মোজাফ্ফর হোসেনের গল্প 'লাশটি জীবিত, বাকিরা মৃত' নিয়ে আলাপ

 


কুলদা রায় : 
এই গল্পটির সূত্র কিভাবে পেয়েছিলেন?

মোজাফ্ফর: 
অনেক আগে নির্মাণাধীন ভবনে লাশ ঝুলে থাকার খবর পড়েছিলাম একটি খবরের কাগজে। সম্ভবত ২০০২ সালের দিকে। ঘটনাটি সেই সময় মনে ততটা দাগ কাটেনি। বছরপাঁচেক পর হঠাৎই মনে পড়ে গেলে আমাকে ভাবিয়ে তুললো। তারপর থেকে নির্মাণাধীন ভবন দেখলেই মনে পড়ে যেত ঐ ঝুলন্ত লাশটির কথা।
মনে হত, আমি ওকে চিনি, ওকে আমি দেখতে পাচ্ছি- এই ভবনেও ঝুলে আছে। লাশটি প্রতিটি নির্মাণাধীন ভবনে ঝুলে থেকে কি যেন বলতে চাচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হল, কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। যেহেতু আমি দেখতে পাচ্ছি এবং আমি অন্যদের মতো ব্যস্তও নয়, কাজেই আমার দায়িত্ব ওর কথা সকলকে জানানোর। সেই দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে গল্পটি লেখা। 


কুলদা রায় :
 গল্পের ভঙ্গিটি জার্নালিস্টিক। এই নির্মাণশৈলী নিয়ে কিছু বলুন।

মোজাফ্ফর: 
আমি ইচ্ছে করেই লিটারারি জার্নালিজম টেকনিকটা অ্যাপ্লাই করেছি। এই গল্পে এই ধরনের টেকনিকের দরকার ছিল। এখানে ঐতিহ্যগত নির্মাণশৈলী ব্যবহার করলে গল্পটা এতটা কমিউনিকেটিভ হত না। আমি নিজে যেহেতু সাংবাদিকতা পেশায় আছি, তাই আমার মনে হল, গল্পটির জন্য এই শৈলিটা উপযুক্ত হবে। 
 

কুলদা রায় :
এ ধরনের কাহিনী নিয়ে কৃষণ চন্দরের একটি গল্প পড়েছিলাম। একটি গাছের নিচে একটি লোক চাপা পড়েছিল। লোকটা আপনার গল্পের লোকটির মত মারা যায়নি। জীবিত ছিল। তাকে উদ্ধারের বৃত্তান্ত নিয়েই গল্পটি ছিল। লোকটি আর উদ্ধার হয় না। এক ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে পড়ে শেষ পর্যন্ত মারাই গেল। কিন্তু আপনার গল্পটিতে লাশ নামানো নিয়ে মূল আখ্যানটি। লাশ নিজে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। তার পরিবার-পরিজনের প্রতিক্রিয়াটি দেখতে পাচ্ছি। মর্মভেদী।

এই গল্পটি লিখতে এতদিন সময় নিলেন কেন? এবং যে সময়টিতে আপনি খবরটি দেখেছিলেন সেই সময়ে অনলাইন পিউজপোর্টাল হয়নি। টকশো বা লাইভকাস্ট তেমন গড়ে ওঠেনি।

মোজাফ্ফর: 
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নানাভাবে আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তোলে। একটি রাষ্ট্রের স্বরূপ চেনা যায় তার আমলাতন্ত্র দ্বারা। ব্যক্তির অস্তিত্ব আর রাষ্ট্রের অস্তিত্ব একবিষয় না। বেশিরভাগ সময় ব্যক্তি হয় প্রটাগনিস্ট এবং রাষ্ট্র এন্টাগনিস্ট- সেটা কিন্তু এই আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণেই। তাই আধুনিক সাহিত্যে এসে ব্যক্তির শত্রু আর সেই জমিদার-সুদখোর-মাতব্বর না, অর্থাৎ সমাজ না; রাষ্ট্র। কাফকার সাহিত্যে এই দিকটা আরো ভালো করে ফুটে উঠেছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্যে আমলাতন্ত্র নিজেই বন্দি!

