আনিসুল হকের গল্প-চুরি নিয়ে খোলা আলাপ : তিন সুন্দরীর নিদ্রা-জার্নি

 কুলদা রায়

এক। ভূমিকা

বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকী শিল্প ও সাহিত্য বিভাগে গেল মাসে (১৮ সেটেম্বর, ২০১৫) আনিসুল হকের একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। নাম--পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারী, আপনার জন্য

আনিসুল হকের গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পরে অনলাইনে তুমুল বিতর্ক ওঠে। প্রথম অভিযোগটি ওঠে আনিসুল হক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর বেঁচে থাকো সর্দিকাশি গল্পটি নকল করে লিখেছেন। এর পরে আরেকটি অভিযোগ ওঠে, নোবেল পুরস্কারজয়ী কলাম্বিয়ান লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘নিদ্রিতা সুন্দরী ও একটি এ্যারোপ্লেন ‘ নামে একটি বিখ্যাত গল্পের নকল।
এ ধরনের অভিযোগ স্বস্তিকর নয়। আনিসুল হকের মত মূলধারার লেখক অন্য লেখকের লেখা  নকল করে লিখবেন সেটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।  এ ধরনের ঘটনা থেকে নবীন লেখক-পাঠক লেখালেখির নামের-শিল্পকর্ম নির্মাণ বিষয়ে ভুল বার্তা পেতে পারেন। ফলে লেখা তিনটি গভীরভাবে পড়ে পাঠ করে অভিযোগ খতিয়ে দেখা ছাড়া উপায় থাকে না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে মূল গল্প তিনটি, , তাদের তুলনামূলক নিকট বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এই লেখাটি করা হয়েছে।


দুই। মার্কেজ, মুজতবা ও আনিসুলের তিন রমনীর জার্নি--
১.
মার্কেজের গল্পটি শুরু হয়েছে—একটি নারী প্যাসেঞ্জারের রূপ বর্ণনা করে। প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে গল্পের উত্তম পুরুষের কথকের দেখা হয়েছে প্যারিসের চার্লস ডি গল বিমানবন্দরে। তিনি যাচ্ছেন নিউ ইয়র্কে। সুন্দরীর রূপ বর্ণনা করছেন মার্কেজ—
নমনীয় এক সৌন্দর্য ছিল তার পুরো অঙ্গে। স্নিগ্ধ ত্বকে পাউরুটির মতো তুলতুলে আমেজ ও পটলচেরা চোখের চাহনির গভীরে আমি তা দেখেছি। সেই সঙ্গে কাঁধ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া সোজা কালো চুলে এক চিরন্তন সৌন্দর্যের ঢেউ খেলছিল। হয়তো ইন্দোনেশিয়া বা আন্দিজের মতো প্রাচীন সে সৌন্দর্য, তবে মহাকালিক। তার পরিধেয় প্রতিটি পোশাকে ছিল সূক্ষ্ম রুচির পরিচয়-লিনেক্স (বনবিড়ালের চামড়া) জ্যাকেট, সূক্ষ্ম ফুল অঙ্কিত ঢিলেঢালা সিল্কের ব্লাউজ, লিনেন কাপড়ের ট্রাউজার আর বাগানবিলাস রঙের ছোট ছোট ডোরাকাটা জুতা।

আনিসুল হকের গল্পের কথকও উত্তম পুরুষ। তিনি আসছেন প্লেনে নয়-- ট্রেনে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায়। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে কথক দেখেছেন একটি নারীকে। শুরুতেই তার রূপ বর্ণিত হচ্ছে—

পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারীটি পুরোনো প্ল্যাটফর্মে এইমাত্র পা রাখল।
আমি ঘ্রাণ নিলাম। বাতাস আমাকে জানিয়ে দিল। হ্যাঁ, এসেছে একজন।
আমি পেছনে ফিরে তাকালাম। মেয়েটি পরেছে ঘিয়ে রঙের একটা ফতুয়া, গ্যাবাডিনের একটা ট্রাউজার। তার চুল খোলা। মেয়েটির নাকে একটা নাকফুল। মেয়েটি ঈষৎ শ্যাম বর্ণ।

মার্কেজের বর্ণনার মধ্যে ধ্রুপদী রূপকল্প এসে যাচ্ছে। চোখের বর্ণনার পরেই আসছে চুলের বর্ণনা। তারপরে গায়ের পরিধেয় পোশাকের কথা।

আর আনিসের লেখায় আসছে—শুরুতে পোষাকের বিবরণী। তারপর ঢেউ খেলানো চুল।

মার্কেজ বলে দিচ্ছেন, 'এ পর্যন্ত দেখা সকল মেয়ের মধ্যে তুমি সবচেয়ে সুন্দর'। রূপ বর্ণনার পরেই এই 'সব চেয়ে সুন্দর' হিসেবে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। আনিস তার গল্পের নারীটিকে শুরুতেই, রূপবর্ণনার আগে বলে দিচ্ছেন, আমি পেছনে না তাকিয়ে শুধু বাতাসে শ্বাস নিয়ে বলতে পারি, এক শ হাত পেছনে একটি অত্যন্ত রূপবতী তরুণী অবস্থান করছে।

