ভালোবাসার গল্প : দি হ্যাঞ্চ ব্যাক অফ দি নতরদ্যাম

 


কুলদা রায়


আমি গ্রীনজোরিকে ভালবাসি। গ্রীনজোরি আমাকে।

কলেজে পড়ার শুরুতেই গ্রীনজোরির সঙ্গে দেখা মেলে। এক সঙ্গে তিনজন—পুরো অমনিবাস। হান্স ব্যাক অব নতরদাম, বার্ জাগর্ল এবং নাইনটি থ্রি। বাবা বলল, দ্যাখ—পড়ে দ্যাখ।

বইটি বেশ মোটা।শুরু হয়েছে একটি উৎসবের প্রস্তুতির বর্ণনা দিয়ে। দীর্ঘ বর্ণনা। টেনে নিয়ে গেল সেই ফরাসী দেশে। সেখানে দেখতে পাচ্ছি লা এসমারেল্ডা নামের এক জিপসী মেয়েকে। অপরূপ সুন্দরী। ঘাগরা পরে রাস্তায় নাচছে। হাতে তানপুরা। সহ নৃত্যশিল্পী জালি নামের এক ছাগল। জিপসী মেয়েটির নাচ দেখে পাগল হয়েছে নতরদাম চার্চের ব্রহ্মচারী পাদরী জাঁ ক্লদ,একজন ক্যাপটেন, কুঁজো এতিম গীজার ঘণ্টাবাদক কোয়াসিমোদো এবং কবি ও দার্শনিক গ্রীনজোরি।

এসমারেল্ডা নতরদাম থেকে একটু দূরে ভবঘুরে পল্লীতে থাকে। এই ভবঘুরেরা হল চোর, মাতাল, খুনে, অভাবী, দাগী অপরাধী। তারা এই মেয়েটিকে তাদের হৃদয়ের বোন বলে জানে।

গ্রীনজোরির সঙ্গে মেয়েটির বিবাহ নামক একটি ঘটনা আছে।কাগজ কলমে। ঐ পর্যন্তই। তার বেশি কিছু নয়। গ্রীনজোরি তাকে ভালবাসে একজন কবির মতো করে—একজন দার্শনিকের মতো করে।স্বামীর মতো নয়। ছায়ার মতো তাকে পথে পথে আগলে রাখে।কিন্তু তাকে কখনো ভালবাসে নি এসমারেল্ডা।কবিকে করুণা করা ছাড়া কে কবে ভালবেসেছে?

এসমারেল্ডাকে ভালবেসেছে কুৎসিৎ দর্শন কোয়াসিমোদো। চার্চের ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে দেখেছে রাস্তায় নৃত্যরত এসমারেল্ডাকে। তাকে নিয়ে মাধুর্য্যমণ্ডিত স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু আবার চার্চের পুরোহিত জাঁ ক্লদের আশ্রিত কোয়াসিমোদো জানে দুঃস্বপ্নেও এই জিপসী মেয়েটির ভালবাসবে না। তার ভালবাসা পাওয়ার আশাও করে না। কিন্তু একাকী গন্ধবিধুর ধুপের মতো ভালবাসতে তো কোনো অসুবিধা নেই। তাই তাকে ভালবাসে কোয়াসিমোদো।

আর তাকে ভালবাসে ক্ষ্যাপা ষণ্ডের মতো সেই চার্চের পাদরী ফরাসী দেশের ঈশ্বরপ্রায় জাঁ ক্লদ।এ ভালবাসা একতরফা।তার ভালবাসায় ক্ষমতার চূড়ান্ত জোর আছে।ভালবাসতে গিয়ে কুকুরের মতো পাগলা হয়ে ওঠে ব্রহ্মচারী। মেয়েটির কানে কানে বলে, বলো, বলো মেয়ে—তুমি আমাকে ভালবাসো। বলো, ভালবাসো আমাকে।বলতে বলতে জাঁ ক্লদের হেঁচকি ওঠে। বিকৃত হয়ে ওঠে মুখমণ্ডল। হিংস্র বাঘের মত তার নখদন্ত বেরিয়ে পড়ে। 

এসমারেল্ডা কিন্তু ভালবাসে ক্যাপটেনকে।রাজার সেনাবাহিনীর ক্যাপটেন। যুবক। সুদর্শন। প্রাণবন্ত। টগবগে ঘোড়ায় চড়া ক্যাপটেন মেয়েদের ভালবাসায় প্লুত। ভালবাসা পেতে তার কোনো ঝামেলা নেই। তার চাই শুধু ভালবাসা।হাত বাড়ালেই যে ভালবাসা পাওয়া যায়। যে ভালবাসার জন্য কোনো কষ্ট করতে হয় না। যে ভালবাসা ছেড়ে যেতেও কোনো পাপবোধ জাগে না। এই অবাধ ভালবাসা ছাড়া আছে কি? সে বলে, ফুলের বনে যার কাছে যাই—তারেই লাগে ভাল, ও রজনীগন্ধা--—তোমার গন্ধসূধা ঢালো। এসমারেল্ডা তার দেহমনের সমস্ত সুগন্ধিই নিবেদন করেছে ক্যাপটেনকে।ক্যাপটেন ছাড়া তার ভুবনে আর কেউ নেই।