গল্পটি লিখতে এতদিন সময় নেয়ার প্রধান কারণ হল, শুরুতে লাশটির প্রতি আমার ভীষণ আবেগ কাজ করছিল। এত আবেগ নিয়ে লেখা সম্ভব ছিল না। যখন অনুভব করলাম, লাশটির প্রতি আমি নৈর্ব্যক্তিক হতে পারছি, তখনই লিখতে শুরু করলাম। মাঝে মধ্যে এই থামাটার দরকার হয়। কবিতায় হয়ত কিছুটা আবেগ থাকা ভালো, কিন্তু কথাসাহিত্যে আবেগ থাকলে চলে না। চরিত্রকে আপনি যত আপন ভাববেন, গল্পটা তত একপেশে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। 


কুলদা রায় :
গল্পটিতে প্রথম লাইনের আহাজারি শুনতে পাচ্ছি দুজন জননীর। একজন লাশটির মা। আরেকজন লাশটির মেয়ের মা। দুজনেরই কপালপোড়া। কারো স্বামী সন্তান টেকে না। আপনি কেন দুজনকে জননী হিসেবে পরিচিতি দিলেন শুরুতেই?

আপনি গল্পের শুরুটা এই আহাজারি দিয়ে কেন করলেন? বাকি গল্পে আহাজারি ছিল মানুষের কাছে। ক্ষমতার কাছে। কিন্তু শুরুটা আল্লার কাছে, যিনি সে আহাজারি শোনেন বলেও প্রমাণ পাওয়া যায় না গল্পের শেষে গিয়েও। দুই জননীকে কঠিন ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে।

মোজাফ্ফর: 
মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত সংসারে যে কোনো ধরনের সহিংসতা, অনিয়ম, অপঘাতের শিকার হন নারীরা। নারী বলতে স্পেসিফিক ‘মা’। কারণ পুরুষের মৃত্যু ঘটলে বা অঙ্গহানি হলে সংসার-সন্তানের ভার গিয়ে পড়ে নারীর ঘাড়ে। কিন্তু নারীর মৃত্যু হলে পুরুষ সেই ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে পারেন। যুদ্ধাক্রান্ত দেশে দেখেন, পুরুষরা যুদ্ধে গিয়ে হয় শহীদ নয়ত গাজী খেতাব পান। কিন্তু নারীরা পুরুষের অবর্তমানে সংসারযুদ্ধকে যে চালিয়ে যান, তার কোনো খেতাব পান না। যে কারণে লিসিসট্রাটা (‘লিসিসট্রাটা’ নাটকের নামচরিত্র) বলেছে, ‘ওয়ার ইজ কনসার্নড্ উইথ উইমেন’।

এই গল্পের শুরুতে যে হাহাকার-আহাজারি সেটা প্রত্যাশিত। কেননা সদ্যমৃতের নিচে দাঁড়িয়ে মা ও স্ত্রী। তবে আমার ফোকাস পয়েন্টটা ছিল আহাজারিতে না; আহাজারিটা কিভাবে স্তব্ধ হয়ে এলো সেটির দিকে। আপনার অধিকার যখন আস্তে আস্তে খর্ব হয়ে আসে, তখন আপনি হয়ত শুরুতে প্রতিবাদ জানাবেন, তারপর ক্রমেই নীরব-নিথর হয়ে পড়বেন।



কুলদা রায় :
 কথক হিসেবে যিনি আছেন তিনি দুএকটি যায়গায় উঁকি দিয়ে কোনো শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কথা বলেন। তাদেরকে তুমি বলে সম্বোধন করেন। তাতে মনে হয় কথক একজন শিক্ষক। তাদেরকে বলেন, এটা গল্প। অর্থাৎ এই বলার মধ্যে দিয়েই পাঠককে গল্পের অংশ হয়ে ওঠা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছেন। এটা কেন করছেন? এটা কি ব্রেখট বর্ণিত এলিয়েনেশন কৌশল?