২.
তুষার ঝড়ের জন্য মার্কেজের বিমান ছাড়তে দেরি হচ্ছে। বলা হচ্ছে এই ঝড়টি এ শতাব্দীর মধ্যে সব চেয়ে বড় ঝড়। কিন্তু মেয়েটিকে দেখার পরে বিমানবন্দরের সকল ঝোড়ো হাওয়া বসন্তের হাওয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। কথক বোর্ডিং পাসের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন একজন ডাচ মহিলার পেছনে। তার ঝগড়ার কারণে ঘণ্টাখানেক দেরি হল। এর মধ্যেই সেই সুন্দরী চলে গেলেন সামনে। টার্মিনালে হারিয়ে গেলেন। মেয়েটির দেখার বাসনা লুপ্ত হল। টিকিট চেকার মহিলার সঙ্গে কথক একটু রঙ্গ রসিকতা করলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রথম দর্শনে ভালোবাসায় তিনি বিশ্বাস করেন কি না। ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, 'অবশ্যই, বরং এ ছাড়া অন্য কিছু অসম্ভব'। এ সবই মার্কেজ সেই সুন্দরী নারীটির প্রতি তার আকর্ষণের ইঙ্গিত হিসেবে বলছেন। পাঠককে ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছেন। এরপরে কথক প্লেনের টিকিট পেয়েছেন। ৪ নং সিট বেছে নিয়েছেন। প্রথম শ্রেণীর টিকিট। তার বিমান সকালের বদলে সন্ধ্যায় ছাড়ল।

আনিসের গল্পে মেয়েটিকে কথক কাছ থেকে ব্যাকুল হয়ে দেখতে লাগলেন। তার রূপের সংগে মোম্বাই সিনেমার এক নায়িকার কথা বললেন। তার ঘাড়, নাক, নাকফুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করছেন। ট্রেন মিস হতে পারে এই ভয়ে সুন্দরীকে রেখে আরেকটি প্লাটফর্মে তিনি চলে যেতে বাধ্য হলেন। টিকিট করা ছিল। ট্রেনে বোর্ডিং পাস লাগে না। টিকিট নং আগে থেকেই দেওয়া থাকে। চেকিংও দরকার হয় না। ফলে আনিসের গল্পে এটা বাদ। কথক ট্রেনে উঠে পড়লেন। তবে মার্কেজের মত এই টিকিটও প্রথম শ্রেণীর।

৩.
মার্কেজের কথক জানতেন না তার চার নম্বর সিটের পাশের সিট কোন যাত্রীর। কিন্তু তিনি দেখলেন, যে-রূপবতী নারীকে দেখেই তিনি পাগল হয়েছিলেন তিনিই হলেন তার পাশের সিটের যাত্রী।
আনিসের গল্পের মেয়েটিও কাকতালীয়ভাবে তার মুখোমুখি সিটে বসেছে। অদ্ভুত মিল ঘটছে দুটি গল্পেই।
মার্কেজের মেয়েটি কথকের সঙ্গে কথা বললেন না। একটু প্রসাধনী করলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন।

আনিসের গল্পের রূপবতী মেয়েটিও কথকের সঙ্গে কথা বললেন না। ঘুমিয়ে পড়লেন।

৪.
ঘুমিয়ে পড়ার পরে মার্কেজের সুন্দরীকে কথক মন ভরে দেখতে লাগলেন। তার কাছে মেয়ে প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি বলে  বিশ্বাস হচ্ছে। তাই তার পাশে শুয়ে থাকা মোহিনীর জাদু থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বের হতে পারছিলেন না। কোনো খাবার খেলেন না। কথক মদ খেতে খেতে ঘুমন্ত মেয়েটির প্রতি চিয়ার্স করলেন। তাকে নিয়ে সুখ স্বপ্নও দেখলেন। বাথরুমেও গেলেন। আট ঘণ্টা পরে তার ঘুম ভাঙল।

আনিসের গল্পের মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়ার পরে কথক তাকে দেখতে লাগলেন বিভোর হয়ে। এর মধ্যে খাবার খেলেন। মেয়েটি উঠল না খেতে। বাঙালিরা প্রকাশ্যে মদ খায় না বলে কথককে মদ খেতে দেখা গেল না। মার্কেজের কথকের মত আনিসের কথকও বাথরুমে ঘুরে এলেন।

মেয়েটির ঘুম ভাঙল টঙ্গি স্টেশনে। তেজগাঁ বিমানবন্দর স্টেশনের আগের স্টেশনে।

৫.
আনিসের সুন্দরীটি একটা ফার্স্ট এইড বক্স খুলে তার পায়ের একটা আঙ্গুলে লাগালেন। এ সময় কথকের সঙ্গে কোন কথা বললেন না। এরপরে ঘটনাটুকুতে মার্কেজের গল্প থেকে আনিস একটু সরে গেলেন। আনিস একটি ছোট্ট উপকাহিনী যুক্ত করলেন। সেটি কী? মেয়েটি ফ্যান ঘোরাতে গিয়ে ব্যর্থ হল। কথক তার জন্য ফ্যান ঘুরিয়ে দিতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলল। মেয়েটি দয়াপরবশ হয়ে তার আঙুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।

