গল্পের বই : বৃষ্টিচিহ্নিত জল
পাঠ প্রতিক্রিয়া
মৈত্রেয়ী সরকার
যে কোনো স্রোতের গায়ে স্পর্শ ছোঁয়াতেই চোখে ভেসে ওঠে কপোতাক্ষ, বেত্রবতী, মধুমতী, কীর্তনখোলা,পানঘুচি, সোনাই,বলেশ্বর,চিত্রা।
সে এক অলৌকিক মায়ার রাজ্য।নিরন্তর তার স্নেহটান। সে স্নেহটান বহুদেশে বহুনদ দলে কিছুতেই তৃপ্ত হয় না।তাই শিকড়ের খোঁজে বারবার ছুটে যেতে হয় আমার সোনার বাংলায়।হ্যা।পূর্ববঙ্গের গল্প লেখেন কুলদা রায়।সে গল্পে ফেলে আসা ভূমির রূপকথা বলে। বাস্তবতা আর জাদুবাস্তবতার মেলবন্ধনে গল্প হেঁটে চলে ইতিকথা ও ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। কুলদা রায় গল্প লেখেন না,গল্পদাদুর আসরে গল্প বলেন। তার বলা গল্প শুনতে শুনতে পাঠক ধীরে ধীরে চলে যান স্বপ্নের দেশে। সেখানে রাজপুত্র রাজকন্যারা এক মায়ার রাজ্যে খেলা করে বেড়ায়। রূপকথার পরী নেমে এসে সোনার কাঠি রূপোর কাঠি ছোঁয়ায়,নেচে নেচে ওঠে নতুন রাজ্য। হ্যাঁ।এভাবেই কুলদা রায় তার গল্পের ভূবন নির্মান করেন।
তিনি এক দক্ষ কুশলী পাহাড়ি। বাস্তবতা থেকে অতিবাস্তবতার জগতে যেমন পাঠককে হাত ধরে চড়াইতে নিয়ে যান তেমনি এক ধাক্কায় নামিয়ে আনতে পারেন বাস্তবের ভূমিতে। এভাবে চড়াই উৎরাইয়ের মতো বাস্তবতা ও জাদুবাস্তবতার ওঠা নামার খেলা চলতে থাকে তার গল্পে।
তিনি হারিয়ে যাওয়া সময় ও হারানো মানুষের খোঁজ করেন তার গল্পে। ফিরিয়ে আনেন হারানো নদী,হারানো গান, হারানো সময়,হারানো লক্ষীদীঘা ধান কিম্বা হারানো মানুষকে।অ তীত থেকে
বর্তমানে তার গল্পের অনায়াস যাতায়াত। যেন কয়েকলক্ষ বছর আগের মানুষকে মার্কেজের ম্যাজিকে জীবন্ত করে তোলেন মুহুর্তে। বাংলা গল্পের ধারায় এ এক নতুন সংযোজন। বাংলাদেশের নদী জঙ্গল, খাল বিল,মাঠ ভরা ধান,জাল ভরা মাছ সমস্তই তার হাতে জীবন্ত সত্তা হয়ে ওঠে,তারা কথা কয়,গান গায়,হেসে খেলে বেড়ায়। কুলদা রায় দক্ষ গল্পকার। অভিনব তার গল্পের শৈলী। তিনি গল্পের ছক যেভাবে আঁকেন, যেভাবে শব্দশৈলী ব্যবহার করেন,যেভাবে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত বিলা ভুঁইয়ের সংলাপ বলেন আর ফেলে আসা বঙ্গভূমের সংস্কৃতির সূক্ষ্ম ধারাগুলোকেও দৃঢ় করে তোলেন তাতে তার কলমের শক্তির তীব্রতার আন্দাজ পাওয়া যায়।
বিচিত্র জীবন অভিজ্ঞতা ছাড়া কখনো কলম সমৃদ্ধ হয় না। কুলদা রায় জীবনকে বহুকৌণিক মাত্রায় দেখেছেন। কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনা এবং চাকরির সুবাদে অবাধে ঘুরেছেন বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামান্তরে। দেখেছেন বাংলাদেশের নদী প্রান্তর, মাঝি মাল্লা, ধান পাট,হাট বাজার,লাঙ্গল গরু,ধর্মাধর্ম সবকিছুই। একাত্তর দেখেছেন তিনি,মুক্তিযুদ্ধ তাকে গৃহছাড়া করেছে,রিফিউজি ক্যাম্প তাকে বাঁচার লড়াই শিখিয়েছে। ধংশস্তুপ হয়ে থাকা স্বাধীন বাংলাদেশ তাকে নতুন ভাবে গড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে। একদিন সেই সোনার বাংলা থেকে তিনি নির্বাসিত হয়েছেন। এ নির্বাসন যেন আমাদের জন্মগত অভিশাপ। তাই প্রবাস কুলদার মনে শিকড়ের সন্ধানে জাগায়,ইতিহাসে অতীতে ভেসে বেড়ানোর মন্ত্র জাগায়।