দি আর্ট অফ ফিকশন: কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার


কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের চিন্তা থেকে কুলদা রায় ওয়াসি আহমেদের সাথে যোগাযোগ করেন। ফোনালাপে ওয়াসি আহমেদকে কুলদা রায় তাঁর ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলে নিভৃতচারী লেখক ওয়াসি আহমেদ সাক্ষাৎকার বিষয়ে তাঁর সম্মতি দেন। গল্পপাঠ টিমের তৈরি করা বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ওয়াসি আহমেদ। প্রশ্নের অধিকাংশ জুড়ে আছে তাঁর লেখালেখি- লেখার কলকব্জা। প্রাসঙ্গিক ভাবে আনুষঙ্গিক বেশ কিছু প্রশ্ন এসেছে। ওয়াসি আহমেদ সযত্নে সব প্রশ্নের উত্তর লিখে পাঠিয়েছেন। আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ-সম্পূরক প্র্রশ্ন হয়ত করা যেত। ভবিষ্যতের জন্য সেগুলো তোলা রইল। বাংলা সাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে ওয়াসি আহমেদের এই সাক্ষাৎকার লেখক ও মননশীল পাঠকের জন্য নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজন। সাক্ষাৎকারের প্রশ্নগুলো তৈরি করেছেন: দীপেন ভট্টাচার্য, কুলদা রায়, রুখসানা কাজল, রুমা মোদক, মোজাফ্ফর হোসেন, সাদিয়া সুলতানা, স্মৃতি ভদ্র এবং নাহার তৃণা।


গল্পপাঠ:
কীভাবে লেখালেখিতে এলেন? পরিবারে শিল্প-সাহিত্য চর্চার ঐতিহ্য কেমন ছিল?

ওয়াসি আহমেদ:
লেখালেখিতে আসার পেছনে মূলত বন্ধু-বান্ধবদের প্রভাব-প্ররোচনাই কাজ করেছে। পরিবারে পড়াশোনার জন্য উন্নত পরিবেশ থাকলেও শিল্প-সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে মোটেও তেমন ছিল না। পরিবারের কেউ--মায়ের দিক থেকে বা বাবার দিক থেকে--সাহিত্যচর্চা করেছেন শুনিনি। তবে খাতার পাতায় এক বয়সে ছড়া/কবিতা কে না মকশো করে! সে অন্য কথা।

কলেজে, ঢাকা কলেজে, ভর্তি হওয়ার পর এমন কিছু সাহিত্যানুরাগী বন্ধুদের সংস্পর্শে এলাম যারা পড়াশোনায় তো বটেই, চিন্তা-ভাবনায়ও আমার চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। ফলে অনেকটা তাদের সংসর্গের কারণেই সাহিত্য-দর্শন-রাজনীতি বিষয়ক পড়াশোনায় আমার ঝুঁকে পড়া। সেই সাথে তাদের দু-একজনের সাহিত্যপ্রয়াসও আমাকে পেয়ে বসেছিল। এ এক বিরল বন্ধুভাগ্য।

শুরুটা এভাবেই হয়েছিল। তারপরও বলব সেই শুরুতে স্থিরতা ছিল না। পরবর্তী কালে আমি যে তা ধরে রাখব বা লেখালেখি আমার জীবনযাপনের সহগামী হবে, তেমন কোনো জোরালো ইঙ্গিত ছিল বলে মনে হয় না।

গল্পপাঠ:
ছেলেবেলা থেকে কী ধরনের বইপত্র পড়তেন? সে সময় মনে খুব দাগ কেটেছিল এমন বইয়ের কথা কি এখন মনে পড়ে?
 
ওয়াসি আহমেদ:
ছেলেবেলায় নিজেদের বাসায় বা নানাবাড়িতে প্রচুর বই-পত্র দেখেছি। বাংলা বই, ইংরেজি বই ও দুষ্প্রাপ্য সিলেটি নাগরি অক্ষরে লেখা বেঢপ লম্বাটে বই। উল্লেখযোগ্য বাংলা বইয়ের মধ্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে বিদেশে’, যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’, অবধূতের ‘মরুতীর্থে হিংলাজ’, মীর মোশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’, গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’-র কথা মনে পড়ছে। ‘বিষাদসিন্ধু’ ও ‘বিশ্বনবী’ বই দুটি তখনকার দিনে প্রায় সব শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমান পরিবারে পাওয়া যেত-- গ্রাম-শহর নির্বিশেষে। এ ছাড়া বাংলা পত্রপত্রিকার মধ্যে বাঁধাই করা ‘মাহেনও’, ‘আল ইসলাহ’, ‘পাকজমহুরিয়াত’ এর কথা মনে আছে। আর একটা পত্রিকা ছিল, নাম সম্ভবত ‘পূবালী’; ভালো পত্রিকা, অবশ্য ভালো-মন্দ সে বয়সে যাচাই করার অবস্থা ছিল না। বেশ পরে পত্রিকাটা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে এর মান সম্বন্ধে নিঃসংশয় হয়েছিলাম। আমার মা-বাবা নানা ধরনের বই পড়তেন, তবে সে সময় কোন বই আমার মনে দাগ কেটেছিল বলা মুশকিল। হতে পারে শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’ বা নীহার গুপ্তের কোনো বই। ‘রিক্তর বেদন’ কার লেখা মনে করতে পারছি না, মনে যেটুকু আছে-- বেশ সাশ্রুনয়নে পাঠ সম্পন্ন হয়েছিল। তবে একে দাগ কাটা বলা চলে না। আসলে ছেলেবেলায় আমার পড়াশোনা পাঠ্য বইয়েই আটকে ছিল।

গল্পপাঠ:

শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে। কবিতার বইও আছে বেশ কয়েকটি। পরে গল্পে চলে এলেন। কবিতার কাছ থেকে গল্পের জন্য কী নিয়েছেন?