এই আঙুল কাটা আর ব্যান্ডেজ বাঁধার উপকাহিনীটি পাওয়া যাচ্ছে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বেঁচে থাকো সর্দি কাশি’ গল্পে। গল্পে এক ডাক্তার এ-রকম রেল ভ্রমণে গেছেন। সেখানে অচেনা এক সুন্দরী সহযাত্রিনীকে দেখে কাতর হয়েছেন ডাক্তারটি। মেয়েটি তার সঙ্গে কথা বলছে না। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে ডাক্তারের আঙুল কেটে গেল। মেয়েটি তখন তার হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। মুজতবা আলীর ডাক্তার ধন্য হয়ে গেল। আনিসের কথকও ধন্য হয়ে গেল। নারী স্পর্শে পৃথিবীর সকল পুরুষই ধন্য হয়ে যায়। তাকে ধন্যবাদ দিলে মেয়েটি শুধু একটি হাসল। কোনো কথা বলল না।

এরপরে মুজতবা আলী শেষ। আনিসের গল্পটি আবার খুঁজে পাওয়া যায় মার্কেজের গল্পে।

মার্কেজের সুন্দরীটি বিমানবন্দরে নামলেন। স্প্যানিশ প্রথায় একটু ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এটা শুধু প্রথা। সকলকেই করতে হয়। তারপর সুন্দরী নিউ ইয়র্কের আমাজান জঙ্গলে হারিয়ে গেলেন।

আনিসের মেয়েটিকে নিতে এসেছিল একটি যুবক। এসেছিল তার সঙ্গে সুন্দরীটি চলে গেল। আনিস লিখছেন—মিশে গেল কমলাপুর রেলস্টেশনের ভিড়ে।

মার্কেজের মিশে যাওয়া আর আনিসের কমলাপুর রেনস্টেশনের ভিড়ে মিশে যাওয়া ব্যাপারটি তো একই ঘটনার দুরকম শব্দের প্রকাশ মাত্র। ভাবে কোনো পার্থক্য নেই।


তিন। ফেসবুকের একটি পোস্ট--

ফেসবুকে ঝড় ওঠার পরে বেশ কয়েকদিন আনিসুল হক নিশ্চুপ ছিলেন। এই অভিযোগ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

তবে আনিস আহমেদ নামে ভয়েস অফ আমেরিকয় কর্মরত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ফেসবুকে আনিসুল হকের উদ্দেশে একটি পোস্ট দেন। তিনি লেখেছেন--

সম্প্রতি জনৈক ... চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন এ রকম একটি অভিযোগ এনেছেন যে আপনার সাম্প্রতিক একটি গল্প, সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পের অনুকরণে লেখা হয়েছে। আমি প্রথম আলোয় প্রকাশিত আপনার গল্পটি এবং সৈয়দ মুজতবা আলির গল্পটি পড়ে নিশ্চিত হয়েছি যে কোন ক্রমেই আপনি তাঁকে অনুকরণ করেননি। ট্রেন যাত্রা এবং আঙুল কেটে যাবার ঘটনায় মিল আছে বটে কিন্তু দুটি গল্পের প্রেক্ষপট, কাহিনীর বিস্তার, সংলাপ ও চরিত্র ভিন্নধর্মী। সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পটি রসাত্মক এবং মিলনাত্মক, আপনার গল্পটি বিয়োগান্তক। আপনার গল্পের নায়িকা বাকশক্তি রহিত ব্যক্তি। আর রেলগাড়িতে সহযাত্রী কারও জন্য আবেগ আপ্লুত হয়ে যাওয়া র ঘটনা তো নতুন কিছু নয়। সেটা অনুকরণের অভিযোগ অমূলক। আমি ভাবছিলাম আপনি আপনার ফেইবসুক বন্ধু ও অনুরাগীদের উদ্দেশ্যে এটা পরিস্কার করে দিতে পারেন কি না যে এই আভিযোগ- ভিত্তিহীন এবং সম্ভবত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত...


চার। আনিসুল হক উপর্যুক্ত পোস্ট পড়ে ফেসবুকে একটি প্রতিক্রিয়া লেখেন। প্রতিক্রিয়াটি হুবহু তুলে দেওয়া হল--

আনিস স্যার বলায় এই পোস্ট দেয়া আমার কর্তব্য বলে মনে করছি... আনিস স্যার আমার পক্ষ সমর্থন করে ফেসবুকে লিখছেন, আর আমি চুপচাপ বসে আছি এটা ঠিক নয়। আনিস স্যারকে ধন্যবাদ। শ্রদ্ধেয় স্যার, আমি কেন এতক্ষণ চুপচাপ ছিলাম, সেটা আগে বলে নিই।

আমি কখনোই কোনো বিতর্কে জড়াতে চাই না। কারণ আমি শ্রমিক মানুষ, কাজ করে খাই। বিতর্ক অকারণে সময় নষ্ট করে। মনোযোগ নষ্ট করে। ওই সময়টা আমি পড়তে পারি, লিখতে পারি, ঘুমাতে পারি, টিভি দেখতে পারি, ঝিমুতে পারি। তর্ক করে সময় নষ্ট করব, সেই সময় আমার কই। কাজেই আমাকে আপনারা বিতর্ক করতে দেখবেন খুব কম। তবে ফেইসবুকের একটা প্রচারণা আমাকে ফোন করে ও ইনবক্সে মেইল করে জানিয়েছেন আমার বন্ধুরা। এটাও আমার কাছে একটা রহস্য। দেশে ও বিদেশের পত্র-পত্রিকায় আমার বই নিয়ে মাঝে-মধ্যে ইতিবাচক আলোচনাও ছাপা হয়েছে। কেউ সেটা আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করে না। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে একটা পোস্ট ফেইসবুকে বেরিয়েছে, এটা আমাকে জানানোর জন্য আমার বন্ধুদের দায়িত্ববোধ আমাকে বিস্মিত করেছে। শ্রদ্ধেয় আনিস আহমেদ স্যার যখন আমার পক্ষে লড়ছেন, তখন ভাবলাম, আর চুপচাপ থাকা উচিত হবে না। শিক্ষক ও অগ্রজ লেখকের পরামর্শই আমার জন্য আদেশ।

আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, আমি দেশ-বিদেশের প্রচুর লেখা নকল করে নিজের নামে চালিয়েছি। সর্বশেষ যা করেছি, তাহলো সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প মেরে দিয়ে নিজের নামে চালিয়েছি।

আমার এই গল্পটা, যা গত শুক্রবারের প্রথম আলো সাময়িকীতে বেরিয়েছে, তার প্রেরণা কোত্থেকে কোত্থেকে পেয়েছি, সেটা আগে বলে নিই।

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘স্লিপিং বিউটি এন্ড দি এরোপ্লেন।’ গল্পে আছে, বিমানবন্দরে একটা খুব সুন্দর মেয়েকে তিনি দেখলেন, আশ্চর্য সে তারই প্লেনে উঠল, আশ্চর্য সে তারই পাশে বসল এবং বসেই ঘুমিয়ে পড়ল। ট্রেনে হাত কাটার ঘটনা আমার নিজের জীবনের ঘটনা। চট্টগ্রাম থেকে আসার পথে ফ্যানে হাত দিয়ে আঙুল কেটেছিলাম। তর্জনী। এই কারণে এখন আমাকে টাইপ করতে দেখবেন, দেখবেন যে আমি ডান হাতের তর্জনী ব্যবহার করি না। ডান হাতের মধ্যমা আর বাম হাতের তর্জনী ব্যবহার করি। আমার সেই এক্সিডেন্টের সাক্ষী আছেন আমার স্ত্রী ছাড়াও গৌতম চক্রবর্তী আর সুমনা শারমীন। ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়ার বর্ণনার সময় আমার খুব বেশি মনে পড়ছিল নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতা, আমার ভালোবাসা বা প্রেম সংক্রান্ত কোনো স্মৃতি নেই। তাতে তিনি লিখেছিলেন, ডেটলে রক্তাক্ত ক্ষত মুছে দিয়ে পূরবী বলেছিল, তোর বউ তোকে খুব ভালোবাসবে দেখিস। পূরবী বা রানুদি কিছু একটা। আমার এই গল্পের লাইন-- নারী আর ঘুমন্ত নারী এক নয়--সুনীলের কবিতার লাইন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ তো ব্যবহার করেছিই। আপনারা সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পটাও পড়ুন, আমারটাও পড়ুন, কোনো মিল পেলে তা হবে এই যে তারটাতেও ছেলে আর মেয়ের প্রেম হয়, আমারটাতেও। ছেলে ছেলে বা মেয়ে মেয়ের প্রেম নিয়ে আমরা কেউই লিখি নাই। তারটাতেও আঙুল কাটা যায়, আমারটাতেও। তবে আমি যখন লিখি, তখন বেঁচে থাকো সর্দি-কাশির কোনো স্মৃতি আমার মধ্যে দূরবর্তীভাবেও কাজ করেনি। আর ইশারা ভাষায় কথা বলাটার ধারণাও আমি পেয়েছি আমার সাপ্তাহিক পূর্বাভাসের দিনগুলোয়, তখন আমরা থাকতাম নয়াপল্টনে, পাশেই একটা মূক ও বধির বিদ্যালয় ছিল। সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা হাত নেড়ে নেড়ে ভাব বিনিময় করত। তার মানে আমার বা লেখকদের গল্পের পেছনে থাকে জীবনের অভিজ্ঞতা আর পাঠের অভিজ্ঞতা।

আর আমার বিরুদ্ধে বিদেশি গল্প মেরে দেওয়ার অভিযোগ কেন। আমি একটা গদ্যকার্টুনে অনেকগুলো জোকস, ডিটবিটস, অ্যানেকডটস ব্যবহার করেছিলাম ইন্টারনেট থেকে নিয়ে। সেটা গদ্যকার্টুনে স্বীকার করা আছে। পরে সেইসব কৌতুক, অ্যানেকডটস আলাদা আলাদাভাবে স্টাটাস দিয়েছিলাম। তখনই বলা শুরু হলো, আমি নকল করে গল্প লিখেছি। এদেরকে কেউ বোঝান, কৌতুক কেউ বানায় না। ধরা যাক, আমি লিখলাম, আইনস্টাইন ছোটবেলায় বলেছিলেন, কবুতরের বাচ্চা হয়েছে তার জন্য একটা ছোট দরজা বানাতে হবে, কারণ মা কবুতর বেরুবে বড় দরজা দিয়ে, বাচ্চার জন্য তো ছোট লাগবে। এইটার জন্য সূত্র উল্লেখ করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তাহলে সৈয়দ মুজতবা আলীর বইকেনা প্রবন্ধের নিচে ফুটনোট বোঝাই থাকত। আর আমার লেখা স্টাটাসকে আমি আমার লেখা গল্প বলে কখনো দাবি করি না।