মোজাফ্ফর:
ঠিক এলিয়েনেশন কৌশল আমি বলবো না। গল্পটা খুব মর্মস্পর্শী হওয়ায় পাঠক দ্রুত লাশের বা লাশের পরিবারের পক্ষ নিয়ে হাহাকার করতে শুরু করে দেয়ার সম্ভাবনা আছে। আমি এজন্যে বারবার পাঠককে ধাক্কা দিয়েছি। পাঠক যদি কোনো চরিত্রের সঙ্গে একান্তভাবে একাত্ম হয়ে ওঠে, তাহলে সে তার বোধবুদ্ধি, বিশ্লেষণ ক্ষমতা হারাবে। আমি পাঠককে ইনভল্ব না করে দর্শকের ভূমিকায় রাখতে চেয়েছি। শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝাতে চেয়েছি, এটাই ঘটনা-- আবার এটাই গল্প।



কুলদা রায় :
গল্পটিতে লাশের পরিবারের তিনজনের ভূমিকা আছে। লাশের মা’ই কথা বলেন। দাবি দাওয়া তোলেন। দাবী দাওয়া থেকে সরেও আসেন। বউটি কোনো কথা বলে না। সিঁড়ির দিকে চেয়ে থাকে। শাশুড়ির পিছনে পিছনে থাকে। একটা নিয়তি মেনে নেওয়া মৃদু মানুষই মনে হয় তাকে। আর তার মেয়েটি শুধু বলে, মরা মানুষ কি আবার জ্যান্ত হবে না? এইটুকু। এইটুক হলেও মর্মভেদী। হয়তো এ কারণেই এরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এই চরিত্র নির্মাণের ব্যাখ্যা শুনতে ইচ্ছে করছে।

মোজাফ্ফর:
তিনটি চরিত্র তিনরকম ভাষা নিয়ে এসেছে। তিনজনের অনুভূতি এক কিন্তু উপলব্ধি আলাদা। লাশটির মা সংসারে আগে অনেক মৃত্যু দেখেছে। তার সংসারে সেই বাকি রইল কেবল। অর্থাৎ তার বেদনার একটা সমাপ্তি আছে। অন্যদিকে লাশটির শাশুড়িও পরিবারে মৃত্যু দেখেছে। জামাইয়ের মৃত্যু তাকে আহত করেছে বটে কিন্তু তাকে স্তব্ধ করেছে তার সদ্য বিধবা মেয়ে। সে তখন তার মেয়ে ও নাতনি নিয়ে ভাবছে। কারণ সে তার মেয়ে এবং মেয়ের-মেয়ের মধ্যে তার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে। অর্থাৎ কয়েক প্রজন্মে ছড়িয়ে পড়ছে একই হাহাকার। সেই হাহাকার থেকে সে বাকরুদ্ধ, নির্বিকার। অন্যদিকে এই ঘটনায় লাশটির স্ত্রীর পুরো ভাবনার জায়গাটা ব্ল্যাংক্ হয়ে গেছে। ভাষা দিয়ে এই শূন্যতা বোঝানো যেত না। 


কুলদা রায় :
 লাশটির কোনো নাম আপনি দেননি। একটা নাম হতে পারত। এমন কি লাশটি বাবা, মা, ভাই, বৌ বা মেয়ে কারোই নাম দেননি। তবে কমিউনিকেট করতে তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু দুজন লোকের নাম দিচ্ছেন। একজন বিল্ডিংয়ের মালিক। আরেকজন ফেসবুকিয়ান ছেলেটি, যে লাশের ছবি ফেসবুকে দিয়ে সেলিব্রিটি হয়ে গেল। এই নাম নিয়ে দু’ধরনের অবস্থান নেওয়ার কারণ কি?

মোজাফ্ফর: 
লাশটির নাম দিইনি কারণ আমরা তাকে চিনি না। লাশটির পরিবারকেও আমরা জানি না। আমরা তাদের চিনতেও চাই না। কিন্তু ভবন মালিককে আমরা চিনি। তাকে চেনার অনেকগুলো কারণ আমাদের থাকে। তাকে অনেকসময় বাধ্য হয়ে আমাদের চিনতে হয়। দেখবেন আমরা সবসময় কে খুন হল, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করি কার নির্দেশে খুনটা করা হল, তাকে জানার জন্যে। যার নির্দেশে খুনটা হল, তাকে চেনা দরকার। এই চেনার প্রবণতা অনেক সময় ক্রিমিন্যালের প্রতি sympathetic antipathy and antipathetic sympathy থেকে জেগে ওঠে।

আর ছেলেটির নাম দিয়েছি, কারণ সে এই ঘটনার মধ্য থেকে নামটা অর্জন করেছে। 


কুলদা রায় :
এই গল্পে মুক্তিযুদ্ধেরও একটি ঘটনা আছে। সেটা হল লাশের বাবা অস্ত্র নিয়েই মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। কেন যুদ্ধে গিয়েছিলেন সেটা জানা যায় না। জানানোর প্রয়োজনও বোধ করছেন না। তবে জীবনবাজী রেখে যুদ্ধ করাটা গল্পের মধ্যে বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটায় না। লাশের বাবাকেও কোনো বিশেষ করে তোলে না। শুধু একটি বাড়তি তথ্য যোগ করে মাত্র।