জাঁ ক্লদ চার্চের পাদরী। অমিত ক্ষমতা তার। তার কথাই আইন। পবিত্রতার একটা রেশমী মুখোশ আছে তার মুখে, চোখে, কণ্ঠে। তার কথাই ঈশ্বরের কথা। এসমারেল্ডাকে তার চাই। তিনি বলেন—এই মেয়ে, তুমি যদি আমাকে তোমার ভালবাসা না দাও তাহলে তোমাকে শুলে চড়তে হবে।শুলে চড়ার প্রয়োজনীয় আয়োজনও তিনি করেছেন। শুলে চড়ার আগের মুহুর্তেও তিনি বলছেন মেয়েটির কানে কানে—হে মেয়ে,তুমি বলো—আমাকে ভালবাসো। যদি বলো—তাহলে তোমাকে আমি বাঁচাব। ডাইনীর বদলে তোমাকে দেবী বানিয়ে দেব।


সেই সমবেত জনতার সামনে, সেনা সামন্তদের সামনে, প্রবল প্রতান্বিত পাদরীর সামনে সেই নিঃসঙ্গ কুঁজো কুৎসিত দর্শন কোয়াসিমোদো নিজের জীবন বিপন্ন করে এসমারেল্ডাকে চিলের মতো ছোঁ করে মৃত্যুর হাত থেকে তুলে নিয়েছে ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে। অবাক বিস্ময়ে দেখতে পাই—কোয়াসিমোদো নিরীহ নির্বিবাদি দার্শনিক গ্রীনজোরির কাছে পৌঁছে দিয়েছে মৃত্যু ভয়ে আতংকিত এসমারেল্ডাকে।আর গ্রীনজোরি তাকে, এসমারেল্ডাকে, তার ছাগলসহ নদীর পাড়ে নিয়ে গছে। নদী পার করে বিপদসীমার বাইরে এগিয়ে দিয়েছে। ঠিক এ সময় এসমারেল্ডার মনে হল—এই কবি ও দার্শনিক লোকটি তাকে স্বার্থহীনভাবে ভালবেসেছে। তাকেই ভালবাসা দরকার--এই বেঁচে যাওয়ার ক্ষণে উপলদ্ধি করল এসমারেল্ডা—কবির জন্য আর কোনো করুণা নয়--তাকে ভালবাসা দেওয়ার জন্য সে প্রস্তুত।

কবি ভালবাসে শুধু সেই ভালবাসাটিকে। আর কিছু নয়। ভিতরের ভালবাসার মায়াটুকু। মায়ার মর্মটিকে। নদীর ওপারে পৌঁছে দিয়ে গ্রীনজোরি ফিরে গেল সেই পুরনো ভবঘুরেদের কাছে। যারা আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে প্যারিস শহরটির বিখ্যাত চার্চটিকে—ভেঙে চুরে দিচ্ছে পাপের শহরটিকে।

গ্রীনজোরির মনে কোনো খেদ নেই। সে এসমারেল্ডা নামের একটি রক্ত মাংসের মেয়েটিকে চায় নি। চেয়ে নিয়েছে তার প্রিয় ছাগলটিকে। ছাগলটির নাম জালি। জালি কখনো ভুল মানুষকে ভালবাসে না। সে জানে প্রকৃত ভালবাসা।


২.

আমার বাবার সঙ্গে ভিক্টর হুগোর এই ধ্রুপদী উপন্যাস দি হ্যান্স অব নতরদাম পড়েছি। সেই একাশি সালে। বাবা পড়েছে বারান্দায় শুয়ে শুয়ে। আকাশে চাঁদ উঠেছে। ফুল ফুটেছে। বাঁশি বাজছে। হাতি নাচছে। ঘোড়া নাচছে। আর পুকুর পাড়ে কে? পুকুর পাড়ে কোনো এক ছায়া। পুকুর পাড়ে কোনো এক মায়া। বাবা বলছে, ও কিছু নয়। কিছু নয়রে খোকা। ও জালি। গ্রীনজোরির জালি। গ্রীনজোরি নেই। গ্রীনজোরি পুকুর পাড়ে জালিকে একলা ফেলে রেখে কোথায় চলে গেছে---কেউ জানে না।


৩.