ওয়াসি আহমেদ:

কয়েকটি না, কবিতার বই একটিই। ছেলেমানুষি ব্যাপার। কলেজে পড়াকালীন দৈনিক বাংলায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার পর কণ্ঠস্বরে কবিতা ছাপা হয়ে যাওয়াই সম্ভবত এর কারণ। সেই সাথে বন্ধুদের ইন্ধনও ছিল-- বিশেষ করে আফসান চৌধুরীর, যিনি আমার কবিতার বইয়ের শুধু হুজুগে প্রকাশকই নন, প্রচ্ছদকারও বটেন। ছাত্রাবস্থায় কবিতা ছাড়াও নানা ধরনের লেখা লিখেছি। পারিকল্পিত লেখা বলা যাবে না। পুস্তক সমালোচনা, মহিলা সমিতিতে মঞ্চস্হ নাগরিক বা থিয়েটারের নাটকের ওপর আলোচনা(যা রামেন্দু মজুমদারের থিয়েটার-এ ছাপা হতো)। অনুবাদসহ সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধও কিছু কিছু লেখা হয়েছিল। রফিক আজাদের প্রথম কবিতার বই ‘অসম্ভবের পায়ে’ ও হুমায়ূন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’-র সমালোচনা লিখেছিলাম। নন্দিত নরকে-র ওপর লেখাটা ছাপা হয়েছিল কণ্ঠস্বরে।

গল্পে এসেছি বেশ পরে, গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি। কবিতার কাছ থেকে গল্পের জন্য কিছু নিইনি। গল্প লিখতে গিয়ে কী লিখব, কেন লিখব ঠিক করেই শুরু করেছি। কবিতা-পর্ব থেকে গল্প-পর্ব একদমই আলাদা।

গল্পপাঠ:
শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল? আখ্যান এবং আঙ্গিকের দিক থেকে আপনি আপনার সমকালে নতুন পথে হেঁটেছেন। সাহিত্যে নিজের সিগনেচার তৈরির বিষয়ে আলাদা করে কি কোনো চিন্তাভাবনা ছিল?

ওয়াসি আহমেদ:
ওই যে বললাম গল্প লিখতে বসেছি বেশ পরে, আর কী লিখব নিয়ে যেমন ভেবেছি, তেমনি কেন লিখব-র জবাব পাওয়াটাও ছিল জরুরি। ফলে শুরুর দিকের লেখাগুলোকেও লেখালেখির যাত্রায় একটা পর্যায় হিসেবেই দেখি।

নতুন পথে হাঁটাব তেমন কোনো সচেতন প্রয়াস ছিল বলে মনে হয় না। যা ছিল, তা নিজের উপলব্ধিকে নিজের মতো করে ধরার ইচ্ছা বা চিন্তা-ভাবনা।

গল্পপাঠ:
আরেকটা বিষয় লক্ষ করা যায়, বিশেষ করে আপনার গল্পে, আপনি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষায় পরিবর্তন এনেছেন। শুরুর দিকে মানবিক এবং ব্যক্তিগত গদ্য পরের দিকে এসে নৈর্ব্যক্তিক হয়ে উঠেছে। একদিকে তারুণ্যের দ্রোহ, অন্যদিকে শিল্পের জিজ্ঞাসা—এই দুয়ের বোঝাপড়া কি কখনো করতে হয়েছে? 
 
ওয়াসি আহমেদ:
সময়ের সঙ্গে যতটা হয়েছে তার চেয়ে বরং বিষয়ের প্রয়োজনে বা চাপেই ভাষা বদলেছে। শুরুর দিকে আমার গদ্য কি ব্যক্তিগত ছিল, সেই সাথে মানবিক? ভাষার মানবিক-অমানবিক বলে কি কিছু আছে? পেছন ফিরে নিজের গল্পভাষা নিয়ে ভাবলে মনে হয় আমি বরাবরই মিতাচারিতা বা রেটিসেন্সকে ভাষার অন্যতম শক্তি হিসেবে দেখেছি। সেই সাথে নৈব্যক্তিকতাকেও।

লিখতে গিয়ে তো কত ধরনের বোঝাপড়াই করতে হয়, শিল্পকে ক্ষুণ্ন না করে যতটা সম্ভব। একটা বিষয় বরাবর মেনে চলি, তা হলো-- লেখালেখি জিনিসটা প্রথম ও শেষ বিচারে শিল্প, সুতরাং শিল্পকে আমার প্রয়োজনে যেভাবেই খাটাই, তা হতে হবে শিল্পসম্মত-- যার কোনো মাপজোখ নেই। কথাটা হয়তো বেশি সোজা-সরল হয়ে গেল, বিশেষ করে শিল্পসম্মত বলাটা। ব্যাপরটা সাবজেকটিভ। নিজের বিচার-বিবেচনাই শেষ কথা।
 
গল্পপাঠ:
গল্পের বীজ কোথা থেকে পান? আপনি গ্রামের মানুষ নন। শহরে থেকেছেন। পড়াশুনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাকরি জীবন ছিল শহরভিত্তিক এবং বিদেশ। কিন্তু আপনার অনেক আখ্যান, চরিত্রগুলো গ্রামজীবনের, আধা শহরের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তদের থেকে এসেছেন যা আপনি যাপন করেননি বলে মনে হয়। তাহলে এই জীবনটা আপনি পেলেন কীভাবে?
 
ওয়াসি আহমেদ:
গল্প তো চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। কথা হলো, কোন গল্পটা আমাকে তাড়া করছে বা আমি কোন গল্পের পিছু নিয়েছি। যেভাবে এত দিন লিখে এসেছি তাতে মনে হয় একটা আপাত-তুচ্ছ বিষয় বা ঘটনা যাতে গল্পের তথাকথিত কোনো মাল-মশলা নেই, তাও হয়ে উঠতে পারে বিপুল শাখাপ্রশাখাময় এক গল্প-মহিরুহ।

আমি শহরে বাস করছি দীর্ঘদিন, তার মানে এই নয় গ্রাম আমার অচেনা। গ্রামে বাস না করেও গ্রামলগ্ন হওয়া যায় না তা তো না। বাংলাদেশের সব অঞ্চলের না হলেও বেশ কিছু অঞ্চলের গ্রাম আমার খুব কাছ থেকে চেনা। তবে গ্রাম যে বদলাচ্ছে, দ্রুত বদলাচ্ছে, তাও ঠিক। ফলে শৈশব-কৈশোর যার গ্রামে কেটেছে, নিবিড়ভাবে কেটেছে, তার পক্ষেও কি এই রূপান্তরের ব্যাপারটা ধরা সহজ, যদি না সেই চোখ থাকে-- দেখার ও উপলব্ধির?

