দীপেন ভট্টাচার্যের গল্প 'নিস্তার মোল্লার মহাভারত' গল্প নিয়ে আলাপ

 


দীপেন ভট্টাচার্য এ সময়ের অন্যতম সেরা গল্পকার। তার গল্পে বিজ্ঞান, পুরান, কল্পনা, ইতিহাস, দার্শনিকতার অসামান্য সম্মিলন থাকে। সম্প্রতি গল্পপাঠের জন্য লিখেছেন যাদুকরী ভাষায় নিস্তার মোল্লার মহাভারত গল্পটি। এই গল্পটির কলকব্জা নিয়ে গল্পকারের সঙ্গে ১০/১২/ ২০১৫--১০/১৪/১৫ অন্তর্জালে কথা বলেছেন কুলদা রায়। 
মূল গল্পটির পড়ার লিঙ্ক--নিস্তার মোল্লার মহাভারত। 

১. কুলদা রায় : 
আপনার এই গল্পটি সারাদিন ধরে পড়েছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু একটু করে পড়েছি ট্যাব থেকে। মনে হয়েছিল বাসায় ফিরে পড়ব। শুধু একটু চোখ বুলিয়ে নেবো ভেবেছিলাম। কিন্তু গল্প আমাকে চুম্বকের মত টেনেছে। বাসায় যাওয়ার অপেক্ষা করতে দেয়নি।
এই গল্পটিতে একটি শব্দ আছে। 'আলোর ভাষা'। যারা আলোক বিজ্ঞান পড়েছেন তারা আলোর সূত্র জানেন। মানিকের পুতুল নাচের ইতিকথায় সূর্যবিজ্ঞানের কথা লেখা ছিল। কিন্তু সেটা বুড়ো যাদবের কবিরাজি মিথ মাত্র। আলোর ভাষা বলে কোনো শব্দ কথাসাহিত্যে এতো সতর্কভাবে ব্যবহার এর আগে কেউ করেছেন কিনা সন্দেহ আছে। গল্পটিতে একবার মাত্রই শব্দযুগল ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই ভাষাসূত্রের ব্যবহার করেছেন আখ্যানের মধ্যে।

এই শব্দটি কি করে আপনার মধ্যে এলো? কিভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন এই শব্দযুগলকে ব্যবহার করবেন?
গল্প লেখার আগে , না, লিখতে লিখতে শব্দটি আপনি সৃষ্টি করলেন?


১. দীপেন ভট্টাচার্য : 
সুপ্রিয় কুলদা, এই গল্পটি আপনার কারনেই সৃষ্ট যদিও বহুবছর ধরে আমার নিচের স্বপ্নটি মাথায় ভাসছিল - প্রটাগনিস্ট একটি ঘরে ঢুকে দেখল তাতে বান্ডিলের পর বান্ডিল কাগজ স্তূপীকৃত, একজন সাধক লিখে যাচ্ছেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হল আপনি এত বিশাল রচনা কী করে লিখলেন তিনি উত্তর দিলেন, আমি প্রথমে এক লাইন বাংলা লিকে তাকে ইংরেজী অনুবাদ করেছি সেটা দেখলাম দু লাইন হয়ে গেলাম, পুনরায় সেটা বাংলা করতে গিয়ে দেখে চার লাইন। এরকম অনুবাদ ও পুনর্নুবাদের অসীম সংখ্যক পদক্ষেপে এই সৃষ্টি।

কিন্তু গল্পটি লিখতে গিয়ে এই স্বপ্নের themeটা খুব একটা মূল্য পেল না কারণ গল্পের রেশের সঙ্গে সেটা অত প্রয়োজনীয় মনে হল না যদিও নিতান্তই এতদিনের একটা ideaর loyalty দেখাতে আমি একটা লাইন এই বিস্ময়কর ঘটনার জন্য রেখেছি।

যে মানুষটি এরকম সর্বোচ্চ সৃষ্টি করতে পারেন তাঁর কাছে মেয়েকে বাল্যবিবাহ দেবার আগ্রহ আশা করি নি। এই বোধটাকে কীভাবে প্রকাশ করব তার জন্যই আলোর ভাষা কথাটার ব্যবহার। নিস্তার ভাই আলোর ভাষাটা বুঝতে পেরেছিলেন, সূর্যের আলোর ব্যতিচারই তার মাঝে এরকম সৃজনশক্তি দিয়েছিল। তবে "আলোর ভাষা" কথাটা নিস্তার ভাইয়ের সাথে ঐ কথোপকথনের আগে মাথায় সচেতন্ভাবে আসে নি।

পুতুল নাচের ইতিকথার কথাটা স্মরণ করিয়ে দিলেন, ইন্টারেস্টিং যোগাযোগ।



২. কুলদা রায় : 
গল্পের শুরুতেই আপনি একটি প্রবেশক দিচ্ছেন। বলছেন--এটা গল্প। এটা আহামরি কোনো গল্প নয়। সহস্র পড়া-গল্পের মধ্যে একটি গল্প হবে মাত্র। মূল গল্প পাড়ার আগেই আপনি পাঠককে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইছেন। গল্প থেকে একটা দূরত্ব সৃষ্টি করে দিতে চাইছেন। এবং গল্পের মাঝে মাঝেই গল্প থেকে এরকম পাঠককে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন।
কিন্তু মজার কাণ্ড হল, গল্পের মধ্যে যতবারই আপনি সঞ্চালকের মত কথা বলে পাঠককে গল্প থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছেন--আখ্যানে কিন্তু ভীন্নঘটনাই ঘটছে। পাঠককে আখ্যানের মধ্যে প্রবেশ করা মাত্রই সম্মোহিত হয়ে যাচ্ছে। একাত্ম হয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্রেখটের অ্যাালিয়েনেশন তত্ত্বটি মনে পড়ে পড়ছে।
এটা করার পেছনে আপনার লজিকটি কি ছিল?

