ইসাক বাবেলের গল্প : যীশুর পাপ

ভাষান্তর : কুলদা রায়

আরিনা একটি হোটেলে কাজ করে। প্রধান সিঁড়ির পাশে ছোটো একটা ঘরে সে থাকে। ঘরটি অতিথি কক্ষের কাছে। দারোয়ানের সাহায্যকারী সেরগেইয়ের ঘর প্রবেশ দরোজার পাশে। তাদের দুজনের মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক আছে। 

ইস্টার পরবের রবিবারে আরিনা সেরগেইয়ের জমজ বাচ্চা প্রসব করেছিল। এরপরে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। তারারা উজ্জ্বল হয়েছে। সেরগেই আবার কামার্ত হয়েছে। 
এর ফলে আরিনা আবার নিজেকে একটা ঝামেলার মধ্যে দেখতে পেলো। তার পেটে বাচ্চা এসেছে। তার দিনগুলো যেন বলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে ছয় মাসে পড়েছে। পেটের আকার বড়ো হয়ে গেছে। এ সময়ে সেরগেই ঠিক করেছে সে সেনাদলে যোগ দেবে। সেজন্য সেনাদলে নাম লিখিয়েছে। আরিনার এই ঝামেলার সময়ে তার পাশে থাকবে না। তার একাকেই সবকিছু সাামলাতে হবে। আরিনার সব তালগোল পাকিয়ে গেল। 
তাই তার খুব অভিমান হলো। সেরগেইয়ের কাছে গিয়ে বলল, ‘কোনো মানে হয় না, সেরিওগা। তোমার জন্য আমার অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। চার বছরের জন্য আমরা দূরে থাকব। তুমি ফিরে আসার আগে, চার বছরে, তুমি যেভাবেই দেখো না কেনো, আমাকে আরো দুই বা তিনবার গর্ভ ধারণ করতে হতে পারে। এর মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই।'

'এই হোটেলে যে আসে-- সেই আমার প্রভু হয়ে যায়--মালিক হয়ে যায়। এই হোটেলে কাজ করতে গেলে প্রায়ই তাদের ফরমায়েশে কাপড় খুলতে হয়। তাদের সঙ্গে শুতে হয়। সে একজন ইহুদী হতে পারে। মোটের উপর সে যে কেউই হতে পারে। এর মধ্যে তুমি ঘরে ফিরবে। আমার গর্ভাশয়টা আর ভালো থাকবে না। আমি তখন একজন ব্যবহৃত মহিলায় পরিণত হবো। তোমার আর উপযুক্ত থাকবো না। তুমি আর আমার সঙ্গে শোবে না।' 

'ব্যাপারটা সেরকম।' সেরিওগা মাথা নাড়ল। 

'আমাকে বিয়ে করতে চায় এরকম অনেকে আছে। ট্রোফিমিচ নামের ঠিকাদারটি মোটেই ভদ্রলোক নয়। আর নিকোলো-স্বাইৎস্কি গির্জার তত্ত্বাবধায়ক ইসাই আব্রামিচ নামের আধ বুড়ো। নিকোলো স্বাইৎস্কি গীর্জার তত্ত্বাবধায়ক। তার শরীরে কোনো মর্দানী শক্তি নেই। কিন্তু তোমার মর্দানী শক্তি আমার আত্মাকে গুড়ো গুড়ো করে ফেলেছে। প্রভু সাক্ষী আছেন, আমার সব কিছু তুমি চিবিয়ে খেয়েছো। আর তিন মাস পরে শিশুটিকে জন্ম দেবো। শিশুটিকে কোনো এতিমখানায় দিয়ে আসব। তারপর তাদেরকে বিয়ে করব।'

এটা শোনার পরে সেরগেই কোমর থেকে বেল্ট খুলল। তারপর ঠিক তার পেট বরাবর সেই বেল্ট দিয়ে নায়কের মতো পেটাতে লাগল।

'হে,’ আরিনা তাকে বলল, ' পেটে মেরো না। ঐ পেটের মালটা তোমার। অন্য কারো নয়।'

আরিনা আচ্ছা মতো সেরগেইয়ের হাতের বর্বর পিটুনি খেলো। তার চোখ থেকে অনেক তেতো কান্না ঝরলো। তার শরীর রক্তাক্ত হলো। এটা সেরগেইর কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আরিনার জন্য অনেক কিছু। 