গল্পপাঠ:
শুরু থেকে আপনি উপন্যাসের চেয়ে গল্পে বেশি সচল। গল্পে বেশি সক্রিয় হওয়ার বিশেষ কোনো কারণ আছে?
 
ওয়াসি আহমেদ:
আমি মূলত গল্পলেখক, যদিও কয়েকটা উপন্যাস লিখেছি। ছোটগল্পের পরিধিগত সীমাবদ্ধতা আমার কাছে বরাবরই চ্যালেঞ্জিং। বলতে পারেন, সেজন্যই গল্প লেখা। গল্পের সীমিত পরিসরে যেটুকু বলা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি অকথিত, অব্যক্ত, ব্যাখ্যাপ্রবণ রাখা যায়-- পাঠককে সহগামী করা যায়। এই যে সীমার মধ্যে অসীম, এটাই চ্যালেঞ্জের মূল কথা। আর আমার নিজের গল্পভাবনার যে ধরন-ধারণ, তাতে মনে হয়েছে গল্পে আমি অনেক স্বাধীন-- চিন্তায় ও প্রকাশে।

গল্পপাঠ:
উপন্যাসে সেরকম মনে না হওয়ার কী কারণ? না-কি গল্পের প্রতি পক্ষপাতই এর মূলে?

ওয়াসি আহমেদ:
উপন্যাস লিখতে গিয়ে লক্ষ করেছি আমার ভাষা বদলে যায়। গল্পে ভাষাটা এমনিই আসে, বিষয়ের সাথে তাল রেখে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আসে, উপন্যাসে আমার ক্ষেত্রে তেমন হয় না। উপন্যাসে সে অর্থে আমি পরাধীন। গল্পের প্রতি আমার প্রবল পক্ষপাতের এও এক কারণ। একান্তই ব্যক্তিগত অনুভূতি। অন্য কারণ হতে পারে, পড়াশোনোর শুরু থেকেই গল্প অনেক বেশি টেনেছে। রবীন্দ্রনাথ ও তিন বন্দোপাধ্যায় যেমন আমার পঠন-পাঠনে বড় জায়গা জুড়েছিলেন-- সেই সঙ্গে নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়, মুস্তাফা সিরাজ ও আরো অনেকে, তেমনি সে-সময়ই জয়েসের ‘ডাবলিনার্স’-এর কয়েকটা গল্প, কিপলিং ও বোরহেসের কিছু বিদ্যুচ্চমকময় আঁটসাঁট গল্প আমাকে বলতে গেলে বিমূঢ় করে দিয়েছিল। শুরুর সেই ভালো লাগার অভিঘাত অনেক দিন বয়ে বেড়াতে হয়েছিল। পরে তো গল্পপাঠ অনেক বেড়েছে। স্বল্পপরিচিত অনেকের গল্পও আমাকে আলোড়িত করেছে। পোলিশ লেখক ব্রুনো সাল্জের গল্পের বই ‘দ্য স্ট্রিট অফ ক্রকোডাইলস’ বা মার্কিন লেখক জন মারের ‘আ ফিউ শর্ট নোটস অন ট্রপিক্যাল বাটারফ্লাইজ’ পড়ে সেরকম অনুভূতিই হয়েছিল। বাংলা ভাষায় একজন প্রায় অখ্যাত লেখকের কথা বলতে পারি-- বাসুদেব দাশগুপ্ত, যার গল্প এক সময় বেশ নাড়া দিয়েছিল, কিংবা মানিক চক্রবর্তীর দু-তিনটা গল্প। খ্যাতিমানদের মধ্যে অমিয়ভূষণ মজুমদার, অমর মিত্রের কয়েকটা গল্প তো বহু দিন মাথায় গাঁথা হয়ে রয়েছে। আর হাতের কাছে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, বিপ্লব দাস, কায়েস আহমেদ তো ছিলেনই। নাম করতে গেলে দেশি-বিদেশি অনেকের কথাই বলতে হয়।



গল্পপাঠ:
অথচ আপনি যখন লিখতে আসেন তখন বাংলাদেশে সময়টা ছিল উপন্যাসের।
 
ওয়াসি আহমেদ:
এ কথা সত্য যে আমি ও আমার সহযাত্রীরা যখন গল্পে এসেছিলাম, তখন দেশে গল্পের চেয়ে উপন্যাস অনেক বেশি সরব ছিল। পত্র-পত্রিকা যা ছিল তাতে অবশ্য গল্প লেখার জায়গার অভাব হতো না, আর গল্প লিখতামই-বা কজন! তবে গল্পের বইয়ের প্রকাশক জোটানো কঠিন ছিল। তারপরও লিখতে গিয়ে গল্প নিয়েই থেকেছি।


গল্পপাঠ:
লেখার শুরুতেই কী আপনি আখ্যান নির্মাণের রূপরেখা তৈরি করে নেন, নাকি লেখা শুরু করার পর বিচ্ছিন্ন ভাবনারা আপনার গল্পের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে?
 
ওয়াসি আহমেদ:
মোটামুটি একটা রূপরেখা থাকে, রূপরেখা না বলে আবছা গড়ন বলা যেত পারে। তবে গল্পটাকে কোথায় নিয়ে যাব এ নিয়ে ধারণা আগে থেকে থাকলেও লিখতে লিখতে তার গতি-প্রকৃতি বদলাতে পারে। ভাষা তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে নেয়। একটি বাক্য বা বাক্যাংশও অত্যন্ত তাৎপর্যাবাহী হয়ে উঠতে পারে। আবার লেখা চলতে থাকা অবস্থায় নতুন ভাবনাও যুক্ত হতে পারে। সবই নির্ভর করে কী নিয়ে লিখছি তার ওপর।

গল্পপাঠ:
আপনার লেখায় বা দর্শনচিন্তায় কোনো লেখক প্রভাব ফেলেছেন কি?
 
