন?

সাদিক হোসেন
আমি লোকজ মোটিফগুলো নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। তার মধ্যে চরিত্রগুলো কেমন করে থাকে তা আমি দেখতে চাই। আমার প্রথম দিকের বইয়ে গ্রামের বিয়ের গান, মহরমের মর্সিয়া গান নিয়েছি। ‘মোমেন ও মোমেনা’ উপন্যাসে আছে।


কুলদা রায়
‘মোমেন ও মোমেনা’ উপন্যাসের আখ্যান বলুন।

সাদিক হোসেন
একটি পরিবারের মধ্যে গল্পটি বেড়ে উঠেছে। ঐ পরিবারের তিন প্রজন্মের চোখ দিয়ে তার চারপাশের ইতিহাস, ইতিহাসের পরিবর্তন, এর ফাঁকে বিশ্বরাজনীতিরও কিছু অংশ আছে। মূলত গ্রামের পটভূমির ওপর তৈরি করা আখ্যান। আমার গ্রামের বেশিরভাগ লোকেরা দর্জিশিল্প অর্থাৎ জামাকাপড় তৈরির কাজ করে থাকে। এই দর্জিশিল্পের ব্যবসা, তার অর্থনীতি বিভিন্নভাবে এই উপন্যাসে আছে।


কুলদা রায়
বাংলাদেশের বরিশালে দর্জিদেরকে খলিফা বলে। যেমন আবুল কালাম খলিফা। তাদের বাড়ি পরিচিত হয় খলিফা বাড়ি নামে। যেমন যারা তেল নিয়ে কাজ করে তাদেরকে কুলু বলে। তাদের বাড়ি হল- কুলু বাড়ি। আমার এক আত্মীয় কিরণ কুলু। সাং- মিরুখালি কুলুবাড়ি। মঠবাড়িয়া। বরিশাল। পরে এরা কুলু পদবী ব্যবহার করতেন না। ব্যবহার করতেন রায় পদবী। আমি একবার মঠবাড়িয়া গিয়েছি, লোকজনকে জিজ্ঞেস করছি, ভাই, এখানে কিরণ রায়ের বাড়িটা কোথায়? তারা কিরণ রায় বাবুকে চেনে না। শুনে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। আমি তার শারীরিক চেহারা-ছবির বর্ণনা করি। শুনে তারা হেসে ওঠেন। বলেন, ও, আপনি কিরণ কুলুর বাড়ি যাবেন। কুলু বাড়ির পোলা আবার রায় হইলো কবে!

সাদিক হোসেন
এই উপন্যাসে আমি লিখিত ইতিহাসের চেয়ে লৌকিক ইতিহাসকে প্রাধান্য দিয়েছি। গ্রামের প্রবীণ লোকদের কাছে জানতে চেয়েছি তাঁদের অতীত কথা। তাঁরা বলেছেন তাঁদের জীবনের গল্প- যা মৌখিক ইতিহাস। সেগুলো আমার উপন্যাসে ব্যবহার করেছি।


কুলদা রায়
যেটা বলা হয় কথাসাহিত্য কোনও না কোনওভাবে সত্যি ইতিহাস হয়ে দাঁড়ায়। 

সাদিক হোসেন
অবশ্যই। লেখায় ইতিহাস এবং রাজনীতির বয়ান থাকে। 


কুলদা রায়
আপনি লৌকিক ইতিহাস, পুরাণ, কিংবদন্তী থেকে উপাদান নিয়ে লিখেছেন--তার সঙ্গে কি লিখিত ইতিহাসকে মিলিয়ে সত্যিমিথ্যেকে যাচাই করে নিয়েছিলেন?

সাদিক হোসেন
আমার উপন্যাসটি একটি অঞ্চলকে ভিত্তি করে লিখেছি। এই অঞ্চলেরই মানুষ আমি। এই এলাকার লিখিত ইতিহাসটা আমার জানা আছে। মৌখিক ইতিহাসের সঙ্গে লিখিত ইতিহাসের মধ্যে যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক থাকে, যেমন- দুজন দুজনকে কখনো অস্বীকার করে-- সেটাও আমার উপন্যাসের প্রধান বিষয় বলা যায়। আমার উপন্যাসে বৃক্ষ, পশুপাখি ইত্যাদি কথা বলে। সকলে গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই রকম অনেক চরিত্র আছে এই উপন্যাসে।


কুলদা রায়
এটাতো শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখাতেও পাওয়া যায়। 

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে এই ধরনের ব্যাপার আছে। তবে তিনি তো অনেক সময় প্রায় ফেবলের মধ্যে চলে যান। আমি একটু অন্যরকমভাবে কাজ করেছি। ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে আমি তখন পড়াশুনা করছিলাম। তা ছাড়া মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমার খুব প্রিয় ছিলেন। এই দুটো বিষয় এক সঙ্গে মিশে এক ধরনের নতুন প্রণোদনা আমার মধ্যে কাজ করেছিল। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের অনেক গল্প আছে। ‘মাছটা’ নামে একটি গল্পে আছে--একজন শিক্ষক ছাত্রকে বলছে একটি মাছের কথা। তখন মাছটা গল্পে একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে।


কুলদা রায়
সেক্ষেত্রে শ্যামলের এই মাছ বা সাপ তারা ঠিক মানবীয় চরিত্র ধারণ করে। মানুষের মতোই আচরণ করে। এক্ষেত্রে কি এগুলো ফেবল হয়ে ওঠে?

সাদিক হোসেন
হয়ত পুরোপুরি নয়। কিন্তু ম্যাজিক রিয়্যালিজমের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এটা একরকমভাবে ইতিহাসের পুনরুদ্ধার করতে চায়। সেদিক দিয়ে এগুলোকে কি আমরা ম্যাজিক রিয়্যালিজম বলতে পারি?

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কুলদা রায়
নাইজেরিয়ান গল্পগুলোতে এ ধরনের ঘটনা হরহামেশা থাকে। যেমন আমোস তুতুওলার ক্ষেত্রে এই ধরনের প্রানিগুলো রিয়েল মানুষের মতো চরিত্র হয়ে চলে আসে। তার জন্য কোনও ধরনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দরকার হয় না।


সাদিক হোসেন
আফ্রিকার গল্পগুলোর ধরন অন্যরকম। বেন ও'কোরির কিছু লেখা পড়েছিলাম। তার মধ্যেও আফ্রিকার প্রচুর লোককথা, গল্প--এগুলো চলে এসেছে। আমার মনে হয়--আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। উপনিবেশের ফলে আফ্রিকা তার নিজের ভাষাটাও হারিয়ে ফেলেছিল। ইতিহাসটাও হারিয়েছিল। ফলে ইতিহাস খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা লৌকিক গল্পগাথার মধ্যে ফিরেছে। আত্মপরিচয়টিকে এই জাদুবাস্তবতার মধ্যে দিয়ে রক্ষা করেছে। লিখিত ইতিহাস বলতে আগে কিছুই ছিল না। উপনিবেশের পরেই এই লিখিত ইতিহাসটা বানানো হয়েছে। তার আগের ভাষা, ধর্ম--সবই তো ওরা হারিয়ে ফেলেছিল। এলিস আমাদির একটা লেখায় আমি পড়েছিলাম--ওনার লেখার মধ্যে উপনিবেশবাদ, আধুনিকতা থাকুক না কেন, উনি বলেন--যাই লিখি না কেন, আমাকে লিখতে হচ্ছে ইংরেজিতে। আমার নিজস্ব ভাষাতে আমি প্রকাশ করতে পারি না। আমার নিজের ভাষা বলতে কিছু নেই আর। এজন্য ওদের লেখার মধ্যে এক ধরনের দুঃখের স্রোত সাবলাইম ফর্মে সব সময় বয়ে চলে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------

কুলদা রায়
আফ্রিকার যে-মানুষগুলো আমরা দেখি, সিয়েরা লিওনের যে-মানুষগুলো আমরা দেখি, তাদের মধ্যে এখনো প্রবলভাবে এথনিক রেসিজম, টেররিজম বা ভায়োলেন্স প্রবলভাবেই চলছে। এক ধরনের নৈরাজ্য যেন এদেরকে ঘিরে আছে। শেষ হয় না। নাইজেরিয়ার পূর্বাঞ্চলে প্রধান হল--ইগবো ভাষীরা, পশ্চিম দিকে হলো--ইউরোবা ভাষীরা, এদের মধ্যে আবার অ্সংখ্য ডায়ালেক্ট আছে। এক অঞ্চলের ডায়ালেক্ট অন্য অঞ্চলের মানুষরা বুঝতে পারে না। বুঝতে তাদের কষ্ট হয়। আমার একজন নাইজেরিয়ার বান্ধবী আছে, জেনিফার, ইগবো ডায়ালেক্টের মেয়ে। ওকে আমি যখন ইগবো কিছু পড়তে বলতাম- ও সুন্দরভাবে পড়ে শোনাত। তার ব্যাখ্যা বলতে পারত। কিন্তু তাকে যখন ইউরোবা ভাষার কিছু পড়তে দিলাম, দেখলাম- জেনিফার তা পড়তে পারছে না। একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক আছে। এরা মিলতে পারেনি। কিন্তু এরা সবাই ইংরেজি ভাষাটা জানে। ইংরেজি ভাষাটা সবার জন্য যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে গেছে। এটাকে নেতিবাচকভাবে নেওয়া হচ্ছে। নেওয়াই যায়। কিন্তু আবার যদি অন্যভাবে দেখি, তা হলো--ইংরেজি ভাষা আবার খণ্ড-বিখণ্ড আফ্রিকাকে সামগ্রিকভাবে কিন্তু একত্রিত করেছে। উপনিবেশের কারণে এদের মধ্যে একদিক থেকে এক ধরনের ঐক্যবোধও কিন্তু এনে দিয়েছে। তারা নিজেদেরকে আফ্রিকান আত্মপরিচয়ের গভীরে নিয়ে গেছে। কোনোভাবেই তারা ইউরোপীয় হয়নি। তাদের মধ্যে আফ্রিকার ভয়েজ বা স্বর গড়ে উঠেছে। যেকোনো আফ্রিকান লেখকের লেখা পড়লেই আফ্রিকার স্বর শুনতে পাই। সব মানুষকে এই ইংরেজি ভাষাই ঐক্যের এই যোগাযোগটা গড়ে দিয়েছে। আমরাও দীর্ঘকাল উপনিবেশের কবলে ছিলাম। আফ্রিকানদের মত বাঙালিরা ইংরেজিটা ভালোভাবে শিখিনি। ইংরেজিটাকে আমরা ভালোভাবে গ্রহণও করিনি। ফলে বাঙালিরা বাঙালিদের ভাষাটা নির্মাণ করেছে। কিন্তু গুজরাটিদের ভাষা তারা বোঝে না। তাদের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। আমার কিছু কেরালার বন্ধু আছে তাদেরকে যখন জিজ্ঞেস করি, তোমরা কি বাংলা সাহিত্য কিছু পড়েছ, তখন তারা বলে, আমরা রবীন্দ্রনাথকে জানি। এই পর্যন্ত। আর কাউকে জানে না। বাঙালিরা ইউরোপীয় সাহিত্যকে যতটা জানে, এমন কি আফ্রিকান সাহিত্য বিষয়েও জানে--তার সামান্য অংশও কিন্তু মালায়ালাম সাহিত্য সম্পর্কে জানেই না। বাংলাদেশের বাঙালিরা তো মনে হয় মালায়ালাম ভাষার নামই শোনেনি। অথচ আমরা মার্কেজের দেশের সাহিত্য বিষয়ে ভুরি ভুরি জানি।