তারপর কোনো দিশা না পেয়ে সে যীশু খ্রিস্টের কাছে এলো। বলল, 
'বেশি কিছু বলতে চাই না।’ সে বলল, ' প্রভু যীশু, আমার নাম আরিনা। ৎভারাস্কায়া স্ট্রিটের মাদ্রিদ এন্ড লুভর হোটেল থেকে এসেছি। সেখানে আমি কাজ করি। কাজটা বলার মতো এমন কিছু নয়। সেখানে প্রায়ই আমাকে কাপড় খুলতে হয়। সে হোটেলে যে-ই ঘর ভাড়া নিক না কেনো সে হয়ে যায় আমার প্রভু আর মালিক। হতে পারে সে একজন ইহুদি। হতে পারে যে কেউ। এ দুনিয়ায় সেরিওগা নামে তোমার আরেকজন দাস ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে দারোয়ানের সাহায্যকারী। গেল বছর ইস্টার পরবের রবিবারে আমি তার জমজ সন্তানকে গর্ভে ধরেছিলাম।'

তারপর সে প্রভুকে বিস্তার করে সেরগেইএর সঙ্গে শোয়া থেকে শুরু করে পেটানো পর্যন্ত সব ঘটনা বলল। 
শুনে ত্রাণকর্তা চিন্তা করে বললেন,'যদি সেরিওগা মোটের উপর সেনাবাহিনীতে না যায়, তাহলে কী হবে?’ 

‘'পুলিশ তাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাবে।’’ আরিনা জবাব দিল। 

‘'আহ, পুলিশ।’’ ত্রাণকর্তা মাথা নেড়ে বললেন। ‘'পুলিশের কথায় ভয়ে আমার সব গোলমাল হয়ে যায়। পুলিশের নাম বললেই আমি সব ভুলে যাই। পুলিশের কাছে গেলেই তোমার জীবনটা বরবাদ করে দেবে ওরা। তার চেয়ে কেমন হবে এসব সেক্স বাদ দিয়ে যদি তুমি সৎ জীবন কাটাতে শুরু করো?

'চার বছর ধরে?' নারীটি আর্তনাদ করে উঠল। ' তুমি কি বলতে চাইছো সবাইকে তাদের জীবনধর্ম ত্যাগ করতে হবে? তুমি সেই পুরনো গৎ বাঁধা কথাই বলছো। তাহলে কীভাবে আমাদের উন্নতি হবে -- কীভাবে আমরা সংখ্যায় বাড়বো? এইসব অকেজো উপদেশ দেওয়া থেকে আমাকে রেহাই দাও প্রভু।'

প্রভুর গাল লাল হয়ে গেল। নারীটির কথা তার কোমল মর্মে স্পর্শ করেছে। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। তুমি কখনো নিজের কানে চুমু দিতে পারো না। এমন কি ঈশ্বর এটা জানেন। 

'ওহে ঈশ্বরের দাসী, মহিমান্বিত পাপী, কুমারী আরিনা, তোমার কী করা দরকার তা আমি তোমাকে এখন বলবো,' সকল মহিমা নিয়ে প্রভু ঘোষণা করলেন, 'আমার একজন ছোটো ফেরেশতা আছে। স্বর্গে সে অকম্মার মতো তিড়িং বিড়িং বেড়ায়। আলফ্রেড তার নাম। মোটের উপর সে নাগালের বাইরে চলে গেছে। প্রায়ই সে বিনবিন করে কান্নাকাটি করে বলে, -- ‘’কুড়ি বছর ধরে আমি ফেরেশতা হয়ে আছি। এই দীর্ঘ সময় ধরে কেনো তুমি আমাকে নাবালক করে রেখেছো, প্রভু?’ 

