আমার মহালয়া

পূজা মানেই হল আমাদের মহালয়া।

কবে দুর্গা পূজা সেটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা ছিল না। শুধু হিসেব করা হত কোন ভোরে মহালয়াটি হবে। সে জন্য আমাদের কিছু প্রস্তুতি ছিল। সেটা শুরু হত আমাদের দূর সম্পর্কের জেঠী কালিপদর মার তরফ থেকে। ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি তিনি দুটো পাকা তাল নিয়ে আসতেন আমাদের বাড়ি। এসে আমার মাকে শুধাতেন খোকার বাবা কখন ফিরবে কাজ থেকে। বাবা ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। সে অবধি কালিপদর মা আমাদের রান্না ঘরের বারান্দায় বসে থাকতেন। মাঝে মাঝে পান তামুক মুখে দিতেন। দুটো ডাল-ভাত খেতেন। তারপর বাবা ফিরলে তাগিদ দিয়ে বলতেন, ময়ালয়া কিন্তু চালাইও বাপধন। ভুইল্যা যাইয়োও না।

বাবা ভুলতেন না। কিছুদিন ধরেই আমাদের ভাঙ্গা রেডিওটা কাউকে ধরতে দিতেন না। ওটা গুড়াগাড়া কেউ ধরলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই ব্যাপারে আমাদের ঠাকুরদাও বেশ সতর্ক থাকেন। আমাদের রেডিওর উপর চাপ কমাতে এই সময় বাইরে থেকে তিনি আকাশবানী শুনে আসতেন।

আর বাবা কাজ থেকে ফিরে নিয়মিত রেডিওর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতেন। কখনো একটু জোরে—কখনো একটু আস্তে করে ভলিউম বাড়ানো কমানো করতেন। পিছনের স্ক্রু খুলে ঝাড়া-মোছা করতেন। আবার মোড়ের নিখিল মিস্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে একটু সারাই করে আনতেন। কোনো ভাবেই যেন মহালয়ার দিনে রেডিওটা বিগড়ে না যায়। মহালয়ার আগের দিন মা পাঁচ প্রকার শাক তুলে আনতেন। সেটা দিয়ে রাতে সুক্তো রাঁধা হত। আর করা হত সিঁয়োই পিঠে। আর হাড়ি ভরে হত দিঘা ধানের পান্তা ভাত।

কালিপদর মা বিকেলেই চলে আসতেন। আসতেন চেঁচানিকান্দী থেকে হীরা দিদিমা। সঙ্গে নাতিপুতি। তারা রাতে ঘুমোবে না। তারা রাত জেগে বিজয় সরকারের গান করবে। তারা এনেছে কলাপাতায় করা তালের পিঠে। নারিকেল বাড়ি থেকে মেজোমামা সন্ধ্যার আগেই এসেছে ঢেপের খই নিয়ে। ছোট পিসি নৌকায় করে রওনা হয়েছে—আসতে আসতে মধ্য রাত গড়িয়ে যাবে। নিয়ে আসবে ঘরে পাতা দই।

আমাদের উঠোনে এর মধ্যেই খাটরা, বোড়াশী, সোনাকুড় থেকেও লোকজন এসে গেছে। পাশের বাড়ির রমেন দাদার পালান থেকে খড় এনে তারা সবাই বসেছে।
বাবা জানেন কখন আকাশবানীর বিশেষ অধিবেশন শুরু হবে ভোর রাতে। তার আগেই ভল্যুম নেড়ে চেড়ে পরীক্ষা করে নিচ্ছেন। কালিপদর মা খন খনে গলায় বলছেন, অ বাবা শঙ্কর, মহালয়া দিতি কিন্তু ভুইল্যা যাইও না। সারা বচ্ছর ধইরা চাইয়া আছি। মা দুগ্‌গা আসবে। সেইডা না শুইন্যা বাঁচি কী কইরা?