ওয়াসি আহমেদ:
এ নিয়ে সেভাবে ভাবিনি। প্রভাব থাকাই স্বাভাবিক। অনেক বিষয়-আশয় রয়েছে যা নানা লেখকের লেখায় পেয়েছি আর সেসব এমনভাবে নিজের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে মিশে গেছে যে কোথা থেকে কী আমার লেখায় বা চিন্তায় ভর করেছে বলা মুশকিল।

গল্পপাঠ:
মানুষের চরিত্র আপনার সাহিত্যে একরৈখিক নয়৷ নিম্নবিত্তের কিংবা মধ্যবিত্ত সবাই বিপরীত মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। চরিত্র নির্মাণে কী ভাবনা আপনাকে প্রভাবিত করেছে? 
 
ওয়াসি আহমেদ:
মানুষের জীবন একভাবে, সোজা পথে হাঁটে না, তেমনি দুজন মানুষের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাও এক নয়। লিখতে গিয়ে যেহেতু প্রধাণত মানুষ নিয়ে লিখেছি, পরিবেশ-পরিস্থিতি তাদের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলে বা একটা পরিস্থিতিতে একজন ব্যক্তি কীভাবে নিজেকে ও তার চারপাশকে দেখছে, অন্যদের দেখছে, তার মানসিক প্রতিক্রিয়া কেমন হচ্ছে এসব তো বরাবরই ভাবিয়েছে। বলা নিষ্প্রয়োজন, লেখকমাত্রেই ব্যাপারটা মোটামুটি এক। দেখার ও উপলব্ধির ধরন একজন থেকে অন্যজনের আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে এই দেখার পেছনে অবশ্যই কাজ করে লেখক নিজে তার চরিত্রটিকে কীভাবে দেখছেন তার ওপর। এখানে লেখকের নিজের জীবনদর্শন কোনো না কোনাভাবে আলো ফেলে।
 
 
গল্পপাঠ:
আপনার অধিকাংশ লেখার মূল বিষয়বস্তু সামাজিক অসঙ্গতি, রাষ্ট্রীয় নিষ্পেষণ। ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বোঝাপড়া। আপনার কি মনে হয়, বর্তমানে এসে সাহিত্য এই কাঠামোর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে?

ওয়াসি আহমেদ:
সাহিত্য নিয়ে এমন আশা করি না। সাহিত্য দিয়ে যা হয় তা একটা অনুভূতির বা আবেগের সঞ্চার। লেখক যখন নানাবিধ চাপে লিখতে বসেন তখন তার লক্ষ্য থাকে প্রথমত নিজেকে ভারমুক্ত করা। আর লেখার মাধ্যমে তার মনোভাব পাঠকের মনে সঞ্চারিত করা গেলে সেটা হয় বাড়তি পাওনা। বিষয়টাকে আমি এভাবেই দেখি।
 
গল্পপাঠ:
কার জন্য গল্প লেখেন? পাঠকের জন্য না নিজের জন্য, নাকি উভয়ের জন্য? 
 
ওয়াসি আহমেদ:
আগেই বলছি লেখকের লেখাজোখা প্রথমত নিজেকে ভারমুক্ত করতে। আমারও তাই। একটা সময় ছিল লেখা হয়ে গেলে সে লেখা টেবিলেই অনেক দিন পড়ে থেকেছে, হারিয়েও গেছে কখনো কখনো। সেদিক থেকে দেখলে আমি বলব নিজেকে চাপমুক্ত করতেই লিখি। পাঠক পড়বে, পড়ে কী ভাববে এ চিন্তা মাথায় নিয়ে আমার পক্ষে লেখা সস্ভব নয়।

গল্পপাঠ:
মিডিয়া ও প্রযুক্তির এই কালে এসে উপন্যাসের ভবিষ্যত কী? বা সাহিত্যকেই আপনি কোন অবস্থান থেকে দেখেন? 
 
ওয়াসি আহমেদ:
বছর কয়েক আগে ‘উপন্যাসের মৃত্যু’ নামে একটা ছোট প্রবন্ধ লিখেছিলাম। লেখার কারণ ছিল ব্রিটিশ লেখক উইল সেল্ফের একটা নিবন্ধ। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় তিনি লিখেছিলেন : The novel is dead, this time for real.

উপন্যাসের আশু মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করে তিনি যুক্তি দেখিয়েছিলেন, প্রযুক্তি ও মিডিয়া আগ্রাসনের এ সময়ে সস্তা বিনোদনের এত হাতছানি থাকতে উপন্যাসের মৃত্যু ঠেকানোর উপায় নেই। মন্তব্যটি উইল সেলফ করেছিলেন বড় পরিসরের সিরিয়াস উপন্যাসের প্রসঙ্গ টেনে। উইল সেল্ফের বহু আগে গত শতকের গোড়ার দিকে স্পেনীয় দার্শনিক ওর্তগা গাসেত উপন্যাসের মৃত্যু পরোয়ানা জারী করেছিলেন এই বলে যে সমাজে উপন্যাসের উপযোগিতা নেই।

সে যা-ই হোক। নিজের মতামত যে কেউ যেমন খুশি প্রকাশ করতেই পারেন। আমার কখনো মনে হয় না সৃজনশীল লেখালেখি--তা গল্প হোক বা উপন্যাস--আগামীতে মানুষ পড়বে না। পড়বে এ জন্য যে, সৃজনশীল রচনা তাকে নিজের ও আশপাশের দিকে তো বটেই, অতীত ও ভবিষ্যতের দিকেও তার দৃষ্টি ও চিন্তাকে নিবিষ্ট করার ক্ষমতা রাখে, সেই সাথে নতুন ভাবনায় প্ররোচিত করতেও-- যা অন্য কিছুতে হওয়ার নয়। ভিসুয়্যাল মিডিয়ার মধ্যে নাটক-সিনেমায় অনেকটা হয়, তবে একটা ভালো উপন্যাস পড়তে গিয়ে--ধরা যাক ‘নীলকণ্ঠ পাথির খোঁজে’ বা ‘খোয়াবনামা’ বা ‘ডক্টর জিভাগো’--লেখকের সঙ্গে পাঠকের যে নীরব, গভীর, সংগোপন যোগাযোগ (কমিউনিয়ন) গড়ে ওঠে তার তূল্য কী হতে পারে!