২. দীপেন ভট্টাচার্য : 
ব্রেখটের আলিয়েনেশনের আইডিয়াটা সচেতনভাবে আসে নি, তবে যা বলেছেন তার থেকে ভিন্ন নয়। বাস্তব সম্পর্কে পাঠকের বোধ কি লেখক শুধুমাত্র তার কথা দিয়ে বদলাতে পারবে? তার অস্তিত্ব, তার সময়ের প্রবাহ সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্থ করবে। আমি যদি শক্তিশালী লেখক হতাম তাহলে বোধহয় সেটা করা যেত। আমি মুরাকামির wind up bird chronicle পড়তে পড়তে সম্মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম, কয়েকদিন ধরে রাতে দুঃস্ব্প্ন দেখতাম।
মাউন্ট শাস্তা গল্পে আমি পাঠককে অন্তর্ভূক্ত করতে চেয়েছিলাম। একটা email addressও দিয়েছিলাম সেখানে যদি তার মনে হয় আমার গল্পটা আগে সে পড়েছে (অথবা তার সময় পেছন দিকে বইছে) সেটা আমাকে জানাতে। এখানেও আমি তাকে তার পৃথিবী সম্পর্কে একটা দ্বিধাই রাখতে চাই। জীবনে তার choiceগুলোর ওপর ভিত্তি করে তার জীবনের ধারা বদলেছে। এই গল্প পড়াটাও তার একটা choice। সেই choiceয়ের ওপর ভিত্তি করে তার জীবন বদলাতে পারে যেমন অমল, বিথী আর নিস্তারের জীবন বলেছিল বিথীকে বিয়ে দেবার choiceয়ের জন্য।



৩. কুলদা রায় 
এই গল্পটির মধ্য সূত্রকাল ১৯৭৩ সাল। মহামারী, বন্যা সবই হয়েছিল সেই বছর, নতুন দেশে ছিল এক ধরণের অস্থিরতা।
কিন্তু অস্থিরতার স্বরূপটি বলছেন না। শুধু বলছেন অস্থিরতাটি --পুরনো নয়। নতুন ধরনের। আপনি গল্পে বেশ কিছু অস্থিরতার কথাও বলেছেন। তবে সেগুলোর সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষ নানাভাবে পরিচিত। যেমন মন্বন্তর, মহামারি, ঝড়, বন্যা, দেশভাগ, দাঙ্গা ইত্যাদি।
কিন্তু ১৯৭৩ সালের মহামারির সঙ্গে যে অস্থিরতাটি দেখা দিয়েছিল সেটাকে আপনি নতুন ধরনের বলার কারণটি কি? এবং কারণটি কখনোই সরাসরি ব্যাখ্যা করেননি। করার দরকারও বোধ করেননি।

৩. দীপেন ভট্টাচার্য : 
গল্পের মাঝে সরাসরি রাজনীতি আমি আনতে চাই না। আর যদি সেটা আসে সেটা রূপক হিসেবে আসবে। ৭৩/৭৪ সালে কি ধরণের ব্যাপক সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল সেটা আমরা জানি তার পরিণতি হল মুজিবের হত্যাকাণ্ড দিয়ে। এই গল্পের পুরোই দিক ঘুরে গেল যেমন নুসরা বেগমের আবির্ভাবে তেমনই মুজিবের মৃত্যুতে। এই মৃত্যু অমলকে আর নিস্তারের বাসায় যেতে দিল না, তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। ৭১য়ের আগে ছিল দেশভাগ ও দাঙ্গা, ৭১য়ের পরে যে অস্থিরতা এল তাকে ঠিকমত প্রকাশ করার উপায় নেই, স্বাধীনতার ফসল হেলায় হারানো হল, তাই এখানেও তাকে শুধু বিমূর্তভাবে বলা হল। শুধুমাত্র নিস্তার মোল্লা দুএকবার বললেন তিনি ভবিষাৎ দেখেছেন এবং সেটি ভাল নয়।


৪. কুলদা রায় 
বিথী ১৬ বছরের কিশোরী। আর কথক অমল সবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছেন। অমলের বিথীদের বাড়িতে সহজ যাওয়া আসার সম্পর্ক ছিল। বাড়িতে সেভাবে রক্ষণশীল কেউ ছিল না। এক্ষেত্রে বিথীর সঙ্গে অমলের একটা প্রেম হতে পারত। তাদের মধ্যে সেরকম কিছু ঘটল না। কিছু শারীরিক সম্পর্ক দেখানো যেত।
সেটাও দেখা গেল না। অথচ আমাদের গল্পকারা এ ধরনের সুযোগকে হাতছাড়া করতেন ননা। প্রেম, বিদ্রোহ, ভ্রান্তি, বিচ্ছেদের হাহাকারকেই গল্পে মুখ্য করে তুলত। বাংলা সাহিত্যের এই প্রচলিত আখ্যান ধারার বাইরে আপনার পাত্র পাত্রীকে নিয়ে অন্য ধারার গল্প লিখলেন। এরকম কেন করলেন?


৪. দীপেন ভট্টাচার্য :
অমলের ঢাকায় স্বজন বলতে কেউ ছিল না, নিস্তার ভাইয়ের পরিবারকে সে নিজের পরিবার হিসেবে নিয়েছিল, এটা তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই যে সাম্যাবস্থা অর্থাৎ সে আকাশ ও বিথীর দাদা এটাকে সে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। গল্পকারেরও জন্য এটা প্রয়োজনীয় কারণ শেষাবধি দুটি পৃথিবী বা মহাবিশ্বের পার্থক্য বোঝাতে বিথীর সঙ্গে অমলের সম্পর্কটার বিবর্তনটা দেখানো দরকারী। এক পৃথিবীতে অমল বিথীর প্রিয় দাদা যার কাছে অনুযোগ করা যায়, অপর পৃথিবীতে সে শুধুই অমলদা যাকে বিথী চিনতো কোনো এককালে। এখানে বিথীর সঙ্গে প্রেম (বা শারীরিক সম্পর্ক) থাকলে স্বাভাবিক বিবর্তনেই অমলের সঙ্গে বিথীর বিচ্ছেদ হয়ে যেত, লেখক বিথী-অমলের সম্পর্কটা দুটো বাস্তবতার উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারতো না।

গল্পকার তার পৃথিবী যে অন্য পথে চলেছে সেটা পাঠককে নানান ঘটনার মধ্যে দিয়ে বোঝাতে চাইছে, খনার বচন বদলে গেছে, গোপালদেবের কাহিনী বদলেছে, বিথীর আচরণ বদলেছে, তাকে বিথী নামে নতুন জায়গায় কেউ চেনে না। কেন বদলেছে? নিস্তার ভাই অমলকে ভবিষ্যতের কথা বলতে গেছে তখনই মহাবিশ্ব তাতে হস্তক্ষেপ করেছে, এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করেছে যেখানে অমল ভবিষৎ জানবে না। কিন্তু এই হস্তক্ষেপের একটা পরিণাম হল নিস্তার ভাইয়ের পরিবার থেকে অমলের বিসর্জন, বিথীর ভালবাসা থেকে বিযুক্তি।

