ইভান বুনিন'এর গল্প : মৃদু শ্বাস

ভাষান্তরঃ কুলদা রায়

কবরস্থানে পরিস্কার মাটির উপরে একটি নতুন ক্রুশ কাঠ দাঁড়িয়ে আছে। ওক গাছের এই ক্রুস কাঠটি বেশ শক্ত সামর্থ্য, বড়োসড়ো, মসৃণ। দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। 

এখন এপ্রিল মাস। কিন্তু দিনগুলো ধূসর। দূর থেকে যে কেউই নেড়া গাছগুলোর ভেতর দিয়ে কবরস্থানের সমাধীপাথর দেখতে পাবে। এটা বেশ নামী ক্যাথিড্রাল কবরস্থান। শহর হলেও এই কবরস্থানটিতে একটি গ্রামীন পরিবেশ আছে।


ঠাণ্ডা হাওয়া শিস কেটে যায়। শিস কেটে যায় ক্রুসকাঠের গোড়ায় রাখা পুষ্পগুচ্ছের ভিতর দিয়ে। ক্রুসকাঠে ব্রোঞ্জের তৈরি বড়ো ফলক রয়েছে। এতে একটি খুব চটপটে ও আকর্ষণীয় স্কুলবালিকার মাঝারী আকারের ছবি আঁকা আছে। তার চোখ দুটি হাসিখুশি আর অবাক করার মতো উজ্জ্বল। 
তার নাম ওলগা মেস্কারক্সি। 

সে ছিল ছোট্ট একটা মেয়ে। 

তার স্কুলের মেয়েরা চপল। তারা করিডোর ও ক্লাশরুমে কলরব করে। তাদের পরনে বিসদৃশ্য বাদামী কটকটে পোষাক। এদের সঙ্গে এই ওলগা মেয়েটিকে আলাদা করার উপায় ছিল না। তাকে দেখে খুব বেশি হলে কেউ হয়তো বলতে পারত, সুন্দরী, ধনী আর সুখী ছোট্ট মেয়েদের অন্যতম। কিন্তু সে বেশ বুদ্ধিমতি, আমুদে। ক্লাশের নীতিবাগিশ শিক্ষককে থোড়াই কেয়ার করতো। তারপর সে বেড়ে উঠতে শুরু করেছিল। ফুলের মতো ফুটে উঠছিল। সেটা বহুদিন ধরে নয়-- যেন ঘণ্টায় ঘণ্টায় তার এই বাড়বাড়ন্ত হচ্ছিল। চৌদ্দ বছর বয়সে, তার কোমর হয়েছিল সরু। কমনীয় পা দুটো। এর মধ্যে পরিপুষ্ট স্তনরেখা উঁকি দিচ্ছিল। এইসব দেহরেখার আকর্ষণ কোনো মানবিক ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। 

পনেরোতে রূপসী বলে তার নাম ডাক ছিল। তার স্কুলের বান্ধবীরা সে সময়ে কতো যত্নই না নিতো তাদের চুলের, তারা কী পরিস্কার পরিচ্ছন্নই না থাকত, আর তারা চলাফেরার মধ্যে ছিল সতর্ক আর সাবধানী। কিন্তু এসব ব্যাপারে ওলগার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কোনো কিছুকেই ভয় ছিল না। তার আঙ্গুলে কালির দাগ লেগে থাকে, মুখের লালচে আভা, এলোমেলো দুরন্ত তার চুল, অথবা তাড়াহুড়া করে যাওয়ার সময়-- ডিগবাজি খেয়ে পড়ে।  তখন তার হাঁটু বের হয়ে যায়।  তাতে তার কোনো মাথা ব্যথা ছিল না।