গল্পপাঠ:
রাইটারস ব্লকে কি আক্রান্ত হয়েছেন কখনো? হলে কীভাবে এই ব্লক কাটিয়েছেন?
 
ওয়াসি আহমেদ:
রাইটারস ব্লক সব লেখকের ক্ষেত্রেই কমবেশি ঘটে, বিশেষ করে যারা বেশি বেশি লিখেন। এটা মোকাবিলার পথ একেকজনের একেক রকম। আমি নিজে যেহেতু কম লিখি, লেখা না এলে হাত গুটিয়ে বসে থাকি, রাইটারস ব্লকে আক্রান্ত হওয়ার তেমন ঘটনা ঘটেনি। তবে আমার মনে হয়, যিনি গল্প-উপন্যাস লেখেন, তিনি তখন অন্য কিছু লিখলে আক্রান্ত হওয়ার ভোগান্তি অনেকটা লাঘব হতে পারে।

গল্পপাঠ:
লাইফ এন্ডস পিসফুলি সিক্স মিটারস বিফোর—আপনার বেশ কিছু লেখায় মুক্তির অমোঘ উপায় আত্মহত্যা। নৈরাশ্যবাদ আপনার সাহিত্যকে কী প্রভাবিত করে?
 
ওয়াসি আহমেদ:
মুক্তির এমন নিদান লেখক হিসেবে আমি দিতে পারি না, দিইও নি। ব্যাপারটা আমার গল্পের চরিত্রের। সাস্প্রতিককালে একটা গল্প লিখেছি ‘শিশিযাপন’ নামে যেখানে বিষয়টা অনেকটা খোলামেলাভাবে এসেছে। এ গল্পে যে গ্রামের কথা বলা হয়েছে সেখানে আত্মহত্যাকে মানুষ আত্মহত্যা বলে না, তারা বেঁচে থাকার যন্ত্রণা উপসমের জন্য ঘরে বিষের শিশি মজুত রাখে, অনেকটা ওষুধের মতো-- কখন কাজে লাগে বলা তো যায় না। এটা সত্যি সত্যি উত্তরাঞ্চলের একটা বড় গ্রামের কাহিনি। গল্পে গ্রামের নামটা বদলে দিয়েছি। এ নিয়ে কয়েক মিনিটের একটা ডকু ফিল্মও হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। করেছিলেন সম্ভবত শাইক সিরাজ। গ্রামটা আত্মহত্যার গ্রাম বলে পরিচিতি পেয়েছিল। বছরে আট-নটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটত। ব্যাপারটাকে গল্পে পল্লবিত করতে নানা কিছু যোগ করেছি, সেই সাথে বিষয়টাকে অনুধাবন করতেও। একটা ঘটনা দেখে বা শুনে আলোড়িত হলেই চলে না, তাকে নিজের মতো ইন্টারপ্রেটও করতে হয়।
 
নৈরাশ্য ও হতাশা থেকে লেখার তাড়না তৈরি হলেও লেখককে নৈরাশ্যবাদী ভাবার কারণ নেই। অনেক সময় তো এমন হয়, পরিত্রাণহীন নৈরাশকে বুক চিরে দেখাতে হয়। তাই বলে এ থেকে উত্তোরনের জন্য অযৌক্তিক আশা-ভরসার কথা শোনানোর মতো ইনোসেন্ট আমি নই। যারা এটা পারেন তারা আমার ঈর্ষার পাত্র।

গল্পপাঠ:
ডলফিন গলির কুকুরবাহিনী গল্পটি লিখেছেন ১৯৮৬ সনে। তখন দেশে এরশাদের সামরিক শাসনকাল চলছে। দেশে ভয়ানক ত্রাসের রাজত্ব চলছে। ছাত্ররা ফুঁসে উঠেছে। তাদের মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই গল্পটি নির্মেদ বিবরণীর মতো। কোনো পাত্রপাত্রী নেই। শেষে এসে বলছেন এই কুকুরগুলোর সঙ্গে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চলে গেছে। এইখানে এসে আমরা একজন পাত্রকে পাই। না, তিনি কোনো একজন নয়। সমষ্টি মানুষ। এই রকম করে লেখার চিন্তাটা কীভাবে পেয়েছিলেন? 
 
ওয়াসি আহমেদ:
শুধু এরশাদের শাসন আমল কেন, এতে সব শাসন আমলের চিত্রই পাওয়া যাবে। পাত্র-পাত্রী দেশের আপামর মানুষ, যারা এক অর্থে কুকুরের সঙ্গে জীবন ভাগাভাগি করে চললেও নিজেরা তারা তা জানে না। ফলে মৃত কুকুরদের যখন সিটি কর্পোরেশনের ট্রাকে চড়িয়ে বিদায় করা হয়, তারা প্রথমে খুশি হলেও অল্প সময়েই নানা সংকটে পড়ে, এবং একসময় কুকুরদের সঙ্গে নিজেদের কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চালান হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তাদের সচকিত ও সন্ত্রস্ত করে তোলে।

গল্পটা যে-সময় লেখা তখন আমি লেক সার্কাসের ডলফিন গলিতেই থাকতাম। রাতে কুকুরের হল্লাগোল্লায় ঘুম কেটে যেত। গল্পের এটুকু নিখাঁদ বাস্তব। বাকিটুকু, আসলটুকু, বানানো। গোড়ার দিকে লেখা এ গল্পটি আমার এখনো প্রিয়।

গল্পপাঠ:
আপনার ‘বক ও বাঁশফুল’ গল্পে মিথ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে মিথই কি আপনাকে গল্পটি লিখতে প্ররোচিত করেছিল নাকি গল্পে আপনি জীবনের যে গূঢ়তার সন্ধান দিতে চেয়েছেন সেই ভাবনার ডালপালা প্রসারিত করতেই আপনি মিথের আশ্রয় নিয়েছেন?
 