মাটির তুলসী মঞ্চে শঙ্খ ফুঁ দিয়ে সান্ধ্য প্রদীপ জ্বালাবার স্বপ্ন জাগায়। তার গল্প আসলে অতীত কবিতা। সে কবিতা রূপসী বাংলার বুকে ছিন্ন খঞ্জনার মতো ছেঁড়া ডুমুরের পাতায় নেচে নেচে যায়। গৈলাগ্রাম,গৌরনদী, মোরলগঞ্জ,বাগেরহাট, কলারোয়া,গোপালগঞ্জ, ফুলতলা গভীর রাত্রে তার স্বপ্নের পথে পথে ভেসে আসে। সেই অনি:শেষ জীবনের কথা তার না লিখে উপায় নেই। এ মায়ার রাজ্য তাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়।আর তিনি পূর্বপুরুষের তর্পণ করে যান গল্পের অলৌকিক ভোরের মোহময় আবেশে।
কুলদা রায়ের গল্প পড়ে যে পাঠ অনুভুতি হয় তাকে শুষ্ক আলোচনায় আনা একেবারেই সম্ভব নয় তবুও তার গল্প পাঠের পর যে শিগরণ জাগে, রোমাঞ্চ জাগে তাকে খানিক ব্যাখ্যা না করলে যে ছোটোগল্পের প্রতি দায়বদ্ধতায় অবিচার হয়ে যায়।' সুবলসখার বিবাহ বৃত্তান্ত' গল্পটি মহাকাব্যের মেজাজে লেখা।আঠাশ পাতার গল্পে বিলপথে এক বিবাহ যাত্রার বর্ননা দিয়ে গল্প শুরু হয়। বাংলাদেশের গ্রামীন জীবন,তাদের আচার সংস্কার, রঙ্গ তামাশা, বিবাহের রীতিনীতি বলতে বলতেই লেখক বাস্তব আর জাদুবাস্তবতার আসা যাওয়া নিয়ে খেলা করেন জলপরীর রূপকে। ক্লাইম্যাক্সে যখন তিনি নির্মম মোচড় দিয়ে চুয়াত্তরের নিদারুণ দুর্ভিক্ষ ও অন্তহীন মৃত্যুর ইতিকথা বলেন তখন চাবুক হাকড়ানোর মতোই পাঠকের মনে সজোরে আঘাত নেমে আসে। বাস্তব আর জাদুবাস্তবতার খেলা খেলতে খেলতেই মূল সত্যের সন্ধানে দিয়ে অবলীলায় চলে যান।
গল্পের ইতিহাসে বহুকাল বেচেঁ থাকার মতো গল্প মেঘনাদ বধ। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ' ভাঙ্গা চশমা' গল্পের অপ্রকৃতস্থ শিক্ষককে আমরা দেখেছি যে তিনি ইংরেজি শেখাতে পাগল আর কুলদা রায়ের মেঘনাদ বধ গল্পে জহুর স্যারের মৃত্যুশয্যা পর্যন্ত মেঘনাদ বধ পড়ানোর যে গল্প বলেন সে গল্প আমাদের চোখে জল এনে দেয়। এ পোড়া পরাধীন দেশে প্রকৃত স্বাধীনতা যে কোনোদিন আসবে না তা জহুর স্যারের মেঘনাদ বধের রূপকে গল্পকার তুলে ধরেছেন।এই প্যাশানেট বাংলা শিক্ষক স্কুল থেকে, ছাত্রদের থেকে,পরিবারের কাছ থেকে, সমাজের কাছ থেকে নির্বাসিত হয়ে যখন মেঘনাদ বধ পাঠ করতে করতেই মৃত্যুর গহ্বরে তলিয়ে যান তখন জহুর স্যারের সাথে সাথে আমাদের স্বাধীনতাও তলিয়ে যায় গভীর অমানিশায়।
'কারবালা বিবি 'মিথ ও রিয়ালিটির মিশ্রণে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধনামা।মেনাজ ফকিরের মুখের জারি গান যখন কারবালার প্রান্তরে এজিদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের কথা বলে তখনই আরেক প্রান্তে ভেসে ওঠে শেখ মুজিবর রহমানের টুংগিপাড়ায় খান সেনাদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের ছবি। মিথ থেকে পার্থিব আর পার্থিব থেকে অপার্থিব হয়ে ওঠা এ গল্পের বিষয় বৈচিত্র্য ও শক্তিশালী গঠনশৈলী এ সময়ের ছোটোগল্পের ধারায় এক ব্যাতিক্রমী দৃষ্টান্ত।
' বৃষ্টি চিহ্নিত জল' রোম্যান্টিক ধারার সেরা গল্প। তবে গল্পের ভিতর তীর্থনাথ ও অঞ্জলির অনন্ত ভালোবাসার আড়ালে লেখক এক বিশেষ কাল,সময় ও সমাজকে সূক্ষাতিসূক্ষ ভাবে উপস্থিত করেছেন। ট্রাজিক প্রেমের উর্ধে এ লেখা রাধা কৃষ্ণলীলার পদাবলী গান হয়ে উঠেছে,হয়ে উঠেছে গ্রাম বাংলার জীবন্ত চলন্তিকা।