তার প্রতি কোনো পক্ষপাত ছাড়া বিবেচনা করলে তার অনেক অদেখা ব্যাপারই সামনে আসে। তার শেষ দুই বছরে স্কুলের সব কিছু থেকে সে আলাদা হয়ে ছিল। হয়ে উঠেছিল শান্ত সুন্দর, চৌকশ, চটপটে ও লাবণ্যময়। আর বুদ্ধির আলো তার চোখে দেখা যেতো। ওলগা মেস্কেরক্সির মতো আর কেউ এতো ভালো নাচতে পারত না। তার মতো দৌঁড়াতে বা স্কেটিং করার মতোও কেউ ছিল না। তার মতো এতো ভক্ত অন্য কারো জোটেনি। জুনিয়র ক্লাশে কিছু কিছু কারণে তার জনপ্রিয়তা ছিল অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। গোপনে গোপনে সে একটি বালিকায় পরিণত হচ্ছিল এবং গোপনে গোপনে তার খ্যাতি সারা স্কুলে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। সে খুবই চপলা, ভক্ত ছাড়া সে চলতে পারে না-- এ ধরনের কিছু রটনা ছিল। সেনশিন নামে একটি বালকের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক আছে বলেও ফিসফাস ছিল। এই প্রেমিকটির প্রতি কিন্তু তার ব্যবহার স্বাভাবিক ছিল না। ঘন ঘন তার মন বদলাতে লাগল। দেখে বেচারা ছেলেটি শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে…

জীবনের শেষ শীতে, ওলগা মেক্সারক্সি ফূর্তিতে সম্পূর্ণ লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছিল বলে স্কুলের কেউ কেউ বলেছিল। সেই শীতে খুব বেশি বরফ ঝরেছিল। রোদ ছিল অনেক। তুষার জমেছিল। তুষার ঢাকা স্কুলের বাগানের দীর্ঘকায় ফারগাছের পিছনে সূর্য আগে আগে ডুবে যেতো। তা সত্বেও এখানে সব সময়ই ছিল সুন্দর আর ছিল উজ্জ্বল আবহাওয়া। এর মধ্যে তুষার ঝরার লক্ষ্মণ ছিল। ছিল পরের দিনে সূর্য ওঠার প্রতিশ্রুতি। প্রতিশ্রুতি ছিল ক্যাথিড্রাল স্ট্রিটে হেঁটে যাওয়া যাবে, টাউন পার্কে স্কেটিং করা যাবে, হবে গোলাপী সূর্যাস্ত, থাকবে গানবাজনা। তার স্কুলের সবার মধ্যে ওলগা ছিল কোনো ধরনের উদ্বেগহীন। সুখীতম হওয়ার জন্য তার মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া ছিল না। 

একদিন বিনোদন কক্ষের মধ্যে দিয়ে ঘূর্ণিঝড়ের মতো খিপ্রগতিতে ছোট ছোট মেয়েরা তাকে তাড়া করছিল আর আনন্দে চিৎকার করছিল। হঠাৎ করে তখন হেডমিস্ট্রেস তাকে ডেকে পাঠালেন। সে হুট করে থেমে গেল। একটা গভীর শ্বাস নিল। স্বভাবমতো খুব তাড়াহুড়া করে তার চুলগুলো ঠিক করল। তার পরণের এপ্রোন কাঁধ পর্যন্ত টেনে তুলল। তারপর দীপ্ত চোখে উপরতলায় ছুটল।

হেড মিস্ট্রেস মানুষটি ছিলেন ছোটো খাটো আর তার চুল সাদা হলেও দেখতে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়েসী মনে হয়। রুশ সম্রাটের ছবির নিচে লেখার টেবিলে বসেছিলেন তিনি। হাত দিয়ে বুনছিলেন কোনো পোষাক। 

তাকে দেখে উলবোনা থেকে চোখ তুললেন না হেডমিস্ট্রেস। ফরাসী ভাষায় বললেন, ‘সুপ্রভাত মিস মেস্কারেক্সি।’ বললেন, ‘’ তোমার স্বভাব চরিত্র নিয়ে কথা বলতে এটাই প্রথমবার নয়, অনেকবারই তোমাকে ডেকে আনতে হয়েছে।’’ 