কিন্তু আসলেই কি তাই? হয়তো পৃথিবী বদলায় নি। হয়তো কেশব ব্যানার্জির খনার বচন সঠিকভাবে মনে নেই, গোপালদেবের কাহিনীও ঠিক মনে নেই, নিস্তার ভাইয়ের মহাকাব্যের মাত্র কয়েকটি পাতা সে পড়েছে। বিথীর কথাই ঠিক, নিস্তার ভাই আসলে কিছুই লেখেন নি। হয়তো এতদিন পরে বড় দাদা হিসেবে বিথীর ভালবাসা না পেয়ে অমল নিজেকে বাঁচানোর জন্য এই দ্বিতীয় পৃথিবীর কথা বলছে। মনে করছে অন্য পৃথিবীতে সে নিস্তার ভাইয়ের পরিবারের একজন হয়ে রয়ে গেছে। সেই পৃথিবী আলোময় হয়ে আছে।

এই দুটি সম্ভাবনাই সত্য।


৫. কুলদা রায় :
আপনার গল্পে ভ্রমণ থাকে। সেটা নানা অর্থেই থাকে। স্বদেশ প্রবাস উভয়ই থাকে। আবার ট্রানসিটও ব্যবহার করতে তে দেখা যায় চরিত্রদেরকে।
এ গল্পে বিমান ভ্রমণ নেই। তবে স্থান, কালের ভ্রমণ রয়েছে। ঐতিহাসিক চরিত্র রাজা গোপালের কাল, দেশভাগের কাল, মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে গণহত্যার কাল, মুক্তিযুদ্ধোত্তর কাল, পচাত্তরের সামরিক ক্যু দেতার কাল, ভবিষ্যৎ কালেও ভ্রমণ করানোর চেষ্টা করেছেন।
সব কালের মধ্যেই অন্ধকার চিত্রটা দেখাচ্ছেন।
এ বিষয়ে আপনার কথা শুনতে চাইছি।


৫. দীপেন ভট্টাচার্য : 
ইতিহাসের মূল্য কী? আমরা যাকে ইতিহাস বলি, যে মানুষদের দিয়ে ইতিহাস তৈরি তারা চলে গেছে, আমরা তাদের ভাল মন্দ যাই বলি তাদের কিছু আসবে যাবে না, কারণ তাদের তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আমাদের "বর্তমান" মনে আমরা সৃষ্টি করতে চাই একটা রশি যা কিনা আমাদেরকে আমাদের পূর্বপুরুষের সাথে যুক্ত করবে, আমাদের জন্মভূমির সাথে যুক্ত করবে, ইত্যাদি। এটা এক ধরণের বাঁচার উপায় যদিও শেষাবধি মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে এর মূল্য খুবই কম। সেইখানে প্রকৃতির মাঝে একক মানুষের যে অস্তিত্ব সেই অস্তিত্বের যে angst, এক ধরনের অর্থহীনতা সেটা মননশীল মানুষকে পীড়া দিতে বাধ্য। তাই আমার শত চেষ্টা সত্ত্বেও আমার গল্পে এক ধরণের অন্ধকার বিরাজ করে। এই অন্ধকার দুঃখ-দারিদ্রের বা সামাজিক কর্মকাণ্ডের নয়, এটা একটা সার্বিক অস্তিত্বের। এক অর্থে এটা আমার একটা সীমাবদ্ধতা।


৬. কুলদা রায় : 
আপনার এই গল্পটির মধ্যে আখ্যানের প্রচলিত প্রথায় শুধু ঘটনা থাকে না। একটা আখ্যান সিরিজ আছে। আছে ইতিহাস, পরম্পরা, ঐতিহ্য, চরিত্রের মনস্তত্ত্ব, সামাজিক প্রথার উত্তরাধিকার, সমাজের ধারাবাহিক রূপান্তরের শর্ত ও বিবরণ, বিজ্ঞান ( এ গল্পে বিশেষ করে আলোক বিজ্ঞান), কল্পনা, দর্শন এবং আরও অনেক কিছু। এইরকম বহু বিষয়কে বয়ানের একটি সুতোর মধ্যে গেঁথেছেন যাকে বলা যায় বহুস্বর বা পলিফোনিক। আপনার গল্পটি কোনো অর্থেই আর সাধারণ ন্যারেটিভ থাকে না--হয়ে ওঠে গ্রান্ড ন্যারেটিভ। পড়তে শুরু করলেই একটি বিস্তৃত পরিসর বা জগতের মধ্যে ঢুকে পড়তে হয়। এর আলো হাওয়া, অন্ধকার, ঘ্রাণ অঘ্রাণ, জল ও অজল, প্রাণ ও জরার মধ্যে গতিচক্রের বিপুল প্রবাহের অন্তর্গত হয়ে উঠতে হয়। নানাবিধ সৌকর্য থাকে, বিন্দু থেকে সিন্ধু দর্শন করানোই আপনার অন্বিষ্ট হয়ে ওঠে।
আমরা কিন্তু এ সময়ের লেখালেখিতে তেমন করে দেখতে পাই না। কিন্তু আপনার গল্পের মধ্যে দিয়ে এই ঘোরলাগা জীবন ও জগতের বয়ানপর্ব পেয়ে যাই। অর্থাৎ বিনাশের কালের মধ্যে দিয়ে এক ধরনের দার্শনিকতায়ও পৌঁছে দিচ্ছেন।
এ দিক থেকে আমাদের সর্বশেষ লেখক ছিলেন, বলতেই হচ্ছে--ছিলেন শব্দটি, শহীদুল জহির।
এই বড় পরিসরের গল্প আঙ্গিকের উত্তরাধিকারী হলেন কিভাবে?

৬. দীপেন ভট্টাচার্য : 
অনেক ধন্যবাদ, আপনি এরকম মনে করেন বলে। আপনার মূলায়ণকে আমি বিশেষ মূল্য দিই। আপনি যেভাবে আমার লেখাকে বর্ণনা করেছেন তা আমাকেও নতুনভাবে লেখার সাথে পরিচয় করাচ্ছে, কারণ লেখার মধ্যে থেকে তার মূল্যায়ণ ও পরিসর যাচাই করা স্ম্ভব নয়।