ওয়াসি আহমেদ:
দুটোই, একটি অপরটির পরিপূরক হয়ে এসেছে। মিথ হচ্ছে কালেকটিভ আনকনশাস যা নানাভাবে আমাদের জীবন ঘেঁষে থাকে, কখনো মিশে থাকে, এবং অলেক্ষ্যে আমাদের পরিচালনা করে, এমনকী শাসনও করে। একটা জনপদের মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাস, পছন্দ-অপছন্দ, সংস্কার ও নানা ধরনের আত্মিক দ্বন্দ্ব ধারণ করে মিথ এক অমিত শক্তি হয়ে টিকে থাকে। এ গল্পে মিথকে সেভাবেই দেখেছি।

গল্পপাঠ:
দেশীয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে আপনার 'মেঘসাঁতার' গল্পের বিষয়বস্তু বেশ অভিনব। এমন একটি গল্পের বীজ আপনার ভেতর কীভাবে অঙ্কুরিত হলো?
 
ওয়াসি আহমেদ:
আমার কিছু গল্পে মনোবিকার (কোথাও কোথাও মনোবিকলন!)একটা অবস্থান নিয়ে নিয়েছে দেখতে পাচ্ছি। একে কি অভিনব কিছু বলা যাবে? পরিবেশ-পরিস্থিতি মানুষকে, বিশেষত ব্যক্তি মানুষকে, কত কী ভাবায়, করায়। সে নিজে কি জানে কী পরিস্থিতি তার সামনে রয়েছে? সে যে অনিশ্চিত জীবনযাপন করে, তাতে সে জানে না কোন পরিস্থিতিতে সে কেমন আচরণ করবে। হতে পারে, সাবকনশাস তার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, হতে পারে দীর্ঘ দিনের চাপা (রিপ্রেসড) অনুভূতি তাকে তার অজান্তেই চালিত করে, কখনো সহিংসও করে তোলে। শেষটা ফ্রয়েডিয় ব্যাখ্যা।


গল্পপাঠ:
আপনার 'খাঁচা এবং অচিন পাখি' গল্পটি বাংলা সাহিত্যের একটি শক্তিশালী সংযোজন হিসেবে ধরা যায়। গল্প টি লেখার পর কি আপনার মনে হয়েছিল এটি আপনার গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে? এ গল্পের পেছনে কোনো গল্প আছে?
 
ওয়াসি আহমেদ:
না, মোটেও তেমন কিছু মনে হয়নি। এ গল্পটা একটা বিশেষ কারণে আমার কাছে স্মরণীয়।

সুলেমান নামে যে চরিত্রটিকে নিয়ে এ গল্প, সে বাস্তবে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ। তার নামও তাই-- সুলেমান। সে একজন যুদ্ধাহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, মোহাম্মদপুরে একটা সরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে তার ঠাঁই হয়েছিল। কারো কাছে সে বিপথগামী, কারো কাছে খেপাটে।

সুলেমানের কথা প্রথম জানতে পারি সাংবাদিক-ইতহাসবিদ বন্ধু আফসান চৌধুরির কাছে। এও জানতে পারি, আফসান সুলেমানকে নিয়ে একটা দীর্ঘ কবিতা লিখছেন ইংরেজিতে-- নাম ‘কনভারসেশন উইথ সুলেমান’। ফুলস্কেপ সাইজের এক তাড়া কাগজে টাইপ করা খসড়া কবিতাটি আমরা দুজন মিলে একাধিকবার পড়ি। একজন পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে এ কবিতায় যে তীব্র ক্ষোভ ও যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে তা আমাকে বিহ্বল করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন-আশা-ভরসার ধ্বংসাবশেষের ওপর বসে একজন পঙ্গু যোদ্ধাকে নিয়ে লেখা এ কবিতা এক অসামান্য সৃষ্টি। এত ঝাঁঝালো, এত আর্দ্র, এত অসামান্য রূপকল্পময়! কবিতাটি পরে বই আকারে বেরিয়েছিল।

নব্বুই এর গোড়ার দিকের কথা। একদিন খবর পাই সুলেমান বেঁচে নেই। মরে গিয়ে সুলেমান আমার মাথায় হানা দিতে থাকে। আমি তখন গল্পটা লিখি এবং নাঈম হাসানের বেজায় অনিয়মিত পত্রিকা নিরন্তর-এ তা ছাপা হয়। মজার ব্যাপার হলো, আফসান চৌধুরি তখন গল্পটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। অসাধারণ অনুবাদ! বোরহেসের ভাষায় বললে : মোর অথেনটিক দেন দ্য অরিজিনাল।

গল্পটির প্রসঙ্গে এই ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ এসেই পড়ে। বলা যায় আমার ক্ষুদ্র লেখালেখি জীবনে এ এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। ঘটনাটা পরে আমাকে নানাভাবে উজ্জীবিত করেছে এবং আজো করে। এ গল্প নিয়ে আমার অনুভূতি এটুকুই। একটা পরিকল্পনা আছে-- আমার এ গল্প ও আফসান চৌধুরির কবিতা নিয়ে একটা ছোট বই করার, সঙ্গে যোগ হবে আমাদের দুজনের জবানিতে এই যৌথ লিখনক্রিয়ার গল্প। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই এমন পরিকল্পনা।


গল্পপাঠ:
উপন্যাসে ইতিহাস আপনার পছন্দের বিষয়। কিন্তু এক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রত্যক্ষ বয়ান নয়, সম্ভাবনার দিকটি আপনি তুলে ধরেন। তলকুঠুরির গানের মতো ঐতিহাসিক উপন্যাস বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। নানকার প্রথা ও বিদ্রোহ নিয়ে সম্ভবত একমাত্র উপন্যাস। ইতিহাসের পাঠ হিসেবে কেউ এই উপন্যাসকে গ্রহণ করতে চাইলে আপনি কতটা উৎসাহ দেবেন? 
 