' সোনার কলস' গল্পে লেখক সুরোরিয়ালিজমের জগতে চলে যান গল্প বলতে বলতে।বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামজীবনের অসহায় নববিবাহিত কুৎসিত দর্শনা মেয়েরা যেভাবে রূপের জন্য লাঞ্ছিত হয়ে আত্মহনন করে সেকথা মিথ ও সুরোরিয়ালিজমের ছোঁয়ায় যেভাবে গল্পে উঠে এসেছে তাতে সহজেই বলা যায় কুলদা রায় লেখকদের লেখা শেখানোর গল্পকার।
' মথি উদয়ের তারা ' গল্পেও সেই রূপকথা, পুরাণ, মিথ ও বাইবেলের সংমিশ্রনের ভিতর নিদারুণ ভাবে বাংলাদেশের সমাজ সত্যকে মিশিয়ে লেখক এমন এক অলৌকিক রাজ্যের গল্প নির্মান করেছেন যেখানে পাঠক একবার প্রবেশ করলে আর বেরিয়ে আসতে পারে না, মায়ার ছলনায় শুধু ঘুরে বেড়ায়।
' দুধ কুমারের ঐরাবত ' গল্পটির মধ্যে কথকতা ও নিম্নবর্ণ সমাজের ইতিহাসের তথ্য জুড়ে জুড়ে এক মালা গেঁথেছেন। কিন্তু সে মালার সুগন্ধ বিষাক্ত বিষবাস্প হয়ে গেছে গল্পের শেষে। মুক্তিযুদ্ধকালের মৃত্যুর মিছিলে দুধকুমারের ঐরাবতের মৃত্যু ও হাজার হাজার অসহায় গ্রামবাসীর মৃত্যু গল্পকে এক যুদ্ধক্ষেত্রের প্রান্তরে পৌঁছে দেয়। গল্প হয়ে ওঠে জাদুবাস্তবতার আড়ালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত দলিল।
'জন্মকাল',' কোমল পুষ্প','পরিছায়া পরিমায়া','গন্নাবিবির জুতাপাখি',' শুয়াচেন পাখি',' শবনম অথবা হিমিকালিপি' এ সমস্ত গল্পই বাংলা গল্পের জগতে অন্যশৈলীর, নতুন ঘরানার গল্প। কুলদা রায়ের গল্প ধরতে পারা যতোটা কঠিন আবার ততোটাই সহজ। ব্যাতিক্রমী লেখাকে যেমন কোনো শব্দ দিয়েই সঠিকভাবে ধরা যায় না তেমনি কুলদা রায়ের গল্পকে নির্দিষ্ট ছকে, নির্দিষ্ট নিয়মে ধরাটাও অসম্ভব।প্রতিটি পাঠকের কাছে নতুন নতুন অর্থে এ গল্প উঠে আসার ক্ষমতা রাখে। এমন শক্তিশালী ও নতুন ঘরানার গল্পকারকে এই ক্ষুদ্র পরিসরের লেখায় ফুটিয়ে তোলা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। মুগ্ধতার শেষ নেই। তার গল্পশৈলীই বলে দেয় ভবিষ্যতে তিনি বাংলা ছোটোগল্পের জগতে সঠিক অর্থেই গল্পলেখা শেখার গল্পকার হয়ে উঠবেন। এমন গল্পের পায়ে হাজার হাজার পুরষ্কারের মাথা নত হতে পারে,নবীন লেখকের অনন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তি নত হতে পারে,এমন ভবিষ্যৎবাণী করলে তা খুব একটা অতিউক্তি হবে না। লেখকের প্রতি অনন্ত মুগ্ধতা থেকেই হয়তো এতো শব্দগুচ্ছের উদ্ভব।
কুলদা রায়ের মতো ভিন্ন শৈলীর ও ঘরাণার শক্তিশালী গল্পকার বর্তমান বাংলা গল্পজগতে খুবই কম। তাকে আরো পড়া দরকার। আরো জানা দরকার,আরো চেনা দরকার। তিনি পঞ্চাশটা গল্প লিখেই যে বাংলা সাহিত্য জগতে স্থায়ী আসন করে নেবেন এ আমার স্থির বিশ্বাস।
-------------------------------
বৃষ্টিচিহ্নিত জল--------------------------------
কুলদা রায়ের ১৫টি যাদু-বাস্তব গল্পের সংকলন।
কলকাতার প্রকাশক : সোপান, ২০৬, বিধান সরণী, কলকাতা। ফোন--৯৪৩৩৩৪৩৬১৬।।
ঢাকার প্রকাশক --নালন্দা। বাংলা বাজার ঢাকা। ফোন--০১৫৫২৪৫৬৯১৯
পাওয়া যাবে-- সন্ধিপাঠ, আজিজ সুপার মার্কেট ঢাকা।
লেখক পরিচিতি
মৈত্রেয়ী সরকার
অধ্যাপক।
গল্পকার।
গল্পকার।
কোলকাতায় থাকেন।
0 Comments