আমি বিজ্ঞানের ছাত্র, নিজের জন্য একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাই যা কিনা সম্ভব-অসম্ভবের সমচ্ছেদে বিরাজ করবে। কিন্তু যেহেতু প্রকৃতির চিত্রটি আমাদের মস্তিষ্কের মধ্য দিয়ে একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উপস্থাপিত হচ্ছে সেজন্য আমরা - মানুষেরা - সেই পরিস্থিতিতে কীভাবে আচরণ করবে সেটা দেখতে আমি আগ্রহী। যেহেতু মানুষ নানাবিধ সঙ্কেতের (পারিপার্শ্বিক জগতের input - ভাষা, সংস্কৃতি, পরিবার, কাজ ইত্যাদি) মধ্যে দিয়ে চলে সেই সঙ্কেতগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করি। এজন্য কিছুটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বৃহত্তর জগতটা চলে আসে, যে কোনো মানুষের জীবনই যে ক্ষুদ্র নয়, প্রকৃতির প্রতিটি অংশের সঙ্গে সে সবসময় মিথষ্ক্রিয়ায় নিমজ্জিত, সেইজন্য একটা বিশাল পরিসর চলে আসে, তার মধ্যে ইতিহাস, সমাজ, দর্শন থাকবে। পাঠককেও এর মধ্যে সচেতনভাবে অংশ নেবেন। অন্যদিকে এই গল্পটিতে বাংলার ইতিহাস ও সমাজের যে চিত্র সেটা আমার খুবই ব্যক্তিগত অনুরাগ, ভালবাসা ও অভিজ্ঞতার নিরিখে লেখা। অনেক পাঠকই, আমার বিশ্বাস, এর সাথে একাত্মতা বোধ করবেন।

উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি খুব কঠিন। আমি তো কখনই এরকম ভাবি নি। আমার সাহিত্য সচেতনতা খুব বেশী আছে তাও বলব না, আমি যেন সেই গণ্ডীর আশেপাশে ঘুরি, ভেতরে প্রবেশ করা আমার জন্য দুঃসাহসের কাজ হবে।

গল্প নিজের জন্য সৃষ্টি করা, তার মধ্যে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে আমার আনন্দ, পাঠকদের জন্যেও সেটা মাঝে মাঝে যদি চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসে তাহলে আমি খুব খুশি। আমি রৈখিক কোনো প্লট লাইন এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি, এতে লেখক পাঠক দুজনেই সন্তুষ্ট হবেন না। পাঠককে সর্বক্ষণ নতুন অবস্থায় নিয়ে যাবার জন্য লেখককে কাঠখড় পোড়াতে হবে, ভাবতে হবে, নাহলে গল্পটির কোনো মূল্যই থাকবে না। লেখক যদি নতুন কিছু না দিতে পারেন তাহলে সেই গল্প না লেখাই ভাল।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমার গল্পগুলিকে মূল্যায়ণ করার জন্য।


৭. কুলদা রায় : 
এই গল্পের চরিত্রগুলো মৃদু মানুষ। নিস্তার মোল্লা, তার ছেলে আকাশ, মেয়ে বিথী অথবা অমল--তারা শান্ত, কোমল। তারা চড়া সুরে কথা বলে না। আর অমল তো ঘোর লাগা। রহস্য খুঁজতে কোমল জলের মত চলে। এ কারণে কারো সঙ্গে তার সম্পর্ক জটিল হয় না। নিরবে সরে যায়। কিন্তু কিছু ভোলে না। ইতিহাস ঐতিহ্যে চোখ মেলে। আবার হাত পা গুটিয়েও বসে থাকে না। উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যায়। আরেকটা দেশে থিতু হয়। মোটেই বৈষয়িকভাবে মলিন নয়। অথচ নিজেকে প্রজেক্ট করারও কিছু নেই।
বহুদিন পরে বিথীর সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কন্তু আবেগ প্রকাশ করছেন না। নিরাবেগে বিথীর তথ্য দিচ্ছেন। নিস্তার সাহেবের গল্প বলছেন। যেন গল্প বলাটাই তার কাজ।
আবার বিথীর চরিত্রও এরকম নিরিবিলি। মোটেই রক্ষণশীল নয়। বাইরের লোকের সামনেও অসংকোচে কথা বলে। কিন্তু পরিবারের গণ্ডীর বাইরে যায় না।
অল্প বয়সের বিয়েটাকে মেনে নেয়। কিন্তু বাবার যত্নের জন্যে সে বাড়ি ছেড়েও চলে আসে। লেখাপড়া করে। বিয়েও করে। কমিউনিটিতেও পিছিনে নেই। আবার অমল যে কিশোরীবেলার দাদা তাকে নিয়ে বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই। এক ধরনের পারিবারিক পর্দাপ্রথা মেনে চলার মত ব্যাপার।
আর বিথীর নামে--তিনি অমলকে দাওয়াত দিচ্ছেন। এইটুকু। কিন্তু তিনি গল্পের অংশ নিচ্ছেন না। তিনি যেন নিয়তির হয়ে অমলকে শুধু দাওয়াত দেওয়ার জন্যই এসেছেন। আর কিছু নয়।
বিথীর ভাইটি আকাশ, চুপচাপ। একটু রাগ আছে। কিন্তু সেটাও শান্ত রাগ। ঘর ছেড়ে বন্ধুর বাড়ি চলে গেছে, সেখান বিদেশে। এই রাগ-বিরাগের জন্য কোনো ফেটে পড়া নেই।
শুধু ফুফুর মধ্যে একটু কর্তৃত্ত্বপরায়ণতা আছে। তিনি সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন হুট করে এসে। সেটা নিয়ে কারো মতামতের তোয়াক্কা করছেন না। তবে হৈচৈও করছেন না। শুধু অমলের কানে পৌছে দিচ্ছেন--তার সঙ্গে বিথীর একটা প্রেমের সন্দেহ তিনি করছেন। তবে সেটা জোরালোও মনে হয় না। মনে হয় বিয়েতে যেন বিথী কোনো সহজে রাজী হয়ে যায় সেজন্যই তার এই কৌশল। তবে তিনি শুধু এইটুকু করেছেন। মা মরা মেয়েটিকে পাত্রস্থ করার জন্য এইটুকু কৌশলকে অপরাধ মনে হয় না। তিনিও শান্ত। শান্তভাবেই আপনি নির্মাণ করেছেন সবাইকে।
নিস্তার সাহেবের মধ্যেও সেই শান্ত স্বভাব। ঘোরলাগা হলেও তার মধ্যে অমলের মত মরিয়া ভাবটি নেই।
এ ধরনের মৃদু মানুষের উপাখ্যান বলছেন আপনি। কারো মধ্যেই মেলোড্রামা করার প্রবণতা দেখা যায় না। এ ধরনের চরিত্র নিয়ে কাহিনীকে আকর্ষণীয় করা কঠিন। বাঁক বদলকরা জটিল। কিন্তু আপনি যেন সেই সি-টিম নিয়েই বিশ্বকাপ জয় করার মত অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছেন। পাঠককে বাধ্য করছেন এই সব মৃদু মানুষের প্রতি ঈশ্বরের মত সম্ভ্রম দেখাতে। এটা আপনার গল্পের অন্যতম প্রধান শক্তি।
এটা কি করে সম্ভব করলেন?