ওয়াসি আহমেদ:
উপন্যাস কেন ইতিহাসের পাঠ হতে যাবে? ইতিহাসে যা আছে বা নেই তাকে একটা আখ্যানের ভিতর দিযে পাঠকের মনে সঞ্চারিত করা আর ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ পাঠ নেওয়া এক হতে পারে না। লিখতে গিয়ে যথেষ্ট সাবধান ছিলাম যাতে কেউ একে স্রেফ ঐতিহাসিক আখ্যান হিসেবে না নেন। বিস্তর ইতিহাসভিত্তিক ঘটনা থাকলেও আমি ইতিহাসকে পাশ কাটিয়েই এগিয়েছি, আর তা করতে গিয়ে এবং সেই সময়কে ধরিয়ে দিতে অনেক বানোয়াট গল্প জুড়েছি, যার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। 
 
গল্পপাঠ:
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীর প্রেক্ষাপট থেকে লিখেছেন সর্বশেষ উপন্যাস 'বরফকল'। শেফালি বেগমের পালিয়ে বেড়ানো জীবনের গল্পটি ইতিহাসের আরেক ধরনের পাঠ আমাদের দেয়। এই অলিখিত ইতিহাসকে আপনি আশ্রয় দিয়েছেন উপন্যাসে। উপন্যাসটি পড়ার সময় মনে হচ্ছিল, আপনার কোথায় যেন একটা দায় আছে। আবার নাও থাকতে পারে। শিল্পে দায় থাকা কতটা জরুরি? 
 
 ওয়াসি আহমেদ:
একটা বিষয় যখন লেখককে তাড়া করে ও একসময় তাকে মাথা ঝুঁকিয়ে টেবিলে বসতে বাধ্য করে, তখন একে দায় ছাড়া কী বলা যায়! ‘বরফকল’ লেখার প্রস্তুতি ছিল অনেক দিনের, আর তা শেফালি বেগম ও তার মেয়ে চম্পার জীবনের গল্পের মধ্য দিয়ে এক ভিন্ন বয়ান রচনার তাড়নায়। এই বয়ানে তারা মা-মেয়ে রাষ্ট্রের অপরিনামদর্শীতার ভিকটিম, সমাজের সুধীজনের ছদ্মাবরণের ভিকটিম, স্বার্থপর ইচ্ছাপূরণের ভিকটিম। এ দায় তো একা একজন লেখকের না।

সাহিত্যে দায় নিয়ে কথাবার্তা, বিশেষ করে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে, অনেক সময় ‘লোকরঞ্জক’ বলেই মনে হয়-- যেন বলাটা কর্তব্য। শুনতে শুনতে দায়টা বুঝি টাল খায়।

তারপরও এ তো বলতেই হয় দায় ছাড়া কী করে সম্ভব! শিল্প আপনি যেমনই নির্মাণ করেন, দায় থেকে যে করেন তা তো অবিসংবাদী।
 
গল্পপাঠ:
আপনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন। বিশ্বের বিশিষ্ট লেখকদের এ প্রোগ্রামে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা শুনতে চাই। 
 
ওয়াসি আহমেদ:
আয়ওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রোগ্রাম (IWP) লেখালেখির ওয়ার্কশপ নয়। এটি তিন মাস ব্যাপী রেসিডেন্সি প্রোগ্রাম যেখানে বিশ্বের নানা জায়গা থেকে নবীন-প্রবীন লেখকদের জড়ো করা হয়। লেখকদের লেখালেখির যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। তবে কোনো প্রজেক্ট দেওয়া হয় না যা রেসিডেন্সিকালীন সময়ে লেখকদের করতে হবে। অবশ্য কয়েকটা কাজ করতে হয়, যেমন-- দু-তিনটা বক্তৃতা, নিজের লেখা থেকে পাঠ, লেখালেখির ওপর প্যানেল আলোচনায় অংশগ্রহণ, সাক্ষাৎকার। এ ছাড়া কেউ চাইলে বাড়তি আরও কিছু কর্মসূচির ব্যবস্থা করা হয়, যেমন-- নিজের লেখা নাটকের মঞ্চায়ন, আন্ডারগ্রেড ছাত্রদের একটি-দুটি ক্লাস নেওয়া। এ ছাড়া কারো কারো লেখার অনুবাদ নিয়ে কর্মশালাও হয়। অভিজ্ঞতা হিসাবে সবই অত্যন্ত সুখকর। তিন মাস ধরে পৃথিবীর নানা দেশের জনা-তিরিশেক লেখকের সঙ্গে বসবাস, মতবিনিময়, অড্ডা, খুনসুটি মিলিয়ে এ এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা।

গল্পপাঠ:
মৌলিক লেখালেখির পাশাপাশি আপনি কিছু অনুবাদও করেছেন। বিশেষ করে নিজের কিছু গল্প বাংলা থেকে ইংরেজিতে। আপনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। নিজে কখনো ইংরেজি ভাষায় লেখার কথা ভেবেছেন? বাংলাদেশের সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে আপনি কতটা সন্তুষ্ট ও আশাবাদী?
 