টেবিলের দিকে এগিয়ে এসে ওলগা উত্তর দিল, 'বলুন, আমি শুনছি ম্যাডাম।’’ হেডমিস্ট্রেসের দিকে সে উজ্জ্বল আর হাসিখুশি চোখ নিয়ে চেয়ে রইল। কিন্তু তার মুখ ছিল ভাবলেশ শূণ্য। আর সে সৌজন্যপ্রকাশের কোনো ধার ধারেনি। তার স্বভাব মতো এর মধ্যেই সে ছিল স্থির। 

‘'তুমি খুব হেলা ভরে আমার কথা শুনবে-- দুর্ভাগ্যবশত এটা বুঝতে আমার বাকি নেই।’’। হেডমিস্ট্রেস বললেন উলের সুতাকে একটু টান দিয়ে। মসৃণ ফ্লোরে বলটি ঘুরে ঘুরে সুতা খুলছে। ওলগা এটা খুব কৌতুহল নিয়ে খেয়াল করল। হেডমিস্ট্রেস তার চোখ তুললেন। বললেন, ‘’ আমি এককথা আর বারবার বলতে চাই না।এবারেই শেষ।"

ওলগার খুব ভালো লাগছিল এই চকচকে মসৃণ ফ্লোর আর উলের কাজটি। বেশ ঠাণ্ডা এই দিনটতে ঘরের মধ্যে উজ্জ্বল ডাচ ফায়ার প্লেস থেকে উষ্ণ হাওয়া ঘরটিকে আরামদায়ক করেছে। লেখার টেবিলের উপর উপত্যকার তাজা লিলি ফুল রয়েছে। সে তরুণ সম্রাটের ছবির দিকে তাকালো। জমকালো হলরুমের দেয়াল জুড়ে ছবিটা আঁকা হয়েছে। হেডমিট্রেসের সাদা চুলের মধ্যে সিঁথি কাটা। সুন্দর করে চুল দোলে। সে চুপ করে অপেক্ষা করে। 

‘'তুমি আর ছোটো মেয়েটি নেই।’’ অর্থপূর্ণভাবে হেডমিস্ট্রেস বললেন। এই কথার মধ্যে দিয়ে গুপ্ত রাগ বোঝানো শুরু করলেন। 

‘’হ্যাঁ ম্যাডাম। ওলগা প্রায় ফূর্তি ভরে স্বাভাবিক উত্তর করল। 

‘'কিন্তু এখনো তুমি  বড়ো হওনি।’’ হেডমিস্ট্রেস বললেন। তখনো তার গলায় তখনো অর্থপূর্ণ স্বর। তার রুগ্ন মুখ সামান্য উজ্জ্বল হলো। ‘’ প্রথম কথা হলো-- চুলগুলো ওরকম করেছ কেনো? মেয়েদের মতো চুল রাখো।’

‘'এটা আমার দোষ নয় ম্যাডাম। আমার সুন্দর চুল আছে।’ নিজের সুন্দর করে আচড়ানো চুল দুহাত দিয়ে ছুঁয়ে ওলগা উত্তর করল। 

‘'আ এটা কি তাই? তোমাকে দোষ দেওয়া হচ্ছে না!’ হেডমিস্ট্রেস বললেন। ‘ তুমি যেভাবে চুল বেঁধেছো তার জন্য তোমাকে দোষ দেওয়া হচ্ছে না। ঐ দামী চিরুনীর জন্য দোষ দেয়া হচ্ছে না। বিশ রুবল দামের জুতো কিনে তোমার অভিভাবকদের ফতুর করছ-- এর জন্যও তোমাকে দায়ী করা হচ্ছে না। কিন্তু আবারও বলি, তুমি এখনো কেবল একটি স্কুলবালিকা।’’ 

আর এখানে ওলগা তার স্বাভাবিকতা ও ধৈর্য নষ্ট করেই হঠাৎ করে তার নম্রতাকে ভেঙ্গে ফেলল। বলল--

‘'ক্ষমা করবেন ম্যাডাম। আপনি ভুল করছেন-- আমি  আর ছোটো নই, আমি পূর্ণ একজন নারী। আর, আপনি কি জানেন এজন্য কাকে দায়ী করা দরকার? এজন্য আমাদের প্রতিবেশি আলেক্সেই মিখাইলোভিচ মালিন্তিনকে দায়ী করতে হবে। তিনি আমার বাবার বন্ধু। তিনি আপনার ভাই। গত গ্রীষ্মে দেশে এটা ঘটেছিল…..’'
…………………………..