দুটো গল্প পড়ুন। নকলবাজ লেখককে হাতে নাতে ধরুন।

আমি যখনই কোনো দেশি বা বিদেশি গল্প থেকে নিই, সঙ্গে সঙ্গে তা স্বীকার করি, কারণ তাতে আমার গৌরব বাড়ে। কমে না।

আনিস আহমেদ স্যারকে আবারো ধন্যবাদ।


পাঁচ। আনিসুল হকের প্রতিক্রিয়ার সার সংক্ষেপ--

আনিসুল হক মার্কেজের গল্পটি নকল করে লেখেননি বলে দাবি করেন। বলেন, একটু অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেছেন মাত্র। মার্কেজের গল্পের সুন্দরী মেয়েটি যুবকটির পাশের সিটে ঘুমিয়ে পড়ে। তার গল্পের নায়িকাও কিছু সময় ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়ে। আর কোনো মিল নেই। মার্কেজের চেয়ে আনিসুল হক সৈয়দ মুজতবা আলীর বেঁচে থাকো সর্দি কাশি গল্পের আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে তিনি যে গল্পটি লিখেছেন সেটা নিজের জীবনেই ঘটেছিল। সেটা মুজতবা আলীর গল্প থেকে নকল করেননি। এবং তিনি আরও দাবি করেন বিদেশি পত্র-পত্রিকা থেকে নানা বিষয় নিয়ে পুনরুৎপাদন করে লেখা যায়। সেজন্য কোনো সূত্র উল্লেখ করার দরকার নেই।


ছয়। একটু বিশ্লেষণ

সেদিন হয়তো আনিসুল হক সত্যি সত্যি ট্রেনে করে আসছিলেন সপরিবারে। তার আঙুলও কেটেছিল হয়তো। ঘটনা হয়তো গল্পটির মতো ঘটেছে। ঘটতেই পারে জীবনে। গল্পতো জীবনের বাইরে নয়।

আনিস স্বীকার করছেন, মার্কেজের গল্পটি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। তার মানে মার্কেজের গল্পটিও আনিস পড়েছেন। সেটি তার মনে আছে। মুজতবা আলীর গল্পটি এত জনপ্রিয় যে সেটা তার মতো গল্পকারের না পড়ার কথা নয়। এবং মার্কেজের লেখার শক্তিটি এমন যে তা পাঠকের মনে গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে।

সেক্ষেত্রে গল্প দুটির মত একই ঘটনা লেখকের জীবনে ঘটে থাকলে তিনি তাদের মতো করে লিখবেন না। অন্যরকম করে লিখবেন। ভিন্ন পারসপেকশন থেকে ঘটনাটিকে দেখবেন। লিখলে সেটা হবে তাদের গল্প থেকেও শিল্পমানে আরও সুন্দর। ভিন্ন সৌন্দর্য থাকবে। ভিন্ন আঙ্গিক থাকবে। ভিন্ন ভাষাভঙ্গি থাকবে। ভিন্ন উদ্দেশ্যে থাকবে।
নাহলে একই ঘটনা নিয়ে লেখার তো অর্থ হয় না।

অথবা লেখক বলে দিতে পারেন, যে ঘটনা তার নিজের জীবনে ঘটেছে সেটা মার্কেজ এবং মুজতবা আলীর গল্পের সঙ্গে মিল আছে। গল্পের মধ্যেই তার সূত্র উল্লেখ করে দেবেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। লেখকের সৃষ্টিকে সম্মান দেখাবেন। সেটাই লেখকের সততা। সেটাই নৈতিকতা। কিন্তু সেটা করেননি আনিসুল হক।

গল্প তিনটির তুলনামূলক আলোচনা করে দেখা যায়, আনিসুল হকের গল্প মৌলিক নয়। মার্কেজের গল্পের সঙ্গে ৯০% মিল রয়েছে। মার্কেজের গল্পের সঙ্গে একটু পার্থক্য আনতে মুজতবা আলীর গল্প থেকে আঙুল কাটার অংশটা নিয়েছেন। নিজের কোনো নির্মাণ দিচ্ছেন না। ভিন্ন পারসপেকশন হাজির করতে পারছেন না। জোলো বিবরণী দিচ্ছেন। কিশোর বয়েসী প্রেমের তুল্য ভাষা দিচ্ছেন। এটা একজন মৌলিক লেখক করেন না। কিন্তু আনিসের গল্পটিকে ‘মেরে দেওয়া’র মতই মনে হয়। এবং তিনি ‘মেরে দেওয়া’কে জায়েজ করার জন্য সাক্ষী রাখছেন তার নিজের পরিবারকে। চুরিবিদ্যার দায় পরিবারের উপরও চাপাচ্ছেন। সর্বোপরি এ গল্পটি ছাড়া তাঁর অন্য লেখাতেও ইন্টারনেট থেকে তুলে নিয়ে বাংলায় অনুবাদ করে নিজের লেখা বলে চালিয়েছেন, তারও প্রমাণ রয়েছে। (লিঙ্ক--নীড়পাতা)। সেগুলোর কোনো সূত্র দেননি।
যে-কাহিনী বিশ্বসাহিত্যের অংশ, সেটা অনুপ্রেরণা হতে পারে। কিন্তু চুরি করা হতে পারে না।