'তাই তোমাকে আলফ্রেড ফেরেশতাকে দিয়ে দেবো। সে চার বছর তোমার স্বামী হয়ে থাকবে। সে থাকবে তোমার প্রার্থনা হয়ে। সে তোমাকে রক্ষা করবে। সে হবে তোমার সান্ত্বনা। ছেলেমেয়ে হওয়া নিয়ে মোটেই তুমি দুশ্চিন্তা করবে না। কারণ এ সময়কালে তুমি একটি হাঁসের বাচ্চাকেও পেটে ধরবে না। তার কাছ থেকে তুমি অনেক সুখ পাবে। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনো বাচ্চা পাবে না। তাকে একা শিশুর মতো থাকতে দিও। 

'এটাই আমার দরকার,' দাসী আরিনা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে চোখ মুছল। বলল, ' গেল দুই বছরে তিন তিনবার এভাবে বাচ্চা কাচ্চা পেটে ধরে আমি প্রায় কবরের কাছে চলে গিয়েছিলাম। 

'তোমার জন্য সব কিছু মধুর হয়ে উঠবে, হে ঈশ্বরের সন্তান আরিনা। তোমার প্রার্থনা একটি মৃদু গানের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠুক। আমেন।'

আর তাই এটাই সিদ্ধান্ত হলো। আলফ্রেড এসে গেল। সে একজন তরুণ যুবক। দুর্বল তার দেহ। তার ফ্যাকাশে নীল রঙের কাঁধে দুটো পাখা নড়ছে। তারা যেন স্বর্গের দুটো ঘুঘু পাখির মতো গোলাপী আলোর মধ্যে খেলা করছে। আরিনা তার দিকে তার পুষ্ট বাহু বাড়িয়ে দিল। বুকে তুলে নিল। তার কোমল নারী স্বভাব হেতু সে আনন্দে কাঁদল।

‘'আলফ্রেড, তুমি আমার আরাম। আমার আনন্দ। তুমি একমাত্র আমারই, আমারই একান্তজন….’’

'প্রতিরাতে বিছানায় যাওয়ার আগে তার পিঠের পাখা যেন অবশ্যই খুলে রেখো'--বিদায় নেওয়ার সময় প্রভু তাকে এই কঠোর নির্দেশ দিয়ে গেলেন। দরোজার মতো কব্জা দিয়ে পাখাগুলো আটকানো থাকে। প্রতি রাতে ওগুলো খুলে ফেলে পরিস্কার কাপড়ে জড়িয়ে রাখতে হবে। কারণ পাখাগুলো খুবই পলকা। বিছানায় নড়াচড়ার সময়ে ক্ষতি হতে পারে। এভাবেই এদের সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু এই তরুণীর চোখে এর চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই। 

শেষবার প্রভু তাদের মিলন উৎসবে আশীর্বাদ করলেন। সে সময়ে বিশপদের বৃন্দগান হচ্ছিল। সে উপলক্ষে তাদের ডাকা হয়েছিল। গুরুগম্ভীর তানে তার প্রশংসাবানী ঘোষিত হচ্ছিল। স্বর্গবাসীদের জন্য খাবারদাবারের বিস্তর আয়োজন থাকে। কিন্তু আরিনার মিলন উৎসবে সেরকম কোনো আয়োজন ছিল না। 

তারপর আরিনা আর আলফ্রেড, দুজনে দুজনার হাত ধরলো। একটি রূপোর মই বেয়ে তারা নিচে নামল। সোজা তারা পৃথিবীতে ফিরে এলো। তারা পেত্রোভকা স্ট্রিটে চলে এলো। এই স্ট্রিটে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। তবে সেরা সব জিনিস বিক্রি হয়। আলফ্রেডের জন্য যা কিছু দরকার তার সবই আরিনা করবে। 'তার তো মোজা আছে' এটা কেউ বললেও আরিনা তার জন্য নতুন মোজা কিনে আনবে, যেমন মা তার সন্তানের জন্য খুব স্বাভাবিকভাবে কেনে। তার জন্য সে কিনল চামড়ার দামী হাফ বুটজুতো, ডোরাকাটা পশমের পাজামা, খুব সুন্দর শিকারী জ্যাকেট আর নীলচে বিদ্যুৎ রঙের গেঞ্জি। 

‘’ আর যা যা দরকার, প্রিয়,’ সে বলল, ‘’ আমরা বাড়িতে খুঁজে নেবো।’’

সেদিন আরিনা হোটেলে কাজে গেল না। ছুটি নিল। সেরগেই এসে খুব হৈ চৈ করল। কিন্তু সে সেরিওগাকে পাত্তাই দিল না। দরোজা খুলল না। এমন কি সে ঘরের বাইরেও এলো না। বন্ধ দরজার পেছন থেকে শুধু বলে দিলঃ