একই ভারতীয় উপমহাদেশে থেকেও গুজরাতি, মালায়ালিদের থেকে ভাব, ভাষা, সাহিত্যের দিক থেকে আলাদা--অপরিচিত। অথচ একই ভূখণ্ডের মানুষ হিসেবে এক সময়ে আমরা একই ছিলাম । উনিশশো সাতচল্লিশে এসে আলাদা হয়ে গেলাম। এতো কাছের হওয়া সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে সেই ঐক্যবোধটা তৈরি হয়নি। বৃটিশ উপনিবেশ আমাদেরকে সেই ঐক্যের দিকে ফেরায়নি। বিভাজিত হয়ে গেছি। ক্রমশ আরো দূরে সরে যাচ্ছি। কেন বৃটিশ উপনিবেশ সেই ঐক্যের দিকে যেতে দেয়নি তা হয়তো ইতিহাসবিদরা ভালো বলতে পারবেন।

ভাষা নিয়ে যে দুঃখবোধটা আফ্রিকার সাহিত্যিকদের মধ্যে আছে আপনি বললেন, তাদের মধ্যে জাতিগত দ্বান্দ্বিক বিভাজনটা দেখতে পাওয়া যায়--তা সত্বেও আফ্রিকান কিন্তু আরেকভাবে উপনিবেশের প্রশংসাও করে। তাদের মধ্যে ঐক্যের ভিতটা গড়ে দিয়েছে এই উপনিবেশী ভাষাটা-- সেটা তারা স্বীকারও করে। আবার ধরেন লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে যেসব ম্যাজিক রিয়ালিজমের গল্পগুলো আমরা পড়তে পারছি--এগুলো আপনার কেমন লাগে?

সাদিক হোসেন
লাতিন আমেরিকার সাহিত্য আমার খুব ভালো লাগে। বোর্হেস আমার প্রিয়। মার্কেজ আমার খুব প্রিয়। কার্লোস ফুয়েন্তেসের ‘আউরা’ উপন্যাসটি আমি বহুবার পড়েছি। হোসে সারামাগোর একটি বই কদিন আগে পড়ে শেষ করলাম।


কুলদা রায়
আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকান যেসব গল্পের কথা বললেন, তাতে মনে হয়--আপনি সাহিত্যের ম্যাজিক রিয়েলিজমকে বেছে নিয়েছেন। সেদিকেই আপনার পক্ষপাত। একটু আগেও সেটা বলেছেন। আপনার লেখার মধ্যেও এই ধারা দেখতে পাওয়া যায়। প্রথম দিক থেকেই কি আপনি এই জাদুবাস্তবাদী ধারায় লিখবেন বলে ঠিক করে নিয়েছিলেন?

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ। 


কুলদা রায়
কিন্তু আপনি ম্যাজিক রিয়ালিজমের দিকে কেন গেলেন বা যেতে চান কেন? 

সাদিক হোসেন
এখন আমি অনেকটা চলে এসেছি এইদিকে, সেই যে বললাম না- মৌখিক ইতিহাসের সঙ্গে লিখিত ইতিহাসের যে-দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্বটা আমার উপন্যাসের একটা বড় বিষয় ছিল বা প্রধান বিষয় হিসেবে আমি দেখছিলাম। মৌখিক গল্পগুলো বা মৌখিক ইতিহাসের চর্চাটা অনেক সময় আমাকে ম্যাজিক রিয়ালিজমের দিকে নিয়ে গেছে। এটা আমি যে খুব ইচ্ছাকৃতভাবে করতে চাইছিলাম তা নয়, ব্যাপারটা খুব সহজভাবেই আমার লেখায় চলে এসেছিল।


কুলদা রায়
প্রতিক্রিয়াটা কেমন হলো, উপন্যাসটা প্রকাশ পাওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গে বা অন্যান্য জায়গার পাঠকরা আপনার জাদুবাস্তব ঘরানার লেখাকে কীভাবে তারা নিলেন, কীভাবে দেখলেন?

সাদিক হোসেন
আমার এই উপন্যাসটা সোপান থেকে বেরিয়েছে... তেমন একটা বিজ্ঞাপন হয়নি বইটার, তবুও যারা পড়েছেন বেশির ভাগই তারা আমাকে ফোন করে তাঁদের ভালোলাগা জানিয়েছেন, এখন বইটাও বেশ ভাল বিক্রি হয়, অনেকেই প্রশংসা করেছেন, সাধন চট্টোপাধ্যায় আমার বইয়ের খুব প্রশংসা করেছিলেন।


কুলদা রায়
নেগেটিভ সমালোচনা কিছু পেয়েছিলেন?

সাদিক হোসেন
না, ওই অর্থে এখন অব্দি কোনও নেগেটিভ সমালোচনা পাইনি। পরিচয় পত্রিকায় একটা ভালো সমালোচনা বেরিয়েছিল, প্রায় দু/তিন পৃষ্ঠা জুড়ে সেটা ছাপা হয়েছিল।


কুলদা রায়
আমি একটা জিনিস দেখি যে শামীম আহমেদের 'সাত আসমান' উপন্যাসেও কিন্তু সেই ১৯৪৭-এর আগের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দেশভাগের ঘটনাগুলি, মুর্শিদাবাদ এলাকায় যা ঘটল, সেই ব্যাপারগুলি লিখতে গিয়ে তিনি কিন্তু ম্যাজিক রিয়েলিজমকে খুব গভীরভাবে ব্যবহার করেছেন। সেটা তো আপনি দেখেছেন শামিমের বইয়ে!
সাদিক হোসেন
হ্যাঁ, একমত আমি আপনার সঙ্গে এই ব্যাপারে।

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কুলদা রায় 
শামিম প্রবলভাবে মৌখিক ইতিহাস না, উনি টেক্সট ইতিহাসের ওপর ডিপেন্ড করেছেন, মৌখিক ইতিহাস মানে আখ্যানটাকে তিনি নিয়েছেন এবং সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে কিন্তু তিনি লিখিত ইতিহাসের সাহায্য নিয়েছেন। সেক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে, মানে আপনি যে বললেন মৌখিক ইতিহাসটাকে নিয়েছেন, সেটা কি শুধু আখ্যানের কারণেই? শামিমের সঙ্গে আপনার পার্থক্য কী?


সাদিক হোসেন
আমার আখ্যানটাই গড়ে উঠেছে মৌখিক ইতিহাস এবং লিখিত ইতিহাসের একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে, তার সঙ্গে আমার উপন্যাস একেবারে সমকালীন রাজনীতির দিকে দৃষ্টিপাত করেছে, যেমন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক অবস্থা আর সমকালীন রাজনীতির সঙ্গে বিশ্ব-রাজনীতিও চলে এসেছে। আমার উপন্যাসে একশো বছর বা মোটামুটি- সত্তর-আশি বছরের একটা যাত্রা আছে তার মধ্যে, এবং এই যাত্রাটা মূলত লিখিত ও মৌখিক ইতিহাসের একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই এগিয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদম সমকালীন একটা রাজনৈতিক ইতিহাসের ওপর তির্যক দৃষ্টিপাতও করেছে।


---------------------------------------------------------------------------------------------------------------

কুলদা রায়
সেটা কোন রাজনীতি বা কোন সময়ের রাজনীতি?

সাদিক হোসেন
আমার উপন্যাসটা লেখা হয়েছিল ২০০৯-১০-এর দিকে, তখন পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার ছিল, একই সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে তখন আফগানিস্থান, ইরাক আর মধ্যপ্রাচ্যে একটা টালমাটাল অবস্থা... সেই টালমাটাল অবস্থাটাও চলে এসেছে উপন্যাসে।


কুলদা রায়
এই যে রাজনৈতিক ইতিহাসটা আপনার লেখার মধ্যে নিয়ে এসেছেন, মৌখিক ইতিহাসের সঙ্গে দ্বান্দ্বিকভাবে একটা অবস্থান তৈরি করে, তো এটা কি আরও আগের ইতিহাস, আমাদের পুরনো ইতিহাসটা কি এসেছে আপনার আখ্যান হিসেবে কিংবা একটা ভিত্তি হিসেবে? পুরনো ইতিহাসটা এসেছে কি না, যেমন ধরুন- নকশাল আন্দোলন বা ১৯৪৭-এর দেশভাগ, এটাও এর ভেতর এসেছে, না কেবলমাত্র সমকালীন?