মুক্তিযুদ্ধের সময় লাশের জন্মই হয়নি। তবে যুদ্ধের সময়ে সে মায়ের পেটে ছিল। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে নয় মাস ধরে। শেষ দিকের চার পাঁচ মাসের সময়ে গর্ভবতী ছিল। এটা নিয়ে মানুষের সন্দেহ থাকলেও লাশের বাবার কোনো সন্দেহ ছিল না। এটা বেশ প্রতীকী। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অনেকের ভারতের দান বলার চেষ্টা করে থাকে।

যাই হোক লাশের বাবা লোকটি যুদ্ধের আগে হয়তো মাটি কাটার কাজটিই করতেন। যুদ্ধের পরেও তাই। তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় নি। খাবার না পেয়ে একদিন লোকটি হার্ট স্ট্রোক করল। মারা গেল। এই মৃত্যু তো মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যায় না। রাষ্ট্র সেটা মানবেও না। মানলে রাষ্ট্রকে দায় নিতে হবে। সেজন্য প্রচারিত হল লোকটি সাপের কামড়ে মারা গেছে। নিয়তি। নিয়তির বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকে না। প্রশ্ন তোলার কোনো উপায়ও রাখছেন না। আপনি এ রকম কিছু তথ্য বুনে যাচ্ছেন।

আপনি আরো তথ্য দিচ্ছেন র‍্যাব নামের এলিট বাহিনী আছে। তারা যে কাউকে গুলি করে মারতে পারে। জবাবদিহির দরকার হয় না। তথ্য দিচ্ছেন দেশের মন্ত্রী মারা গেছেন বিদেশে। তার ডেডবডি আসবে দেশে। সে জন্যে পুলিশরা ব্যস্ত। এ জন্যে নির্মাণশ্রমিকের পচাগলা ডেডবডি তার পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়ার সময় নেই পুলিশের। ফেসবুক, মিডিয়ার লাইভ শো, টকশো, লাইভ টেলিকাস্ট, স্মার্টফোন, ব্লগ-- এদের যাদুকরী কাজকারবার উল্লেখ আছে। এগুলো তো ক্ষমতারই নানা রকম হাত, সেটা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ব্যাখ্যা দিয়ে বলার চেষ্টা করছেন না। মিশেল ফুকো কথিত ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার জন্যই কিছু সুবিধাদি ভিক্টিমকে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেটা কোনোভাবে ভিকটিমকে ক্ষমতার লম্বা হাতের মুঠো থেকে মুক্ত করার শক্তি যোগায় না, নতুন করেই ক্ষমতার জালে ফেলে নিয়তির মতই। এই তথ্যগুলো বীজ বুনে যাওয়ার মত করে।নিরীহ ভঙ্গিতে গল্পে বুনে গেছেন

সেগুলো জ্বলে ওঠে না একপাঠে। তবে দ্বিতীয়পাঠে সতর্ক পাঠক হিসেবে আবিষ্কার করতে পারলে বিস্ফোরকের মত মাথার ভেতরে জ্বলে ওঠে। আমাদের মূলধারার গল্পে এ ভঙ্গিমাটি পাওয়া যায় না।

এই বিস্ময়কর লিখন ভঙ্গিমাটি কোথায় পেলেন? কিভাবে পেলেন? 


মোজাফ্ফর: 
মুক্তিযুদ্ধের অংশটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছোটগল্পে অনর্থক কোনো প্রসঙ্গ টানার সুযোগ থাকে না। আবার বিশদবয়ানে যাবারও উপায় নেই। এই অংশটি না থাকলে হয়ত মূলগল্পের কোনো ক্ষতি হত না। কিন্তু আমি রাষ্ট্রের যে স্বরূপ তুলে ধরতে চাইছি, সেটার ইনটেনসিটি কমে যেত। অংশটির গুরুত্ব আপনার প্রশ্নের পর্যালোচনা অংশেই ভালোভাবে উঠে এসেছে। আমি বরং ন্যারেটিভ টেকনিক নিয়ে কথা বলি। এখানে যে নির্মাণশৈলিটা আমি প্রয়োগ করেছি, সেটা কোথাও রেডিমেইড পাইনি। অর্থাৎ কাউকে বা কোনো পার্টিকুলার লেখাকে হুবহু অনুসরণ করার সুযোগ ছিল না। আমাকে গল্পের প্রয়োজনে এই পথে হাটতে হয়েছে।