এই আলাপের এক মাস পরের ঘটনা। ট্রেন স্টেশনে সবে একটি ট্রেন এসে থামল। ভিড় করে লোকজন ট্রেন থেকে নামছে। ওলগা মাস্কেরাক্সির পরিচিত লোকজনের সঙ্গে কোন চিনপরিচয় নেই এমন একজন 
কুশ্রী আর চণ্ডাল চেহারার একজন কসাক অফিসার ট্রেন থেকে নামল। নেমে স্টেশনে একগাদা লোকের সামনে ওলগা মাক্সেরেক্সিকে গুলি করল। ওলগা মাক্সেরাক্সির মরার আগে  অবিশ্বাস্য এক স্বীকারোক্তি দিয়ে যায়। তখন খুনির পরিচয়টি সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।  এই  স্বীকারোক্তি হেডমিস্ট্রেসকে স্তদ্ধ্ব করে দেয়। 

খুনি কসাক অফিসার মৃতদেহ পরীক্ষাকারীকে বলেছিল,  এই কাজটি করার জন্য দায়ী আসলে মাক্সেরাক্সিই। তার সঙ্গে মেয়েটি ঘনিষ্ট সম্পর্ক রেখেছিল। তাকে বিয়ে করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। খুন করার দিনটিতে ট্রেন স্টেশনে নভোচেকাক্স শহরে চলে যাওয়ার কথা ছিল তার। হঠাৎ করে তখন মাক্সেরাক্সি তাকে জানায় যে, সে কখনোই তাকে বিয়ে করার কথা ভাবেনি। সে বিয়ে করার কথা বলে তার সঙ্গে এতোদিন  মজা করেছিল। তাকে বোকা বানিয়েছিল। তারপর সে, মাক্সিরাক্সি নামের মেয়েটি কসাক অফিসারকে তার নিজের ডাইরিটি দিয়েছিল। বলেছিল, পড়ে দেখো--তোমাকে নিয়ে কী লিখেছি।
‘এক ঝলক দেখলাম ডাইরির ওই পৃষ্ঠাগুলো।’’ বলেছিল  কসাক অফিসারটি। ‘  যখন পড়ছিলাম তখন  মাক্সিরাক্সি প্লাটফর্মে হাঁটাহাঁটি করছিল। আমার পড়া শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছিল। কোনো সুযোগ না দিয়ে আমি তাকে গুলি করলাম। আমার ওভারকোটের পকেটে ডাইরিটি আছে। দেখুন-- গত বছরের ১০ জুলাই তারিখে সে লিখেছে--''

এবং মৃতদেহ পরীক্ষাকারী ডাইরিটি  পড়ল। সেখানে মাক্সিরাক্সি লিখেছে--

‘এখন রাত প্রায় দুটো বাজে। আমার ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু অচিরেই জেগে যাই।… আজ আমি একজন পূর্ণ নারীতে পরিণত হয়েছি। বাবা, মা আর টয়লা-- সবাই শহরে গিয়েছে। আমাকে একা রেখে গিয়েছে। একা হতে পেরে কী যে খুশি লাগছিল তা বলতে পারি না। ভোরবেলা বাগানে হাঁটলাম। হাঁটলাম মাঠের মধ্যে। বনের মধ্যে গেলাম। মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবী আমার একার। এর আগে এরকম মজার চিন্তা আর কখনো করিনি। নিজে নিজেই দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর ঘণ্টাখানেক গান বাজালাম। এই গান শুনে মনে হলো আমি চিরকাল বেঁচে থাকব। এর আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে নিজেকে বেশি সুখী মনে হচ্ছিল। তারপর বাবার পড়ার ঘরে ঘুমিয়ে পড়লাম। 