৭. দীপেন ভট্টাচার্য : 
আপনার চরিত্রের ব্যাপারে উত্তরটা আমি ঠিক দিতে পারব না, কারণ জ্ঞানতঃ আমি সেটা করি নি। অমলের চরিত্রটি প্রথম এসেছিল একজন সাক্ষী হিসেবে, সে নিস্তার মোল্লার সৃষ্টি অর্থাৎ মহাভারত লেখার ব্যাপারটা প্রত্যক্ষ করবে, তাই তার চরিত্র পুরো গল্প জুড়ে সেরকমই রয়ে গেছে, তাকে বিশেষায়িত করা হয় নি। বলতে গেলে সবাই নিস্তার মোল্লার সৃজনের সাক্ষী, তাদেরকে খুব low-key রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র ফুফুর জন্য একটা বাক্য রাখা আছে যে সে অমলকে অপছন্দের দৃষ্টিতে দেখেছে, কারণ ফুফু হল the instrument of change। যদিও গল্পে তার আবির্ভাব মাত্র দু তিনটে লাইনে, কিন্তু সেই পৃথিবীকে দুভাগ করে দিয়েছে।

লেখার সময়টা নিয়ে পরে লিখছি। এই নিচের প্যারাটা লিখতে আমার দু-তিন ঘন্টা সময় লেগেছে, চক্রপাণি দত্ত সম্পর্কে জানতে ...
"পৃষ্ঠা ৬,৪৪৪ আপাতঃদৃষ্টিতে মানুষের দেহকে খুবই দুর্বল মনে হলেও তার দেহের গঠন কাশগাছের মতই নমনীয় আবার লোহার মত কঠিন। আমি একটি বিশেষ ধরণের কন্টকারীর পাতা খুঁজছি বহুদিন ধরে,' চক্রপাণি ভূর্যপত্রে একটি মসীমাখা বেতের কলমে লিখলেন, 'আমার নিশ্চিত বিশ্বাস বেদনার উপশমে কন্টকারী কার্যকরী হবে।' এই সময়ে বদ্ধ দরজার বাইরে একজন চিৎকার করে উঠল, 'আচার্য চক্রপাণি দত্তকে রাজসভায় তলব, মহারাজ নয়পালের সমূহ প্রয়োজন।' চক্রপাণি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, চিকিৎসাসংগ্রহ বইটি তাঁর জীবদ্দশায় আর শেষ হবে না। ..... "


৮. কুলদা রায়
রাজনীতিকে আপনি সরাপরি আনতে চাননি এটা সত্যি। কোনো গল্পেই সে-রকম করে আনেন না আপনি। কমিটেড গল্পকারের মত সস্তা হতে চান না। ধ্রুপদী ন্যারেটরের মত নিরপেক্ষ থাকতে চান। যেরকম করে মহাভারতের কুরুপাণ্ডব যুদ্ধের বর্ণনাকারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে সঞ্জয় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের দাবী করেছিলেন, তিনি অন্ধ মহারাজের কাছে যুদ্ধের বর্ণনা দেবেন, কিন্তু নিজে যুদ্ধের অংশ হবেন না। যুদ্ধে দুপক্ষের কোনটিতেই পক্ষ নেবেন না। কোনো প্রভাব বিস্তারকারী মন্তব্য করবেন না। জার্নালিস্টিক বিবরণীদাতার ভূমিকা পালন করবেন মাত্র। যুদ্ধের ভেতর-বাইরেটা তুলে ধরবেন --যা শুনে অন্ধ মহারাজ স্বচক্ষেই যেন যুদ্ধটা দেখার মত করে দেখতে পান। নিজেই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

আপনি যেভাবে গল্পটি বলেছেন, গল্পটিতে দেশভাগ, দাঙ্গা, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালের অস্তিরতার কথা বলেছেন, শেখ মুজিব হত্যার কথাটি বলেছেন--তাতে কিন্তু গল্পটিরর অন্যসব উপাদানের মধ্যে থেকে রাজনীতিটাই মূখ্য হয়ে উঠেছে। আপনি যেন নানা কথার মধ্যে দিয়ে, ফুটবল খেলার স্ট্রাইকারের মত ছল-চাতুরির মধ্যে দিয়ে ভাষার বল নিয়ে পাঠককে এই বিয়োগান্তক হত্যাকাণ্ডটিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই, গোলমুখে তীব্র সুনিশ্চিত শট করছেন মাত্র। এই ঘটনাটিকে যাতে কেউ ভুল করেও যেন রাজনীতি মনে না করে সেজন্য আপনি শেখ মুজিবের বহুবিখ্যাত উপাধীটি পর্যন্ত উল্লেখ করছেন না, শেখ মুজিব যে কে ছিলেন সেটাও বলার দরকার মনে করছেন না। এক ধরনের গুপ্ত কথার মত করে এই রাজনৈতিক গুপ্তহত্যার বিবরণীটিতে পাঠককে হাজির করে দিচ্ছেন।

সে কারণে গল্পটিকে আমার কাছে রাজনৈতিকই মনে হয়েছে।

আবার আপনি ইতিহাসকেও মূল্যবান করতে চান না। কারণ আপনি তো ইতিহাস লিখছেন না। আপনি সাহিত্য লিখছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক তথ্যের মধ্যে দিয়ে গল্পটিকে ইতিহাসই করে তুলছেন। সেক্ষেত্রে যেন মনে হয়, আমাদের সুপ্রাচীনকালের ইতিহাসের মধ্যে যেমন করে আমাদের পূর্বসূরীরা ইতিহাসের নিয়ামক হতে পারেন নি, গ্রীক ট্রাজেডির মত নিয়তির শিকার হয়েছেন মাত্র, জয়ী হওয়ার বাসনা নিয়ে এই নিয়তিকে আমরা মেনে নিয়েও মুক্তিযুদ্ধের মত করে বিজয়ী হওয়ার বাসনা করেছি মাত্র--কিন্তু ইতিহাসে সে বাসনা পুরনের কোনো নেই, ফলে মুক্তিযুদ্ধের পরে আবার অস্থিরকালটিতে আমাদের পড়তে হয়েছে। আমাদেরকে পঁচাত্তরের শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে সে বাসনার মূলে যে কুঠারাঘাত করা হল, তাকে মেনেও নিয়েছি বিথীর হুট করে বিয়ের মেনে নেওয়ার মত করে, তাতে মনে হয়, এই গল্পটি রাজনীতির উর্দ্ধে উঠে ইতিহাসের নিয়তিকেই ধারণ করেছে। কারণ রাজনীতি নিয়ামক শক্তি আছে। ইতিহাসের সে শক্তি নেই।
আবার গল্পটি যেভাবে শুরু হয়েছিল, একটি টেলিভিশনের সন্ধান করতে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে একটি অতিপ্রাকৃতিক রহস্যের অনুসন্ধানে যাত্রা মনে হয়েছিল। তবে সেটা রহস্য উদ্ধারের থেকে তার মধ্যে আলোক বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের অবতারণা দেখতে পাওয়া। বিজ্ঞানের photo interference বা আলোর বিচ্যুতির মত বৈজ্ঞানিক পরিভাষাটিও ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে গল্পটিকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী করার একটা প্রচেষ্টাও ছিল।