কুলদা রায় :
 আখ্যানগত দিক থেকে গল্পটি সার্কাসটিক। কিন্তু আপনি সার্কাজমের পথ না মাড়িয়ে গেছেন জার্নালিস্টিক পথে। কোনো রসিকতাসুলভ শব্দ বা বাক্য ব্যবহার করেননি। মৃদুস্বরে সিরিয়াস ধারায় লিখে গেছেন। এই সার্কাজমকে এড়ানোর কারণ কি?

মোজাফ্ফর :
 গল্পের আখ্যান অংশে Deadpan Sarcasm কাজ করছে। এই ধরনের সারকাজমে স্পিকার ঠাট্টা বা আবেগ ছাড়া গল্পটি বলে যান। যে কারণে পাঠক বা শ্রোতা দ্বিধায় পড়ে যান গল্পের সত্যতা নিয়ে। তারা বুঝতে পারেন না গল্পকথক mock করছেন না jok করছেন। এখানে হিউমর আছে কোথাও কোথাও, তবে মৃদু। আমি সবসময় বলি যে, আমরা একটা বানোয়াট বাস্তবতায় বাস করছি। এই বাস্তবতাটাই সার্কাসটিক। যখন গল্পটা এই বাস্তবতা নিয়ে হয়, তখন বলার স্বরটা সার্কাসটিক না হলেও চলে। তবে উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমি আবার ভিন্ন মত পোষণ করি। যে কারণে মঈনুল আহসান সাবেরের ‘এখন পরিমল’ উপন্যাসটা সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। এভাবে না বললে, উপন্যাসটা বক্তব্যপ্রধান হয়ে উঠতো। একই কথা খাটে দস্তয়ভস্কির ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’ বড়গল্পের ক্ষেত্রে। 
 

কুলদা রায় : 
 রমাপদ চৌধুরীর ‘আজকের গল্প’ নামে একটি গল্প আছে। সেখানে পরিবারের ছোট মেয়েটির জন্য এক জোড়া জুতো কেনা হয়। জুতোটির একপাটি রাস্তায় পড়ে যায়। সেটা গলির মুচি কুড়িয়ে পায়। জুতোর পাটিটি ফেরত চাইতে গেলে মুচি কিছু টাকা চায়। সেটাকে অন্যায় মনে করে জুতোর পাটিটি না নিয়েই চলে আসে। রেগে বাকি জুতোটিও ছুড়ে ফেলে দিতে যায় প্রতিবাদ হিসেবে। এইখানে গল্পটি শেষ হলে পাঠক খুশি হওয়ার কথা। তিনি সেটা না করে আরেকটি প্যারা যুক্ত করে বলেন, না, বাস্তবটা ছিল ভিন্ন। তিনি মোটেই একপাটি জুতো ছুড়ে দেননি। সেটা না করে তিনি টাকা দিয়ে পাটিটি ফেরত এনেছিলেন। এভাবে দুটি বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিলেন রমাপদ চৌধুরী।

আপনার গল্পেও এরকম একটি আঙ্গিক ক্রাফট ব্যবহার করেছেন। তবে শেষ প্যারায় নয়। শেষের বেশ কিছুটা আগে। সেখানে দেখা যাচ্ছে একটি ছেলে লাশটির ছবি তুলেছে। ফেসবুকে দিয়েছে। সেখান থেকে অনেক মানুষ জেনেছে। মিডিয়ায় চলে গেছে। সরকার জেনেছে। লাশটিকে নামানো হয়েছে। তার পরিবার কিছু টাকা পয়সাও পেয়েছে। প্রায় একটি স্বস্তিকর পরিণতি পেয়েছে আখ্যানটি। কিন্তু এই পর্যন্ত এসেই আপনি একটি তল পরিবর্তন করে আরেকটি তলে নিয়ে গেছেন। আরেকটি বাস্তবতায় পৌঁছে দিচ্ছেন। বলছেন, না, লাশের পরিবারটির দুর্ভোগ শেষ হয়নি। তারা গ্রামে ফিরে গেছে। বউটি ধর্ষিত হয়েছে। দুর্বৃত্তরা টাকা পয়সা নিয়ে গেছে। তারা নিঃস্ব গেকে আরো নিঃস্ব হয়েছে। পাঠককে তার নিজের পুরনো ভাবনা থেকে বের করে দিচ্ছেন। তাকে সুখী হতে না দিয়ে বিষাদগ্রস্ত করে তুলছেন। অথচ মূলধারার গল্পকাররা এটা করেন না। ‘অবশেষে তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল’ ধরনের পরিণতি টেনে দেন। এতে গল্পের কাটতি হয়। রিস্ক থাকে না। কিন্তু আপনি প্রচলিত এই পথে গেলেন না। ভিন্ন তলের মধ্যে দিয়ে সত্যের বহুবিধ রূপ দর্শন করালেন। এই ভিন্নধারায় লেখার বাসনা কেন করছেন?