ঝুম্পা লাহিড়ীর অপরিচিত ভূমি নামের গল্পের শুরুতেই Nathaniel Hawthaome র একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। সেই কবিতার মূল কথার সঙ্গে ঝুম্পার গল্পের মূল ভাব মিলে গেছে। কিন্তু ঝুম্পারটা গল্প। আর উদ্ধৃতি দিয়ে অনুপ্রেরণার সূত্রও জানিয়ে দিচ্ছেন। এটাই তো রীতি।

তাহলে সাহিত্য কী হলে নকল হয় ওঠে। চুরি হয়ে ওঠে—সেটা নিয়ে একটু তত্ত্ব-তল্লাশ করা যেতে পারে।


সাত। কুম্ভীলকবৃত্তি ওরফে সাহিত্য-চুরি কি জিনিস

Plagiarism নামের ইংরেজিতে যে শব্দটি আছে তাকেই বাংলা ভাষায় কুম্ভীলকবৃত্তি বলা যেতে পারে। একে বলা হয়--অন্যায়ভাবে অপরের সৃষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ আত্মসাৎ। কোনো লেখকের ভাষা, চিন্তা, আইডিয়া বা ভাব, অভিব্যক্তিকে, উপস্থাপনকে অন্য কোনো লেখক যদি নকল বা চুরি করে নিজের নামে চালায় তবে তাকে কুম্ভীলকবৃত্তি বলা হবে। অন্যের অনুমতি ছাড়া কোনো জিনিস নকল করাকে সাহিত্যের চুরি হিসেবে ধরা হয়। 

 plagiarism as the "use, without giving reasonable and appropriate credit to or acknowledging the author or source, of another person's original work, whether such work is made up of code, formulas, ideas, language, research, strategies, writing or other form. 

অক্সফোর্ড ডিকশোনারিতে লেখা হয়েছে-- the wrongful appropriation or purloining and publication as one's own, of the ideas, or the expression of the ideas… of another। একডেমিক দিক থেকে এই ঘটনাকে অসৎ কর্ম হিসেবে গন্য করা হয়। সাংবাদিকতা পেশায়ও এটাকে নীতির লঙ্ঘন বলে ধরা হয়। বলা হয় এ ঘটনা হল-- unfair competition or a violation of the doctrine of moral rights। 

কুম্ভীলকবৃত্তি সহজাতভাবে একাডেমীক ও শিল্প ক্ষেত্রে মারাত্মক কোনো অপরাধের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন হিসেবে এটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে প্রবাদ রয়েছে--তুমি যে জিনিসটি নিজে সৃষ্টি করো নি, সেটা নিজের কোনো কাজে ব্যবহারের আগে তার প্রতি ঋণ স্বীকার করো। Plagiarism is also considered a moral offense against anyone who has provided the plagiarist with a benefit in exchange for what is specifically supposed to be original content (for example, the plagiarist's publisher, employer, or teacher). In such cases, acts of plagiarism may sometimes also form part of a claim for breach of the plagiarist's contract, or, if done knowingly, for a civil wrong.

ফেনেল হাডসন নামে একজন ব্রিটিশ লেখকের মতে, যে সব লেখক অন্য লেখকের লেখা নকল বা চুরি করে তারা আসলে অন্যের ঘুমের ভেতরে ঢুকে পড়তে চায়। অন্যের স্বপ্ন চুরি করতে চায়। এটাকে তিনি মন্দ কাজ বলে মনে করেন।


আট। আলেক্স হ্যালির রুটস নিয়ে মামলা

রুটস আলেক্স হ্যালির বিখ্যাত উপন্যাস। এটা পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল। আফ্রিকা থেকে দাস হিসেবে  কালো মানুষদেরকে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়েছিল-- তাদেরই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাহিনী এই রুটস। ২৯৭৮ সালে যখন রুটস মিনি সিরিজ আকারে বের হচ্ছিল, তখন হ্যারল্ড কোরল্যান্ডার নামে একজন লেখক হ্যালীর নামে মামলা করেছিলেন। তাঁর দি আফ্রিকান নামের বই থেকে হ্যালী চুরি করে লিখেছেন বলে হ্যারল্ড অভিযোগ তুলেছিলেন। প্রমাণসহকারে অভিযোগ করেছিলেন, হ্যালী অন্তত ৮১ টি স্তবক তাঁর বই থেকে সরাসরি নিয়েছেন। 
কোর্টে হ্যারল্ডের আইনজীবী বলেন, হ্যালী তার মক্কেলের বই থেকে বেশ কিছু নকল করেছেন। দুটো বই তুলনা করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। দি আফ্রিকান বইতে আফ্রিকান প্রবাদ,, ঘটনা, আইডিয়া, লেখার প্লট ও ভঙ্গি রুটসের সঙ্গে মিলে যায়। দি আফ্রিকান বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। রুটস প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। আফ্রিকান দাসের পলায়নী স্বভাব, একজন বুড়ো দাসের মনস্তত্ত্ব, একজন দাস নেতার স্বভাব এবং দাস জীবনের সব অনুষঙ্গই দি আফ্রিকান বইতে আছে। ঠিক এগুলোই হ্যালী রুটসে ব্যবহার করেছেন। 
হ্যালী স্বীকার করেন এগুলোর মিল আছে সত্যি তবে রুটস লেখার সময়ে দি আফ্রিকান বইটি তিনি পড়েন নি। কোর্ট বলেন যে, হ্যালী চুরি করেছে। তখন হ্যালী ৬.৫ লাখ ডলার দিয়ে হ্যারল্ডের সঙ্গে মিমাংসা করেন। এবং লিখিত ভাবে অভিযোগ স্বীকার করেন। বিচার শেষ হওয়ার পর স্কিডমোর কলেজের মাইনোরিটি স্টাডিজের শিক্ষক জোসেফ ব্রুচাক জানান, ১৯৭০-১৯৭১ সালে হ্যালীকে দি ফ্রিকান বইটি পড়তে দেন। বইটি নিয়ে তার সংগে আলোচনা করেন। ১৯৮০ সালে আলেক্স হ্যালী লিংকন সেন্টারে বক্তৃতা করতে এসেছিলেন। তখন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ফিলিপ নোবিল কোনো রাখঢাক না করে হ্যালীকে  প্রশ্ন করেন, ৬.৫ লাখ ডলার জরিমানা দেওয়ার পরেও কেনো একজন অপরাধীর বদলে নায়ক হিসেবে তাকে গণ্য করা হবে না?