আমি জানি। গ্রীনজোরিকে আমি জানি। একদিন ঘুম ভেঙে গেলে দেখতে পাই—আমার টেবিলে গ্রীনজোরি একা বসে আছে। উল্টেপাল্টে দেখছে বইগুলো। ভুর্জপাতার মত কাগজগুলো। কি একটা কলম তুলে নিয়ে লিখতে শুরু করেছে। আর মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছে—বাইরে তখন জল পড়ে—পাতা নড়ে।তোমার কথা মনে পড়ে।

তাকে বলি—কে তুমি?

গ্রীনজোরি ফিস ফিস করে বলে--আমি কেউ না। কেউ না।

এরপর ঝমঝম করে বৃষ্টি নামে মেঘ ভেঙে। বৃষ্টি পড়ে ঘরের চালে। গাছের ডালে।বৃষ্টির মধ্যে আবার আমি অক্লেশে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে শুনি, জালি বৃষ্টির মধ্যে ছটফট করছে। জলে ফুটেছে পদ্ম। কে একটা মেয়ে দূরে দূরে ঘুরছে। তার চুল ভিজে হাওয়ায় ওড়ে। তাম্বুরা বাজিয়ে গান করছে–নিশিতে যাইও ফুল বনে।


৪. 
এই গল্পটি থাক। তাহলে ফুলবনের গল্প বলি।

ফুলবনে বহুদিন গেছি।সে সময় প্রতিদিনই গেছি। একা একা যেতে ভালবাসি।চারিদিক শুনশান—কেউ নেই। দুএকটা ঝিঁ ঝিঁ পোকা মাঝে মাঝে বেজে ওঠে। হাওয়ায় কখনো রাত্রিচর পাখির ডানার সাঁই সাঁই শব্দ। মাঝে মাঝে কয়েকটি শেয়াল জুল জুল চোখ নিয়ে সরে যায়। চন্দন বনে, জাফরান বনে আর কয়েকটা কুর্চি গাছের ফাঁক দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীটিকে দেখা যায়। তার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শিশিরের সঙ্গে জেগে থাকে ওদের সঙ্গে সদ্যফোটা অন্ধকারের আলোর মধ্যে--

জ্বালাইয়া চান্দেরও বাতি
বসে থাকি সারা রাতি গো।


৫.

এর মধ্যে এইসব দিনে একটি ফোন এলো। রিনরিনে গলায় মেয়ে কণ্ঠ বলল, তুমি কি একটু আসতে পারবে?
--কোথায়?
--ফুলবনে।
--ফুলবনে তো আমি রোজই যাই।
--জানি। তবে রাতে নয়—দিনে আসবে। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।

কী কথা তাহার সাথে-তার সাথে? কে জানে। আমি হাও বলি না। নাও বলি না। টের পাই-- ফোনটি বেজে চলেছে। রিনরিনে গলা বলে চলেছে—এসো কিন্তু। এসো। দুপুরে। ফুলবনে।


৬.

দুপুর হওয়ার আগেই ফুলবনে পৌঁছে যাই। ফুরফুরে হাওয়া আসছে মলয় পাহাড় থেকে।হাসনুহেনা ফুটেছিল কাল রাতে—তার গন্ধ লেগে আছে ঘাসে। ঘাসের উপরে কে একজন বসে আছে। হাঁটু দুটো বুকের কাছে জড়ো করে ছায়ার মতো। হাওয়ার মতো কেউ বসে আছে। কে? কে বসে আছে এই ঘন দুপুরে ফুলবনে—চিলের ডানার গন্ধ মুছে ফেলে? চেয়ে দেখি—গ্রীনজোরি। গ্রীনজোরি বসে আছে একা। অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে। চোখে বিপন্ন বিস্ময়। পথের দিকে অপলক চেয়ে আছে। আছে অপেক্ষায়।

যখন দুপুর এলো--মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক ট্রেন উড়ে গেল দুরে গারো পাহাড়ের দিকে—আরও দূরে তুরা পাহাড়ের দিকে। তার পিছনে মালার মতো বকের পাতি উড়ে চলেছে। বকের পাতির সাঁই সাঁই শব্দ শুনে গ্রীনজোরি সহসা উঠে দাঁড়িয়েছে। তার পা কাঁপছে। হাত কাঁপছে। চুল কাঁপছে। পড়তে পড়তে বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নিচ্ছে। একটু ওগুচ্ছে। আবার থামছে। এইভাবে ফুলবনে পার হয়ে চলে গেল গ্রীনজোরি। যেমন করে চলে গেছে এসমারেল্ডাকে নদীর পাড়ে রেখে।সঙ্গে এসমারেল্ডার সঙ্গী জালি। পিছন দিকে একবারও না ফিরে। সোজা সামনে। দূরে কোথাও। দুপুরের হাত ধরে। বিকেলের পিছনে পিছনে। সন্ধ্যার অন্ধকারে। রাতের গভীরে।

Post a Comment

0 Comments