সাদিক হোসেন
না না, কারণ নকশাল আন্দোলন বা স্বাধীনতা আন্দোলন কোনটাই যে-গ্রামাঞ্চলটাকে আমি ধরেছিলাম সেখানে তেমন প্রভাব বিস্তার করেনি। মানে খুব প্রত্যক্ষভাবে এই ঘটনাগুলি তেমন একটা প্রভাব বিস্তার করেনি। আর আমার উপন্যাস শুরু হয়েছে সেখান থেকে- প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন শুরু হচ্ছে, আগে ইউনিয়ন বোর্ড ছিল সেগুলি ভেঙে পঞ্চায়েত নির্বাচন এসেছে, সেটা থেকে এই ২০০৯-১০ অব্দি, এই সময়টাকে ধরা হয়েছে। যে গ্রামাঞ্চলকে আমি ধরেছি সেখানে খুব একটা নকশাল আন্দোলন প্রভাব বিস্তার করেনি বরং নকশাল আন্দোলন থেকে বেরিয়ে গিয়ে এক ধরনের, মানে ওই নকশাল মতাদর্শে বিশ্বাসী নয় কিন্তু নিজেদের নকশাল বলে দাবী করা এক ধরনের বামপন্থা শুরু হয়েছিল তার প্রভাব এসে পড়ছিল গ্রামাঞ্চলে- এই ব্যাপারগুলি এসেছে আমার উপন্যাসে।


কুলদা রায়
আপনি আপনার উপন্যাসের নাম দিচ্ছেন 'মোমেন ও মোমেনা'। এখানে মোমেন-কে আমরা 'বিশ্বাসী' অর্থে ধরছি।

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ, বিশ্বাসী বা যারা বেহেস্তে যায় এরকম, এবং তার স্ত্রী লিঙ্গ মোমেনা। আমার গল্পে দুজন চরিত্রও আছে- তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বাস বলতে আমরা যা বুঝি সেটাকে তারা কীভাবে দেখেছে, কীভাবে তারা বিশ্বাস ভেঙে বেরিয়ে গেছে আবার কখনও তার ভেতরে আটকে পড়েছে- এইটা খুব বড় একটা বিষয় আমার উপন্যাসের, এই দুটো চরিত্র খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র এই উপন্যাসের, তাদের নাম কারোর মোমেন-মোমেনা নয় কিন্তু আমি উপন্যাসের নামকরণটা 'মোমেন ও মোমেনা' করেছিলাম এই দৃষ্টিকোণ থেকে।


কুলদা রায়
তার মানে এটা একটা দার্শনিক ডিস্কোর্সও হচ্ছে আপনার লেখার মধ্য দিয়ে?

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ, অবশ্যই, সেই জায়গা থেকেই নামকরণটা করেছিলাম। 


কুলদা রায়
আপনি দার্শনিকতাকে বেছে নিচ্ছেন কেন আপনার লেখার ক্ষেত্রে?

সাদিক হোসেন
তাত্ত্বিক দিক দিয়ে একজন গল্পকার বা একজন লেখক বা একজন কবি যতই অস্বীকার করুক যে সে দার্শনিক বা তাত্ত্বিক দিক দিয়ে খুব বেশি লেখা লিখতে চাইছেন না কিন্তু তিনি যখনই লিখছেন, ধরুন আমি যখন একটি গল্প লিখি মানে আমার দৃষ্টিতে গল্প বলতে আসলে কী তার কিন্তু একটা তাত্ত্বিক সংজ্ঞা রয়েছে, সেই সংজ্ঞাটাকে অনুসরণ করে আমি গল্প লিখি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মধ্যেও প্রচণ্ড তাত্ত্বিকতা লুকিয়ে আছে। এই হিসেবে আমার গল্পের মধ্যে তাত্ত্বিকতা এসেছে কিন্তু খুব যে দার্শনিক জায়গায় আমি নিয়ে গিয়েছি তাও নয় । একেবারে দৈনন্দিন ঘটনা থেকেই আমি গল্প নির্মাণ করেছি, দৃষ্টিপাত করেছি বাইরে থেকে।


কুলদা রায়
অর্থাৎ, আপনি দৈনন্দিন ঘটনার মধ্য থেকে বা আখ্যানের মধ্য থেকে বা চরিত্রের মধ্য থেকে এক ধরণের দার্শনিকতাকেই আবিষ্কার করেছেন বা এটা বের হয়ে এসেছে।

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ, আমার চরিত্রগুলো আবিষ্কার করেছে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো। 


কুলদা রায়
তার জন্য বেশি করে আগে থেকে আপনার দার্শনিকভাবে এটাকে একটা প্রকল্প হিসেবে স্থাপন করতে হবে এই চিন্তাটাও কি আপনার মধ্যে ছিল?

সাদিক হোসেন
না, এটা কখনোই ছিল না। 


কুলদা রায়
আবার ধরেন আমরা নবারুণ ভট্টাচার্যের ক্ষেত্রে দেখি যে তিনি আগে থেকেই একটা দার্শনিক প্রকল্প স্থির করে রেখেছেন। যেমন, তিনি ফ্যাতারুদের ইতিহাস লিখবেন বা তাদের আখ্যানগুলো লিখবেন, তাদের ক্যারেকটারগুলো এরকম হবে- এইসব মিলিয়ে একটা নৈরাজ্যিক হবে। সেখানে নবারুণ এক ধরণের পূর্ব প্রকল্প নিয়েই লিখছেন।

সাদিক হোসেন
আমার মনে হয় প্রত্যেক লেখকের ক্ষেত্রে তাঁর চরিত্র সম্বন্ধে এক ধরনের পূর্বপরিকল্পনা থাকে। সেই পূর্বপরিকল্পনা, যাকে আমরা ডেমোগ্রাফিক্যাল পূর্বপরিকল্পনা বলতে পারি, সেইটুকুই আমার মধ্যে ছিল লেখার সময়। তারপর সেটাকে আমি খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করিনি অন্যান্য লেখকদের মতো, বিশেষ করে নবারুণ ভট্টাচার্যের মতো, উনার চরিত্রগুলো অনেক সময় প্রচণ্ডভাবে নিয়ন্ত্রিত, অন্তত তাঁর রাজনৈতিক বা দার্শনিক প্রকল্পের কথা ভাবতে গেলে। আমি সেই অর্থে খুব বেশি নিয়ন্ত্রিত করিনি। কিন্তু আমার মধ্যে এক ধরনের নির্ধারণ ছিল যে এই চরিত্রগুলো এই এই করতে পারে বা এই এই করবে। এই রকম একটা নির্ধারণ আমার মধ্যে ছিল, সেই হিসেবেই আমি এগিয়েছি কিন্তু খুব বেশি যে আমি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছি তাও না।


কুলদা রায়
অর্থাৎ যে ক্ষেত্রে নবারুণ একটা মেসেজ দিতে চান, দেখা যাচ্ছে যে একজন লেখক মেসেঞ্জার হয়ে উঠছেন, তো সেই ক্ষেত্রে আপনি নিজেকে মেসেঞ্জার হিসেবে দেখতে চান না, তাই তো?

সাদিক হোসেন
না, একদমই চাই না।


কুলদা রায়
কিন্তু সেক্ষেত্রে আমরা মানি বা না মানি নবারুণের ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে তাঁর মধ্যে মেসেঞ্জার হয়ে ওঠবার একটা ব্যাপার যেন আছে!

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ।


কুলদা রায়
তো সেই ক্ষেত্রে যখনই একটা লোক বা একজন লেখক বা একজন ধর্মতাত্ত্বিক মেসেঞ্জারের দায়িত্ব গ্রহণ করে ফেলেন তখন তিনি কিন্তু একটা প্রতিষ্ঠানের দিকেই চলে যান, না কি? কী বলবেন?

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ, গভীরভাবে বলতে গেলে তা তো অবশ্যই। 


কুলদা রায়
সে অর্থে বলতে গেলে নবারুণ ভট্টাচার্যও কিন্তু প্রতিষ্ঠান নির্মাণের পক্ষেরই লোক!


সাদিক হোসেন
হ্যাঁ, অবশ্যই। এবং নবারুণ তো সেটা অনেক সাক্ষাৎকারেও বলেছেন, প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বলেন নি কিন্তু তিনি যে ট্র্যানজিশনাল পিরিয়ডটাকে ধরতে চান, আমাদের দেখাতে চান সেটা কিন্তু এক ধরনের প্রতিষ্ঠান।

কুলদা রায় 
আবার নবারুণকে আমরা কিন্তু একজন প্রতিষ্ঠান বিরোধী হিসেবেও জানি। 

সাদিক হোসেন
সেটা কিন্তু ওপর ওপর বলা আর কি! মেইনস্ট্রিম রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ এইসবের হিসেবে বলা হয় কিন্তু গভীরভাবে বলতে গেলে আপনি যেটা বললেন, আসলেই তাই। আমিও সেটা মনে করি।


কুলদা রায়
তাহলে নবারুণকে কি আমরা একটু উদ্দেশ্যপ্রবণ লেখক বলতে পারি, যে কোনও লেখক যদি মেসেঞ্জার হয়ে উঠতে চান তারা কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রবণ লেখকই হয়ে থাকেন, তাই না?

সাদিক হোসেন
কিন্তু অনেক বিখ্যাত লেখাও আছে যার লেখক মেসেঞ্জার হয়েছেন কিন্তু লেখাটা উৎরে গেছে। এরকম বহু উদাহরণ আছে। উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা অনেক লেখাই সফল হয়েছে, একেবারে সুচারুরূপে উদ্দেশ্য নির্ভর- এরকম অনেক লেখাও আছে।


কুলদা রায়
এরকম অসংখ্য উদাহরণ বাংলা সাহিত্যেই আছে, যেমন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনেক লেখার মধ্যেই...

সাদিক হোসেন
রবীন্দ্রনাথ আরেকটা বড় উদাহরণ, তাঁর বেশিরভাগ লেখার ক্ষেত্রে অন্তত গানের ক্ষেত্রে, ছোটোগল্পের ক্ষেত্রেও এবং বেশ কিছু কবিতাতেও মেসেজ দিচ্ছেন, দিচ্ছেন কিন্তু খুব জোরালো ভাবে। আবার উপন্যাসের শুরু যদি আমি বঙ্কিম দিয়ে করি তাহলে দেখছি বঙ্কিম একজন মেসেঞ্জার, পুরোপুরি। আমাদের উপন্যাসের ইতিহাসটাই তাই।


কুলদা রায়
আপনি কি এই মেসেঞ্জার হওয়াটা এই মুহূর্তের সাহিত্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন? 