নয়। অনুপ্রেরণা নামের জিনিসটি

লেখালেখিতে অনুপ্রেরণা বলে একটি ব্যাপার আছে। যে কোনো লেখকই কারো না কারো লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত বোধ করেন। সেই লেখাগুলোর মধ্যে এমন কিছু তিনি দেখতে পান যা তাকে এই ধরনের আরেকটি গল্পের সন্ধান দেয়। তাকে এরকম আরেকটি গল্প লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। সাধারণত রোমান্টিক উপন্যাসের শক্তিটিই এরকম। পড়ে পাঠক দেখতে পান, এ ধরনের ঘটনা তার জীবনেও আছে। তিনিও লিখতে পারেন। তিনি লেখা শুরু করেন। এক সময় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসের রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তের প্রেমের মত কাহিনী লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে অনেক লেখককে। দেবদাস উপন্যাস বোধহয় সর্বাধিক প্রেরণা সৃষ্টিকারী লেখা। হূমায়ুন আহমদ গেল তিরিশ বছরে নবীন লেখকদের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন। টিভি নাটকের ক্ষেত্রে তিনি একটি টাইপড ফরমাট দিয়ে গেছেন। তাহলে এই অনুপ্রেরণা থেকে তারা লিখছেন কেন? লিখে সহজে নাম করার জন্য। অর্থ অর্জনের জন্য। এর বাইরে আরো কিছু কারণ আছে। তবে প্রতিভাবানরা কিছুদিনের মধ্যে এই অনুপ্রেরণা বা প্রভাব থেকে বের হয়ে আসেন।

অনেক গল্পেরই একই ধরনের উপাদান থাকে। ক্রিস্টোফার বুকারের মতে সব গল্পই সাত ধরনের মৌলিক প্লটের অন্তর্ভুক্ত। এদের কোনোটির সঙ্গে  স্পষ্টভাবে মিল থাকে। কোনটির সঙ্গে কিছুটা অস্পষ্টভাবে মিল থাকে। সাত ধরনের প্লট হল--ক) দানবীয় শক্তিকে পরাজিত করা , খ )গরীব নায়কের ধনসম্পদ অর্জন করা যা পূর্বে সে হারিয়েছিল, গ) গুপ্তধন উদ্ধার, ঘ) সমুদ্রযাত্রা ও ফিরে আসা, ঙ) মিলনাত্মক বা Comedy, চ) বিষাদাত্মক বা Tragedy ও ছ) স্বভাবের রপান্তর বা Rebirth।

তবে প্রতিভাবান গল্পকাররা একই ধরনের প্লটকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে  উপস্থাপন করে গল্পটিকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলেন। আবার কেউ কেউ প্রকাশ মাধ্যমটাকেই বদলে নেন। কোনো গল্পকে নাটকে বা কবিতায় লেখেন। মহাভারতের আখ্যান নিয়ে ভারত প্রেমকথা নামে গল্পসংকলন লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন কবিতা, গীতিনাট্য। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন কাব্যনাট্য।

সুজান কলিন প্রাচীন গ্রিক নায়ক থিসেউস এবং এথেনীয় যুবক ও তরুণীদের নিয়ে লিখেছেন দি হাঙার গেমস। কিন্তু কলিন গল্পের সময়কাল আর সেটিংস পালটে দিয়েছেন।

আবার গল্পের আখ্যানে মিল থাকলেও পরিণতিও ভিন্ন করে দেন। মিলনাত্মক ঘটনাকে বিয়োগাত্মক করে নেন।

little red ridind hood নামেএকটি শিশুতোষ গল্প আছে। গল্পে একটি ছোট মেয়ে বনে পথ হারিয়ে ফেলে। একটি নেকড়ে তাকে খেয়ে ফেলে। এই গল্পটি শিশুদের মনে বিভৎস রস সৃষ্টি করে। ফলে গল্পটি ভালো হলেও শিশুদের পড়তে দেওয়া হত না। পরে গল্পটিকে আরেকজন লেখক নতুন করে লেখেন। সেখানে শিশুটিকে একজন শিকারী নেকড়ের কবল থেকে রক্ষা করে। তখন গল্পটি শিশুদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কেউ কেউ চরিত্র বদলে দেন। বয়স, লিঙ্গ অথবা স্বভাব বদলে দেন। ফলে চরিত্র বদলে যাওয়ার জন্য আখ্যানেও নতুনত্ব আসে।