চারটার সময় কাতিয়া আমাকে জাগালো। বলল, আলেক্সেই মিখাইলোভিচ মালিন্তিন এসেছেন। তাকে দেখে খুব খুশি হলাম। তাকে পাওয়াটা খুব আরামের। তাকে আপ্যায়ন করলাম। তিনি দুটো ঘোড়ায় টানা গাড়িতে এসেছেন । ভিয়েটকা প্রদেশের এই ঘোড়া দুটো খুবই সুশ্রী। তারা সামনের দরোজায় দাঁড়িয়ে রইল। বৃষ্টি হচ্ছিল। সেজন্য তিনি দেরি করছিলেন। আশা করছিলেন সন্ধ্যের মধ্যে রাস্তা শুকিয়ে যাবে। বাড়িতে বাবাকে না দেখে খুব দু:খ প্রকাশ করছিলেন। তিনি ছিলেন বেশ প্রাণবন্ত। আর খুব নম্র ব্যবহার করছিলেন আমার সঙ্গে। আমার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ প্রীতির সম্পর্ক রয়েছে বলে বেশ মজা করছিলেন। চা খাওয়ার আগে দুজনে বাগানে হাঁটলাম। আবহাওয়া ছিল খুব আকর্ষণীয়। সারা ভেজা বাগানের মধ্যে চমৎকার রোদ পড়েছে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে একটু ঠাণ্ডা পড়ে এলো। তিনি আমার হাত ধরাধরি করে হাঁটলেন। বললেন আমাকে, তুমি হলে মার্গারেট, আর আমি যেন ফাউস্ট। তাঁর বয়স ছাপ্পান্ন। কিন্তু দেখতে খুব আকর্ষণীয়। সবসময়ই তিনি সুন্দর পোষাক পরেন। তবে তিনি যখন ছোটো আলখাল্লা পরে আসেন সেটা আমার অপছন্দের। ইংলিশ অডিকলন সগন্ধি মাখেন তিনি। তার চোখ দুটো সবসময়ই তরুণ--কালো বর্ণের। তার লম্বা দাড়ি মাঝখান থেকে নিচের দিকে আকর্ষণীয়রূপে দুভাগ করা। দাড়ি সম্পূর্ণ পাকা। 

কাচ ঘেরা বারান্দায় বসে আমরা চা খেলাম। হঠাৎ করে আমার খারাপ লাগতে শুরু করল। তিনি ধুমপান করছিলেন। আর আমি তখন সোফায় শুয়ে পড়লাম। তখন তিনি আমার পাশে এসে বসলেন। খুব সুন্দর করে কথা বলতে শুরু করলেন। তারপর আমার টেনে নিলেন। হাতে চুমু খেলেন। একটি রুমাল দিয়ে আমার মুখ ঢেকে দিলাম। তিনি অসংখ্যবার সেই রুমালের উপর দিয়েই ঠোঁটে চুমু খেতে লাগলেন…. কিভাবে এটা ঘটছে আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। এরকম যে আমার হতে পারে তা কখনোই ভাবিনি। এরপর আমার একটাই উপায় আছে--সেটা হলো চলে যাওয়া… এক ধরনের ঘৃণা হচ্ছিল তার জন্য। এটা সহ্য করতে পারিনি।’’
…………………………………………………………………………………