সাদিক হোসেন
আমার ইদানীংকালে মনে হচ্ছে একজন লেখককে খুব জোরালোভাবে কিছু কথা বলতে হবে। আর সেটা বলতে গিয়ে যদি তাকে মেসেঞ্জার হতে হয় তাহলে সেই ঝুঁকিটা কিন্তু তাকে নিতে হবে। আমি যে সময়টায় বাস করছি, যে ট্র্যানজিশনাল পিরিয়ডটা এই সময়ে চলছে... দেখুন, এখানে এই কলকাতায় ফুটপাত বন্ধ করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে শপিং মল আর ফুটপাতের লোকগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে... কলকাতাকে আর যেন দেখা যাচ্ছে না- এখন এই পরিবর্তনগুলো ধরতে গেলে লেখককে মাঝে মাঝে মেসেঞ্জার হতে হয়, এই ঝুঁকি লেখককে নিতেই হবে। আমি এতে রাজি আছি। মানে আমার মেসেঞ্জার হতে কোনই আপত্তি নেই। আবার, এটা নির্ভর করে এক একটা সময়ের মানসিকতার ওপর। কিছুদিন পর হয়তো আমিও অন্য কথা বলব। এই আর কী!


কুলদা রায়
আবার আরও একটি উদাহরণ নিয়ে বলছি- সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের 'অলীক মানুষ'। সেখানে পীর সাহেবকে দেখতে পাচ্ছি, একটা অঞ্চলের ইতিহাস দেখতে পাচ্ছি, তাদের লৌকিক ঐতিহ্যগুলো দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বাসের বিষয়টা দেখতে পাচ্ছি, অবিশ্বাসের জায়গাটাও দেখতে পাচ্ছি... কিন্তু শেষ মুহূর্তে আমার মনে হয়েছে যে তিনি এই উপন্যাসে মেসেঞ্জার হতে চাননি।

সাদিক হোসেন
না, 'অলীক মানুষ'-এর ক্ষেত্রে তা হয়নি। তিনি মেসেঞ্জার হতে চাননি। তিনি বিভিন্ন সমস্যাকে গভীরভাবে মানে স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন দিককে গভীরভাবে দেখেছেন।


কুলদা রায়
এমনকি আমার যা মনে হলো যাকে আমরা আফ্রিকার সাহিত্যে দেখি যে সমস্ত মৌখিক ইতিহাস, কিংবদন্তী বা মেটাফিজিক্যাল যেসব বিষয় আছে সেগুলোকে তারা কোন ধরনের আরোপিত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ না করে ব্যবহার করছেন, সিরাজও খুব স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করেছেন তাঁর উপন্যাসে, আমার মনে হয় তিনি কখনোই একজন যুক্তিবাদীর চোখে বা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বা নাগরিক দৃষ্টিকোণ থেকে লোকবিশ্বাস বা ধর্মবিশ্বাস- এটাকে খণ্ডন করার দিকে পা বাড়াননি। তিনি যেন এটাকে সম্মান জানিয়ে উপন্যাসে গ্রহণ করলেন।

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ, এটা তো আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের লেখারও পরতে পরতে পাওয়া যায়। তাঁর খোয়াবনামা-র মধ্যে। তিনি যেভাবে ইতিহাসকে দেখেছেন সেটা কিন্তু একরৈখিক যুক্তিবাদীতা দিয়ে দেখেননি। ইলিয়াসের লেখার ক্ষেত্রেও সেটা একইভাবে প্রযোজ্য।


কুলদা রায়
আবার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মধ্যেও এইরকম লৌকিক-অলৌকিকের মাঝামাঝি একটা ব্যাপার আছে, এরকম কিছু কথা তিনিও বলেন, তিনি আবার খুব জনপ্রিয় একজন লেখকও, আমি খুব বেশি তাঁকে পড়িনি যদিও, তো যতটুকু পড়েছি মনে হয়েছে উনার ভেতর প্রবলভাবে মেসেঞ্জার লেখক হয়ে উঠছেন বা সেদিকেই যাচ্ছেন, একজন লেখক হিসেবে একটা দায়িত্ব নিয়ে একটা বিশ্বাসকে স্থাপন করার বা সাপোর্ট করার চেষ্টা করছেন, এডভোকেসি করার চেষ্টা করছেন- এটা কিন্তু আমার মনে হয় উনার লেখার মধ্যে আছে, বেশ প্রবলভাবেই আছে।

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখার ক্ষেত্রে আমার সেটা মনে হয়! 


কুলদা রায়
কিন্তু উনার ভাষাটা অসাধারণ। পোয়েটিক। 

সাদিক হোসেন
সেটা তাঁর প্রথম দিককার লেখাগুলোতে, যেমন- 'যাও পাখি' পর্যন্ত একধরণের ভাষা ছিল কিন্তু পরবর্তীতে ভাষাটা আমার কাছে আর অতোটা ভালো লাগে না। এখন আমি খুব একটা পড়িও না অবশ্য। তাঁর সাম্প্রতিক লেখাগুলো খুব একটা পড়া হয়নি আমার। কিন্তু উনার লেখার মধ্যে একটা মেটাফিজিক্যাল এক্সিসটেন্স-কে সবসময় স্থাপন করতে চান এবং এই 'মেটাফিজিক্যাল এক্সিসটেন্স'টিকে তিনি একেবারে প্রাথমিক শর্ত হিসেবে নিয়ে আসেন লেখায় এবং সেই শর্তগুলোকে পূর্ণ করবার জন্য এমন কিছু চরিত্র নিয়ে আসেন কিন্তু চরিত্রগুলোকে সব সময় পূর্ণতা দেন না, তাদের যে স্বাধীনতা, মেটাফিজিক্যাল এক্সিসটেন্সের যে স্বাধীনতার কথা উনি বলেন, তিনি কিন্তু একটা পক্ষ নিয়ে নেন।


কুলদা রায়
হ্যাঁ। আবার একই রকমের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ-কে আপনি কীভাবে দেখবেন?

সাদিক হোসেন
হুমায়ূনকে অনেকটাই পড়েছি। ভাষাটাই এমন যে তরতর করে পড়া হয়ে যায়। 


কুলদা রায়
কথা হচ্ছে জনপ্রিয় লেখা নিয়ে। কমার্সিয়াল লেখা নিয়ে।

সাদিক হোসেন
ভারতীয় ইংরেজি লেখকদের মধ্যে দু-ধরনের লেখক আছেন। একটা হলো প্রফেশনাল--যেমন অমিতাভ ঘোষ, বিক্রম শেঠ। আরেক ধরনের লেখক আছেন যারা একদম কমার্শিয়াল লেখক। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এরকম একদমই হয়নি। যার লেখা প্রচুর বিক্রি হয়--তিনিই প্রফেশনাল বা প্রধান লেখক বনে যান। এটা ইংরেজি সাহিত্যের ক্ষেত্রে হয় না। ফরাসি সাহিত্যের ক্ষেত্রেও হয় না। সেখানে হার্ডকোর লেখক আর কমার্শিয়াল লেখক বলে আলাদা ব্যাপার থাকে। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এটা হয় না। প্রধান লেখকদের মধ্যে শীর্ষেন্দু, হুমায়ূন আহমেদ আসতে পারেন। আবার আম পাঠক সতীনাথ ভাদুড়ী পড়েন না। কমলকুমার মজুমদারকে আরও কম পড়েন। হার্ডকোর লেখকদের জন্য এটা এক ধরনের সমস্যা। কমার্শিয়াল লেখকরাই বাংলা সাহিত্যের প্রধান লেখক হয়ে পড়েছে।


কুলদা রায়
শহীদুল জহিরের কথা বলছিলেন। জহিরের মধ্যেও কিন্তু ম্যাজিক রিয়েলিজমের ব্যাপারটা আছে, একটু প্রবলভাবেই আছে।

সাদিক হোসেন
‘মুখের দিকে দেখি’তে মার্কেজের উপন্যাসের শৈলীটা এসে গেছে। সেখানে জহির মার্কেজের উপন্যাসের রেফারেন্স টেনে আনছেন।



কুলদা রায়
কিন্তু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ- এরা যেভাবে লৌকিক বিশ্বাস, কিংবদন্তি, মৌখিক ইতিহাস ইত্যাদিকে নিয়ে এসেছেন তাদের লেখায়, আমার মনে হয়, শহীদুল জহির সেগুলোকে না এনেই এক ধরনের ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে এসেছেন তার লেখায়। একটা সময়কে ধরেছেন।

সাদিক হোসেন
শহীদুল জহির পপুলার ক্যারেক্টার নিয়ে কাজ করেছেন। মার্কেজ এবং আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যেমন করে মৌলিক ও লিখিত ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন, শহীদুল জহির একদম মৌখিক ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে কাজ করেছেন। তিনি এক্ষেত্রে পপ কালচার নিয়ে কাজ করেছেন। তার ‘মুখের দিকে দেখি’ উপন্যাসে কুতুবুদ্দিন একজনের নাম, হিস্টোরিক্যাল কুতুবুদ্দিন আইবকের পুরো নামটা উনি আনছেন না। শুধু প্রথম নামের অংশটুকুই উনি আনছেন। তিনি একজন পপুলার রাজাকে তার উপন্যাসে আনছেন--কিন্তু আনছেন তার ঐতিহাসিক দলিলকে বাদ দিয়ে। এটা এক ধরনের পপ কালচারের প্রবণতা। তিনি এটা খুব সচেতনভাবে করেছেন। ওয়ারহোল যেরকম একই ছবি বারবার সাজিয়ে রাখছেন। এটাকে উনি বলছেন কনজুমারিজম। বারবার একই জিনিস তৈরি হচ্ছে। রিপিটেশন। শহীদুল জহিরের লেখায় কোনও সেন্ট্রাল পয়েন্ট নেই। কোনও চরিত্র মুখ্য চরিত্র নয়। তার কেন্দ্র নেই, তাই পরিসীমাও নেই। প্রতিদিনের জীবন যাপন নিয়ে গড়ে উঠেছে। এটা দার্শনিক দিক থেকে এটা পপ কালচারের কাছাকাছি। এটা মার্কেজ, ইলিয়াস, হোসে সারামাগো করেননি। ইলিয়াসের ব্যাপারটা অন্য রকম।