আবার কেউ কেউ সিরিয়াস গল্পকে প্যারোডি বা হাস্যরসাত্মক করে ফেলেন। The Lord of the Rings নামের গল্পটির বিখ্যাত প্যারোডি Bored of the Rings।

জে কে রোলিং নামের লেখিকা হ্যারিপটার নামে বিখ্যাত রহস্য কাহিনী লিখেছেন। তার এই বইটির উপাদান দুই বা ততোধিক বই থেকে নিয়েছেন। তবে রোলিং যাদুবিদ্যাকে হ্যারিপটারে এনে ধার করা কাহিনীকে নিজের কাহিনী করে ফেলেছেন।

আবার কেউ কেউ একাধিক থিমকে একসঙ্গে জুড়ে দেন। রোমাঞ্চের সঙ্গে ফ্যান্টাসি এবং ভৌতিক আখ্যানের সঙ্গে প্রেম জুড়ে দেন। সেটা নতুন হয়ে ওঠে।

পুরাকালের প্রেমের ঘটনাকে একালের প্রেমের ঘটনার সঙ্গে, স্বাভাবিক প্রেমের সঙ্গে অস্বাভাবিক প্রেম, সহজ প্রেমের সঙ্গে রহস্যময় প্রেম, কল্পনার সঙ্গে ইতিহাসের যোগসূত্র করে গল্পে নতুনত্ব আনার রীতি রয়েছে। একে এক ধরনের ডিকনস্ট্রাকশন বলে। 


দশ। বিদেশি গল্পের ছায়া নিয়ে লেখা

বিদেশী গল্পের ছায়া নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। যেমন বাংলাদেশের কাজী আনোয়ার হোসেন সারা জীবন ধরে বিদেশি গল্পের ছায়া নিয়ে মাসুদ রানা সিরিজ লিখেছেন। ছায়া নিয়ে লেখা ফিকশনের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সেবা প্রকাশনীও গড়েছেন। কিন্তু প্রতিটি লেখার নিচে, প্রতিটি বইয়ের শুরুতেই স্পষ্ট করে লিখে দেন—বইটি বিদেশি কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে লেখা। এটা লিখে দিয়ে মূল লেখাটির প্রতি ক্রেডিট প্রদান করেন। যারা আরো দ্বায়িত্বশীল লেখক/ প্রকাশক তারা বিদেশি মূল লেখক ও লেখাটির সূত্র উল্লেখ করে দেন। এবং যারা শতভাগ সৎ লেখক/প্রকাশক তারা ছায়া অবলম্বনে না লিখে মূল বইটি সরাসরি অনুবাদ করে দেন। বইটি অনুবাদ কাহিনী হিসেবে পাঠক পড়তে পারেন। প্রতিভা ও সামর্থ্য থাকলে কোনো লেখক নিজের মৌলিক লেখাটাই লেখেন।

তাছাড়া একটি শক্তিশালী লেখার গুণই এমন যে লেখাটি পড়লে পাঠককে নতুন নতুন গল্প ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যান্য লেখকের মধ্যে নতুন লেখার জন্ম দেয়। তবে প্রকৃত লেখক খুব সতর্কভাবে এইখান থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসেন। নিজের গল্পটিই লেখেন। সেটাই তার প্রতিভা। সেটাই তার শক্তি।

সমস্যা হল সেইসব লেখকদের জন্য যারা লিখতে চান, লিখতে চান অনেক--অনেক। লিখে নাম করতে চান, পদক পেতে চান, অর্থ পেতে চান, ক্ষমতা পেতে চান, সুবিধা পেতে চান--তারা কিন্তু ধীরে ধীরে অন্যের লেখার ওপর ভর করেই লেখেন। কখনও ভাব থেকে ধার নেন। এই ধার নিতে নিতে এক সময় অন্যের লেখার আখ্যান মেরে দিতে শুরু করেন। নিজের নিয়ন্ত্রিত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করেন। তারা মনে করেন, যে-চৌর্যবৃত্তিটা তিনি করছেন, সেটা কেউ ধরতে পারবে না। এটা শুধু তার লেখার বন্ধ্যাত্বই প্রকাশ করে না, সঙ্গে সঙ্গে নিজের নির্বুদ্ধিতাও প্রকাশ করে ফেলে। ইন্টারনেটের সময়ে চুরি করে পার পাওয়া কঠিন। কেউ না কেউ ধরে ফেলে। আনিসুল হকের গল্পটিও সে রকম Plagiarism-এর একটি উদাহরণ। সোজা ভাষায় বলা যায়- চুরি।

তবে আনিসুল হকের বয়স কম। লেখার ভাষাটিও আয়ত্ত্ব আছে। সেজন্য তিনি নিজের লেখাতেই ফিরে যাবেন আশা করতে পারি। সেটা তাঁর জন্য ও বাংলা ভাষার তরুণ লেখকদের জন্যই স্বাস্থ্যকর।


দশ। পড়ুন--

Post a Comment

0 Comments