আকাশবানী স্টেশন ধরেছে। ঠাকুরদা বলে উঠছেন—চুপ চুপ। মহালয়া আইতেছে। আব্দুল হক বিএ দাদাজান নামাজ পড়ে ফিরে এসে বলছেন, আওয়াজটা একটু বাড়াইয়া দাও। বুড়া হউছি। কানে কম শুনি। এর মধ্যে ঘোষক বলছেন--মহিষারমর্দিনী। রচনা বানীকুমার। সুর ও সংযোজনা পংকজ কুমার মল্লিক। চণ্ডী ভাষ্য পাঠ বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ আমল থেকে। বহু বছর কেটে গেছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বুড়ো হননি। আকাশবানীতে প্রতি বছর মহালয়া করার জন্য তাকে বুড়ো হতে নেই। সবার কান খাড়া হয়ে গেছে।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নান্দীপাঠ শুরু করেছেন। কালিপদর মা কপালে হাত ঠেঁকিয়ে প্রণাম করছেন মা দূর্গার উদ্দেশ্যে। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র তাঁর সেই সামান্য নাকি কণ্ঠে— অসামান্য উদাত্ত গলায় বলছেন, যা দেবী সর্ব ভূতেষু মাতৃ রুপেণ সংস্থিতা। ঢেঊয়ের মত কখনো তাঁর গলা উপরে উঠছে। কখনো মধ্যে নামছে। কখনো নিচু হয়ে আবার কান্নার মত করে, ব্যাকুল হয়ে, কখনো আবদার করে, কখনও রুদ্র হয়ে তার নিজের মাকে ডাকছেন। তাঁর ফাঁকে ফাঁকে গেয়ে উঠছেন হেমন্ত, মানবেন্দ্র, মান্না দে, পংকজ মল্লিক, সন্ধ্যা, নির্মলা মিশ্র, বনশ্রী...।

হীরা দিদিমা চণ্ডির গল্পটা বোঝেন না। বুঝতেও চান না এই সব শাস্ত্র-কথা। তিনি দেখতে পাচ্ছেন—দুর্গা নামের এক মা তার ছেলেপিলে নিয়ে অনেকদিন পরে বাপের বাড়ী আসছে। সঙ্গে আসছে পাক পাক হাঁস, একটা ময়ুর পক্ষী, ভুতুম পেঁচা, গরু মহিষও হেলে দুলে আসছে। বনের বাঘো মামা বয়না ধরেছে সেও মামাবাড়ি আসবে। ঘরের ইঁদুরটা কোন ফাঁকে সবার আগে আগে দৌড়ে এসেছে কেউ টের পায়নি।

মা কাউকেই ফেলে যাবে না। সবাইকে নিয়েই আসবে। অমৃত জ্ঞানে বাপের বাড়ীর দুটো খুদ কুড়ো খাবে। এর চেয়ে আর কী সুখ এ জীবনে?

এর মধ্যে সকাল হচ্ছে। পূব আকাশ রাঙ্গা হচ্ছে। হাওয়া জলের উপর থেকে উড়ে আসছে। টগর ফুল ফুটেছে। এর মধ্যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের মহালয়া পল্লবিত হয়ে আমাদের ভাঙা রেডিও থেকে উঠোনে, উঠোন থেকে হালোটে, হালোট থেকে মাঠে, মাঠ থেকে ঘাটে, ঘাট ঠেকে বাঁটে পৌঁছে যাচ্ছে। কালীপদর মা বারবার বলছেন-- মধুর মধুর।

আমরা সিইঁয়োই পিঠে দিয়ে ঢেঁপের খই খাচ্ছি। দুর্গা অপুকে নিয়ে মাঠ পাড়ি দিয়ে আসছে।
ঠাকুরদা মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছেন—মধুর তোমার শেষ নাহি যে পাই।

Post a Comment

1 Comments

  1. আপনার লেখাও তেমন-মধুর তোমার শেষ যে না পাই।

    ReplyDelete