কুলদা রায়
কেন্দ্রের দিকে একটি কাহিনীকে নিয়ে যাওয়া, একটা প্রটাগোনিস্ট তৈরি করা--এগুলো শহীদুল জহির নেননি। তা সত্ত্বেও উনি পাঠককে ধরে রাখতে সক্ষম হন। তার স্টোরি টেলিং কিন্তু শক্তিশালী। মার্কেজ যে ঘরানার , সেক্ষেত্রে মিথ ব্যবহার করে, লৌকিক ইতিহাস এবং বিশ্বাস ব্যবহার করে ওঁরা যে ম্যাজিক রিয়েলিজম সৃষ্টি করছেন, সেক্ষেতে শহীদুল জহির তাদের লাইনটা সরিয়ে দিয়ে শুধু দুএকটা নাম, স্থানএর নাম নিচ্ছেন। ঐতিহাসিক চরিত্র কুতুবুদ্দিন আইবেককে জহির নিচ্ছেন না। কেবল তার নামটা নিচ্ছেন। উনি রাজাকে নিচ্ছেন--উনি রাজার মুকুটটা নিচ্ছেন। পাঠক যদি বেশি অনুসন্ধানী হন তবে তাকে ইতিহাস বই থেকে কুতুবুদ্দিন আইবককে পড়ে নিতে হবে। পাঠককে একটা দ্বায়িত্ব দিয়ে দিয়েছেন বাড়তি পড়ে নেওয়ার জন্য।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ কিন্তু টোটাল মানুষ, তার পেছনের ইতিহাস, পুরাণ সব পুরে দিচ্ছেন তার ‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসে। মূল আখ্যানের সঙ্গে পাঠককে তার ব্যাক স্টোরিগুলো বলে দিচ্ছেন। পাঠককে বাড়তি খাটুনির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন না। পাঠক সব কিছু হাতের কাছে পেয়ে বিচার বিশ্লেষণ করার সুযোগ পাচ্ছেন। আখ্যানের দিকে মনোযোগ দিতে পারছেন বেশি।

শহীদুল জহির ব্যাক স্টোরি বলেন না। এটা তার স্পেশাল একটা পাওয়ার বলে মনে হয়। আবার এটাও মনে হয়, শহীদুল জহির ম্যাজিক রিয়েলিজমের প্রচলিত ধারা থেকে বাইরে এসে মিথহীন একটা আখ্যান বলেন। আফ্রিকানরা ম্যাজিক রিয়েলিজম ধারায় সেই হারানো ইতিহাসকে উদ্ধারের জন্য গল্পকে ব্যবহার করছেন সার্থকভাবে, সেটা থেকে জহির একটু সরে যাচ্ছেন না?

সাদিক হোসেন
বিপরীতভাবে এটাও তো বলা যায় জহির হয়তো সচেতনভাবেই সরে থাকতে চাইছেন। মিলান কুন্ডেরার একটা গল্প আছে, আনবিয়ারেবল লাইটনেস... নামের উপন্যাসে দেখাচ্ছেন কোনও দার্শনিকতা না থাকলে ইতিহাস না থাকলে, মানুষ সেই শূন্যতাকে বহন করতে পারছে না। এই না থাকার চেয়ে দার্শনিকতা বা ইতিহাসের ভার বহন করা সোজা। এর যে রাজনৈতিক মোটিফগুলো, মানে এর যে রাজনৈতিক দর্শন, ক্লাসিক্যাল অর্থে একে এনার্কিজম বলা যায় না। এটা এনার্কিজমের ভারটাকেও সরিয়ে দিচ্ছে। এই যে এক ধরনের বায়বীয় একটা অবস্থা--এটা শহীদুল জহিরের এক ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বলে আমার মনে হয়েছে। এর ফলে তার লেখায় বারবার পাঠক অস্থির হয়ে পড়েন। আর আমরা ইতিহাস বলে যাকে জানছি তা কতটুকু ভারতীয় ইতিহাস বলে বিশ্বাস করতে পারছি? কতটুকু এই ইতিহাসের প্রতি আমার নাড়ির টান আছে? এই যে ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে- এই দূরত্বটা কতটা আমাদের জন্য অসহনীয় হতে পারে--এই ব্যাপারগুলো শহীদুল জহিরে সাবলাইম ফর্মে এসেছে।


কুলদা রায়
আবার দেখেন, স্বপ্নময় চক্রবর্তীর পাঠক আকর্ষণ করার ক্ষমতা প্রবলভাবে আছে। তিনি পাঠকপ্রিয়ও হয়েছেন। তিনি তার গল্পে তথ্যকে ব্যবহার করেন বই পড়ে, ফিল্ড ওয়ার্ক করে, যাচাই, বাছাই করে--এক ধরনের গবেষণাকর্ম করে তিনি গল্পে তথ্য ব্যবহার করেন। তবে তা এমনভাবে গল্পে ব্যবহার করেন যে যেন আরোপিত বা রিপোর্টধর্মী না হয়। গল্পের আখ্যানের অংশ হয়ে ওঠে। তার মধ্যে ব্যাক স্টোরি, এনথ্রোপলজি পাওয়া যাচ্ছে, আবার যখন তিনি চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে লিখছেন তখন চিকিৎসা শাস্ত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দ ব্যবহার করছেন। তিনি অসামান্য চমক ব্যবহার করেন গল্পে। কখনো সে চমক চাবুকের মত পাঠকের গায়ে লাগে--সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত কী ঘটে গেল পাঠক তার কোনও পূর্ব-অনুমান করতে পারেন না। যে-অর্থে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় বা শহীদুল জহির ম্যাজিক ব্যবহার করেছেন--স্বপ্নময় চক্রবর্তী সে অর্থে ব্যবহার করেননি। কিন্তু গল্পের স্ট্রাকচারে, আখ্যান বর্ণনার ক্ষেত্রে যে টুইস্ট বা চমক উনি ব্যবহার করেন সেটা ঠিক ম্যাজিকের মতো কাজ করে। ছিল রুমাল, হলো বিড়াল- ব্যাপারটার মতো। আপনি একজন জাদুবাস্তববাদী গল্পকার হিসেবে স্বপ্নময়ের এই ম্যাজিককে কীভাবে দেখেন?

সাদিক হোসেন
ম্যাজিক রিয়েলিজমের যে ক্লাসিক্যাল সংজ্ঞা তার মধ্যে হয়তো স্বপ্নময় চক্রবর্তীকে ফেলা যাবে না। ওঁর গল্পের মধ্যে সমান্তরালভাবে একটি গুপ্ত প্রবন্ধও চলতে থাকে। অমিতাভ ঘোষের বেশ কিছু লেখার মধ্যেও এই রকম প্রবণতা আছে। তাদেরকে লাতিন আমেরিকার ইতিহাস ভিত্তিক ম্যাজিক রিয়েলিজম বলা যাবে না। কিন্তু স্বপ্নময়ের ভেতরে অন্যরকম একটা ব্যাপার আছে। চমকে দেয়। কুন্ডেরা এক ধরনের প্রবন্ধ ওঁর গল্পে বারবার প্রস্তাবনা করেন, এটা যতটা ঐতিহাসিক প্রবন্ধ নয় তার চেয়ে অনেক বেশি দার্শনিক প্রবন্ধ হয়ে ওঠে। স্বপ্নময়ের মধ্যে দার্শনিকতাটা ততোটা নয়--তবে এনথ্রোপলজি বা বৈজ্ঞানিকতাটা বেশি আসে। স্ট্রাকচারালি যদি দেখা হবে তবে স্বপ্নময়ের গল্প অমিতাভ ঘোষের কাছাকছি। তারা দুজনে কিছুটা হলেও মিলান কুন্ডেরার ঘরানার লেখক।



কুলদা রায়
স্বপ্নময়ে যেভাবে ডকুমেন্টেশন বা তথ্য ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় সেটা কিন্তু দেবেশ রায়ের মধ্যে আরো প্রবলভাবে উপস্থিত। দেবেশ রায়ের বরিশালের যোগেন মণ্ডল, তিস্তাপারের বৃত্তান্ত উপন্যাস পড়তে গেলে দেখা যায় তিনি অনেক ঘটনা বলছেন। অনেক চরিত্র এসে যাচ্ছে। কখনো মনে হয় ঘটনা পড়ছি না, পড়ছি--ডকুমেন্টেশন। আখ্যান ও ডকুমেন্টেশনের মধ্যে এক ধরনের কনফিউশন তৈরি হয়ে যায়। পাঠক ক্লান্ত বোধ করেন। অথচ অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় বড় আয়তনের উপন্যাস লিখেছেন--নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে ট্রিয়োলজি--দীর্ঘ বয়ান, বহুতলস্পর্শী আখ্যান। পড়তে পড়তে ক্লান্ত লাগে না। একটানা পড়ার দিকে পাঠকে ঠেলে দেয়। আক্রান্ত করে। মহাভারতের মতো একটি ক্লান্তিহীন ভ্রমণের দিকে পাঠককে নিয়ে যান। দেবেশ রায় এক্ষেত্রে অমসৃণ। ক্লান্তিকর। বিরক্তিকর গোলকধাঁধায় ফেলে দেন। মনে হয়, তিনি ডকুমেন্টেশনকে আরো মসৃণ, সুসংস্কৃত করে, আখ্যানের সঙ্গে আত্মীকৃত করে ব্যবহার করতে পারতেন। তাঁর লেখা এক ধরনের র' ম্যাটেরিয়াল হয়ে থাকে।