ওয়াসি আহমেদ:
ইংরেজিতে লেখার কথা কখনো ভাবিনি। নিজের কিছু গল্প ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হয়েছিল বিশেষ প্রয়োজনে। পরে আমার সঙ্গে দেশের ও বাইরের কয়েকজন খ্যাতনামা অনুবাদকও যোগ দিয়েছিলেন, তাতে একটা সংকলন বের করার কাজও হয়ে গিয়েছিল। তবে আসল কথা যা, অনুবাদ অনুবাদই। একটা বিদেশি ভাষায় সৃজনশীল লেখা লিখতে গেলে সে-ভাষার যে ‘মতিগতি’ বা কালচারাল নুয়ান্স আয়েত্বে থাকতে হয় তা সেই ভাষায় লিখতে-পড়তে পারার পুঁজি দিয়ে হয় না। মাতৃভাষা ছেড়ে যারা এ কাজে সফল হয়েছেন তাদের দিকে চোখ ফেরালে বিষয়টা বোঝা যাবে। 
 
বাংলাদেশের সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ কি উল্লেখযোগ্য পরিমানে হয়েছে? আমি খুব একটা পড়ে দেখিনি, কিছু কিছু যা পড়েছি তাতে এটুকু বলতে পারি, যারা অনুবাদ করছেন তাদের অনেকেরই ভাষাটা ভালো জানা থাকলেও সবাই সাহিত্যের লোক নন। হতে পারে, সাহিত্য নিয়ে পড়েছেন বা ইংরেজি ভাষার শিক্ষকতা করেছেন, শুধু এ দিয়ে বড় জোর শুদ্ধ ইংরেজি লেখা চলে।

গল্পপাঠ:
কথাসাহিত্যিক শহীদুল জহির ক্রিয়াপদের প্রমিত রূপের বদলে ঢাকাইয়া কথ্য রূপ ব্যবহার করেছেন। তাকে অনুসরণ করে বাংলাদেশে প্রমিত ভাষাকে বাতিল করে আঞ্চলিক ভাষায় লেখেন কেউ কেউ। আপনি বিদেশি সাহিত্যের একজন বোদ্ধা পাঠক। বিদেশি সাহিত্যে কি এ ধরনের প্রবণতা রয়েছে? এ প্রবণতা  আমাদের সাহিত্যে কী ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করবে বলে মনে করেন?
 
ওয়াসি আহমেদ:
ভাষার প্রমিত-অপ্রমিত ব্যবহার নিয়ে বিতর্কটা আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়। সাহিত্যের ভাষা কত দূর যাবে, কতটা স্বাধীনতা ভোগ করবে, তা সময়ই বলে দেয়। এটা কারো ইচ্ছায় বা মর্জিমাফিক চলে না। আর মূল কথা, ভাষা যেখানে সাহিত্যচর্চার প্রধান নিয়ামক, সেখানে ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা চলবেই। তবে দিন শেষে যা দাঁড়াবে তা হলো ভাষা কতটা লাগসই হচ্ছে। লেখক সব সময়ই চাইবেন তার যা বলার তা যেন উপযুক্ত শব্দে-বাক্যে-উপমায় রূপ পায়। এখানে লেখকের ওপর শ্রেণীকক্ষসুলভ খবরদারি হাস্যকর।

আঞ্চলিক ভাষায় আজকে কেন, অনেক আগেই এ দেশে লেখালেখি হয়েছে। হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ ছাড়াও ইমদাদুল হক মিলনের একটা উপন্যাস রযেছে যার পুরোটাই আঞ্চলিক ভাষায় লেখা।

বিদেশি সাহিত্য যা পড়েছি সবই ইংরেজিতে-- মূল রচনা বা অনুবাদ। অন্য ভাষা তো জানা নেই। ইংরেজিতে ডায়লেক্টবহুল লেখা, লেখকের স্বউদ্ভাবিত সিনটেক্সের নমুনা প্রচুর পাওয়া যায়। আফ্রো-আমেরিকান লেখালেখিতে এক ধরনের মিশেল পাওয়া যায়। তবে সম্পূর্ণ আঞ্চলিক ভাষায় লেখা বিদেশি বই আমার পড়া না থাকলেও ধারণা করি আঞ্চলিক ভাষায় বিভিন্ন দেশে সাহিত্য রচিত হয়েছে-- হওয়াই স্বাভাবিক।

গল্পপাঠ:
এ সময়ের তরুণদের লেখালেখি কি পড়েন? তরুণদের মধ্যে কারা ভালো লিখছেন বলে মনে হয়? তাদের সম্ভাবনার দিক কোনগুলো?
 
ওয়াসি আহমেদ:
সুযোগ পেলেই পড়ি। অনেকেই চমৎকার লেখেন। নামোল্লেখ না করে বলছি, তরুণ লেখকদের লেখায় যে জিনিসটা আমার বিশেষ পছন্দের তা কয়েকজনের ছাঁচ ভাঙার প্রবণতা--বিষয়গত ছাঁচ, বর্ণনাভঙ্গিগত ছাঁচ। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের লেখালেখি ভাষায়-চিন্তায়-আঙ্গিকে ছাঁচবন্দি হয়ে আছে। সবচেয়ে যা পীড়াদায়ক-- আমাদের কল্পনাশক্তিও অনেকটা ছাঁচ-আক্রান্ত। সাদা ও কালোর ভাজে ভাজে যে অনেক শেড রয়েছে, সাদা মানেই সাদা নয়, কালো মানে শুধু কালো নয়-- এই পরিণত উপলব্ধির জন্য যেমন প্রয়োজন পর্যবেক্ষণের শানিত শক্তির, তেমনি কল্পানার শক্তিরও।

গল্পপাঠ:
একটা গল্প ভালো গল্প হয়ে ওঠার জন্য কোন দিকগুলো খেয়াল করা প্রয়োজন—একজন তরুণ লেখকের জন্য আপনার গল্পভাবনা জানতে চাচ্ছি।

ওয়াসি আহমেদ:
তরুণদের কাজ লেখালেখির পাশাপাশি প্রচুর পড়া-- এর বেশি বলা আমাকে মানায় না।

গল্পপাঠ:
ব্যক্তির ইন্দ্রিয় না চেতনা— লেখকের জন্য কোনটা জাগিয়ে তোলা বেশি জরুরি বলে আপনি মনে করেন?

ওয়াসি আহমেদ:

দুটোই।



গল্পপাঠ : 

আপনাকে ধন্যবাদ। 


ওয়াসি আহমেদ : 

আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।




Post a Comment

0 Comments