এপ্রিলের এই দিনগুলোতে শহরটি পরিচ্ছন্ন আর শুষ্ক হয়ে উঠল। পাথরগুলো হয়ে উঠল সাদা। এই সাদা পাথরের উপর দিয়ে হাঁটা খুব সহজ আর আরামদায়ক হয়ে উঠল। প্রতি রবিবার, গীর্জায় আগত মানুষের ভীড় চলে গেলে একজন ছোটোখাটো মহিলা খুব বিষাদ নিয়ে হাঁটছিলেন ক্যাথিড্রাল সড়ক দিয়ে। এই সড়কটি শহরের বাইরে চলে গেছে। তার হাতে ছিল ছোটোদের কালো দস্তানা। সঙ্গে ছিল আবলুস কাঠের ছাতা। অগ্নিনির্বাপক অফিস এলাকা তিনি ছেড়ে গেলেন। রাস্তার পাশে নোংরা বাজার পেরিয়ে গেলেন। এ বাজারে অনেক কামারের দোকান আছে। এখানে মাঠ থেকে তাজা হাওয়া বয়ে যায়। একটু দূরে, আশ্রম আর জেলখানার মাঝখান দিয়ে সাদা আকাশ নেমে এসেছে ধূসর বসন্তের মাঠে। এরপরে আশ্রমের দেওয়ালের পিছনে মাটির সাঁকোর পার হয়ে গিয়েছে। এখান থেকে বায়ে ঘুরলে বড়ো নিচু বাগানের মতো জায়গা দেখা যাবে।  এর চারিদিকেই সাদা দেওয়াল ঘেরা। এর গেটে লেখা আছে-’ আমাদের গর্বের ভদ্রমহোদয়া’। এখানে ছোটো মতো মহিলাটি দ্রুত ছোট করে ক্রস চিহ্ন আঁকেন। তিনি সব সময়ই বড় রাস্তা দিয়ে হাঁটেন। ওকগাছের ক্রুশ কাঠের উলটো দিকে বেঞ্চির কাছে পৌঁছে বসে পড়েন।

এই শীতল হাওয়ার বসন্তে সেখানে তিনি বসে রইলেন এক ঘণ্টা কি দু ঘণ্টা সময়। হাল্কা বুটের মধ্যে তার পা আর শিশুদের দস্তানার ভেতর হাত ঠাণ্ডায় অসাড় হওয়া পর্যন্ত বসে রইলেন। এই ঠাণ্ডার মধ্যে পাখিরা মধুর সুরে গান গাইছে। তিনি এই গান শুনছেন। চিনামাটির ফুলের মালার গায়ে হাওয়া শিষ কেটে যাচ্ছে। তিনি এই শিষ কান পেতে শুনছেন। শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে ভাবেন-- তার চোখের সামনে মৃত ফুলের মালা দেখতে চান না। সেজন্য তিনি তার জীবনের অর্ধেক দান করতে রাজী আছেন। এখানে মাটির নিচে শুয়ে আছে ওলগা মাক্সিরাক্সি। বোকামির জন্য সে আশ্চর্যজনক এই মৃত্যুর সীমানায় ঝাঁপ দিয়েছে। তিন মাস আগেও সে ছিল প্রাণে ভরপুর, মনোমুগ্ধকর আর সুখী। তবুও কেনো এই ষোড়শী স্কুলবালিকা মাটির ডিপির নিচে চলে গেল? কেনো সে আজ ওক গাছের ক্রুসের নিচে আছে? এগুলো তিনি ভাবেন। যে বালিকার চোখে ছিল মৃত্যুহীন জীবনের ঝলক সে কেনো আজ একটি তামার ফলকের নিচে আছে? ওলগা মাক্সিরাক্সির উজ্জ্বল চোখের সঙ্গে এই ভয়ংকর ঘটনাটিকে কিভাবে মেলানো যায়?--তার আত্মার অন্তঃস্থলে ছোটো মহিলা সুখীই আছেন। সাধারণত যেসব মানুষ কোনো উৎসাহমূলক স্বপ্নে বিভোর থাকে, স্বাভাবিক থাকে, সুখী হয়, তিনি তাদের সবার মতোই একজন মানুষ। 