সাদিক হোসেন
সতীনাথ ভাদুড়ীর ঘরানার সঙ্গে দেবেশ রায়ের মিল পাওয়া যায়। লেখন শৈলীর দিক থেকে দেবেশ রায় ও সতীনাথ ভাদুড়ীর মধ্যে এক ধরনের নৈকট্য আছে। তিনি সম্ভবত মেলোড্রামা বা পাঠকের পরিতৃপ্তি ব্যাপারটাকে মাইনাস করে দিতে চান। তিনি তাঁর টেক্সটটাকে এমন এক স্তরে রাখতে চান যাকে পাঠক শুধু আবেগ দিয়ে দেখবেন না। বুদ্ধি দিয়ে সজাগভাবে দেখবেন। ব্রেশটের নাটকের ক্ষেত্রে যেটা হয়। সে অর্থে দেবেশ অনেকটা ব্রেশটিয়। ব্রেশটের নাটকে দুটো দিক থাকে। একটি হল--নাটকের আখ্যান। আরেকটি হল-- নাটক চলাকালীন নানা কর্মকাণ্ড। দর্শকদের নানাভাবে বোঝানো হচ্ছে--এটা নাটক হচ্ছে। সত্যি নয়। এটা গদারের ফিল্মের ক্ষেত্রেও হয়। দরজা বন্ধ করার পরে আমরা দরজার আওয়াজ পেতে থাকি। গদার বলতে চাইছেন--এটা তো তোমরা ফিল্ম দেখছ। উনি কোনও ভ্রান্ত বাস্তবতা দেখাতে চাইতেন না। উনি এমন কোনও রিয়েলিটিতে আমাদের নিয়ে যেতে চান না যাতে আমরা নিজেদের রিয়েলিটি ভুলে যাই। তিনি সব সময়ই চান যে, আমাদের রিয়েলিটির সঙ্গে আখ্যানের একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি হোক। এটা মনে হয় দেবেশ রায় তার লেখায় করার চেষ্টা করেন।


কুলদা রায়
পুতুল নাচ বা যাত্রার দলের পালার ব্যাপারটা উদাহরণ হিসেবে আনা যেতে পারে। পুতুল নাচে রূপভান আখ্যান দেখতে দেখতে আমরা আখ্যানের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাই। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা কখনো ভুলে যাই না--এটা অভিনয়। আখ্যানটা কয়েকটি বানানো পুতুল অভিনয় করে দেখাচ্ছে। তাদেরকে আবার পেছন থেকে কয়েকজন দড়ি ধরে গোপনে নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে রূপভানকে যখন বাঘে আক্রমণ করতে যায় তখন ভয়ে আমাদের গায়ে কাঁটা দেয় বটে, কিন্তু লাঠি সোটা নিয়ে স্টেজের বাঘটিকে মারতে ছুটে যাই না। আমরা আখ্যানটিকে বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি। আবেগকে বুদ্ধির উপরে উঠতে দেই না।

সাদিক হোসেন
আমরা স্টেজের সঙ্গে কখনোই একাত্ম হই না। সাধারণ ফিলম যেমন আমাদেরকে একাত্ম করে ফেলে আখ্যানের সঙ্গে--সেরকম ব্রেশটের নাটক একাত্ম করতে দেয় না। কিন্তু কোথাও আমাদেরকে যোগাযোগটা কিন্তু ঠিকই করে।


কুলদা রায়
কিন্তু গল্পের ক্ষেত্রে, কবিতার ক্ষেত্রে, গান ও নাচের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত অর্কেস্ট্রার মত কেন্দ্রীয়ভাবে এক ধরনের বেজে ওঠা যাকে আনন্দ বলা যেতে পারে, বেদনা বলা যেতে পারে, মাধুর্য বলা যেতে পারে সে রকম ব্যাখ্যাতীত বোধই তো পেতে চাই, একে আসলে চূড়ান্ত বিচারের আবেগের অন্য নাম বলা যেতে পারে। যুক্তি তর্কের পর্ব শেষ করে তা আসলে যুক্তির বাইরে চলে যায়। এর কথাই আমরা ক্লাসিক্যাল লিটারেচার হিসেবে ধরি--নান্দনিকতার চূড়ান্ত রূপ হিসেবে ধরি।

দেবেশ রায়ের একটি গল্প ‘উদ্বাস্তু’ গল্পের আখ্যান এমনভাবে বর্ণিত হয় যে সেটা বুদ্ধিতে স্পর্শ করার পাশাপাশি আমাকে আবেগাক্রান্ত করে ফেলে। পড়ে শুরুতে স্থবির হয়ে পড়ি। তারপর একসময় সেই স্থবিরতা ছেঁটে ফেলে তাকে নানা কায়দায় বুদ্ধিগ্রাহ্য করে বিশ্লেষণ করতে বসি। দেবেশ রায়ের এই ধরনের গল্পের সংখ্যা, আমার কাছে মনে হয়--খুব কমই আছে। এ ধরনের গল্প এক ধরনের লজিক তৈরি করছে। আবার লজিকটাকে ভেঙেও ফেলছে। কোনও আবেগে আক্রান্ত করতে দিতে চাইছে না সত্যি, নানা ডকুমেন্টেশন সত্যি সত্যি আবেগকে আসতে বাধা দিচ্ছে । কিন্তু যখন লোকটা থানা থেকে ফিরে আসে, তার স্ত্রীর কাছে এসে হতবাক হয়ে যাচ্ছে যে, এই মানুষটির সঙ্গে এতোদিন স্বামীস্ত্রী হিসেবে আছে। লোকে তাই জানে। তাদের ঘরে একটি মেয়েও হয়েছে। মেয়েটি এখন অনেকটাই সাবালিকা, কিন্তু সেই সাতচল্লিশে যখন দেশত্যাগ করছে--তারপর থেকে কখনোই প্রশ্ন ওঠেনি এই সত্যব্রত আদৌ কি সত্যব্রত, নাকি অন্য কোনো সত্যব্রত যে দাঙ্গায় মারা গিয়েছিল। এই অণিমা কি সত্যি সত্যি এই সত্যব্রত নামধারী লোকটির স্ত্রী, নাকি এনামূল হকচৌধুরীর স্ত্রী? নানা তথ্য প্রমাণ দিয়ে দেবেশ আমাদেরকে কনফিউজড করে দেন। কিন্তু যতগুলো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকুক না কেনো --সত্যব্রত নামে একাধিক মানুষ থাকুক না কেন, অণিমা নামে এনামূল হকচৌধুরীর স্ত্রী বা সত্যব্রতের স্ত্রী হোক না কেন, অঞ্জনা সত্যব্রতের বা এনামূল হক চৌধুরীর ঔরসজাত হোক না কেন--সাতচল্লিশের দেশভাগ যে এদের সবার আত্মপরিচয়কে ভেঙে দুমড়ে মুছে দিয়েছে-- মানুষের সম্পর্ক যে আর কখনোই সন্দেহের উর্দ্ধে উঠতে পারছে না, উদ্বাস্ত করে রেখেছেন বহুকালের জন্য--প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত এই উদ্বাস্তু চিহ্নটি যাবে না এই ধরনের সত্যের ঐক্যমতে কিন্তু পৌঁছে দিচ্ছেন দেবেশ এই গল্পটিতে।

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ, সাতচল্লিশ সে ধরনের বড় ঘটনাই বটে। আমাদেরকে সর্বার্থেই বিভাজিত করে দিয়েছে বহুর মধ্যে ঐক্যে রাখতে দিচ্ছে না।


কুলদা রায়
অমর মিত্রের ‘পাসিং শো’ গল্পটি পড়েছেন?

সাদিক হোসেন
না, পড়িনি।


কুলদা রায়
অমর মিত্রের ‘ধনপতির চর’ উপন্যাস?

সাদিক হোসেন
পড়েছি। 


কুলদা রায়
ধনপতির চরে একটা মিউজিক্যাল ব্যাপার আছে। অমর মিত্র অবশ্য সেই মিউজিকের কথাটি বলছেন না। কিন্তু উপন্যাসের ভাষা, তার বৈচিত্র্যময় চরিত্র, ভাসমান দ্বীপ, কিংবদন্তির কাছিম, সেই বৃটিশপূর্বকালের পেদ্রো নামের এক বুড়ো পর্তুগীজ জলদস্যু, আর সমকালের ভূমিদখলের কৌশলগুলোকে অমর মিত্র মালা বুনে যাওয়ার মতো করে বলেছেন। মহাকাব্যের মত বহুকাহিনীর মধ্যে দিয়ে একটি কেন্দ্রীয় আখ্যানপ্রবাহ কিন্তু আছে।

কিন্তু অমর মিত্রের ‘ধ্রুবপুত্র’ উপন্যাস মহাকবি কালিদাসের সময়কালের আখ্যান। তার জন্য তিনি একটি গুরুগম্ভীর ভাষা নির্মাণ করেছেন। অমর মিত্র আখ্যান অনুসারের নানা ভাষা ব্যবহার করেন। একটি ভাষার ওপর নির্ভর করেন না। নানা ভাষা তৈরি করতে ভালোবাসেন--ভাষা নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন। রবীন্দ্রনাথের চরিত্ররা তাঁর ভাষায় কথা বলে, তাঁর ভাষায় ভাবে--সবই তাঁর হাতে গড়া। এই ভাষা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা অটোমেটিকভাবে চলে আসে। এই ভাষা প্রবাহ ব্যাপারটা অমর মিত্রের মধ্যেও দেখতে পাই। তার গল্প উপন্যাসে এই অটোমেটিক ভাষা প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র নিয়ন্ত্রণের বিষয়টা চোখে পড়ে। এটা তাঁর একটা শক্তির দিক। অমর মিত্রের লেখা বিষয়ে এই সময়ের তরুণ গল্পকার হিসেবে আপনার মতামত কী?