‘’ সেরগেই নিফান্তিয়াইচ, আমি এখন আমার পা ধুচ্ছি। আর কোনো হৈ চৈ করো না-- মিনতি করছি।’’

আর একটিও শব্দ না বলে সেরিওগা চলে গেল। ফেরেশতার মহিমা নিজ থেকেই প্রকাশ হতে শুরু করল। 

আরিনা ব্যবসায়ীদের উপযোগী রান্নাবান্না করল। সে খুব গরবিনী হয়ে ছিল। টেবিলে সাজিয়ে রাখলো আধা পাইন্ট ভদকা, সঙ্গে সোডা, আলুর সঙ্গে ডানুবে মাছ--কেতলি ভর্তি চা। পৃথিবীর নানা ধরনের ভালো ভালো চর্ব চুষ্য খেয়ে দেয়ে আলফ্রেড গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। চোখের পলকে আরিনা তার কব্জা থেকে পাখা খুলে নিল। সেগুলো কাপড়ে মুড়ে রাখল। হাতে করে তুলে তাকে নিয়ে বিছানায় রাখল। 

তার বালিশ পুরনো কাপড়ের তৈরি। ভেতরে পালক ভরা। পাপে পূর্ণ বিছানাকে স্বর্গীয় তুষারের মতো অদ্ভুত সুন্দর বললে অসত্য বলা হবে। তবে স্বর্গীয় দীপ্তি এখানে পাঠানো হয়েছে। যেমন চাঁদ থেকে ছুটে আসা রুপোলী তীর ।-- সেই রুপোলী রঙ আবার বদলে হয়ে যাচ্ছে লাল। ঘরের অঙিনা ভেসে যাচ্ছে আলোর স্রোতে। আলফ্রেডের চকচকে পায়ে ধীরে ধীরে সে আলো পড়ছে। তাই দেখে আরিনা আনন্দে কাঁদছে। গান গাইছে আর প্রার্থনা করছে। আর ফিসফিস করে নিজেকে শোনালো, আরিনা, তুমি, তোমার জন্য এই সুখ অনুমোদন করা হয়েছে। এই পৃথিবীতে এরকমটা হয় বলে শোনা যায় না। আশীর্বাদ ধন্য নারীদের একজন তুমি। 

তারা দুজনে শেষ ফোঁটা পর্যন্ত ভদকা পান করেছিল। এরপর তার প্রভাব শুরু হলো। তারা খুব তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে গেল। আরিনা তার ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বার বড়ো গরম পেট নিয়ে আলফ্রেডের গায়ের উপর চড়ে বসল। একজন ফেরেশতার সঙ্গে ঘুমানো জন্য তার বিছানা যথেষ্ট নয়। দেয়ালের পাশে ঘড়ঘড় শব্দ করে নাক ডেকে ঘুমানোর স্বভাব এই কদাকার বেশ্যার। ছয় মাসের পেট নিয়ে একারই দরকার হয় একটি বিছানার। সেখানে অন্য কারো জায়গা হয় না। তাছাড়া, তার জ্বলন্ত পেট সেরগেইর লালসায় বড়ো হয়েছে। তার পেটকে আরো উষ্ণ করার ইচ্ছে জেগেছে। সে তার মাতাল ঘুমের মধ্যে আলফ্রেডের উপর চেপে বসল। এক সপ্তাহ বয়সের বাচ্চার মতো দুর্বল আলফ্রেডকে আমোদে আল্লাদে উন্মত্ত হয়ে ঠেসে চিড়ে চ্যাপ্টা করে ফেলল। তার স্ফীত ওজনের নিচে পড়ে সে গুড়ো গুড়ো হয়ে যেতে লাগল। বেচারা আলফ্রেড গায়েবী শক্তির আশা ছেড়ে দিল। কাপড়ের জড়িয়ে থাকা তার পাখার আশাও ছেড়ে দিল। তারপর ফ্যাকাশে কান্নায় ভেঙে পড়ল। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে সব কিছু শেষ হলো।

সকাল হলো। সব গাছই মাটির দিকে নত হলো। দূরের উত্তরাঞ্চলের বনে ফার গাছগুলো যাজকে রূপান্তরিত হলো। প্রার্থনায় এই যাজক গাছগুলো হাঁটু মুড়ে বসল। 

প্রভুর সিংহাসনের সামনে আবার আরিনা এসে দাঁড়ালো। তার কাঁধ চওড়া আর শক্তিশালী। নবীন মৃতদেহ নুয়ে আছে তার রক্তাক্ত বাহুতে। 

‘'দেখো, প্রভু….’