এই ছোটো মহিলাটি হলেন ওলগা মাক্সিরাক্সির ক্লাশ টিচার। তার বয়স তিরিশ। তিনি দীর্ঘকাল ধরে কিছু কল্পনার জগতে আছেন। এই কল্পনা বা বিভ্রমকেই তিনি তার প্রকৃত জীবনের অংশ করে নিয়েছেন। প্রথম কল্পনাটি ছিল ভাইকে নিয়ে। ভাইটি একজন দুঃখী লেফটেন্যান্ট। গুরুত্বপূর্ণ নন। এই ভাইটি তার আত্মার সঙ্গে গভীর বাঁধনে জড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আছে তার ভবিষ্যতের সঙ্গেও। তিনি কিছু কারণে অদ্ভুত সব কল্পনা করেন। তিনি একটি অদ্ভুত প্রত্যাশার মধ্যে বাস করেছিলেন।  ভেবেছিলেন তার ভাই বড়ো কেউ হবেন একদিন। এজন্য তার ভাইকে ধন্যবাদ। তার কপাল তাকে কিছু রূপকথার দেশে নিয়ে যায়। তারপর, যখন তার ভাই মুকদেন শহরে খুন হয়, তখন সে নিজেকে অত্যন্ত খুশীর সঙ্গে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, সে অন্যদের মতো নয়। সৌন্দর্যের বদলে, রমনীসুলভ আচরণের পরিবর্তে তার আছে বুদ্ধিমত্তা আর আগ্রহ। আদর্শের জন্য সে প্রাণ দিয়েছে।

এবং এখন ওলগা মাক্সিরাক্সি তার সব কল্পনা, দরদ আর আনন্দের প্রধান বিষয়। প্রত্যেক ছুটির দিনই সে ওলগার কবরস্থানে ছুটে যান। তার ভাইয়ের মৃত্যুর পরেই সে এই কবরস্থানে যাওয়ার অভ্যাসটি গড়ে তুলেছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি ওক গাছের ক্রুসকাঠ থেকে চোখ ফেরাতে পারেন না। ফুলে ঢাকা কফিনের মধ্য থাকা ওলগার ম্লান মুখটিকে মনে করেন। মনে করেন একদা স্কুলে তার সম্পর্কে কীসব কথাবার্তা শুনেছেন। একবার দুপুরের খাবারের সময়ে স্কুলের বাগানে হাঁটতে হাঁটতে ওলগা মাক্সিরাক্সি খুব তাড়াহুড়ার মতো করে লম্বাটে আর মোটাসোটা তার প্রিয় বান্ধবীকে বলেছিল--

‘'আমি বাবার বইগুলো পড়ছিলাম। মজার মজার অনেক পুরনো বই আছে। রমনীরা উপভোগ করতে চায় যে ধরনের সৌন্দর্য -- সে বিষয়ে পড়েছি। সেখানে অনেক কথাই লেখা আছে। তুই দেখ, তার সব কিছু মনে রাখতে পারি না। যাই হোক না কেনো, মনে আছে--অবশ্যই ফুটন্ত কালো আলকাতরার মতো কালো হবে চোখ--ঠিক বলছি তোকে -- ফুটন্ত আলকাতরার মতো কালো! ভ্রু হবে রাত্রির মতো। প্রথম আলোর মতো লালচে হবে তার ত্বক। দেহ হবে মেধহীন। সাধারণের চেয়ে সামান্য লম্বা হবে হাতের গড়ন। উপযুক্ত বড় ধরনের স্তন। স্বাভাবিক গোলাকার পা। খোসার ভেতরের মতো রঙ হবে হাটুর। উঁচু কাঁধ ঢালু হয়ে নামবে। হৃদয় দিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি সুন্দরের অনুষঙ্গগুলো। এর সবই ঠিক। কিন্তু তুই কি জানিস এরগুলোর মধ্য কোনটি বড়ো কথা?--মৃদু শ্বাস। এবং এটা আমার আছে। কিভাবে আমি শ্বাস নেই সেটা কান পেতে শুনে দ্যাখ। এটা কি মৃদু নয়? 

এখন এই মৃদু শ্বাস আবার পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে মেঘের মধ্যে। বসন্তের শীতল হাওয়ার মধ্যে…..

Post a Comment

0 Comments