সাদিক হোসেন
স্বপ্নময় চক্রবর্তী ও অমর মিত্র দুজনেই এক সময়ের গল্পকার। দুজনের বয়সও এক। লেখালেখিটাও দুজনে একই সময়ে শুরু করেছেন। স্বপ্নময় চক্রবর্তী একটা বিষয়কে নেন। উনি এক ধরনের পূর্বজ্ঞানকে ধারালো করতে করতে ঐ বিষয়ের দিকে এগোতে চান। অমর মিত্র যে বিষয়টা নেন তার মধ্যে ইমেজ অনেক বেশি থাকে। পরপর ইমেজ আসতে থাকে--আসতে থাকে। স্বপ্নময় চক্রবর্তী অনেক বেশি শব্দের মূর্ছনা তৈরি করেন। অমর মিত্র মূর্ছনার চেয়ে ইমেজ তৈরি করতে চান। দু'জনের দু-রকম নির্মাণ। 


কুলদা রায়
এ সময়ের কথাসাহিত্যিকদের নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? তারা কীভাবে প্রবীণদের গ্রহণ বা বর্জন করছেন?

সাদিক হোসেন
এটা বলা খুব কঠিন।এই কোলকাতায় যতজন কবি তার চেয়ে অনেক কম গদ্যকার। সামরান হুদা, শামিম আহমেদের গল্প ভালো লাগে। বিনোদ ঘোষালের বেশ কিছু লেখা আকর্ষণ করে। তিনি অন্য রকম করে লেখেন, সেভাবে আমি লিখিনা। কিন্তু তিনি ভালো লেখেন। বিনোদ খুব তাড়াতাড়ি চরিত্রের মধ্যে যান। এটা খুব ভালো প্রবণতা। আমাকে এটা করতে হলে বেশ পরিশ্রম করতে হয়। ইতিহাস এবং পুরাণের অসামান্য সমন্বয় করে শামিম আহমেদ লেখেন।


কুলদা রায়
শামিমের লেখায় দার্শনিকতার ছাপ থাকে।

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ, তিনি পুরান ও দার্শনিকতার মধ্যে মেল বন্ধন ঘটাতে সিদ্ধহস্ত।


কুলদা রায়
শামিম নিজের মতো করে কাজ করেন। কিন্তু বিনোদের মধ্যে জনপ্রিয় ধারায় লেখার একটা ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়।

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ, সেটা আছে। বিনোদ আমাদের এই মুহুর্তে আমাদের সময়ের জনপ্রিয়তম লেখক। 


কুলদা রায়
এই জনপ্রিয় ধারায় শামিল হওয়ার কারণে বিনোদ তার শক্তির অপচয় করছেন --মনে হতে পারে। অনেক পাঠকের কাছে যাওয়ার জন্য নিজেকে হারাচ্ছেন। শামিম কিন্তু কখনই জনপ্রিয় ধারার মধ্যে যেতে আগ্রহী নন।

শামিমের ‘বিষাদ বিন্দু’ উপন্যাসটি ইয়াজিদের জীবন অবলম্বনে লেখা। ইয়াজিদ কবি। গান পছন্দ করেন। আপাদমস্তক একজন রোমান্টিক শাসক। মীর মশারফ হোসেনের নিষ্ঠুর ইয়াজিদের সঙ্গে শামিমের ইয়াজিদ কোনোভাবেই মেলে না। এই উপন্যাসটির কলেবর শামিম বেশি ছোট করে ফেলেছেন। পড়ে আশ মেটে না।

সাদিক হোসেন
এটা আমারও মনে হয়। আমি একবার এক আড্ডায় শামিমদাকে এটা বলেছিলাম। 


কুলদা রায়
শামিমের ‘সাত আসমান’উপন্যাস ১৯৪৭ এর দেশভাগের পটভুমিকায় লেখা। মুর্শিদাবাদ এলাকায় সম্পন্ন মুসলমান পরিবারের আখ্যানের মধ্যে দিয়ে এলাকার সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক পরিবির্তনগুলোকে জাদুবাস্তববাদী আঙ্গিকে লিখেছেন। এই বইটির আকার ছোট হলেও পরিপুর্ণ লেখা হয়। মনে হয় তাড়াহুড়া করছেন না শামিম।

আমি যখন ‘বিষাদবিন্দু’ পড়লাম তখন আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। কী অসামান্য সাহস আর সুরুচি দেখিয়ে এ ধরনের উপন্যাস তিনি লিখেছেন। স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার একটা রিস্ক আছে। তাছাড়া ধর্ম-আখ্যান জড়িত বলে রিস্কটা বেশি। এদেশে মীর মশারফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ এক সময়ে ঘরে পঠিত হত। সেখানে ইয়াজিদ ধর্মবিরোধী ভিলেন। মুসলমান প্রচারক নবি হযরত মুহাম্মদের নাতিকে হত্যা করার প্রধান ব্যক্তি। ইয়াজিদের প্রতি মানুষের এতো ঘৃণা যে বাংলায় এই নামে কোনও পরিবারে নবজাতকের নাম রাখা হয় না। সেই ইয়াজিদকে নায়ক করে শামিম লিখেছেন। বাংলায় এরকম সাহস আর কারও এখন পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু এই মাপের কাজ করার জন্য যতটা যত্ন নেওয়া দরকার ছিল, সময় দেওয়ার দরকার ছিল সেটা শামিম দেননি। শামিম একাধারে দর্শনের ছাত্র। ইতিহাসে, পুরাণে তার অধিকার ঈর্ষণীয়। নিজস্ব একটি সৌকর্যময় লেখন ভাষা আছে, গল্প শৈলীর প্রতি নিয়ন্ত্রণ সহজাত--ফলে এই বিষয়ে লেখার মতো ঔপন্যাসিক এ সময়ে আর দ্বিতীয়জন আছে কিনা সন্দেহ। সেজন্যই শামিমের কাজে ফাঁকি দেখলে কষ্ট লাগে। শামিম তো মহৎ লেখা লিখবার জন্যই পৃথিবীতে এসেছেন, তাই না।

সাদিক হোসেন
মাইকেল মধুসূদন দত্ত আদ্যোপান্ত একজন রোমান্টিক কবি। কিন্তু তিনি যখন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ লিখছেন সেখানে কিন্তু প্রচলিত রোমান্টিকতা উলটে দিচ্ছেন। তিনি ভগবান রামকে ভিলেনে রূপান্তরিত করেছেন। রাবন আর তার ছেলে মেঘনাদকে নায়কে পরিণত করছেন।

সে সময়ে ফরাসি রোমান্টিকতা, বা ব্রিটিশ রোমান্টিকতার একটা বাঁক বদল চলছিল। তারা প্রচলিত রোমান্টিকতা ভেঙে দিচ্ছিলেন। মূলধারার সাহিত্য থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছিলেন। মাইকেল মধুসূদন সে সময়ের কবি হিসেবে তাই করেছিলেন। শামিম আহমেদও উপন্যাসের ক্ষেত্রে সেকালের কবিদের মত রোমান্টিকতা ভেঙে দিয়ে বিষাদ বিন্দু উপন্যাসটি লিখেছেন। পড়তে শুরু করলেই আমি প্রথমেই বুঝতে পারি তিনি ইয়াজিদকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোতে সাজাচ্ছেন। প্রথমত তিনি ‘বিষাদবিন্দুর’ আখ্যানের একটি কাঠামো রেখেছেন। তারপর ন্যারেশনটাকে উলটে দিচ্ছেন। এ-সময়ের একজন লেখক হিসেবে হয়তো অন্যরকম করে নির্মাণ করতে পারতেন। এখন যে নায়ক বা ভিলেন বলে কিছু রাখতেই হবে এমন কোনও দিব্যি নেই। সেই হিসেবে তিনি ইয়াজিদকে নায়ক বা ভিলেন না করেও এ সময়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্যরকম করে লিখতে পারতেন। কিন্তু হোসেনের বদলে ইয়াজিদকেই যদি নায়ক হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চান তাহলে তিনি লেখক হিসেবে সেই পুরানপন্থিই রয়ে যাচ্ছেন। এইজন্য লেখাটি পড়তে গিয়ে আমার অসুবিধাও হয়েছিল।


কুলদা রায়
আমার কী মনে হয় জানেন, শামিম আহমেদ ‘বিষাদ বিন্দু’ উপন্যাসটিকে একটা ড্রাফট বা খসড়া হিসেবে ধরে নিয়ে পূনর্লিখন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে শামিমের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত আরও ভালো কাজ পেতে পারি--আরেকটি মাস্টারপিস উপন্যাস যোগ হতে পারবে বাংলা সাহিত্যে।

সাদিক হোসেন
হ্যাঁ। সেটা হতে পারে।



কুলদা রায়
কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র আপনার লেখায় মুসলমানদের ঘরের কথা পাওয়া যাচ্ছে বলেছিলেন। এটা শামিমের ক্ষেত্রেও দেখি। শামিমও তার লেখায় মুসলমানদের মিথ, ইতিহাস, মানুষজন সহজাত হিসেবে নিয়ে আসেন। তাদের মুখের ব্যবহৃত ভাষা, শব্দ সেগুলোও নিয়ে আসেন। এগুলো আপনি কতোটা নিয়ে আসছেন?