কিন্তু যীশুর কোমল আত্মা আর সহ্য করতে পারল না। খুব রেগে গিয়ে ফেটে পড়লেন। বুকের গভীর থেকে তাকে গালি দিলেন। 

‘'এটা পৃথিবীতে ঘটেছে। সুতরাং এ ঘটনার দায় দায়িত্ব তোমাকেই সামলাতে হবে আজ থেকে আরিনা।’’ 

‘তা কী করে হয়, প্রভু?’’ আরিনা মিনমিন করে উত্তর দিল। ‘'আমার এই ভারী শরীরটা কি আমি বানিয়েছি? এই ভদকা কি পৃথিবীতে আমি তৈরি করেছি? একজন নারীর বেকুব আর নিঃসঙ্গ আত্মা কি আমি বানিয়েছি?’’

‘'আমি তোমাকে আর কোনো সাহায্য করতে চাই না।’’ যীশু উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘'তুমি কামে উন্মত্ত হয়ে আমার ফেরেশতাকে চিড়ে চ্যাপ্টা বানিয়ে ফেলেছো। তুমি অপবিত্র আবর্জনা।’’

এরপর আরিনাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। তখন বাজে হাওয়া বইছিল। তাকে সোজা ফেরত পাঠানো হলো ৎভারাস্কায়া স্ট্রিটের হোটেল মাদ্রিদ এন্ড লুভরে। এখানে তার জীবনটা প্রায় অচল হয়ে উঠল। হুট করে তার চলাফেরার জায়গাটা ছোটো হয়ে গেল। তাকে সঙ্গ দেওয়ার মতো কেউ নেই।

সেরিওগা মদে মশগুল হয়ে আছে। মদ গিলেই তার শেষ দিন পার করছে। মনে হলো নতুন করে সে মদ গিলতে শিখেছে। তখন সবে ঠিকাদার ট্রিফিমিচ কলোমনা থেকে ফিরেছে। আরিনার দিকে এক নজর তাকালো। সে তখন অনেক ভারী হয়ে গেছে। তার মুখ কালচে। 
‘'ওহ, তুমি, অন্য কিছুর চেয়ে খুব সুন্দর তো তোমার পেট।’’ সে বলল। এই রকম আরো কিছু কথা বলে চলল উঁচু গলায়। 
ইসাই আব্রামিচ নামের সেই আধ বুড়ো আরিনার সুন্দর বড়ো হয়ে ওঠা পেটের কথা শুনে সেখানে এলো। তখন তার মুখ দাঁত শূন্য। কথা বলতে গেলে হাওয়া বের হয়ে যায়। 

‘'আমি তোমাকে আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে করতে পারব না।’ সে বলল, ‘'মোটের উপর এসব ঘটে গেছে। তবুও, অন্যেরা যেমন তোমার সঙ্গে শোয়, সেভাবেই আমি তোমার সঙ্গে শুতে পারি।’’
এইসব কুচিন্তা বাদ দিয়ে বুড়ো হাবড়া লোকটির এই সময়ে ছয় ফুট মাটির কবরে ঘুমিয়ে থাকার কথা। কিন্তু সে তা না করে সে এখন খুব বেশি করে আরিনার আত্মার মধ্যে থুতু ছিটানোর কাজে ব্যস্ত। রান্নার বাবুর্চি, ব্যবসায়ী, ভীনদেশীদের মতোই তার এই পাঠাগিরি এখনো চলছে। এসব খারাপ কাজের মধ্যেই সে আমোদ খুঁজে বেড়ায়। 