কিন্তু তার চেয়েও যখন জর্জ হোর্হে লুইসের লাইনটির উল্লেখ করা হয়, গল্পটির পরিণতির মধ্যে দিয়ে এই সব ঘটনার বাইরে অন্য এক পরাভাবনায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, টেনে দেওয়া হয়-- পাঠককে ফেরত নেওয়া হয় তার নিজের জগতে, তখন মনে হয় গল্পটি ব্যক্তি-নৈর্ব্যক্তির উর্ধে উঠে দার্শনিকতায় পৌঁছে গেছে। সেটাই হয়তো আপনার গোপন ফাঁদ। পাঠক সে ফাঁদে পড়ে যান।

এ বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা জানতে ইচ্ছে করছে।

৮. দীপেন ভট্টাচার্য :
হা, হা, আপনি আসলে আমার থেকে এই জিনিসটা অনেক ভালভাবে ব্যাখা করেছেন , লেখক তার অবচেতন মনে কী করে সে নিজেই জানে না। আমার 'দিতার ঘড়ি' ছিল ১৯৭১য়ের ওপর রূপক যদিও তাতে স্থান, কাল, দেশ সবকিছুই কল্পিত। সেখানে আপনি ওপরে যা যা বললেন তাই বর্ণিত হয়েছে, এমনকি ৭১য়ের পরবর্তীকালের ঘটনাও। যদিও অনেকে সেটা বুঝতে পারেন নি কারণ কাহিনীতে বাংলাদেশ বা ৭১ কথাটা কোথাও ছিল না।
দিতার ঘড়ির যান্ত্রিকেরা এই গল্পেও হয়তো উপস্থিত, আয়নার প্রকৌশলে তাদের হাত আছে। তারাই বাংলার ইতিহাস সৃষ্টি করছে, ভবিষ্যদবাণী করছে।
৬৪র দাঙ্গা, ৬৯, ৭১, ৭৫ বা অন্য যেকোনো রাজনৈতিক উথ্বান পতন আমাদের জীবনকে তছনছ করেছে, যাই লেখা হোক না, লেখকের মননে তার ছাপ থাকবেই। আমরা যাই করি না কেন প্রেক্ষাপটে সামাজিক রাজনৈতিক দাবানল জ্বলবেই। পাঠককে সেই দাবানলকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে, দূর থেকে, কোনো ছন্দপতন ছাড়া। এই গল্পে সময়ের স্রোতে গোপালদেব, শেখ মুজিব, তাজুদ্দিন ভেসে যাচ্ছে একটা বিশেষ স্থান-কালের কাঠামোয়, অন্য পৃথিবীতে হয়তো শেখ মুজিব বেঁচেছে, কিন্তু সেটা ছাপার অক্ষরে লিখলে পাঠকের ধ্যানভঙ্গ হত, এই গল্পের ছন্দ পতন হত।
গল্প তার উদ্দেশ্য প্রাপ্তি করেছে কিনা সেটা পাঠক জানবে, লেখক সেটা বুঝতে পারবে না। লেখকের একটা অতৃপ্তি সবসময় থাকবে, তার শিল্প সীমানা ছাড়িয়ে পাঠককে স্পর্শ করতে পারলে তার আনন্দ, কিন্তু লেখক যেভাবে তার মহাবিশ্ব কল্পনা করবে সেটা সে (লেখক) কখনই পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারবে না। তাই কিছু অতৃপ্তি থাকবে।


৯. কুলদা রায় : 
গল্পটি নির্মাণের গল্পটি বলুন। 

৯. দীপেন ভট্টাচার্য : 
জোর করে আমি কোনো কাহিনী বানাতে পারি না। একটা আইডিয়া বীজের আকারে মনে আসতে হবে। সেটা কীভাবে আসে বলতে পারব না। বহু বছর ধরে আমার মাথায় এই দৃশ্যটা ছিল, আমি একটা ঘরে ঢুকে দেখছি একজন বৃদ্ধ মনীষী লিখে চলেছেন, সামনে তার দিস্তা দিস্তা কাগজ, ঘর উপচে পড়ছে পাণ্ডুলিপিতে। তিনি আমাকে বললেন তাঁর লেখা শুরু হয়েছিল একটি লাইন দিয়ে, সেই লাইনটি তিনি একটি বিদেশী ভাষায় রূপান্তর করতে গিয়ে দেখলেন সেটা দুটো বাক্য হয়ে গেছে, মনে হল নতুন কোনো উপাদান যুক্ত হয়েছে, তখন তিনি আবার সেটা নিজের ভাষায় তরজমা করলেন। সেটা করতে গিয়ে দেখলেন চারটা বাক্য হয়েছে, সেটা আবার বিদেশী ভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে ছটা বা আটটা বাক্য ইত্যাদি। মোট কথা এরকম অনুবাদ, পুনঃ অনুবাদের পাল্লায় পড়ে এক মহাকাব্য রচিত হয়েছে, তাও আবার একই সময়ে দুই ভাষায়।

যাইহোক বন্ধুবর কুলদা রায় যখন বললেন একটা গল্প কার্তিক সংখ্যায় দিতে হবে তখন মনের কোনো এক কুঠুরী থেকে ওপরের আইডিয়াটা বের করলাম। মনে হল এই মনীষীকে পুরোনো ঢাকায় অবস্থান করালে ভাল হয়। কিন্তু এর চেয়ে বেশী কিছু মাথায় এল না। সেখানে তাকে আমরা আবিষ্কার করব অমলের মাধ্যমে, তারপর কিছু একটা হবে, হয়তো শেষাবধি এমন কিছু হবে যাতে মনে আসলে কোনো মহাকাব্য রচিত হয় নি। এটুকু নিয়ে দু-তিন দিন ধরে চিন্তা করলাম কম্পিউটারে কোনো অক্ষর টাইপ করার আগে।