সাদিক হোসেন
এটা আমি খুব সচেতনভাবেই ভেবেছি। আমি একটি মুসলিম পরিবারে জন্মেছি। মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবন যাপন বিষয়ে আমি খুব ভালো জানি। এই কারণে আমার গল্পের চরিত্রগুলো মুসলিম। এই চরিত্রগুলোর মধ্যে দিয়ে আমি যে সমস্যাগুলো হাজির করতে চাইছি সেগুলো কিন্তু একদমই সমকালীন বিষয়।

ওপার বাংলা (বাংলাদেশ) ও এপার বাংলার মুসলমান চরিত্রদের মধ্যে একটা মূলগত পার্থক্য আছে বলে আমার মনে হয়। বাংলাদেশের মুসলিম চরিত্ররা প্রচণ্ড সামাজিকভাবে চলাফেরা করতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কোনও লেখক যখন কোনো মুসলিম চরিত্র আনেন তাদেরকে কোনো ব্যবহৃত দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে আনার চেষ্টা করেন। যেমন স্বাধীনতা সংগ্রাম, নকশাল আন্দোলন, অথবা ধর্মীয় ভার্সেস একজন আধুনিক মানুষের সমস্যা। এইরকম বড় বড় ঘটনা বা সমস্যার ভেতর দিয়েই একজন মুসলমান চরিত্রকে গল্প বা উপন্যাসে দেখা হয়। আমি আমার গল্প উপন্যাসে এটা একদমই বর্জন করবার চেষ্টা করেছি। তদের দৈনন্দিন সমস্যা আনতে চেষ্টা করেছি। এবং তারা আখ্যানে যেন বিশেষভাবে নয়--খুব ফ্রিলি হাঁটাচলা করতে পারেন সেটা আনার চেষ্টা করেছি।


কুলদা রায়
আপনি পশ্চিম বঙ্গে মুসলমান চরিত্রদের বিষয়ে যা বললেন সেটা কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্যের হিন্দু লেখকদের লেখা হিন্দু চরিত্রদের বেলায়ও একদম ঠিক।

সাদিক হোসেন
এটা অদ্ভুতভাবে মিলে যায়। যেকোন দেশের সংখ্যালঘুদের স্বাভাবিক জীবন আর নেই। তারা সাহিত্যে ব্যবহৃত কোনও দর্শনের ভার বহনকারী হিসেবে টিকে আছে।



কুলদা রায়
এই সংখ্যালঘু লেখকরা আত্মরক্ষার এক বর্ম ঠিক রেখেই লেখেন। 

সাদিক হোসেন
আমি এটা আমার গল্পে খুব সচেতনভাবেই ভাঙতে চেয়েছি।

কুলদা রায়
বিপরীতক্রমে সংখ্যাগুরুরা প্রবলভাবে নিজেদেরকে প্রটাগোনিস্ট হিসেবে সাহিত্যে প্রকাশ করেন। এটা কিন্তু পশ্চিমা বা বাইরের দেশগুলোতে নেই। আমি অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করি, কলকাতার হিন্দু লেখকরা যখন লেখেন তখন তাদের লেখার মধ্যে সচেতনভাবে হোক অবচেতনভাবে হোক হিন্দুত্বের ঝোঁক থাকে। সংখ্যালঘুদের বিষয়গুলো একটু কম চলে আসে। আবার বাংলাদেশের মুসলমান লেখকরা একইভাবে মুসলমান শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেই লেখেন।

সাদিক হোসেন
আপনি ঠিক বলেছেন। সংখ্যাগুরু লেখকদের লেখায় সংখ্যালঘু চরিত্র খুবই কম। 


কুলদা রায়
বাংলাদেশের লেখকদের লেখায় মুসলমানদের লড়াই সংগ্রাম প্রবলভাবে ফুটে উঠছে। পশ্চিম বঙ্গেও হিন্দু লেখকদের লেখায় হিন্দুদের লড়াই সংগ্রাম প্রবলভাবেই আসছে। মুসলমানরা নেই। পুরনো দিনের এই দেওয়ালটা এ সময়ের লেখকরা ভাঙতে পারছেন না। বাংলাদেশের কিছু লেখকের মধ্যে আরেকটি আওয়াজ আমরা লক্ষ্য করি। তারা বলছেন, বাংলাদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের জীবন যাপন পশ্চিম বঙ্গের হিন্দুদের চেয়ে আলাদা। আমাদের আখ্যানও আলাদা। সুতরাং, আমাদের ভাষাটাও আলাদা।

তারা বলছেন আমরা যে গদ্য ব্যবহার করছি তা তৈরি হয়েছে বৃটিশদের আনুকূল্যে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে। তৈরি করেছেন হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা। তারা হিন্দুয়ানি ধারায় বাংলা গদ্য বানিয়েছেন। এটাকে আমরা কেনো ব্যবহার করব। আমরা আমাদের নিজের উপযোগী ভাষা তৈরি করে নেব। কলকাতার লেখকরা ঘোষণা না দিয়েই সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত বাংলা মান ভাষায় লিখে চলেছেন। তাদের লেখায় আরবি, উর্দু শব্দ থেকে যাচ্ছে। তাদের একটি যুক্তি আছে যে, তারা এই মান ভাষাটি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। তাতেই অভ্যস্ত হয়ে আছেন। তারা ভাষা পরিবর্তনের দরকার বোধ করছেন না। কিন্তু বাংলাদেশের কিছু মুসলমান লেখকও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত মান বাংলা ভাষাকে আর ব্যবহার করতে চায় না। তারা বাংলাদেশি একটা ভাষা নির্মাণ করতে চাইছেন। এ বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখেছেন?


সাদিক হোসেন
ক্ষমতার সঙ্গে ভাষার একটা প্রবল যোগ আছে। আমি বাংলাদেশের লেখা পড়ার সুযোগ খুব বেশি পাই না। বাংলাদেশের মানুষের নিজস্ব একটা আইডেনটিটি তৈরি হয়ে গেছে। এই আইডেনটিটির জন্য নিজস্ব ভাষার গড়ন দরকার। সেই কারণে বাংলাদেশের লেখকরা নিজেদের জন্য একটা ভাষা তৈরি করে নেবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। দেবেশ রায় একবার আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, পশ্চিম বঙ্গের পত্রিকাগুলো পরিকল্পনা করে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচলিত আরবি উর্দু শব্দকে সরিয়ে দিয়ে সংস্কৃত শব্দকে ব্যবহার করছে। আমার সন্দেহ হয় বাংলাদেশে পশ্চিম বঙ্গের ঠিক উল্টোটা ঘটতে পারে। সবই তো ক্ষমতার ব্যাপার। ক্ষমতা সব সময়ই ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।

প্রচলিত যেসব শব্দ বাংলাদেশের মানুষ ব্যবহার করে তাদেরকে হটিয়ে দিয়ে হয়তো উর্দু আরবি ফারসি শব্দ জোর করে প্রচলন করার চেষ্টা করতে পারে। এই ধরনের ভাষার প্রতি ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ঘটতে পারে। দেখুন আমার হয়তো কিছু নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো তারা হয়তো আমার নাম মনে রাখতে পারল না। নাম মনে রাখার চেষ্টাও করল না। পরে কখনো আমার প্রসঙ্গ এলে ওরা বলে, ওই যে সেদিন যে-মুসলিম ছেলেটা এসেছিল। শব্দকে সম্প্রদায় দিয়ে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা। এটা তো সচেতন বা অবচেতনভাবে সাদিক হোসেন নামের ভাষাকে অস্বীকার করার প্রবণতা।


কুলদা রায়
এই সাম্প্রদায়িক ভাষার ডিজাইনটা মাথার মধ্যে বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। 

সাদিক হোসেন
এটা তো আরো ভয়ঙ্কর। এগুলো আনকনসাসে রয়ে যাচ্ছে। আমরা সচেতনভাবে বলি যে, আমরা সাম্প্রদায়িক হব না। কিন্তু অবচেতনে অনেক সাম্প্রদায়িক আচরণ করে ফেলি যা আমরা রিয়ালাইজও করতে পারি না যে, তা সাম্প্রদায়িক হচ্ছে কিনা। এটা পরিকল্পিতভাবে আমাদের সংস্কৃতির অংশ করে ফেলা হচ্ছে।

কুলদা রায়আপনি যে মুসলমান পরিবার থেকে এসেছেন সেখান থেকে সেই চরিত্রগুলো আপনার লেখায় আসছে, সেই সম্প্রদায়ের মিথগুলো আসছে। ঐতিহ্যগুলো আসছে। আপনি সেগুলো স্বচ্ছন্দ্যভাবেই লিখছেন। পশ্চিমবঙ্গের পাঠকরা আপনার এই লেখাগুলো কীভাবে নিচ্ছেন?

সাদিক হোসেনতারা মুসলিম পরিবার, মুসলিম সমাজ, মুসলিম সম্প্রদায়কে খুব এক্সোটিক ওয়েতে দেখেন। কতটা সাহিত্যের জন্য ভালোলাগা, গল্পের জন্য কতটা ভালো লাগা আর কতটা এক্সটিক কারণে ভালো লাগা--তা নিয়ে আমার নিজেরও ধন্ধ আছে। অনেক ক্ষেত্রে অনেকে বলেছেন তোমার এই গল্পটা ভালো। পরে তার সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বুঝেছি উনি গল্পটিকে পুরোপুরি এক্সটিক ব্যাপার হিসেবে দেখছেন। তাদের মধ্যে এক ধরনের এক্সটিক দৃষ্টিকোণ আমি দেখতে পাই। এক্সটিক গল্প, এক্সটিক ন্যারেশন--পাঠকদের মধ্যে এই ধরনের একটা ব্যাপার আছে। অবশ্য আমার গল্পকে জনপ্রিয় করতে সহযোগিতাও করে এইসব ব্যাপারগুলো। সেটা তো আমি চাইও না। গল্পের বুনটের ক্ষেত্রে প্রশংসা না হয়ে প্রশ্নটি হয়ে যায় এক্সটিক কারণে।


কুলদা রায়
লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনার পরিকল্পনা কী? 

সাদিক হোসেন
আমার সাত আটটা ছোট গল্প জমেছে। আরো একটা দুটো লেখার পরে একটি ছোট গল্পের বই করতে চাই। ছোট গল্পগুলোকে আমি সিরিজ হিসেবে ভাবি। কবিতার যেমন সিরিজ হয়। সম্মোহন বলে আমার ছোট গল্পের প্রথম যে বইটি বেরিয়েছিল সেখানে গল্পগুলো একটি সিরিজ আকারে ছিল। আর যে বইটি এবার পুরস্কার পেলো, ওই বইটার গল্পগুলোও একটা সিরিজ। এখন যে বইটি লিখছি এইটাও একটা সিরিজ। এই সিরিজটার মধ্যে অনেক বেশি পপুলার রাজনৈতিক কনটেম্পোরারি বিষয়গুলো নিয়ে এসেছি। জানি না বইটা হবে কিনা।

কুলদা রায়
আপনাকে ধন্যবাদ।

সাদিক হোসেন
আপনাকেও ধন্যবাদ




Post a Comment

0 Comments