এবং বলা যায় এটাই আমার গল্পের শেষ। 

প্রসবের তিন মাস আগের দিনগুলো খুব তাড়াতাড়িই উড়ে চলে গেল। তখন আরিনা প্রায় মরতে বসেছে। অনেক কষ্টেসৃষ্টে হেঁটে বাড়ির পেছনের উঠোনে গেল। তত্ত্বাবধায়কের ঘরের পিছনে দাঁড়িয়ে রেশমী আকাশের দিকে তার বিশাল পেটটা উঁচিয়ে ধরল। বেকুবের মতো বলল,

‘এই যে প্রভু, দেখো আমার এই অদ্ভুত এই পেটটা! পেটের মধ্যে ছানারা হাতুড়ি দিয়ে ঢোল বাজাচ্ছে। কেনো আবার আমাকে এই রকম কষ্ট পেতে হচ্ছে, প্রভু? অনেক হয়েছে আমার জীবনে। আর না।'

এই কথাগুলো শুনে যীশুর চোখ ভিজে গেল। এই ভেজা চোখ নিয়ে তিনি আরিনার জন্য কাতর হলেন। তার সামনে ত্রাতা যীশু হাটু মুড়ে বসলেন। 

‘’ ক্ষমা করো, ক্ষুদে আরিনা। পাপে পূর্ণ ঈশ্বর, এই আমি তোমার প্রতি এসব ক্ষতি করেছি। 
‘’ তোমার জন্য কোনো ক্ষমা নেই, যীশু খ্রিস্ট।’ সে বলল, ‘'কোনো ক্ষমা নেই। এবং কখনোই ক্ষমা পাবে না। ‘’
ইংরেজি অনুবাদ-- মিরা গিন্সবার্গ

লেখক পরিচিতি
ইসাক বাবেল

জন্ম ১৮৯৪, ওডেশা, ইউক্রেইন। ১৯৪০ সনের ২৭শে জানুয়ারি, স্তালিনের আদেশ অনুসারে, তাঁকে সোভিয়েত ইউনিয়নের শত্রু সাজিয়ে, মস্কোর বুতির্কা কারাগারে গুলি করে হত্যা করা হয়।
তিনি রাশিয়ার কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার ও অনুবাদক। তার বিখ্যাত বই-- Red Cavalry, Story of My Dovecote and The Odessa Tales.। বাবেল ম্যাক্সিম গোর্কির বন্ধু ছিলেন। গোর্কির পত্রিকায় কাজ করতেন।
নিকোলাই গোগলের লেখার অনুসারী ছিলেন তিনি। যখন তিনি যখনই অনন্য কোনো গল্প লিখেছেন তখন যেন গোগল তার গল্পে হাজির হয়ে যেতেন। একাকী যেন কোনো মায়াস্বরে কথা বলতেন। স্বচ্ছন্দে তিনি গল্প বলতেন। যেন অন্য কাউকে নয়, গল্পটি নিজেকেই শোনাতেন, নানাবিধ চরিত্র স্বর শোনা যেতো। এমন কি কথক পেছন থেকে একজন চরিত্র হয়ে উঠত। গোগল ঠিক বর্ণনা রীতিতে গল্প বলতেন না। অসংখ্য কণ্ঠস্বর যেন অর্কেস্টার মতো বেযে উঠে গল্পটি বেজে উঠত।
যারা বাবেলের লেখার সঙ্গে পরিচিত নন, তারা এই গল্পে ব্লাশফেমীর উপস্থিতি থেকে চমকে উঠবেন। চমকে উঠবেন নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি দেখে। কাফকার মতো বাবেলও ছিলেন একজন বিধ্বংসী লেখক। এই ধরনের লেখকদের মূল প্রবণতাই হলো তার পাঠকদের মাথাকে আউলাঝাউলা করে দেওয়া। চিন্তার জগতটাতে ঝড় বইয়ে দেওয়া।


এই 'যীশুর পাপ' গল্পটি লেখা হয়েছিল ১৯২২ সালে। এর ঠিক পাঁচ বছর আগে হলে গল্পটি প্রকাশের সুযোগ পেতো না। বিপ্লবের আগে বাবেলের লেখায় ধর্মবিরোধী ভাবনা থাকায় মামলা খেয়েছিলেন।।


অনুবাদক পরিচিতি
কুলদা রায়
গল্পকার। প্রবন্ধকার।
নিউ ইয়র্কে থাকেন। 


Post a Comment

0 Comments