ভাবলাম বাংলাবাজার, ফরাসগঞ্জ এলাকার প্রাচীনত্বের মাঝে এরকম একটি বিশাল রহস্যময় জিনিস রচিত হতে পারে। এইসব এলাকা আমার পরিচিত, তবুও Google Earth থেকে ঢাকার ছবি ও মানচিত্র ঘেঁটে শেষ পর্যন্ত কেশব ব্যানার্জি রোডে তাঁর অবস্থান ঠিক করলাম। অমলের বাসা হল তাঁতিবাজার। তাঁতিবাজার থেকে আমাদের প্রটাগনিস্ট অমল যখন সেই বাড়িতে টেলিভিশন কেনার জন্য যাচ্ছিল তখন সে কিশোরীলাল জুবিলী স্কুলে আটকে গেল (আমি ক্লাস ফোরে এক বছরের জন্য জুবিলী স্কুলে পড়েছি)। সেখানে নানাবিধ অতীত স্মৃতিচারণের সময় তার একটা বোধদয় হল যে প্রতিটি মানুষ পৃথিবীকে ভিন্নভাবে দেখে, আর নিজেকে সে ভাবল জগৎ সংসারের বাইরের এক পর্যবেক্ষক।

অমলকে যে আমি টেলিভিশন কেনার ছুতায় নিস্তার মোল্লার ওখানে পাঠাচ্ছি সেটা একদম প্রথমে "রঙ্গীন টেলিভিশনে ঝলকে ওঠে উত্তর মেরুর শুভ্র তুষার" লাইনটা লেখার আগে মাথায় আসে নি। এবার অমল এল নিস্তার মোল্লার বাড়িতে, কিন্তু সরাসরি তাঁকে দৃশ্যে নিয়ে আসা যাবে না, সেটা করা হল তাঁর ছেলে আকাশকে দিয়ে। অমলকে দিয়ে নিস্তারের বাড়ির কড়া নাড়ানোর পরই আকাশের চরিত্রটি আমার মাথায় আসে, আগে নয়। আমি অমল হয়ে একজনের বাড়িতে কড়া নাড়লে কি হতে পারে সেটা ভাবি, বাড়িতে তরুণ কেউ থাকলে তার দরজা খোলার সম্ভাবনা বেশী।

অমল যে নিস্তার মোল্লার টেলিভিশন ঠিক করে দিতে পারবে সেটা আমিও বুঝতে পারি নি। সেই অর্থে আমি লেখক যেন একই সাথে পাঠক, ঘটনার গতিস্রোত যেন পূর্বনির্ধারিত, আমি যখন কম্পিউটারের স্ক্রিনে টাইপ-করা কালো অক্ষরগুলো দেখছি তারাই যেন আমাকে বলে দিচ্ছে এর পরে কাহিনীর নদী কোনদিকে মোড় নেবে।

আকাশকে সৃষ্টি করার সাথে সাথে নিস্তার মোল্লা এক বৃদ্ধ মনীষী থেকে খুব সাধারণ মাঝবয়সী পারিবারিক মানুষ হয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁর একটা রহস্য আছে। প্রথমে আমি রহস্যটা উন্মোচন করেছিলাম নিস্তার মোল্লাকে দিয়ে সরাসরি। অমল পরিবারের আস্থাভাজন হবার পরে নিস্তার তাকে ডেকে নিয়ে গেল সেই ঘরে যেখানে পাণ্ডুলিপির স্তম্ভ সাজানো। ঘরটাকে রহস্যময় করার জন্য আয়নার অবতারণা, আয়নার ব্যাপারে বোর্হেসের উক্তিটি এখানে আমি না দিয়ে পারলাম না কারণ বহুবছর আগে Tlon, Uqbar, Orbis Tertius পড়তে গিয়ে নিচের প্যারাটি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল -

Down at the far end of the hallway, the mirror hovered, shadowing us. We discovered (very late at night such discovery is inevitable) that there is something monstrous about mirrors. That is when Bioy remembered a saying y one of the heresiarchs of Uqbar: Mirror and copulation are abominable, for they multiply the number of mankind.

কিন্তু শুধু আয়না দিলে হবে না, সেই আয়নাকে ব্যবহার করতে হবে।

সূর্যালোক দিয়ে যে আয়নার প্রতিফলন ও পুনঃ প্রতিফলনে এক ধরণের interference বা ব্যতিচার দিয়ে হয়তো আয়নার মধ্যে অতীত কাহিনীকে গাঁথা হয়েছিল, আবার সূর্যালোক দিয়েই সেই কাহিনী মূর্ত হয়ে উঠেছে এরকম আইডিয়াটায় আসতে আমার একটু সময় লেগেছে। এর জন্য নিস্তারকে ছাদে কয়েকটা আয়না বসাতে হয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম সে কোনো মিস্ত্রী ডেকে এই কাজটা করাবে, কিন্তু সূর্যের আকাশে চলনের সাথে সাথে ঐ আয়নাগুলোর দিক পাল্টাতে হবে, এর জন্য বিশেষ মোটর তৈরি করতে হবে। সেটা ১৯৭৩র পুরোনো ঢাকায় সহজে সম্ভব ছিল না। তাই নিস্তার এক ধরণের দড়ি সিস্টেমের মাধ্যমে তার আয়নাগুলো চালাতো।

পুরাতন আয়না দিয়ে এরকম একটা কারিগরী ব্যাপার কি করা সম্ভব? জিনিসটা একটু অস্পষ্ট থেকে গেল। আমার 'দিতার ঘড়ি' উপন্যাসে আমি 'সমতলভূমিতে' কয়েক শত বছর আগে 'যান্ত্রিক' নামে একটি দার্শনিক-বিজ্ঞানী-প্রকৌশলী সমাজের কথা বলেছিলাম যারা শুধু উন্নত যন্ত্রই বানাত না, ভবিষ্যৎ দ্রষ্টাও ছিল। এই 'যান্ত্রিকেরা' যে আয়না দিয়ে পুরাতন বা ভবিষ্যৎ সময়কে সৃষ্টি করতে পারে সেটা আমার মনে ছিল, কিন্তু এই যান্ত্রিকদের এই লেখায় নিয়ে এলাম না, কারণ 'দিতার ঘড়ির' বাইরে আপাততঃ তাদের স্থান নেই।