মোজাফ্ফর :
 এখানে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় নিজের লেখা একটি প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করছি : ‘যে গল্পটা তৈরি, সেটা সাহিত্য না। মানে দশজন লিখলে যদি দশরকম সম্ভাবনা বের হয়ে না আসে তবে সেটা গল্প বটে কিন্তু সাহিত্য না। অর্থাৎ সাহিত্যের প্রধান কাজ হল, ব্যক্তির সম্ভাবনাগুলো খুঁজে খুঁজে বের করা। ব্যক্তির সেই সম্ভাবনাগুলো বাস্তবে বিদ্যমান থাকতেও পারে, নাও পারে। মার্ক টোয়েন যথার্থই বলছেন- ÔFiction is obliged to stick to possibilities, Truth isn’t.’ অস্কার ওয়াইল্ড-এর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলি- Ôliterature always anticipates life. It does not copy it, but molds it to its purpose’। একটু ভেঙে বললে, সাহিত্য হল অন্য এক বাস্তবতা যেখানে বায়বীয় চরিত্রগুলো বাস্তবের চরিত্রদের পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করে। তাই ক্ষেত্রবিশেষ বাস্তবের চরিত্ররা হয়ে ওঠে বায়বীয় চরিত্রদের ছায়া বিশেষ। এই অর্থে দুইটা জগত আলাদা আবার অভিন্নও।

সাহিত্য অনেকগুলো আপেক্ষিক সত্যের মাঝে যে অস্পষ্টতার প্রজ্ঞা তা থেকেই নিজের প্রজ্ঞাকে বের করে আনে। সাহিত্য প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করে চলে ব্যক্তির সম্ভাবনাকে। সত্য আবিষ্কার করা সাহিত্যের কাজ না, এখানেই বিজ্ঞানের সাথে সাহিত্যের বিরোধ। যে সাহিত্যে আবিষ্কার নেই তার প্রয়োজন মূল্য নিতান্তই কম। কুন্ডেরা তাকে বলছেন- ‘অনৈতিক সাহিত্য’ (দি আর্ট অব নভেল)। অর্থাৎ নতুন কিছু আবিষ্কার করা সাহিত্যের নৈতিকতার মধ্যে পড়ে।

যে কারণে আমার গল্পগুলো শেষপর্যন্ত বাস্তবতা-নির্ভর না থেকে সম্ভাবনা-নির্ভর হয়ে ওঠে। এই গল্পেও সেটা হয়েছে। আমি কয়েকটি সম্ভাবনা দাঁড় করেছি। এর কোনো একটি সত্য অথবা সত্যটা এর বাইরে অবস্থান করছে। আমি সত্যটা বলার জন্যে কখনই লিখি না। তাই বলে কি ‘ট্রুথ অব ফিকশন’ বলে কিছু নেই? অবশ্যই আছে। তবে সেটি ঘটনা নয়, ঘটনার বিন্যাসে। যেমন, আপনি আকুতাগাওয়া রিউনোসুকের ‘ইন অ্যা গ্রুভ’ গল্পে একই ঘটনার এক এক ক্যারেক্টার এক এক রকম সত্য তুলে ধরে, যেগুলো একটির সঙ্গে অন্যটি একেবারে বিপরীত। কোন বর্ণনাকারীকে বা কোন ঘটনাকে আমরা সত্য বলে মনে করবো?


মূল গল্পটি পড়ার লিঙ্ক :

Post a Comment

0 Comments