যাইহোক নিস্তার যখন অমলকে পাণ্ডুলিপির ঘরটা দেখালো এটুকু লেখার পরে মনে হল ঐ পাণ্ডুলিপির ঘরে অমলের প্রবেশটা এত সোজাসুজি হওয়া চলবে না। এই জন্য গোপালদেবের কাহিনীর অবতারণা। অমল এই কাহিনী হঠাৎ করে আবিষ্কার করে এবং নিস্তার তার পাণ্ডুলিপির ঘর দেখাতে বাধ্য হয়। সপ্তম শতকে বাংলার রাজা ছিলেন গোপালদেব, কিন্তু এখানে নদীতে ভেলার কাহিনীটি পুরোই কাল্পনিক, তবে গোপালের কাহিনীর ভাবটি আনতে আমাকে নীহাররঞ্জন রায়ের 'বাঙালীর ইতিহাস' বইটি ঘাঁটতে হয়েছে। পরবর্তীকালে ১৪ শতকের সুলতান রুকনুদ্দিন বারবক শাহ ও তার চিকিৎসক অনন্ত সেনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটার সূত্র রমেশচন্দ্র মজুমদারের 'বাংলাদেশের ইতিহাস'। নীহাররঞ্জন রায়ের বইটিতেই চিকিৎসক চক্রপাণি দত্তর ক্থা পাই। কিন্তু তিনি কী ধরণের ঔষধের ব্যবহার করবেন সেটা খুঁজতে গিয়ে Google Booksয়ে পেলাম শ্রী বিরজাচরণ গুপ্ত কবিভূষণের ১৯০৮ সনের বই বনৌষধিদর্পন যাকে ইংরেজীতে বলা হচ্ছে The Ayurvedic Materia Medica। সেখানেই আমি চক্রপাণি দত্তর কন্টকারী বা Nightshade গাছের পাতার ব্যবহারের কথা পাই। চক্রপাণি দশম শতকে রাজা নয়পালের সমসাময়িক ছিলেন।

এই ঐতিহাসিক কাহিনীগুলির সত্যের কাছাকাছি হওয়া দরকার ছিল, নাহলে এই কাহিনীর গাঁথনী আলগা হয়ে যেত।

এবার খনার বচনটি নিয়ে বলি। ইন্টারনেটে দেখলাম অনেক খনার বচন আছে, কিন্তু একই বচনের মধ্যে আবার কিছু ঊনিশ-বিশ আছে। এই যে ঊনিশ-বিশ দেখলাম এটা আমাকে এই গল্পটিতে দুটি পৃথিবী বা বাস্তবতার অবতারণা করতে সাহায্য করেছে। গল্পের শুরুতে যখন খনার বচনটি দিই তখনও আমি জানতাম না গল্পের শেষে আমি এটা আবার ব্যবহার করব, গোপালের কাহিনীর বেলাও একই ঘটনা।

অমল নিস্তারের পরিবারের একজন হল, কিন্তু কীভাবে সে এই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে সেজন্য একটু ভাবনা চিন্তা করতে হল। বিথীর বিয়ে দেবার জন্য নিস্তারের বোন নুসরার আগমন হল, অমলের এই বিয়েতে মত ছিল না। নুসরার আগমনকে পরবর্তীকালে অমল একটা মহাজাগতিক প্রেক্ষাপটে ভাবার চেষ্টা করল, নিস্তার তাকে যাতে ভবিষ্যতের কথা না বলতে পারে সে জন্যই যেন নুসরার আগমন। এখানে ভবিষ্যতের কথাটা কী? হয়তো শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড। দেশের উত্তাল পরিস্থিতির সঙ্গে একটা বৈজ্ঞানিক দর্শন যে মহাবিশ্ব আমাদেরকে ভবিষ্যৎ দেখার সমস্ত পথ বন্ধ করে রেখেছে এই যোগাযোগটা আমি নুসরা বেগমকে দৃশ্যপটে নিয়ে আসার পরই কল্পনা করেছি আগে নয়। নুসরা হল আমার instrument of change।

এর পরের অংশটা লেখা কঠিন ছিল না। একটা কথা আমাকে মনে রাখতে হয় যে আমি গল্পের শুরুতে যে সব জিনিসের কথা উল্লেখ করেছি সেগুলোকে আবার নিয়ে আসতে হবে। সেইজন্য খনার বচন, গোপালের কাহিনী ও বাগানের স্বপ্ন দিয়ে কাহিনী শেষ হয়েছে। গল্পের কোনো লাইনই অহেতুক হবে না, প্রতিটি বাক্যের পেছনে একটা কারণ থাকতে হবে।

গল্পের স্বাভাবিক স্রোতে যদি আবেগ সৃষ্টি হয় সেটুকুই আমি গ্রহণ করি, অমল ও বিথীর মধ্যে দাদা ও ছোট বোনের মত সখ্যতা ছিল, ভালবাসা ও স্নেহ। সেটিকে নতুন পৃথিবীতে আর ধরে রাখা গেল না কারণ এর মধ্যে ২০ বছর চলে গেছে। অমল বিথীর কাছে দাদা হিসাবে হয়তো সেই ভালবাসাটা চেয়েছিল, কিন্তু সেটার অভাবে বা সেটা কেমন করে ঘটল তার জন্য আলাদা একটা পৃথিবীরই অবতারণা করল। তুষার ও রাতে স্বপ্নের মধ্যে যে বেদনা সে যে আর এক পৃথিবীতে আছে সেটাই স্মরণ করালো।

লেখার শুরুতে আমি পাঠককে তার নামটা উচ্চারণ করতে বলেছিলাম, যাতে তারা তার নামের ধ্বনিটি শুনতে পায়, লেখার শেষে আবার। এর মাধ্যমে পাঠককে তার বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন ও একই সাথে সন্দিহান করা ছিল উদ্দেশ্য, অমল যেমন তার পৃথিবী সম্পর্কে সন্দিহান হয়েছিল। এটাও এক ধরণের instrument, পাঠককে গল্পকারের সাথে সম্পৃক্ত করার। সফল লেখক তিনি যিনি পাঠককে বন্দী করতে পারবেন।

গল্প লিখতে গিয়ে আমি একটা জিনিস বুঝেছি একটা ভাল বীজ আইডিয়া না থাকলে গল্প শুরু করা যায় না। আবার সেটা শুরু করলে গল্পের ধারা যেন নিজের থেকেই জটিল হতে আরম্ভ করে, আমার যেন তার ওপর কোনো হাত নেই। এই গল্পটি লিখতে আমার সাত দিন সময় লেগেছিল।


কুলদা রায়
আপনাকে ধন্যবাদ।

দীপেন ভট্টাচার্য
আপনাকেও ধন্যবাদ। 

লেখক পরিচিতি
দীপেন ভট্টাচার্য
জন্ম ১৯৫৯। আদি নিবাস এলেঙ্গা, টাঙ্গাইল।
বিজ্ঞানী। গল্পকার। মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইন্সটিটিউটের গবেষক ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে (ইউসিয়ার) গামা রশ্মি জ্যোতির্বিদ হিসেবে যোগ দেন। এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক।

বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর প্রকাশিত বই : দিতার ঘড়ি, নিওলিথ স্বপ্ন, অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো।

Post a Comment

0 Comments